> চন্দ্ররাতের মায়া পর্ব ৯, ১২ এবং সর্বশেষ পর্ব
-->

চন্দ্ররাতের মায়া পর্ব ৯, ১২ এবং সর্বশেষ পর্ব

কিছুক্ষণ পর তীব্র নন্দিতাকে ছেড়ে দিলো।নন্দিতা এক হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে।লজ্জায় দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে পাশ ফিরে দারিয়ে রইলো।

চোখ খুলে দেখলো তীব্র বাইক নিয়ে হাজির।চোখের ইশারায় বাইকে উঠতে বললো।নন্দিতাও বাধ্য মেয়ের মতো বাইকে উঠলো।উঠে তীব্রর ঘাড়ে এক হাত রাখলো।ফুসকাওয়ালা মামার দিকে তাকাতেই দেখলো সে মুচকি হাসছে।নন্দিতা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।তীব্রও একটু লাজুক হাসি দিয়ে বাইক নিয়ে চললো।

- কোথায় যাচ্ছি আমরা? (নন্দিতা)

- বাড়িতে

- কার বাড়িতে? 

- কার বাড়ি মানে? আমার বাড়ি কি তোমার না? 

- আমি সেটা বলিনি,ধুর তুমি সারাক্ষণ ঝগড়া করো।কথা বলবো না যাও তো

- তোমার শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছি

- আমার বাড়িতে একটা কথা বললে কি হতো,বাবা মা তো চিন্তা করবে

- আমি ফোন করে বলে দিয়েছি যে আপনাদের মেয়ে আমার সাথে আসবে

- কেনো বলতে গেলে? তুমি জানো যে আমি আসবো?

- হুম।তোমায় তো আমার থেকে ভালো কেউ বুঝবে না।

বৃষ্টি হচ্ছে। সাথে ঠান্ডা বাতাস।নন্দিতার শীত শীত হতে লাগলো।তবে ভালোই লাগছে তার। পেছন থেকে তীব্রকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে থাকলো।

বাড়িতে ঢুকেই তীব্র নিজের মতো ঘরে গেলো।নন্দিতা জীর্ণ পায়ে এগুচ্ছে। ভেজা শাড়ি লেপ্টে যাওয়ায় হাটতে সমস্যা হচ্ছে। শেখর চৌধুরী সেখানে উবু হয়ে খবেরে কাগজ পড়ছে।নন্দিতা কাছে যেতেই তিনি বললেন

- বৌমা চলে এসছো,হাহাহাহা, কেনো ঝগড়া করতে যাও বলোতো।জানোই তো রাগ করে যতবার ই বাবার বাড়িতে যাবা ততবার ই তীব্র গিয়ে নিয়ে আসবে।

নন্দিতা লজ্জা পেলো।মুচকি হেসে মাথা নিচ করে রইলো।শেখর চৌধুরী বললেন 

- বৌমা যাও,ঘরে গিয়ে ভেজা কাপর পাল্টে নাও।আর আমার জন্য একটু চা করতে পারবে? তোমার হাতের চা না খেলে আমার তৃপ্তি আসে না।

- হ্যা বাবা আমি এক্ষুনি চেঞ্জ করে আসছি।দুই মিনিট দারান।

একপ্রকার হনহন করেই নিজের ঘরে গেলো নন্দিতা।ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়ে শাড়িটা খুলে ওয়াসরুমে চলে গেলো।ওয়াসরুমে গিয়ে দেখে তীব্র সারা শরীরে বডিওয়াস দিয়ে ফেলায় ভরিয়ে ফেলেছে।নন্দিতা পিছু পা হয়ে মনে মনে ভাবলো " এই লোকটা এমন কেন,দরজাও লাগায় না,প্রাইভেসি বলতে কিচ্ছু নাই"।নন্দিতা বেড় হয়ে আসতেই তীব্র নন্দিতার হাত ধরে টেনে ওয়াসরুমে নিয়ে যায়। নিয়ে গিয়ে নিজের সাথে শক্ত করে ধরে রাখলো।নন্দিতা লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো

- কি? হ্যা? 

- কিছুনা,একটু আদর করতে মন চাচ্ছে

- ধুর,তুমি স্নান করো।আমি বাইরে আছি।

নন্দিতা চেঞ্জ করে নিচে গেলো চা বানাতে।যেতেই আরোহীর বাবা আহনাফ চৌধুরী নন্দিতাকে ডাকলো।তিনি বই পড়ছেন।বইয়ে চোখ রেখেই বললেন-

- কেমন আছো নন্দিতা

-আরেহ চাচা,কেমন আছেন, কখন এসেছেন? 

- এসেছি সকালে।তোমাদের ছেলে হয়েছে না মেয়ে? 

নন্দিতার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।এই প্রশ্ন তাকে জ্বালিয়ে পুরিয়ে শেষ করে দেয়।ক্ষত বিক্ষত মনটা যেনো নির্জীবিত হয়ে ওঠে।নন্দিতা চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গেলো সেখান থেকে।আহনাফ চৌধুরী কিছুটা অবাক হলেন।তিনি শেখর চৌধুরীর কাছে গেলেন।এই বিষয়ে জানতে চাইলে শেখর চৌধুরী তাকে সবটা খুলে বললো।শুনে আহনাফ চৌধুরী মনে মনে নিজের কাছে নিজেই ছোট বোধ করলেন।

তীব্র বিছানায় বসে ফোন স্ক্রোল করছিলো।নন্দিতা দরজা খুলে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েই হাউমাউ করে কান্না করতে লাগলো।তীব্র ফোনটা রেখে নন্দিতার পাশে গিয়ে 

- কি হয়েছে নন্দিতা?কাঁদছো কেন? কেউ কিছু বলেছে? 

নন্দিতা কিছুই বললো না।তীব্রকে জরিয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্না করলো।অনেক্ক্ষণ কান্নার পর তীব্রকে বলে

- তীব্র, তুমি কি আমায় নিয়ে খুশি? 

- হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন? 

- আমি তো তোমায় বাবা হওয়ার সুখ দিতে পারলাম না এখনো।আচ্ছা তুমিও কি মনে মনে এজন্য আমাকে ঘৃণা করো? 

- তোমার কি সেটাই মনে হয়? 

- না,আমি জানি তুমি আমায় কখনো ঠকাবে না।কিন্তু আমার জন্য তুমি,তোমার মা বাবা কষ্ট পাচ্ছে।একটা কথা বলবো,রাখবা? 

- কি কথা? 

- তুমি বিয়ে করো নাও।প্লিজ আমার কথাটা শুনো।আমার জন্য তুমি সারাজীবন বাবা ডাক থেকে বঞ্চিত হবা,এটা আমি মানতে পারবো না

- নন্দিত লা থামো তুমি।আমিতো বলেছিই, বাবা না হতে পারায় আমায় কোনো সমস্যা নেই,তবুও কেন এসব বলো তুমি?

- দেখো এখন হয়তো তুমি বলছো।কিন্তু যখন আমাদের বয়স হবে,তখন তো আমাদের কাউকে লাগবে তাই না?জীবন তো সব সময় একই থাকে না।পাল্টায়,সাথে মন মানষিকতাও।এখন তোমার মনে হচ্ছে এরকম।কিন্তু কিছুদিন পর গিয়ে ঠিকি তুমি বুঝতে পারবে।তখন আমায় ঘৃনা করবে।আমি এটা সহ্য করতে পারবো না।সারা জীবন আমি এই দোষের ভাগী হয়ে থাকতে পারবো না।

- এখন আমায় কি করতে বলছো তুমি?

- যা করার সব আমিই করবো। তুমি শুধু সেটাতে হ্যা বলবে।কথা দাও তুমি আমার কথা শুনবে?

তীব্রর হাত নন্দিতা ওর মাথায় রেখে কথাটা বললো।তীব্র হতভম্ব হয়ে গেলো।এই মুহুর্তে তার কি করা উচিৎ সে বুঝতে পারছে না।হাত সরিয়ে নিলেও নন্দিতার প্রবল জোরে সে রাজি হয়ে গেলো।

রাতে সবাই ডিনার করতে ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত। নন্দিতা সবাইকে খাবার সার্ভ করছে।আরোহী গুনগুন করতে করতে তীব্রর পাশের চেয়ারটায় বসলো।নন্দিতার খুব  ঈর্ষা হতে লাগলো। তীব্রর পাশে কাউকে সে সহ্য করতে পারে না। তীব্র বিষয়টা লক্ষ্য করেও এড়িয়ে গেলো।নন্দিতার শাশুড়ী রাবেয়া চৌধুরী নাক ছিঁচকাচ্ছে।সব রান্না নন্দিতা করেছে।আহনাফ চৌধুরী খাবারের প্রসংশা করছেন।এটা রাবেয়া চৌধুরীর সহ্য হচ্ছে  না।

খাওয়া শেষে নন্দিতা ছাঁদে গেলো।একাকিত্ব কিছু সময় কাটাতে।উঠে দেখলো সেখানে আগে থেকেই শেখর চৌধুরী দারিয়ে আছেন।ওনার খাওয়া শেষে হাটাহাটি করার অভ্যাস।নন্দিতা কাছে গেলো।

- বাবা

- কে বৌমা? তুমি এতো রাতে ছাদে? 

- একটু আসলাম ভালোলাগছে না।আপনাকে কিছু বলার ছিলো

- কি বলো? 

- কিভাবে যে বলবো।

- বৌমা, আমার কাছে কিছু বলতে তো তুমি কখনো সংকোচ বোধ করোনি।তাহলে আজ সংকোচ বোধ করছো যে? 

- বাবা আমি চাই তীব্র আবার বিয়ে করুক।ওকে আমি বাবা হওয়ার সুখ দিতে পারিনি।এর দায় আমায় সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।আমি এটা চাই না বাবা।আপনাদের বয়স হয়েছে।আপনারাও তো চান আপনাদের নাতি নাতনির মুখ দেখতে।তাদের সাথে সময় কাটাতে।আমি সেটাতো অক্ষম বাবা।

- বৌমা তুমি যা বলছো ভেবে বলছো তো? 

- হ্যা বাবা।আমি ভেবেই বলেছি।আমি সারা জীবন আপনাদের এরুপ না পাওয়ার কারন হতে চাই না।

বলেই নন্দিতা চোখ মুছতে মুছতে নিচে নেমে গেলো।কেন যাবি আজ ওর প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। কেন হচ্ছে সেটা ওর অজানা নয়।তীব্রকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাকে ক্রমশ ঘিরে ধরছে।কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে গেলো।

সকালে তীব্রর ডাকে ঘুম ভাঙলো।ঘুমঘুম চোখে তীব্রকে বললো

- কয়টা বাজে? 

- দশটা 

- কিহ? এতে বেলা হয়ে গেছে আর আমি টের ই পাই নি

- তুমি উঠে ফ্রেশ হও।ডাক্তারের কাছে যাবো আমরা।

- ডাক্তার কেন? 

- দীর্ঘদিন হয়ে গেলো।কিন্তু তুমি সন্তান সম্ভবা হচ্ছো না।এটা নিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে।

নন্দিতার বুকটা ধুক করে উঠলো।এই বিষয়ে যেকোনো কথাই নন্দিতার কেমন কাটার মতো বুকে বাঁধে। ফ্রেশ হয়ে রওনা হলো ডাক্তারের চেম্বারে।

কয়েকটা টেস্ট করে রিপোর্ট হাতে ডাক্তার বসে আছে।সামনের চেয়ারে নন্দিতা তীব্র বসে আছে।দু'জনই চিন্তায় সংকুচিত হয়ে আছে।ডাক্তার হাতে রিপোর্ট নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাদের দিকে তাকালো।ভারি ভারি স্বরে বললেন.......


কয়েকটা টেস্ট করে রিপোর্ট হাতে ডাক্তার বসে আছে।সামনের চেয়ারে নন্দিতা তীব্র বসে আছে।দু'জনই চিন্তায় সংকুচিত হয়ে আছে।ডাক্তার হাতে রিপোর্ট নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাদের দিকে তাকালো।ভারি ভারি স্বরে বললেন..

- মিঃতীব্র,আপনাদের বিয়ের কতদিন হলো? 

- ছয় বছর 

- ছয় বছরে আপনার স্ত্রী দুইবার প্রেগন্যান্ট হয়,আর কোনো কারনে বেবি দুইটা বেঁচে নেই 

- জি

- কেন?কারনটা কি বলুন তো

- একবার ও মৃত বেবির জন্ম দেয়,আরেকবার জন্মের পর বেবিটাকে খুজে পাওয়া যায়নি।

- লাস্ট কবে আপনার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট হয়? 

- দুবছর আগে,

- সেই বেবি কোথায়? 

- সাত মাস পর জানতে পারি ওর পেটে কোনো বেবি ছিলো না।টিউমারের জন্য পেটের আকৃতি বৃদ্ধি পেয়েছিলো

- তাহলে প্রেগ্ন্যাসি টেস্টে হয়তো ভুল ছিলো।কোথায় করিয়েছিলেন টেস্ট? 

- হসপিটালে। 

- সম্ভাবনা আছে প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট কারোর সাথে বদল হয়েছে।সে যাই হোক।টিউমার অপারেশন করিয়েছিলেন? 

- জি 

- কতদিন আগে?

- প্রায় দুই-বছর আগে

- মিঃতীব্র আপনি কাল একবার আসুন।আজ তেমন কিছু বলবো না।আপনি কাল দেখা করুন আমার সাথে। 

বলেই ফাইলটা রেখে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন।বেলে চাপ দিতেই তার পি এ আসলো।তাকে বললো " আজ আর রোগী দেখবো না।তাদের বলো কাল আসতে"।

তীব্র আর নন্দিতা কেবিন থেকে বেড় হলো।হসপিটালে আসলে নন্দিতার খুব কান্না পায়।কেননা এখানে আসলেই নবজাতকের দেখা মেলে।যা নন্দিতার মনকে কাচের ন্যায় ভেঙে গুড়িয়ে দেয়।তীব্র বিষয়টি লক্ষ্য করে।কিন্তু তার কিছু করার উপায় থাকে না।

তারা বাড়িতে আসলে রাবেয়া চৌধুরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নন্দিতাকে দেখে।তীব্রকে কর্কষ গলায় বললো" কি,ডাক্তার কি কোনো আশা দিলো?আমার দীর্ঘ বিশ্বাস, এই মেয়ের দ্বারা আমাদের বংশে নতুন কেউ আসবে না. "। রাবেয়া চৌধুরীর কথায় তীব্রর অনেক রাগ হয়।সে কিছু বলে না।মায়ের ওপর দিয়ে কথা বলার অধিকার তার নেই।মা বলতেই পারে।মা বলবে না তো কে বলবে?

রাতে খাওয়ার পর তীব্র ছাঁদে গিয়ে সিগারেট ধরালো।এক হাতে ছাদের কার্নিশ আরেক এক হাতে জলন্ত সিগারেট। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের আলোয় কানায় কানায় ভয়ে গেছে ছাঁদ।কারোর পায়ের শব্দ কানে এলো।তীব্র মগ্ন হয়ে চাঁদ দেখতে থাকলো।যে এসেছে তাকে তীব্র চিনে ফেলেছে।তার শরীরের গন্ধ তার চেনা।যদিও অনেক বছর আগেই তাদের বিচ্ছেদ হয়, তবুও ভালোবাসার মানুষ কখনো পুরোনো হয় না।তীব্র করুন স্বরে বললো

- মিহিতা (তীব্রর ভাবী)

- হুম

- আমি ভালো নেই,জানিনা কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছি আমি 

- একই তাপে পুরছি আমি নিজেও।

- আমি তোমায় ঠকাইনি মিহিতা।তোমার ভালো চেয়েছি আমি

- এই ভালো তো আমি চাইনি তীব্র,বলো চেয়েছিলাম? 

- তখন আমি কেবল ভার্সিটি উঠি।আমার নিজের জীবনের নিশ্চয়তা নেই,তোমায় কিভাবে ভালো রাখতাম বলো ? আমি ভালোবাসার মানুষের কষ্ট সহ্য করতে পারিনা।ভাইয়া তখন মোটামুটি স্যাটেল হয়ে গেছে।তোমার অন্তত দেখতে পারবো এই আশায় ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়ের ব্যাবস্থা করেছিলাম।তোমায় আমি ঠকাইনি মিহিতা,বিশ্বাস করো,আমি তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলাম,তাই এমনটা করেছি।

- আমি জানি তীব্র।কি করবো বলো,আমি যে ভুলতে পারছি না।কিন্তু আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।তুমি কাউকে এতোটা কিভাবে ভালোবাসতে পারো,? পরিবারের এতো কথা,বাইরের মানুষের কথা, নন্দিতার বাচ্চা না হওয়া,এর পরেও তুমি ওকে এতোটা ভালোবাসো।কিভাবে? 

(তীব্র সিগারেট মুখে দিলো)

- আমার খুব হিংসে হয় জানো,এই ভালোবাসা আমার প্রাপ্য ছিলো, কি ছিলো না? 

- ভালোবাসা জিনিসটা কত অদ্ভুত! 

- আমায় ক্ষমা করে দিও তীব্র, তোমার ওপর রাগে,ঘৃণায় আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।একটা মেয়ে সব সহ্য করে,ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারোর সাথে দেখলে তা সহ্য করতে পারে না।অনেক রাত হয়েছে।ঘরে যাও,নন্দিতা অপেক্ষা করছে।

মিহিতা চলে গেলো।তীব্র সিগারেটটা শেষ করে নিজের রুমে গেলো। নন্দিতা শুয়ে পড়েছে,চোখের কোনে জল বেঁধে আছে।কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে হয়তো।তীব্র অনেকক্ষণ ঘুমন্ত নন্দিতাকে দেখলো।মুচকি হেসে নন্দিতার কপালে একটা চুমু দিয়ে শরীরে কাঁথাটা জরিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো।

পরেরদিন সকালে তীব্র নাস্তা না করেই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করার জন্য বেড়িয়ে গেলো।ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে।তিনি একটা পান মুখে দিলেন।তীব্রর দিকে সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। তীব্র না সূচক মাথা নাড়লো।ডাক্তার তার পি এ কে ডাকলো।ডেকে কি যেন বললো।কিছুক্ষণ পর একজন লোক আসলো চেম্বারে।তীব্র কিছুটা অবাক হলো।ডাক্তার তীব্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

- মিঃতীব্র, দেখুনতো,ইনিই কি আপনার স্ত্রীর পেটের টিউমারের অপারেশন করিয়েছিলেন?

তীব্র অস্ফুট স্বরে বললো " হ্যা "।ডাক্তার তখন বললো

- ডাঃ সিহাব,আপনি কি জানেন ডাক্তার প্যাশনটা কি? 

সিহাব- জ্বি স্যার (ভয়ার্ত কন্ঠে)

- আপনি যে এরকম একটা কাজ করলেন,নিজেকে ক্ষমা করতে পেরেছেন তো ? 

তীব্র কিছুটা হতভম্ব হচ্ছে। কি হচ্ছে তার বোধগম্য হলো না।সে যে ডাক্তারের কাছে এসেছে তার নাম ডাঃহাবিব।ডাঃহাবিব তীব্রর উদ্দেশ্য বললেন

- মিঃতীব্র, সরি টু সে,আপনার স্ত্রী কখনো মা হতে পারবে না।

তীব্র মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।মুহুর্তেই সারা শরীর ঘামতে শুরু করলো।তীব্র নিজের শার্টের ওপরের বোতাম খুলে ফেললো।ডাঃ হাবিব তার দিকে জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললেন।

- আপনি উত্তেজিত হবেন না।নিজেকে সামলাম।আপনি ভেঙে পড়লে আপনার স্ত্রীকে শক্তি জোগাবে কে? 

- ডাঃ আপনি এটা কি বললেন? 

- হ্যা মি তীব্র, আপনার স্ত্রী আর কখনো মা হতে পারবে না। কারন বাচ্চা হওয়ার যে নাড়ি থাকে সেটা কেটে ফেলা হয়েছে। 

তীব্রর মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠলো।কাজটা কে করেছে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না।লাথি মেরে চেয়ার থেকে উঠে ডাঃসিহাবের শার্টের কলার ধরে গালে ঠাস ঠাস করে চড় দিতে দিতে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করলো।এসব গালির সাথে সে পরিচিত নয়।নিজেকে যেনো হারিয়ে ফেলেছে।মাথার চুল মুঠ করে ধরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো তীব্র। ডাঃসিহাবের সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে।সাদা এফ্রোন লাল টকটকে হয়ে গেছে।ডাঃহাবিব বেল চাপতেই বাইরে থেকে ৪জন এসে তাদের সরিয়ে দেয়।প্রথমে ২ জন আসে।তারা তীব্রর হিংস্রতার কাছে টিকতে না পেরে ডাঃহাবিব আবার দুজনকে ডেকে পাঠায়।

থানায় অফিসারের সামনে মুখোমুখি হয়ে বসে আছে ডাঃহাবিব। ডানে বসে আছে তীব্র।ডাঃসিহাব কে রাখা হয়েছে ডাঃহাবিবের বাম দিকে।তার মাথায় ব্যান্ডেজ করা।তীব্রর চোখ লাল রক্ত বর্ণ হয়ে আছে।হাতের মুঠ শক্ত।সে কোনো কথা বলছে না।ভেতরে ভেতরে এক পাহাড় কষ্ট নিয়ে বসে আছে।অফিসার গম্ভীর স্বরে বললো

- ডাঃসিহাব,নিজের করা অপরাধ কি শিকার করবেন? না ডলামলা দিতে হবে?

সিহাব- স্যার আমি আমার অপরাধ শিকার করবো।আমি নিজ ইচ্ছেয় করিনি স্যার 

অফিসার- সেটা তো জানি,কার কথা বলেছেন বলুন

সিহাব- আমি যখন ওনার স্ত্রীর অপারেশন করছি তখন কেউ একজন আমার ফোনে ফোন করে

অফিসার- থিয়েটারে ফোন সাথে কেন আপনার? 

সিহাব- স্যার আমার কাছে সবসময় একটা ফোন থাকে,সেখানে অতিপ্রয়োজনীয় ছাড়া ফোন করেনা কেউ।

- ফোন করে কি বললো? 

- ফোন করে বললো নন্দিতা যেন কোনোদিনও মা হতে না পারে সে ব্যাবস্থা করতে।আমি রাজি না হলে একটা ভিডিও পাঠায়।সেই ভিডিওতে দেখলাম কেউ একজন আমার মেয়ের মাথায় পিস্তল তাক করে ধরে আছে।তারা বললো যদি না করি তাহকে আমার মেয়েকে তারা মেরে ফেলবে।বাবা হয়ে মেয়ের এরুপ অবস্থা দেখে তাদের কথা মতো আমি পাপ কাজটা করি।

তীব্র ক্ষিপ্ত হয়ে ডাঃসিহাববের ওপর তেড়ে যেতেই কয়েকজন কনস্টেবল মিলে তীব্রকে আটকালো।অফিসার তীব্রকে বললো " মিঃতীব্র আপনি শান্ত হোন,আমরা বিষয়টা দেখছি।এর সাথে যুক্ত সবাই শাস্তি পাবে " 

তীব্র চেয়ারে বসতেই পোন আসলো।ফোন স্ক্রিনে ভাবী নামটা ভেসে এলো।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কান্নামিশ্রিত আওয়াজ আসলো 

- তীব্র,তোমার ভাইয়াকে পুলিশ এরেস্ট করে নিয়ে যাচ্ছে।তুমি কিছু একটা করো,প্লিজ ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো, প্লিজ।


- তীব্র,তোমার ভাইয়াকে পুলিশ এরেস্ট করে নিয়ে যাচ্ছে।তুমি কিছু একটা করো,প্লিজ ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো, প্লিজ।

- পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে মানে? কেন?

- আমি জানিনা।ওর শুধু ফোন করে বললো ওকে নাকি পুলিশ ঘিরে ফেলেছে।তারপর হঠাৎ ফোনটা কেটে গেলো।তারপর ফোন করলাম ফোন বন্ধ 

- ভাইয়াকে পুলিশ কেন ঘিরে ধরবে,কি এমন করেছে ভাইয়া। আচ্ছা তুমি চিন্তা করিও না, আমি দেখছি

- প্লিজ কিছু একটা করো,আমার খুব টেনশন হচ্ছে। কি হয় আমায় জানাও প্লিজ,আমি অপেক্ষা করে থাকবো

 তীব্র চেয়ার ছেড়ে উঠে থানা থেকে বেড় হতেই হতভম্ব হয়ে গেলো।পুলিশের জিপ এসে থানার সামনে থামলো।সেখান থেকে ভাইয়া নামছে।হাতে হাতকড়া।পড়নে শর্ট প্যান্ট।একজন পুলিশ তার গেঞ্জি ধরে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে আসছে।তীব্র হাত তুলে বাঁধা দিলো।পুলিশ গেঞ্জি ছেড়ে দিলো।

তীব্র অফিসারের সামনে বসে আছে।একেই তো তার একটা সমস্যা নিয়ে কথা হচ্ছে তার মধ্যে ভাইয়া।যে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে এসেছে তিনি অফিসারকে বললো " স্যার,আবাসিক হোটেল থেকে এনারে নিয়ে এসেছি।ব্যাটায় একটা...."। 

বাকিটুকু বলতেই অফিসার হাতের ইশারায় থামতে বললো।তীব্রর বুঝতে বাকি রইলো না কেনো তার ভাইয়াকে থানায় নেওয়া হয়েছে। লক্ষ্য করলো ভাইয়ার দিকে তাকাতেই চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। মনে মনে লজ্জা, ভয় তাকে ঘিরে ধরেছে।তীব্রর মনে মনে ঘৃণা হতে লাগলো।

অফিসার হাতের ইশারায় তাকে লকাপে ঢুকাতে বললো।তীব্র কিছু বললো না।অফিসার ডাঃসিহাবের দিকে তাকিয়ে বললেন

- আপনি থামলেন কেন, বলুন,শুরু করুন

ডাঃসিহাব- স্যার যা বললাম সব সত্যি। আপনি চাইলে আমার ফোন চেক করে দেখতে পারেন।সেইদিনের ভিডিওটা আমি সেইভ করে রেখেছিলাম।

বলেই ফোনটা অফিসারের কাছে এগিয়ে দিলো ডাঃসিহাব।অফিসার কিছুক্ষণ ফোনে সব চেক করলো।তারপর বললো

- মানলাম আপনাকে বাধ্য করা হয়েছে।কিন্তু সে জন্য আপনি আইনের সাহায্য নিতেন।নইলে প্রয়োজনে মিথ্যে বলতেন।সে এসে তো দেখতো না যে নাড়িটা কে'টে'ছে'ন কি না! 

- স্যার আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। একমাত্র মেয়ে।অনেক ভালোবাসি আমি।যদি পরে জানতে পারে আমি কাজটা করিনি,তাহলে আবার যদি আমার মেয়ের ক্ষতি করে দেয় এই ভয়ে আমি কাজটা করেছি স্যার।আমি পাপ করেছি স্যার,আমার শাস্তি আমি মাথা পেতে নিবো।

তীব্র- অফিসার,আমি ভিডিওটা কি দেখতে পারি? 

অফিসার- সিওর

তীব্র ভিতিওটা ওপেন করতেই চমকে উঠলো।আরেহ্ এই ভিডিওটা তো ভাইয়ার সেই পেনড্রাইভে দেখেছিলাম যখন নন্দিতার অপারেশন হয় তখন।তার মানে এসবের পেছনে ভাইয়ার হাত আছে? কেনোই বা সে এসব করতে যাবে?।

তীব্রর নিজের ভাই যে তার এতো বড় ক্ষতি সে করতে পারে এটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি।বোবটের মতো ফোনটা টেবিলে রাখলো।লকাপের দিকে তাকাতেই তীব্রকে দেখে ওর ভাইয়া চোখ সরিয়ে নেয়।তীব্রর ইচ্ছে করছে তার ভাইয়াকে উচিৎ শিক্ষা দিতে।কিন্তু সে সেটা পারবে না।মনে মনে ভাইয়ার মুখে থুথু দিলো।

তখনি ফোনটা আবার বেজে উঠলো। তীব্র রিসিভ করলো না।পরপর কয়েকবার বাজতেই তীব্র রিসিভ করে রাগি কন্ঠে বললো 

- কি হয়েছে? রিসিভ করছি না দেখেও বারবার ফোন দেওয়ার কি আছে

- তীব্র কি হয়েছে,রেগে আছো কেন? 

- তো কি আনন্দে থাকবো?আনন্দে থাকতে দিচ্ছে কেউ? 

- কি হলো তোমার,আচ্ছা তোমার ভাইয়ার কি কোনো খবর পেলে?

- আমার সামনেই লকাপে দারিয়ে আছে। চোরের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে তামাশা দেখছে।

- লকাপে মানে? কি করেছে ও? 

- এখন রাখছি,

বলেই ফোন বন্ধ করে রাখলো তীব্র। অফিসার বললো" মিঃতীব্র আপনি কি এনাকে চেনেন? "।উত্তরে তীব্র কিছু বললো না।রাগি চোখে একবার ওই কালপ্রিটটার দিকে তাকালো।অফিসার তীব্রকে উদ্দেশ্য করে বললো

- মিঃতীব্র, আমরা এর তদন্ত শুরু করে দিয়েছি,খুব শীঘ্রই আমরা অপরাধীকে খুজে বেড় করবো।

- অপরাধীকে খুজতে হবে না।সে সামনেই আছে।তাই না ভাইয়া? 

তীব্রর কথা শুনে ওর ভাইয়া গায়ের গেঞ্জি খুলে ফেললো।মাথার চুল টানতে লাগলো।বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে লকাপের ফ্লোরেই পড়ে গেলো।বিষয়টি দেখে তীব্র কোনো রিয়েকশন করলো না।তার মনের যে ঘৃনা তা ক্রমশ বাড়তেই থাকলো। 

লকাপ খুলে তীব্রর ভাইয়াকে বেড় করা হলো।ডাক্তার এসে প্রেশার চেক করে বললো সব ঠিক আছে।তীব্র অট্টহাসি দিতে দিতে বললো " হাহাহা,অভিনয়ে তুমি বরাবরই সেরা ছিলে ভাইয়া। না হলে আমার ঘরেই আমার বিশ্ব শত্রু, সেটা জানতেই পারলাম না"।অফিসার তীব্রকে উদ্দেশ্য করে বললো 

অফিসার- মিঃ তীব্র আপনি একটু আগে বললেন যে অপরাধী আপনার সামনে।কে সে? 

তীব্র- এই যে সামনে বসে আছে,নাটল জগতের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা।

- একটু পরিষ্কার করে বলবেন? 

- অফিসার আমার স্ত্রীর অপারেশনের পরের দিন আমি বাড়িতে আসি।ওর জন্য স্যুপ করে আর একটু বিশ্রামের জন্য।তখন কোনো কারনে ওর ঘরের লকারে একটা পেনড্রাইভ পাই।সেখানে এই ভিডিওটা পেয়েছিলাম।যখন এই কালপ্রিটটাকে বললাম এটা কিসের ভিডিও, তখন বললো এটা নাকি তার নতুন একটা সিরিজের কনসেপ্ট। 

তীব্র ওর ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে

- ভাইয়া, তোমায় আমার অভিভাবক মানতাম।ভাবতাম তুমিই তো আমার আপন মানুষগুলির মধ্যে একজন।আর সেই তুমিই আমার সাথে এরকম একটা জঘন্য কাজ করতে পারলে?

- আমায় মাফ করে দে তীব্র। আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।তোর প্রতি প্রতিশোধ নিতেই আমি এরকম একটা কাজ করেছি।একটা অপরাধ ঢাকতে গিয়ে অনেক অপরাধে জরিয়ে গেছি 

- কি? আমার ওপর প্রতিশোধ মানে? 

- হ্যা তোর ওপর প্রতিশোধ। মিহিতা যে তোর প্রেমিকা ছিলো সেটা আমায় আগে বলেছিলি?

- হঠাৎ এসব বিষয়ে কেন?

- বিয়ের পর থেকেই মিহিতা আমার থেকে দুরে দুরে থাকতো।আমি কারনটা জানতাম না।আর যখন জানলাম যে তুই আমার জীবন নিয়ে ছেলে ফেলা করেছিস তখন আমি এরকমটা করি।

- এই সামান্য কারনে তুমি এতো বড় পাপ করেছো আমার সাথে? 

- আমার ক্ষমা করে দে তীব্র,আমার মাফ করে দে 

বলেই তীব্রর পা জরিয়ে ধরলো।তীব্র ঝটকা দিয়ে পা ছাড়িয়ে নিলো।কর্কষ স্বরে বললো

- যে মেয়েকে নিয়ে হোটেলে গেলে,সেটা কে? রাস্তায় যারা রংচং মেখে থাকে তারা নিশ্চই?

- ও একজন কো-আর্টিস্ট।একসাথে আমরা কাজ করি।কাজ করতে করতে আমাদের মধ্যে ভালোলাগার সম্পর্ক তৈরী হয়।তারপর

- চুপ,একদম চুপ।লজ্জা লাগছে না এসব বলতে? মুখে একটুও বাঁধছে না? ভাবীকে রেখে এসব করে বেড়াচ্ছো, চরিত্রহীন 

- আর তুই কি? দুধে ধোঁয়া তুলসি পাতা? মিহিতার সাথে তুই শারীরিক সম্পর্ক করিস নি? ওহহ,,,তাতে কোনো দোষ নেই তাই না? 

- কি বললে? কে বলেছে তোমায় এসব কথা? বলো কে বলেছে ( শার্টের কলার ধরে চেচিয়ে বললো)

- আমি নিজ চোক্ষে দেখেছি।তোরা ওই পুরোনো আসবাব পত্র রাখায় ঘরটায় সময় কাটাচ্ছিলি। সে ভিডিও আছে আমার কাছে

এটা যে মিহিতা করেছে তাকে ফাসানোর জন্য এটা বুঝতে পারলো তীব্র।তবে কিছু বললো না,কারন একসময় মিহিতা তার বিরুদ্ধে স্বরযন্ত্র করলেও এখন সে শুধরেছে।সত্যিটা সবার সামনে আসবেই।ওর সাথে যে আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়নি এটা মিহিতা নিজের মুখেই শিকার করবে,এটা ভেবে চুপ করে রইলো।

তবে বেশিক্ষন থাকতে পারলো না।ঘৃনায় থানা থেকে বেড় হয়ে বাহিরের বট গাছটায় বসে রইলো।একটা সিগারেট ধরালো।বেড়িয়ে না আসলে হয়তো সে নিজেকে সামলে নিতে পারতো না। নিজের ভাইয়াকেই রক্তাক্ত করে দিতো।সিগারেট খেতে খেতে হঠাৎ একটা কথা মনে হয়।সিগারেটটা ফেলে দিয়ে দৌড়ে ভেতরে যায়।ওর ভাইয়ার শার্টের কলার ধরে গম্ভীর স্বরে বললো 

- আমার দুই সন্তানকে তুমিই শেষ করেছো তাই না?

তীব্রর কন্ঠটা গম্ভীর হলেও সেখানে যে ওর ভাইয়াকে ভষ্ম বানিয়ে দেওয়ার মতো এতো পরিমান তেজ আছে সেটা ওর ভাইয়া বুঝতে পারলো।নিচু স্বরে বললো

- প্রথম সন্তানটা মৃত জন্ম দিয়েছিলো।তারপরের সন্তানটা

- তারপরের টা কি? 


তীব্রর কন্ঠটা গম্ভীর হলেও সেখানে যে ওর ভাইয়াকে ভষ্ম বানিয়ে দেওয়ার মতো এতো পরিমান তেজ আছে সেটা ওর ভাইয়া বুঝতে পারলো।নিচু স্বরে বললো

- প্রথম সন্তানটা মৃত জন্ম দিয়েছিলো।তারপরের সন্তানটা

- ২য় সন্তানের সাথে কি করেছো? 

- যেদিন তোর ২য় সন্তানটা হলো সেদিন নার্সকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে বাচ্চাটাকে নিয়ে আমি রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ি।তারপর একটা এতিমখানায় রেখে চলে এসেছিলাম।

- তার মানে আমার সন্তান এখনো বেঁচে আছে?

- হ্যা,তুই চিন্তা করিস না,আমি ওকে কোনো কষ্টে রাখিনি,সবরকম সুযোগ সুবিধা দিয়েছি।
 
- তুই যদি আমার নিজের ভাই না হইতি তাহলে এতোক্ষণ পর্যন্ত বেঁচে থাকতি না।বাবা,মাকে সন্তানের থেকে আলাদা করে সুযোগ,সুবিধা করে দিয়েছিস তাই না।তোর সাথে কথা বলতেও ঘৃণা হচ্ছে। কোন এতিমখানায় আমার ছেলে?বল কোথায়? 

অফিসার জিপে তীব্র এবং তার ভাইয়াকে তুললো।তীব্রর সন্তানকে যে এতিমখানায় রাখা হয়েছিলো সেখানে।তীব্র শুধু ছটফট করছে।চোখ গড়িয়ে টপটপ করে অশ্রু গাল বেয়ে পড়ছে।তখনি নন্দিতার ফোন আসলো।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নন্দিতা বললো

- তীব্র কোথায় তুমি? সকাল থেকে তুমি নেই,জানো বাড়িতে..

নন্দিতার কথা থামিয়ে দিয়ে তীব্র বললো, 

- নন্দিতা আমাদের দ্বিতীয় সন্তান এখনো বেঁচে আছে।হসপিটাল থেকে চুরি করেছিলো আমার নিজের মায়ের পেটের কালপ্রিট ভাই।

- কি বললে আবার বলো? প্লিজ আবার বলো না কি বললে? 

- হ্যা নন্দিতা,আমাদের সন্তান বেঁচে আছে।

খট করে শব্দ হয়ে ফোনটা কেটে গেলো।তীব্রর বিষয়টা খটকা লাগলেও সন্তানকে খুঁজে পাওয়ার প্রবল সুখ তাকে অন্য সকল চিন্তা থেকে বিরত রাখলো।প্রায় ৩ ঘন্টা রাস্তা অতিক্রম করার পর যেই এতিমখানা পাওয়া গেলো।তীব্র ঝাপ দিয়ে জিপ থেকে নামলো,জিপটা তখনো থামেনি।

- ভাইয়া কোথায় আমার ছেলে? কোথায়? 

তীব্রর ভাইয়া "সমুদ্র" বলে ডাক দিতেই একটা ফুটফুটে একটা বাচ্চা ছেলে গুটিগুটি পায়ে কাছে এলো।তীব্র নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না।নিজের ছেলেকে জরিয়ে ধরে মুখে চুমু দিতে দিতে কান্না করতে লাগলো।অফিসার ওর ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন " একটা বাবার কাছ থেকে তার সন্তানকে কেড়ে নিয়েছেন,এতো বড় পাষান কিভাবে হতে পারলেন।দেখুন ছেলেকে কাছে পেয়ে বাবার আর্তনাতটা একবার দেখুন।এ যে এক স্বার্থহীন ভালোবাসা "

এই দৃশ্য দেখে ওর ভাইয়ার চোখেও জল এলো।বাচ্চা ছেলেটা হঠাৎ এরুপ কর্মকান্ঠে ভয় পেয়ে গেলো।কেউ এলজন এসে তাকে জরিয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে, জরিয়ে ধরে কান্না করছে,এটার কারন সে জানেনা।তীব্রর ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে তোতলানো স্বরে বললো

- তুপার মেন,ইনি কে?আমায় দলিয়ে ধরে আতে, আমাল ভয় লাগতে

তীব্র বললো

- আমায় চিনোনি? আমি যে তোমার বাবা,তোমার বাবা, একবার বাবা বলে ডাকো? 

- তুমি আমাল বাবা না।তুপার মেন,আমি তোমাল কাতে যাবো 

তীব্রর ভাইয়া দুহাত বাড়াতেই সমুদ্র ওর ভাইয়ার কোলে লাফিয়ে পড়লো।এবং গলা জরিয়ে ধরে থাকলো।তীব্রকে উদ্দেশ্য করে বললো

- এই হলো তোর সন্তান। আমি এতোটাও খারাপ না ভাই আমার,ওকে রোজ আমি দেখতে আসি।যখন যা লাগে সব কিনে দিই।ওর বাবা মায়ের অভাব পূরণের সকল চেষ্টা আমি করেছি।ও আমায় ভালোবেসে সুপার ম্যান বলে ডাকে।সুপার ম্যান তো বলতে পারে না, বলে তুপার মেন।সমুদ্র ইনি হলো তোমার বাবা,"

তীব্র এবং নন্দিতার সন্তান "সমুদ্র"।নন্দিতা এখন তাকে বুকের সাথে জরিয়ে ধরে বসে আছে।তীব্র বসে নন্দিতার সাথেই।এতিমখানা থেকে সোজা তীব্র বাসাতে চলে আসে।সাথে তার সন্তান, ভাইয়া এবং পুলিশ অফিসার ও ছিলো।জিপ বাড়ির সামনে দারাতেই তীব্র ওর সন্তান সমুদ্রকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকেই "নন্দিতা,নন্দিতা কোথায় তুমি,দেখো আমাদের ছেলে।দেখবে না নিজের ছেলেকে?  বলে ডাকতে ডাকতে সোফায় বসলো।

এদিকে নিজের সন্তান বেঁচে আছে এই খবর যখন তীব্র ফোন করে নন্দিতাকে জানায় তৎক্ষনাৎ সে জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়।এতোবড় ধাক্কা সামলাতে পারেনি।কাজের মেয়েটা দেখতে পেলো নন্দিতা ফ্লোরে পড়ে আছে।তারপর মাথায় জল ঢালার পর নন্দিতার শ্বশুর ডাক্তার ডাকলে নন্দিতাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছিলো।জ্বান ফিরতেই তীব্রর সেই "নন্দিতা,নন্দিতা কোথায় তুমি,দেখো আমাদের ছেলে।দেখবে না নিজের ছেলেকে? " কথাটা শুনে স্যালাইনের লাইনটা হাত থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে পাগলের মতো নিচে ছুটতে থাকে।নিজের ছেলেকে দেখতে পেয়ে বুকে জরিয়ে ধরে বসে আছে।কান্না করতে করতে তার চোখের জল শুকিয়ে গেছে। 

অফিসার তীব্রর ভাইয়াকে বললো

- চলুন,আপনার শাস্তির এখনো অনেক বাকি।

- আমি সব শাস্তি মাথা পেতে নিতে রাজি অফিসার। আমার মনে আর কোনো কষ্ট নেই।একটা অপরাধ ঢাকতে আরেকটা অপরাধ করেছিলাম।জরিয়ে গিয়েছিলাম। এখন আমি কিছুটা মুক্ত। শাস্তি আমি মাথা পেতে নিবো।

হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যেতেই তীব্র বললো

- অফিসার দারান।

অফিসার দারালো।তীব্র উঠে চোখের জল মুছলো।কাছে গিয়ে বললো

- ভাইয়া, তুমি যে অপরাধ করেছো তার কোনো ক্ষমা নেই। কিন্তু তুমি তোমার ভুলটা বুঝতে পেরেছো।আর তার থেকে বড় কথা আমি আমার সন্তানকে ফেরত পেয়েছি।আজ যে আমার বড়ই খুশির দিন।এই দিনে আমি চাইনা তোমার জন্য মিহিতা,বাবা,মা মনে মনে কষ্ট পাক।মানুষ ভুল করে তুমিও করেছো  এবং ভুলটা বিঝতে পেরেছো।এটাই অনেক।যতোই হোক,তুমি তে আমার ভাইয়া।ছোট থেকে তোমার আদরে বড় হয়েছি।কিভাবে তোমার শাস্তি দেখবো বলো? 

- ভাই আমার,একটু জরিয়ে ধরতে দিবি তোর এই পাপী ভাইটাকে?

 তীব্রকে জরিয়ে ধরে কান্না করছে।মিঃশেখর তার দুই ছেলেকেই জরিয়ে ধরে তিনিও কান্না করছেন।আজ যে মান অভিমানের পালা শেষ হতে চলেছে।নিজের রক্তের সম্পর্কের ভাইকে রেখে তার সুখের দিনে যে একটা অপূর্নতা রয়ে যাবেই।তাঁদের মান অভিমানের পালা দেখে অফিসার চোখের জল মুছে বললো

- এমন ভালোবাসার সম্পর্ক আমি আগে কখনো দেখিনি।সত্যিই তো,এতো অভিমান রেখে কি হবে।ভুলটা বুঝতে পেরে একসাথে থাকাই তো জীবন।আমরা বাঁচিই বা কয় দিন।এই কটা দিন যদি হিংসা,অভিমান করেই চলে যায় তাহলে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না।আপনাদের পরিবারের ব্যাপার আপনারা বুঝে নিন।আমি আসও তাহলে।

তীব্র- কোথায় যাচ্ছেন অফিসার,মিষ্টি মুখ করে যান।আজ আমার সবথেকে খুশির দিন।

রাবেয়া বেগমকে বেজায় খুশি লাগছে আজ।তিনি অফিসারকে শুধু মিষ্টি খাইয়েই রেহায় দেননি।সাথে পাঁচটা প্যাকেটে মিষ্টি দিয়েছে।নন্দিতাকে জরিয়ে ধরে বললো, " বৌমা,আমাকেও তুমি মাফ করে দিও,অনেক কথা শুনিয়েছি তোমায়"।নন্দিতা উত্তরে বললো " মা কি বলছেন আপনি? আপনি তে মা,মা বলবে না তো কে বলবে? আমার নিজের মাকে তো ছেড়ে এসেছি,এখন আপনিই তে আমার আরেক মা"।শেখর চৌধুরী আহ্লাদে গদোগদো হয়ে বললেন " কই আমার দাদুভাই,দাদুভাই চলো তো আমরা খেলি, তোমার জন্য কতো শত খেলনা কিনে রেখেছি দেখবে চলো"।সমুদ্র আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে শেখর চৌধুরীর সাথে বাগানে গেলো। 

সমুদ্র ব্যাট হাতে দারিয়ে আছে।বল করছে শেখর চৌধুরী। নন্দিতা সমুদ্রের হাত ব্যাটের সাথে ধরে আছে।ছোট বাচ্চাদের যেভাবে হাত ধরে ক্রিকেট খেলায় সেভাবে।আর তীব্র আছে স্টাম্পের পেছনে। রাবেয়া বেগম আশেপাশের সবাইকে মিষ্টি খাওয়াতে ব্যাস্ত।তার মুখে যেন হাসি সরছেই না।

শেখর চৌধুরী বল করলেন, নন্দিতা সমুদ্রের হাত দিয়ে ধরে থাকা ব্যাট দিয়ে বলে মারতেই বলটা উড়ে দুরে গিয়ে পড়ে।সমুদ্র খিলখিল করে হাসছে।তাকে জরিয়ে ধরে হাসছে নন্দিতা।পাশে দারিয়ে চোখে টলমলে জল নিয়ে তীব্র তাকিয়ে আছে।শেখর চৌধুরী তীব্রর কাধে হাত রাখলেন।মা ছেলের এই ভালোবাসা উপভোগ করছে।মায়ের ভালোবাসা কত সুন্দর।সমুদ্র নন্দিতার দিকে তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বললো " তুমি দলিয়ে ধললে আমাল এতো ভালোলাগে কেনো? কেউ দলিয়ে ধললে আমার এতো ভালোলাগে না,কিন্তু তুমি দলিয়ে ধরলে আমাল খুব ভালোলাগে"। 

সন্তানের মুখে এরুপ কথা শুনে একটি মায়ের মনের অবস্থা কিরুপ হতে পারে সেটা বর্নণা করা যায় না।

এভাবেই দিন কাটতে লাগলো।সমুদ্র এখন বড় হয়েছে।ক্লাস টু'য়ে পড়ে। একদিন স্কুল থেকে এসে দেখলো তীব্র দারিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। এটা দেখে কোনোরকমে ব্যাগটা রেখে রান্নাঘর থেকে নন্দিতার হাত ধরে টানতে টানতে ওপরে তীব্রর পাশে নিয়ে এসে বললো

" বাবাই,দেখো মা কে নিয়ে এসছি,লুকিয়ে লুকিয়ে এ্যা খাও তাই না,এবার মজা বুঝবে "।

সমুদ্রের কথা শুনে তীব্র নন্দিতা দু'জনই  হাসছে।তীব্র সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বললো, "সরি বাবু,এই যে দেখো কান ধরছি,এই যে নাক মুলছি,আর কখনো এসব এ্যা জিনিস ছুয়েও দেখবো না,খুশি?"

" খুব খুতি " 

সমুদ্রের এরুপ তোতলানো কথা শুনে তীব্র আর নন্দিতা আবারো হাসলো।তীব্র সমুদ্রকে কোলে নিয়ে নন্দিতাকে জরিয়ে ধরলো।তাদের সুখের জীবন শুরু।একটা ছেলে ফিরে পেলো তার পরিবার।বাবা,মা পেলো তার সন্তান। আর কি চাই? এটাই কি যথেষ্ট নয়? 





সমাপ্ত...





Writer:- জয়ন্ত কুমার জয়






NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner