> মেয়ে
-->

মেয়ে


আমি মেয়ে হয়ে এত দূরে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করবো সেটা আমার পরিবার সহজে মেনে নিলেও আমার আশেপাশের মানুষ আত্বীয়- স্বজন বিশেষ করে আমার চাচা-চাচী একদম মেনে নিতে পারে নি। সেদিন বিকালে বড় চাচা বাবাকে রুমে ডেকে বললো,
~শুনলাম তুই না কি তোর মেয়েকে ময়মনসিংহে ভর্তি করিয়েছিস?
বাবা হাসি হাসি মুখে চাচাকে বললো,
- হ্যাঁ ভাইজান, তুমি তো জানোই শ্রাবণী বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। তাই ওখানেই ওকে ভর্তি করিয়েছি।
চাচা মুখটা গম্ভীর করে বললো,
~তা তোর মেয়ে থাকবে কোথায়?
বাবা বললো,
- কোথায় আর, হোস্টেলেই থাকবে।
চাচা কিছুটা রেগে গিয়ে বাবাকে বললো,
- আমাদের বংশের কোনো মেয়ে একা একা হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে নি। আমারও তো মেয়ে আছে। আমার মেয়েকে তো আমাদের গ্রামের ডিগ্রি কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। তোর মেয়ের এত পড়াশোনার শখ যেহেতু, সেহেতু আমাদের গ্রামের ডিগ্রি কলেজে ভর্তি করিয়ে দিতে পারতি!
বাবা মুচকি হেসে চাচাকে বললো,
- তোমার মেয়ে এতটা ভালো ছাত্রী ছিলো না তাই ডিগ্রিতে ভর্তি করিয়েছো।
চাচা বাবার কথা শুনে আরো রেগে গিয়ে বললো,
~মেয়ে তোর, এখন তুই মেয়েকে ঘরে রাখবি না কি বাংলা বাজারে ছেড়ে দিবি এটা তোর ব্যাপার।
বাবা আর কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে দেখলো আমি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছি। বাবা আমায় বললো,
- মা, বড়দের কথা আড়াল থেকে শুনতে নেই।
আমি মাথা নিচু করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
-- বাবা আমি হোস্টেলে থেকে পড়তে পারবো না। তুমি গ্রামেই কোথাও আমাকে ভর্তি করিয়ে দাও।
বাবা মুচকি হেসে আমার মাথায় হাত রেখে বললো,
- এই সব বাজে কথায় মন খারাপ করিস না। ওরা হিংসায় এমন করে। আজ যদি ওদের মেয়ে ভালো ভার্সিটিতে চান্স পেতো তাহলে এমন বলতো না। একটা কথা মনে রাখিস মা, তুই যত উপরের দিকে উঠবি ততই তোর আশে পাশের মানুষ গুলো নানা রকম কথা বলে তোকে নিচে নামাতে চেষ্টা করবে। তুই এইসব বাজে কথায় কান না দিয়ে বরং জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবি...
এটাই উচিত হবে।
আজ চলে যাবো। জিনিসপত্র সবকিছু যখন প্যাকিং করছি তখন চাচী এসে মাকে বললো,
~শেষমেশ তোর মেয়েকে হোস্টেলে থেকেই পড়াবি?
মা হেসে বললো,
- হ্যাঁ আপা, মেয়েটা এত কষ্ট করে পড়াশোনা করে এত ভালো একটা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে এখন যদি ভর্তি না করাই, তাহলে মেয়েটার মনটা ভেঙে যাবে।
মা'র কথা শুনে চাচী মুখ বাঁকিয়ে বললো,
~এখন তো মেয়েকে একা একা পাঠিয়ে দিচ্ছিস। পরে আবার যেন কাঁদতে না হয়। আর তোর মেয়ের জন্য আমাদের যেন পরে কোনো কথা না শুনতে হয়। একা মেয়ে থাকবে আর না জানি কত কত ছেলের সাথে ঢলাঢলি করবে। মেয়ে মানুষের এত পড়াশোনার কি দরকার? মেয়ে বেপর্দা হয়ে যখন চলাফেরা করবে ছেলেদের সাথে রং-ঢং করে কথা বলবে; তখন দেখবি তোদের সংসারে আল্লাহ গজব নামবে।
চাচীর কথা শুনে মা শুধু বললো,
-আপা আপনি যান তো। আমার মেয়েটা চলে যাবে আমার মনটা এমনিতেই খারাপ। আর পর্দা ঠিক রেখেও একটা মেয়ে পড়াশোনা করতে পারে...
|
|
খুব একটা দরকার না হলে বাড়ি যেতাম না কারণ চাচা-চাচীর নোংরা কথা গুলো খুব গায়ে লাগতো আমার। বাবা মা সবসময় ফোন করে খোঁজ নেয় আর আমাকে যদি বাবা মা'র খুব বেশি দেখতে ইচ্ছে করে তাহলে আমার এইখানে এসে পড়ে। আমার সাথে সারাদিন থেকে বিকালে চলে যায়। পড়াশোনার ফাঁকে দুইটা টিউশনি করাই। টিউশনির প্রথম টাকাটা যখন পাই তখন বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি আর মা'র জন্য একটা শাড়ি কিনি। মা আনন্দিত হয়ে চাচীকে শাড়িটা দেখিয়ে বলেছিলো,
- আপা, আমার মেয়ে টিউশনি করিয়ে নিজে টাকা ইনকাম করে আমাকে এই শাড়িটা কিনে দিয়েছে। শাড়িটা সুন্দর না?
জাবাবে আমার চাচী বলেছিলো,
~খোঁজ নিয়ে দেখ গিয়ে তোর মেয়ে টিউশনি করে টাকা পেয়েছে নাকি অন্য কোনো ভাবে...
প্রেসার লো হয়ে যাবার কারণে বাবা বাজারে মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। সবাই যখন বাবাকে ধরাধরি করে বাসায় এনেছিলো তখন চাচা সবার সামনে চিৎকার করে বলেছিলো,
- আরে ওরে পাপে ধরেছে। এজন্যই আল্লাহ ওর উপর গজব ফেলছে। এত বড় মেয়েকে বাড়িতে না রেখে পড়ালেখার নামে একা বাজারে ছেড়ে দিছে। না জানি মেয়ে কত কি করে..
|
|
পরীক্ষা শেষ হবার পর কয়েকদিনের জন্য বাড়িতে আসলাম। বাবা মা'র সাথে এক সাথে বসে যখন ভাত খাচ্ছি তখন আমার গলায় মাছের কাঁটা বিধে যায়। খুব অস্বস্তি লাগছিলো দেখে বমি করছিলাম। আমার বমি করা দেখে চাচী সবাইকে বলে বেড়াতে শুরু করলো আমার পেটে নাকি বাচ্চা। প্রতিনিয়ত আমাকে আমার বাবা মাকে মানুষের নানা রকম কথা শুনতে হতো। এইসব শুনে মনে হতো পড়াশোনাই বাদ দিয়ে দেই।
কয়েকদিন পর জানতে পারি আমার চাচাতো বোন কোনো এক ছেলের সাথে গেস্ট হাউজে পুলিশের হাতে ধরা খেয়েছে। এত অপমানিত হবার পরেও উনাদের শিক্ষা হয় নি। উনারা আমার পিছনেই লেগে আছে। চাচা আমার বাবাকে বলে,
~ আমার মেয়ে তো ভুল করে একবার একটা কাজ করে ফেলেছে। কিন্তু তোর মেয়ে তো সব সময় করে। দুই দিন পর পর তুই আর তোর বউ মেয়ের এইখানে যাস.. আমরা কি বুঝি না তোরা কেন যাস? তোর মেয়ে ধরা খায় দেখেই মেয়েকে ছাড়াতে যাস।
এই কথাটা শোনার পর আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। বাবা কিছু বলতে যাবে আমি তখন বাবাকে থামিয়ে দিয়ে চাচাকে বললাম,
-- আপনার মত এমন নোংরা চিন্তা ভাবনার মানুষকে আমার চাচা বলে স্বীকার করতেও খারাপ লাগে। শুধু অন্যের মেয়ের দোষ খোঁজেন আর নিজের মেয়ে কত খারাপ কাজ করেছে সেটা চোখে পড়ে না। যে মেয়ে খারাপ তাকে সারাদিন ঘরের ভিতর আটকে রাখলেও দেখা যাবে সেই মেয়ের খাটের নিচে ছেলে মানুষ। আর যে মেয়ে ভালো, সে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে একা একাও থাকলেও সে ভালোই থাকে,সৎ থাকে।
আমার এমন কথা শুনে চাচী রেগে গিয়ে বললো,
~ভার্সিটিতে পড়ে খুব বড় হয়ে গেছো নাকি? বড় চাচার সাথে গলা উঁচু করে কথা বলছো!
আমি চাচীকে ধমকের সুরেই বললাম,
-- আপনি চুপ করেন। ভাতিজি আর নিজের মেয়ের মাঝে কোন তফাৎ নেই। তবুও আমাকে নিয়ে আপনারা স্বামী-স্ত্রী মানুষের কাছে যা তা বলে বেড়িয়েছেন!
আরো কিছু বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাবা আমার হাতটা ধরে বললো,
- মা, থাক বাদ দে। কিছু মানুষ আছে যারা অন্যের সমালোচনা করে তৃপ্তি পায়। আমার ভাই আর ভাবী এমন ধরণের মানুষ।
_______
_________
৬ বছর পর.....
বাবা আর মা বড় চাচাকে সালাম করলো। বাবা চাচাকে বললো,
-ভাইজান আমরা তাহলে আসি। মেয়ে চাকরি পেয়েছে। একটা বাসাও ভাড়া নিয়েছে। মেয়ে এখন চাইছে আমরা যেন ওর সাথে গিয়ে থাকি।
চাচা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
~মেয়েদের ইনকাম করা টাকা বেহালাল হয়। মেয়ে মানুষ ঘরে থাকাই ভালো। পুরুষদের সাথে ঢলাঢলি করে চাকরি করার কোনো দরকার নেই।
বাবা কিছু না বলে শুধু মুচকি হেসে চাচার রুম থেকে বের হয়ে আসলো...
বিঃদ্রঃ- মেয়ে শুনো, তোমায় বলছি। একটা ছেলে যে জিনিসটা খুব সহজে পায় তুমি মেয়ে সেই জিনিসটাই খুব কষ্টে অর্জন করো। তুমি মেয়ে হয়ে একা বাসায় থাকবে,লোকে এটা নিয়ে সমালোচনা করবে। তুমি একা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করবে, এটা নিয়ে সমালোচনা হবে। তুমি চাকরি ক্ষেত্রে প্রমোশন পেলেও সেটা নিয়ে সমালোচনা হবে। এইসব সমালোচনায় কান দিও না বরং অপেক্ষা করো সঠিক জবাব দেওয়ার জন্য...




Writer:- আবুল বাশার পিয়াস
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner