> কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ ০২ - আরিফ আজাদ - Arif Azad - ইসলাম - কুরআন
-->

কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ ০২ - আরিফ আজাদ - Arif Azad - ইসলাম - কুরআন

বেকার, অস্বচ্ছল এবং আর্থিকভাবে নিদারুন কষ্টে আছে এমন বহু মানুষকেই আমি চিনি যারা একটা মানসিক অস্থিরতার ভিতর দিয়ে দিন গুজরান করে। সাধারণত বিপদ-আপদ, দুঃখ-দুর্দশা যখন আমাদের স্পর্শ করে, আমরা তখন খুব বিপন্ন হয়ে পড়ি এবং নিপতিত হই হতাশার ঘন গভীর অন্ধকারে। এমন কঠিন সময়ে আমাদের অন্তর কীভাবে যেন আল্লাহর স্মরণ থেকে বিস্মৃত হয়ে পড়ে।  আমাদের ওপরে নিপতিত দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে দুনিয়ার সম্ভাব্য সকল উপায় তখন মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারলেও, যিনি সকল সমস্যার সমাধানকারী, তার দ্বারস্থ হওয়ার কথা আমরা বেমালুম ভুলে যাই।

আমি সহ এমন অনেক মানুষই চারপাশে আছে যারা জীবনের কঠিন সময়গুলোতে বেশ অগোছালো হয়ে পড়ি। ওই সময়গুলোতে সুন্নাহ আর নফল তো দূর, ফরয আদায়েই কেমন যেন আমরা হাঁপিয়ে উঠি। আমাদের তখন সালাতে মন বসে না, যিকিরে মন বসে না, কুরআন তিলাওয়াতে মন বসে না। জীবন তখন আমাদের কাছে হিমালয় ডিঙানোর মতোই দুষ্কর।

কিন্তু, এমনটা আসলে হওয়ার কথা ছিলো না।

কুরআন থেকে আমি যখন মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনা পড়ছিলাম, একবার একটা জায়গায় এসে আমি ভীষণভাবে ধাক্কা খাই। একটা আয়াত আমার চিন্তার জগতকে এমনভাবে নাড়া দেয় যে— সেদিন থেকে আমার জীবনের দর্শনটাই উল্টেপাল্টে যায়।

যুবক অবস্থায় একবার এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি হয়ে মুসা আলাইহিস সালামকে নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে মাদইয়ানে পালিয়ে আসতে হয়। মাদইয়ানে আসবার পরের একটা ঘটনা কুরআন বেশ গুরুত্ব সহকারে আমাদের সামনে বিধৃত করে। সেই ঘটনায় দেখা যায়— দুজন নারী তাদের বকরীকে পানি পান করাতে এসে একটা কূপের অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দাঁড়িয়ে থাকবার কারণ হচ্ছে, ওই সময়টায় কূপে কিছু পুরুষ মানুষ তাদের নিজ নিজ বকরীকে পানি পান করাচ্ছিলো। যেহেতু কূপে পুরুষেরা ছিলো, তাই নারী-দ্বয় ওই মুহূর্তে কূপের নিকটে না গিয়ে, অদূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করাটাকেই নিজেদের জন্য সমীচীন মনে করলো। পুরুষেরা তাদের কাজ সেরে চলে গেলে তারা কূপের নিকটে যাবে এবং বকরীকে পানি পান করাবে— এমনটাই তাদের পরিকল্পনা।

মাদইয়ানে মুসা আলাইহিস সালাম তখন সদ্য পা রেখেছেন কেবল। এবং ঘটনাক্রমে— ওই কূপের কাছেই একটা গাছের নিচে বসে ছিলেন তিনি। কূপে পুরুষদের আনাগোনা এবং অদূরে দুজন নারীর দাঁড়িয়ে থাকা এবং কূপের কাছে তাদের ঘেঁষতে না পারার বিষয়টা নজর কাড়লো মুসা আলাইহিস সালামের।

মেয়ে দুটো যেহেতু নিজেদের বকরীকে পানি পান করাতে পারছে না, তাই মুসা আলাইহিস সালাম তাদেরকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেলেন। তিনি স্বেচ্ছায় তাদের বকরীগুলোকে কূপ থেকে পানি পান করিয়ে তাদের কাছে ফিরিয়ে দিলেন এবং পুনরায় গাছের নিচে এসে বসে পড়লেন।

গাছের নিচে ফিরে এসে তিনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালার কাছে একটা দুয়া করেছিলেন সেদিন। সেই দুয়াটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা এতো পছন্দ করলেন যে— সেটাকে তিনি মানবজাতির জন্য কুরআনে স্থান দিয়ে দিলেন।

জানেন সেই দুয়াটা কি ছিলো? তিনি সেদিন বলেছিলেন:

'আমার রব! আমার প্রতি যে অনুগ্রহই আপনি করবেন, আমি তার-ই মুখাপেক্ষী'- আল ক্বাসাস ২৪

খেয়াল করুন— নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে মাদইয়ানে পালিয়ে এসেছেন তিনি। মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই পর্যন্ত নেই। কী খাবেন, কী পরবেন, বাকি দিনগুলো কীভাবে কাটাবেন— কোনোকিছুই তিনি জানেন না।

সম্পূর্ণ নতুন এক জায়গায় যদি আমাকে রেখে আসা হয়, যেখানে আমার কোন আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নেই, কোন পরিচিত লোক নেই, এমনকি আমার হাতে একটা পয়সাও নেই যে আমি থাকা-খাওয়ার সংস্থান করবো। ভাবুন তো— এমন একটা অবস্থায় পড়লে আমার মনের অবস্থাটা কী হবে? আল্লাহর কাছে যদি দুয়া করতে হয়, আমি তখন কীরকম দুয়া করবো?

আমি বলবো— ইয়া আল্লাহ, আমাকে থাকার একটা জায়গা মিলিয়ে দিন। ইয়া আল্লাহ, আমাকে খাবারের বন্দোবস্ত করে দিন। ইয়া আল্লাহ, আপনি এই বিদেশ-বিভূইয়ে আমার জন্য একটা উত্তম আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিন৷

কিন্তু দেখুন— এরকম একটা নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েও মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে সেভাবে দুয়া করেননি। তিনি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চান নি, মাথা গোঁজার ঠাঁই চাননি, এমনকি একবেলা আহারের ব্যবস্থার জন্যও দুয়া করেন নি। বরং তিনি বললেন— 'আমার রব! আমার জন্য যে অনুগ্রহ আপনি করবেন, আমি তার-ই মুখাপেক্ষী!

'আমার প্রতি যে অনুগ্রহ আপনি করবেন'— এই কথাটার মানে কী?

মানে হলো— যদি আপনি আমাকে খেতে দেন তো আলহামদুলিল্লাহ, খেতে না দিলেও আলহামদুলিল্লাহ। আমাকে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিলেও আলহামদুলিল্লাহ, যদি আমাকে নিরাশ্রয় করে রাখেন, তা-ও আলহামদুলিল্লাহ৷ আপনি আমাকে যে পরিস্থিতিতে, যে অবস্থায় ফেলবেন— আমি নিঃসংকোচে, নির্ভাবনায় সেই পরিস্থিতিকে, সেই অবস্থাকে মাথা পেতে নেবো।

আরো লক্ষ্যনীয়— একটু আগেই কিন্তু তিনি দুটো মেয়ের বকরীকে পানি পান করিয়ে তাদের উপকার করেছিলেন। তিনি যদি চাইতেন, সেই কাজটাকে উসিলা করে হলেও আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে পারতেন। তিনি বলতে পারতেন— 'আমার রব! খানিক আগেই আমি আপনার দুজন বান্দার উপকার করেছি। এই উসিলায় আপনি আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করুন'।

তিনি সেটাও করেননি। নিজের পুরো ব্যাপারটা তিনি আল্লাহর ওপরে ন্যস্ত করে দিলেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা যে সিদ্ধান্তই তাঁর জন্য স্থির করবেন— সেটাকেই সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়ার জন্য তিনি প্রস্তুত।

আল্লাহর ওপর এই যে ভরসা, বিপদের দিনে আল্লাহর ওপর এই যে নির্ভরতা, এই নির্ভরতা আমাদের মাঝে কোথায়? বিপদে আল্লাহর কাছাকাছি যাওয়ার বদলে, আমরা বরং আল্লাহর কাছ থেকে আরো বেশি দূরে সরে যাই।

আল্লাহর ওপর এই নির্ভরতার ফল মুসা আলাইহিস সালাম কিন্তু সাথে সাথেই পেয়েছিলেন। কুরআন আমাদের জানায়— খানিক বাদেই মেয়েদের একজন এসে মুসা আলাইহিস সালামকে বলে, 'আমার আব্বা আপনাকে ডাকছেন। আপনি আমাদের বকরীকে পানি পান করিয়েছেন, তাই আমার আব্বা আপনাকে এর বিনিময় দিতে চান'।

এর বিনিময় হিশেবে মুসা আলাইহিস সালাম কী পেলেন জানেন? একটা উত্তম আশ্রয়, একজন সৎ কর্মশীলা স্ত্রী এবং একটা গোছানো পরিবার।

মুসা আলাইহিস সালাম তো এসবের কিছুই চান নি। দুয়ার মধ্যে তিনি না আশ্রয়ের কথা বললেন, না স্ত্রীর কথা বললেন আর না বললেন কোন পরিবারের কথা। তিনি স্রেফ বললেন— আপনি যা দিবেন তা-ই চাই। আপনি আমায় কিছু দিলেও খুশি, না দিলেও খুশি'।

তিনি নিজের ইচ্ছাকে নয়, বরণ করেছিলেন আল্লাহর ইচ্ছাকে। আর, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা হচ্ছেন আশ-শাকুর তথা উত্তম বিনিমিয় দাতা। নাম ধাম ধরে কিছু না চেয়েও মুসা আলাইহিস সালামকে কতো কী যে তিনি দিলেন!

মুসা আলাইহিস সালাম আমাকে শিখিয়েছেন—বিপদের দিনে, দুঃখ-দুর্দশার দিনে অস্থির-চিত্ত না হয়ে, ঘাবড়ে না গিয়ে, দিশেহারা না হয়ে আল্লাহর দিকে নিবিড়ভাবে ঝুঁকতে হয়। আল্লাহর স্মরণে নিজেকে আরো বেশি করে ব্যাপৃত রাখতে হয়। তাঁর সিদ্ধান্তকে মাথা পেতে মেনে নিতে হয় এবং সর্বাবস্থায় তাঁর ওপরই নির্ভর করতে হয়।

দুনিয়াতে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে ভুরি ভুরি বই, লেকচার, আর্টিকেল আর তত্ত্বকথা পাওয়া যাবে। কিন্তু, মুসা আলাইহিস সালামের এই একটা দুয়াকে যদি আপনি জীবনে ধারণ করতে পারেন, যদি ঘন-ঘোর বিপদের দিনেও আপনি সন্তুষ্টচিত্তে বলতে পারেন, 'আমার রব! আমার প্রতি যে অনুগ্রহই আপনি করবেন, আমি তার-ই মুখাপেক্ষী', বিশ্বাস করুন— এরচেয়ে ভালো কোন ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের পাঠ দুনিয়ার কোথাও আপনি শিখতে পারবেন না।


Writer:- Arif Azad
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner