Leave a message
> ক্ষণজন্মা - Inspiration - Boipoka365
-->

ক্ষণজন্মা - Inspiration - Boipoka365


Inspiration

রাতে বাসায় ফিরে শুনি সাত তলার রমজান আংকেল আর আন্টি দুই জনই কভিড আক্রান্ত। আমার বউ মিলি এসে বলল, বুড়াবুড়ির তেজ যদি এইবার একটু কমে।

মিলির দোষ নেই। এই বিল্ডিংয়ের বেশীরভাগ ফ্ল্যাটের মানুষই রমজান আংকেল আর আন্টির কথার যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ থাকে সারাক্ষণ। গত সপ্তাহেই আমি অফিস থেকে ফিরছি, লিফটে রমজান আংকেলের সাথে দেখা, দেখেই বললেন, কি হে মেহেদী সাহেব অফিসে খাটাখাটুনি খুব বেশি যাচ্ছে না? বড় হতে হলে সেটা তো একটু করতেই হবে। তবে পড়াশুনা যদি আরাকটু ভালোভাবে করতেন তাইলে হয়ত এখন দেশে এই কষ্ট করতে হতো না। 

আমি মেজাজ খারাপ করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। নিশ্চিত জানি উনি এইবার উনার ছেলের রেজাল্ট শুনাবেন আমাকে। বললেন ,

আমার ছেলেকে দেখুন বুয়েট থেকে বের হয়ে এমআইটিতে পড়তে গেলো এরপর দেখেন ইউএসের মতো দেশে আমার ছেলেকে নিয়ে কেমন টানাটানি চলছে। গত তিনবছরে তিনটা বিগ কোম্পানিতে ছিলো এখন আইবিএমে আছে। সবই হচ্ছে সময়মতো পরিশ্রমের ফল বুঝলেন। 

লিফট পাঁচ তলায় পৌঁছাতে আমি তাড়াতাড়ি বের হয়ে বাঁচলাম। মিলির আরোও বিপদ। রমজান আন্টির সাথে দেখা হলে নানা সময়ে সে নানা ধরনের উপদেশ আর তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের মধ্যে পড়ে যায়।

তোমার গাঁয়ের রঙটা আরএকটু উজ্জ্বল হলে ভালো হতো, যত্ন নাও না নিজের তাই না ?  আর্টসের ছাত্রী ছিলে তারমানে পড়াশুনা করো নাই ঠিকমতো। আমার মেয়েকে দেখো যেমন সুন্দর তেমন ব্রিলিয়ান্ট। বিয়ের বয়স হলে পাত্রের উৎপাতে বাসায় টেকা মুস্কিল ছিলো আমাদের। অটোয়া থেকে প্রায়ই ফোন করে বলে যে তাকে নাকি এখনো মানুষ অল্প বয়সী কলেজ গোয়িং স্টুডেন্ট ভাবে, অথচ দেখো দুই বাচ্চা মানুষ করছে সে। আর তোমার কি অবস্থা, এই বয়সেই খালাম্মা সেজে বসে আছো। 

এই ধরনের নানা কথাবার্তার কারনে ফ্ল্যাটের সবাই মোটামুটি এড়িয়ে চলে রমজান আংকেলদের। বয়স্ক মানুষ, পাল্টা কথা বলাও যায় না। 

পরদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় নীচে নামছি লিফটে চারতলার রেশাদ ভাই উঠলেন, বললেন, মেহেদী ভাই শুনেছেন? সাততলার রমজান আংকেলের কভিড?

--হু ভাই কালই শুনলাম। আমাদের একটা কিছু কি করা উচিৎ না? 

--ভাই কিছু মনে করবেন না, উনার কোন কিছুতে আমাকে পাবেন না। আর করোনা খুব ডেডলি চেহারা নিয়েছে এখন, ভ্যারিয়েন্টটা মারাত্মক। একই বিল্ডিংয়ে থাকা ঠিক হচ্ছে কিনা সেটাই বুঝছি না।

ওইদিন রাতে বাসার দারোয়ানের কাছে শুনলাম, রমজান আংকেলের অবস্থা খারাপ, আনিস ভাই তাকে হসপিটালে ভর্তি করতে নিয়ে গেছেন। বাসায় রমজান আন্টি একা, কাজের মেয়ে আর ড্রাইভারও চলে গেছে ভয়ে। পরিস্থিতি আসলে বেশ খারাপ।

বাসায় উঠার সময় লিফটে ছয় তলার জগলুল আংকেলের সাথে দেখা। ডাবল মাস্ক, গগজ, হেড কাভারে চেনাই যাচ্ছে না। গলা শুনে চিনলাম, উনি বললেন,

মেহেদী শুনছেন, আনিস ওই খিটখিটে বুড়াকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেছে আবার আনিসের বউ রোজী নাকি বাসায় গিয়ে বুড়িকে টেক কেয়ার করছে? এর কোনো মানে হয়? এদের কারনে কভিড এখন পুরা বিল্ডিং এ ছড়িয়ে যাবে। আরে বাবা এদের ছেলে মেয়ে আত্মীয়স্বজন আছে না? তাদের দেখতে বল, কভিডের মতো মারাত্মক অসুখের সময় ভালোমানুষি দেখানোর চেয়ে সতর্ক থাকাটা জরুরী বেশী। 

আমি কিছু বললাম না। মনে পড়ল জগলুল আংকেল ফ্ল্যাটটা কেনার সময় ডেভলপারের সাথে বিরাট গ্যাঞ্জাম লাগিয়ে দিয়েছিলেন, রাগের চোটে ডেভলপরের ইঞ্জিনিয়ারকে চড় মেরে ফেসে গিয়েছিলেন, থানা পুলিশ হয় এই অবস্থা, পরে আনিস ভাই মধ্যস্থতা করে মিটিয়ে দিয়েছিলেন।

বাসায় যাওয়ার পর মিলি বলল, রমজান আংকেলের ছেলে মেয়েরা ফোন করে আনিস ভাই আর রোজী ভাবীকে বারবার রিকোয়েস্ট করেছে বাবা মাকে দেখে রাখার জন্য। তারা এই সময়ে আসতে পারবে না।

আমি জানি সেটার দরকার ছিলো না। আনিস ভাই এমনিতেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন। অন্যের বিপদ দেখলেই কোনকিছু চিন্তা না করেই ঝাঁপিয়ে পড়া তার স্বভাব, আসলে তার ধরনটাই অমন। 

রমজান আংকেল যতোদিন হাসপাতালে থাকলেন, আনিস ভাই আর রোজীভাবী রমজান আংকেল আর আন্টির জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করলেন, আনিস ভাই নিয়মিত হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ রাখলেন, রোজী ভাবী প্রতিদিন আন্টিকে খাবার পৌঁছে দিলেন, সেবা যত্ন করলেন। করোনার রুগীকে এতোটা কাছ থেকে সেবা যত্ন করা খুবই রিস্কি কাজ, যেখানে আত্মীয় স্বজনরাই পালিয়ে যায় সেখানে আনিস ভাই দম্পতি প্রাণপাত করে দিলেন। 

একদিন বিল্ডিংয়ের দারোয়ান আমাকে ডেকে বলল, স্যার আপনি আনিস স্যারকে মানা করেন, এই দুই বুড়াবুড়ির যত্ন আত্তি করার জন্য আল্লাহ তাদের ছেলেমেয়ে দিছে, তারাই যখন দূরে সেইটা আল্লাহর ফয়সালা, এইখানে আনিস স্যার যেটা করতেছে তাতে ভালো মানুষটা বিপদে পড়বে। 

আমি ওকে ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলাম, আনিস ভাইয়ের জন্য দারোয়ানের দরদ অকৃত্রিম। আমি জানি নির্দিষ্ট বেতনের বাইরেও আনিস ভাই দারোয়ানের একটা ছেলের পড়াশুনার খরচ চালান। 

পাঁচ দিনের মাথায় রমজান আংকেল মারা গেলেন। আন্টিকেও ততদিনে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আনিস ভাই রমজান আংকেলের দাফনের জন্য ছোটাছুটি করতে লাগলেন। আমি ওইদিন বাসায় ফিরে অবাক হয়ে গেলাম, এই বিল্ডিংয়ের একজন বাসিন্দা আজ না ফেরার দেশে চলে গেছে সেটার কোন ছাপ নেই, কোথাও কান্নার শব্দ নেই, কারো চেহারায় মন খারাপের লক্ষণ নেই। দারোয়ান খুব স্বাভাবিক ভাবে গেট খুলে দিলো, যেনো গতকাল আর আজকের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। আমি লিফটে যখন উঠছি তখন আমেরিকা থেকে ফোন এলো,

হ্যালো ভাই, আমি নিষাদ, চিনেছেন? 

নিষাদ রমজান আংকেলের ছেলে।আমি বললাম, হু।

ভাই, কিছু মনে করবেন না, বাবা তো চলে গেলেন আমাদের আসার কোন উপায় ছিলো না, মায়ের অবস্থাও শুনেছি খারাপ, আপনারা যা করছেন আপনাদের ঋন আমরা কোনদিন শোধ করতে পারব না। 

আমি চুপ করে রইলাম।

মেহেদী ভাই, কিছু যদি মনে না করেন আপনার ব্যাংক একাউন্ট নম্বরটা দেন আমি টাকা পাঠাতে চাই, মায়ের চিকিৎসার যেনো কোন সমস্যা না হয়, যত টাকা লাগে আমি দেবো।

আমার ক্লান্ত লাগলো। আন্টির এই পরিস্থিতিতে টাকা খুবই দরকারী জিনিস তবু কোথায় খটকা লাগে, সন্তানেরা টাকা দিয়ে সব দায়িত্ব শেষ করে ফেলতে চায়। একদিন কি আমাদেরও এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে? এই যে আন্টি একা হয়ে গেলেন শুধু টাকা দিয়ে কি তার দায়িত্ব নেয়া যাবে? 

রমজান আংকেলের মৃত্যুর সাত দিনের মাথায় আন্টিও মারা গেলেন। মিলি আমাকে ওইরাতে বলল, ভালোই হলো বুঝলে, বেঁচে গেলেন আন্টি, তার ছেলে মেয়েরাও হাফ ছাড়ল।

আমি মৃদু ধমক দিলাম, আহ মিলি, তোমার সবকিছুতে বাঁকা চিন্তা আগে আসে। 

কিন্তু আমি জানি ঠিকিই বলেছে মিলি। 

--কত ঝামেলায় যে আন্টি বেঁচে থাকলে পড়ত তুমি জানো না। একাই থাকতে হতো এই ফ্ল্যাটে, আর শোনো আনিস ভাইয়েরও সম্ভবত কভিড পজেটিভ হয়েছে। 

হওয়ারই কথা। আনিস ভাই আর রোজী ভাবী যেভাবে রমজান আংকেল আর আন্টির দেখাশুনা করেছেন তাতে তাদের আক্রান্ত না হওয়াই অস্বাভাবিক। আমি একটু উদ্ভিগ্ন বোধ করলাম।

পরদিন বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে বসেছি। মিলি এসে বলল, আনিস ভাই আর ভাবী দুই জনই পজেটিভ। আনিস ভাইয়ের অবস্থা একটু খারাপ। শুনলাম অক্সিজেন স্যচুরেশন ফল করেছে। 

আমি উঠে দাঁড়ালাম। 

--কোথায় যাও?

আনিস ভাইকে দেখতে, কিছু লাগবে কিনা দেখে আসি। 

মিলি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, দাঁড়াও একটু। 

কিছুক্ষণ পর দেখি সেও মাস্ক গ্লাভস হেড কভার পরে এসেছে, চলো যাই।

আনিস ভাইয়ের ফ্ল্যাটের সামনে  বিরাট জটলা। সব ফ্ল্যাটেরই লোকজন মনে হয় চলে এসেছে। আনিস ভাইকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। অক্সিজেন মাস্ক লাগানো আনিস ভাইকে স্ট্রেচারে করে নীচে নামানো হলো। নীচে ভীড়। দারোয়ানরা সবাই উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়ানো। পিপিই পরা লোকজন যখন আনিস ভাইকে ধরে এম্বুলেন্সে তুলছে তখন আনিস ভাইয়ের জ্ঞান নেই। 

আমি এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম , রোজী ভাবী বাঁধা দিলেন। বললেন, দরকার হলে অবশ্যিই জানাবেন। এখন আপাতত এই কভিড রিস্কে না যেতে। 

আনিস ভাইকে নিয়ে এম্বুলেন্স বেরিয়ে গেলো। সংগে অতন্দ্র প্রহরীর মতো রোজী ভাবী। নিজেও কভিড পজেটিভ তবু তার সব উৎকন্ঠা ভালোবাসার মানুষটাকে ঘিরে। 

পেছন ফিরে দেখি জগলুল আংকেল তার গগলসের ভেতরে চোখের পানি লুকাবার চেস্টা করছেন।

আনিসের কিছু হবে না, তাই না মেহেদী? 

আমি কিছু বললাম না।

বিল্ডিংয়ের সবাই উদ্বিগ্ন মুখে তখনো নীচে দাঁড়ানো, করোনার ভয় ছাপিয়ে সবাই আনিসভাইকে দেখতে এসেছিল।    

একপাশে দেখলাম দারোয়ান তার বউকে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, বউটা আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে।

আনিস ভাই আমাদের সবাইকে কোন না কোন ঋণে বেঁধে রেখেছেন। অন্যের বিপদ দেখলেই নিজের বিপদ তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়া নিঃস্বার্থ এই মানুষটাকে ভালো না বেসে উপায় নেই। মানুষের এই ভালোবাসাই তাকে ফিরিয়ে আনবে আমি নিশ্চিত।



( সমাপ্ত )




লেখক: খোন্দকার মেহেদী হাসান 

 

Delivered by FeedBurner

a