> আরশিযুগল প্রেম পর্ব ৬, ১০ - ভালোবাসার গল্প - রোমান্টিক লাভ স্টোরি - নৌশিন আহমেদ রোদেলা
-->

আরশিযুগল প্রেম পর্ব ৬, ১০ - ভালোবাসার গল্প - রোমান্টিক লাভ স্টোরি - নৌশিন আহমেদ রোদেলা

রাত আটটা। মাঘের শেষেও ঠান্ডাটা যেন কামড়ে ধরছে শরীর। যানবাহনে পরিপূর্ণ উত্তরাও ঢাকা পড়েছে ঘন কুয়াশায়। ল্যাম্পপোষ্টের আলোতে কুয়াশাগুলো ধোঁয়ার মতো কুন্ডলী পাকাচ্ছে। কাছাকাছি আসতেই মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে। এই শুভ্র কুয়াশার চাদর ভেদ করেই মেয়ের বাড়িতে এসে পৌঁছেছে সাদাফ ও বাকিরা। বেশ সাজানো গুছানো ড্রয়িং রুম। ডানপাশের দেয়ালে  বেশকিছু ফ্যামিলি ফটো। সেই ফটো গুলোতেই চোখ বুলাচ্ছে সাদাফ। হালকা নীল টি-শার্ট আর কালো ব্লেজারে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। সাদাফের সামনের সোফাটাতেই বসে আছেন একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। নাকের নিচে পুরুষালী গোঁফ। শক্তপোক্ত শরীর। বয়স পঞ্চাশের ঘর পেরুলেও চুলে আর গোঁফে পাক ধরেছে মাত্র। চোখে-মুখে কাঠিন্য স্পষ্ট। লোকটি ভারি গলায় আরাফের মা-মামার সাথে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে গল্প থামিয়ে সাদাফের দিকে তাকালেন। শান্ত গলায় বললেন,

---" উনাকে তো চিনলাম না।" 

আরাফের মামা বিগলিত হাসি নিয়ে বললেন, 

---" ও আরাফের বন্ধু। অসাধারণ একটা ছেলে। ছাত্রজীবনে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলো এখন চাকরিও করছে মাশাআল্লাহ! চাকরির দু'বছরের মাথাতেই বনানীতে ফ্ল্যাট কিনে হুলস্থুল কান্ড।"

লোকটি মৃদু হেসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সাদাফের মুখে। শান্ত গলায় বললেন,

---" নাম কি তোমার, বাবা?"

---"রাফাত আল সাদাফ।"

---" রাফাত আল সাদাফ! বেশ ভালো নাম। বাড়ির সবাই ভালো আছেন?" 

সাদাফ মৃদু হেসে বললো, 

---" জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।"

লিয়াকত সাহেব হাসলেন। হঠাৎ করেই খেয়াল করলেন অচেনা এই ছেলেটাকে বেশ ভালো লাগছে তার। স্বল্পভাষী ছেলেটির নিঃসংকোচ কথাবার্তায় সে কি তেজ! কোনো কৃত্রিম ভঙ্গিমা নেই তার চোখে। কাউকে আকৃষ্ট করার জন্য মিথ্যা হাসিও ঝুলে নেই তার ঠোঁটে। সব যেন খুব সাধারণ এবং সত্য। ড্রয়িংরুমের পাশের রুমটিতেই শেফাকে সাজাতে ব্যস্ত ছিলো শুভ্রতা। শেফাকে নিয়ে বের হওয়ার আগমুহূর্তেই গম্ভীর কন্ঠে বলা "রাফাত আল সাদাফ" নামটা কানে এলো তার। কন্ঠের ঝংকার আর নামটা কানে যেতেই চমকে উঠলো শুভ্রতা। কন্ঠটা অর্ধ পরিচিত হলেও নামটা যে তারই। ঠিক এই নামের মানুষটির সাথেই তো...। শুভ্রতার ভাবনার মাঝেই চাপা গলায় ডেকে উঠলেন সায়িদা বেগম, 

---" কি রে শুভ্রতা?  দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? নিয়ে যা ওকে।" 

সায়িদা বেগমের কথায় ঘোর কাটলো শুভ্রতার। ঢোক গিলে শুকনো গলা ভেজানোর বৃথা চেষ্টা করে বললো,

---" তততুমি নিয়ে যাও না, খালামনি। আমি বরং খাবার রেডি করি। প্লিজ?" 

সায়িদা বেগম গরম চোখে তাকালেন। কিছু একটা ভেবে চোখের ইশারায় সম্মতি জানিয়ে শেফাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সাথে সাথেই পর্দা সরিয়ে উঁকি দিলো শুভ্রতা। ডানপাশের সোফায় বসে থাকা সাদাফকে চোখে পড়লো তার। সাথে সাথেই কেঁপে উঠলো বুক। হালকা নীল টি-শার্টের উপর কালো ব্লেজার, ডেনিম ব্লু জিন্স, পায়ে কেটস, ফর্সা গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর কপালে পড়ে থাকা সিল্ক চুলগুলোতে মাতাল করা সুন্দর লাগছে ছেলেটিকে। প্রথম দিন ট্রেনে দেখে তো এতোটা সুন্দর লাগে নি শুভ্রতার, তাহলে আজ কেন? আচ্ছা? তবে কি এই ছেলেটাই শেফা আপুকে দেখতে এসেছে? কথাটা ভেবেই আৎকে উঠলো শুভ্রতা। তাহলে কি শেফা তার সতীন হতে চলেছে? এসব অদ্ভুত চিন্তাভাবনার মাঝ পথেই ভ্রু কুঁচকালো শুভ্রতা। এসব কি ভাবছে সে? শেফার সাথে সাদাফের বিয়ে হলেই বা তার কি আসে যায়? নিজের মনে করা এই প্রশ্নের জবাবে বিরবির করে বলে উঠলো শুভ্রতা,

---" অবশ্যই আসে যায়। আপুর সাথে উনার বিয়ে হলে বছরে একশোবার দেখা হবে উনার সাথে। তখন যদি ব্ল্যাকমেইল করে? বাবা-মাকে যদি বলে দেয়? অথবা, পালিয়ে আসার জন্য চড় লাগায় গালে বা অধিকার চায়?" 

কথাগুলো ভাবতেই গলা শুকিয়ে গেলো শুভ্রতার। এই ঠান্ডার রাতেও কি ভীষণ গরম লাগছে তার। বুকের গহ্বরে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে। কি করবে এখন শুভ্রতা? শুভ্রতার হুট করেই কান্না পেয়ে যাচ্ছে। এই গোটা বাংলাদেশে কি দেখতে আসার মতো শুধু শেফা নামক মেয়েটাই ছিলো? শুভ্রতার বরকে কি সব রেখে তার বোনকেই দেখতে আসতে হলো? নিচের ঠোঁট কামড়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো শুভ্রতা। জিহ্বা দিয়ে  ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে হাজারও চিন্তায় কপাল ভাঁজ করলো সে। কিছুক্ষণ পর ওঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক পায়চারী করলো। নাহ.. কোনো বুদ্ধিই আসছে না মাথায়। হঠাৎ করে ব্রেনটা এমন অকেজো হয়ে গেলো কেন কে জানে? ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখের ঘাম মুছে মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো শুভ্রতা, যায় হয়ে যাক না কেন ছেলেটার সামনে যাওয়া চলবে না। কিছুতেই না। শুভ্রতার এই প্রতিজ্ঞা বেশিক্ষণ টিকলো না। সায়িদা বেগমের গরম চোখের সামনে টিকতে না পেরে বাধ্য হয়েই নাস্তা সাজিয়ে সামনে যেতে হলো তাকে। রান্নাঘরে হাজারো ভাবনা চিন্তায় নিজেকে শাসনে রাখলেও সাদাফের সামনে যেতেই ধুকপুক করে উঠলো বুক। সাদাফ আরাফের সাথে খুনশুটিতে ব্যস্ত। শুভ্রতাকে ঠিক খেয়াল করে নি সে। শুভ্রতা ধুরুধুরু বুকে সামনের টেবিলটাতে খাবারগুলো সাজিয়ে রাখতেই বেখেয়ালি দৃষ্টিতে  তাকালো সাদাফ। দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাতেই  ভ্রু'দুটো কুঁচকে এলো তার। কি ভেবে, আবারও শুভ্রতার মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটাকে বড্ড চেনা লাগছে তার। কোথাও যেন দেখেছে সে। কিন্তু কোথায়? কথাগুলো ভাবতেই চমকে উঠলো সে। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে শুভ্রতার নিমজ্জিত চোখদুটোর দিকে তাকালো। বুকের মাঝে হালকা-মৃদু ঢিপঢিপ শব্দটা ধীরে ধীরে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে লাগলো। এমন সময় পাশ থেকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন মামা,

---" এই মেয়েটা কে, লিয়াকত সাহেব? ভারি মিষ্টি দেখতে।" 

লিয়াকত সাহেব মৃদু হেসে বললেন,

---" আমার ছোট শালিকার মেয়ে শুভ্রতা।" 

"শুভ্রতা" নামটা কানে যেতেই আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ছেড়ে নড়েচড়ে বসলো সাদাফ। অস্থির চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে আড়চোখে শুভ্রতার দিকে তাকালো। শুভ্রতাও গোপনে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সাথে সাথেই চোখাচোখি হয়ে গেল দু'জনের। চোখে চোখ পড়তেই দু'জনেই চোখ সরিয়ে নিলো দ্রুত। অস্বস্তিতে ভারি হয়ে এলো রুমের হাওয়া। দু'জনেই জেনে গেলো দু'জনার পরিচয়। এই অস্বস্তির বাতাসে ছেদ ঘটিয়ে হাসিমুখে বলে উঠলেন মামা,

---" ভারি মিষ্টি নাম। ও তো তাহলে আরাফের হবু শালি হলো, কি বলেন লিয়াকত সাহেব?" 

শুভ্রতা সাথে সাথেই সাদাফের দিকে তাকালো। তারমানে বিয়েটা সাদাফের নয়। প্রথমে খুশিতে ঝলকে উঠলেও মুহূর্তেই মুখটা কালো হয়ে গেলো শুভ্রতার। যার সাথেই বিয়ে হোক না কেন বিয়েটা হয়ে গেলে তো বারবারই মুখোমুখি হতেই হবে তাদের, এখন উপায়? ভয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে শুভ্রতার। দু’সেকেন্ড পরই ঠান্ডা ছাপিয়ে প্রচন্ড গরমে অস্থির হয়ে পড়লো শুভ্রতা। কাঁপা হাতে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়েই ভারি নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো সে। মন বলছে, "এই বুঝি কিছু হলো! এই বুঝি চিনে ফেললেন! এই বুঝি প্রকাশ করলেন সব।" এই ভয়মাখা ক্লান্ত মন নিয়ে শেফার পেছনে, সোফায় হাত রেখে মাথানিচু করে দাঁড়ালো শুভ্রতা। সাদাফ হালকা  চোখে শুভ্রতাকে লক্ষ্য করলেও গম্ভীর মুখে বসে রইলো। শুভ্রতার আনত মুখের পাশ দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট চুলের খেলা করা, চাপা নাক, ভারি পল্লবে ঢাকা চোখ, হলদেটে ফর্সা মুখ আর নাকের পাশে কুচকুচে কালো তিল সব মিলিয়ে অন্যরকম একটা ভালো লাগা ছেয়ে গেলো তার মনে। এর আগে কোনো মেয়েকে এভাবে খেয়াল করে নি সাদাফ। তবে আজ কেন এতোটা গুরুত্ব দিচ্ছে সে? ভাগ্যের ফেরে পেয়ে যাওয়া স্ত্রী বলে? নাকি, একগুচ্ছ হালাল অধিকার বলে?লিয়াকত সাহেবের কথায় সচেতন চোখে চায়ের কাপে চুমুক দিলো সাদাফ। লিয়াকত সাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন,

---" সেই তো।" 

লিয়াকত সাহেবের উত্তরে হালকা হেসে কথা পাড়লেন মামা, 

---" লিয়াকত সাহেব? বলছি কি?  বিয়েটা আমরা তাড়াতাড়িই সেড়ে ফেলতে চাই। দু'পক্ষেরই যখন পছন্দ তখন দেরি করার তো কোনো কারণ দেখি না।" 

লিয়াকত সাহেব খানিক ভেবে বললেন,

---" তা ঠিক। কিন্তু আমার শালিকার শশুড়মশাই আর আমার বড় ভাই দু'জনেই এ বছর হজ্জে যাচ্ছেন। উনারা দু'জনেই আমাদের গার্জিয়ান বলা চলে। তারা হজ্জ থেকে ফিরে এলেই বিয়েটা সম্পন্ন করতে চাইছি আমরা। এটা তো ফেব্রুয়ারি মাস। জুলাইয়ের শেষের দিকেই রওনা দিবেন উনারা। সেপ্টম্বরের দিকে ফিরে আসবেন। তো বিয়ের ডেটটা আমরা সাত/ আট মাস পরে ঠিক করলেই হয়তো বেশি ভালো হতো। এটা উনাদেরও মত।" 

মামা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

---" আপনাদের সমস্যাটা বুঝতে পারছি। আসলে, কিছুদিন যাবৎ দুলাভাইয়ের শরীরটাও তেমন ভালো যাচ্ছে না। হায়াত-মউতের কথা তো আর বলা যায় না। কখন কি হয়ে যায়। তাই বলছিলাম, আপাতত কাবিনটা করিয়ে রাখলে হয় না? রিসেপশনটা না হয় আপনাদের সুবিধামতোই করলেন।" 

বড়দের গুরুগম্ভীর কথার মাঝেই শেফাকে নিয়ে সরে গেলো শুভ্রতা। হাত-পা রীতিমতো কাঁপছে তার। সাদাফ যখন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো শুভ্রতার চোখে লজ্জা, ভয় আর অস্বস্তিতে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিলে তার। কি মোহাবিষ্ট দৃষ্টি তার! রুমে ঢুকেই বেড-টেবিলের উপর থেকে কাঁপা হাতে পানির গ্লাসটা তুলে নিলো শুভ্রতা। এক চুমুকে সবটা শেষ করে গ্লাস হাতেই ধপ করে বসে পড়লো বিছানায়। শেফা তার দিকে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো, 

---" কি হয়েছে তোর? দেখতে এসেছে আমাকে আর ভয়ে মরে যাচ্ছিস তুই। কাহিনী কি?"

শুভ্রতা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। শেফাকে কি করে বুঝাবে তার অস্থিরতা? কিছুক্ষণ মৌন থেকে নিজেকে শান্ত করলো শুভ্রতা। মৃদু গলায় বললো,

---" তোমার যে বিয়ের ডেইট ফিক্সড হয়ে যাচ্ছে আপু। বিয়েটা কি তুমি করছো?" 

শেফা লাজুক হেসে মাথা নাড়লো। শুভ্রতা যেন লাফিয়ে উঠলো। গ্লাসটা টেবিলে রেখে তাড়াহুড়ো করে শেফার সামনে বিছানায় পা তুলে বসলো সে। ক্ষেপা গলায় বললো,

---" দু'মিনিট দেখেই রাজি হয়ে গেলে আপু? একটুও ভাববে না? চরিত্র কেমন কে জানে? আজকালকার ছেলেরা কতটা বাজে হয় ধারনা আছে তোমার? এইসব ছেলেরা দশটার সাথে ডেটিং করে বেড়ায়। রুমডেট হেনতেন কতো কিছু করে। আর এই ছেলেটাকে দেখেই তো আস্ত চিট মনে হচ্ছে। দেখতেও অনেকটা বলদের মতো৷ এই বলদকে বিয়ে করবে তুমি?" 

শেফা সরু চোখে তাকালো। স্বাভাবিক গলায় বললো, 

---"  "এখনকার ছেলেরা" এই দুটো শব্দ বলেই তো সব সমস্যার সমাধান করে দিলি রে বোন। দেখ, এখনকার সব ছেলেদের চরিত্রই যদি ফোর টুয়েন্টি হয় তাহলে সবার জামাই-ই এমন। এতে আমার একার চাপ নেওয়ার তো কিছু নেই। সবাই যদি দশ মাইয়ার বাবুকে বিয়ে করে খুশি খুশি হানিমুনে যেতে পারে তাহলে আমি একা ভার্জিনিটি খুঁজতে গিয়ে চিরকুমারী থাকতে যাবো কেন? একটু চালাক হ বুঝলি? বিয়ের পর এমন টাইট দিবো না চরিত্রে হান্ড্রেডে হান্ড্রেড হয়ে যাবে আমার জামাই। সো নো চাপ!  আর, বলদ কোথায় দেখলি? দেখতে তো বেশ ভালো। যদিও পাশের ছেলেটা হেব্বি ছিলো,এক্কেবারে জোশ কিন্তু প্রবলেম কি জানিস? ব্যাটা খুবই গম্ভীর। আমার বাবা এতো গম্ভীর ছেলে ভাল্লাগে না। সো আমি রাজি।" 

কথাটা শেষ করেই দাঁত বের করে হাসলো শেফা। শুভ্রতা ব্যর্থতা ঘেরা চোখে তাকালো। বোনকে এতোকিছু বুঝানোর পরও যখন বিয়ের খুশিতে নাচছে। সেখানে আর কিইবা বলতে পারে সে? 

________________

রাতের খাবার নিয়ে ব্যস্ত সবাই। আরাফের মায়ের জোরাজোরিতে সায়িদা বেগমকেও চেয়ার টেনে বসতে হয়েছে পাশে। যার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা বাধ্য হয়েই খাবার সার্ভ করতে হচ্ছে শেফাকে। তাকে একটু আধটু সাহায্য করছে শুভ্রতা। খাবার টেবিলে সাদাফের চোখে না পড়ার মতো জায়গা বেছেই দাঁড়িয়েছে শুভ্রতা। সাদাফ থেকে নিজেকে আড়াল করার কতো উদযোগ তার। কিন্তু "নিয়তি" নামক বস্তুটি শুভ্রতার এই লুকোচুরিকে খুব একটা প্রশ্রয় দিলো না। তার সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে হুট করেই গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন লিয়াকত সাহেব,

---" শুভ্রতা মা? সাদাফকে ভাত দাও। ওর প্লেটটা খালি পড়ে আছে তো।"  

লিয়াকত সাহেবের কথায় চমকে উঠলো শুভ্রতা। সাদাফও অস্বস্তিতে উশখুশ করে উঠলো। লিয়াকত সাহেবের তাড়ায় বাধ্য হয়েই সাদাফের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো শুভ্রতা। কিছুটা ঝুঁকে সাদাফের প্লেটে ভাত দিতে গিয়েই সাদাফের গায়ের হালকা মিষ্টি গন্ধ ধাক্কা দিয়ে গেলো নাকে। শুভ্রতার শুষ্ক অনুভূতিগুলো হঠাৎই যেন ভরা বর্ষার মাতাল নদীর মতো টলমলে হয়ে উঠলো। কাঁপা হাতে ভাত দিতে গিয়ে কিছু ভাত পড়ে গেলো সাদাফের গায়ে। শুভ্রতার অস্বস্তি আর কাঁপা হাত দেখে মৃদু গলায় বলে উঠলো সাদাফ,

---" ইটস ওকে। আর লাগবে না। আমার হয়ে গেছে।" 

শুভ্রতা মাথা হেলিয়ে সরে দাঁড়ালো। সায়িদা বেগম বেশ কয়েকবার শুভ্রতাকে দেখে নিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলেন।  আজকের আগে শুভ্রতাকে এতো শান্ত আর ভদ্র হয়ে থাকতে দেখে নি কেউ। শেষ পর্যন্ত তাহলে মেয়েটার বাচ্চামোটা গেলো? খাওয়া-দাওয়া শেষ করে দশটার দিকে ফেরার জন্য উদযোগ করলো তারা। লিয়াকত সাহেবের থেকে বিদায় নেওয়ার ফাঁকে আড়চোখে এক-দুবার শুভ্রতার দিকে তাকালো সাদাফ। মেয়েটা যে ভয়ে সিটিয়ে আছে তা বেশ বুঝতে পারছে সাদাফ। আচ্ছা? কিসের এতো ভয় ওর? ওর কি বিয়ে হয়ে গেছে?  নাকি ভালোবাসার কেউ আছে? সেই ভালোবাসার মানুষটিকে আঁকড়ে রাখতেই কি সাদাফকে ভয় পাচ্ছে শুভ্রতা? কথাগুলো ভেবে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সাদাফ। সবার থেকে বিদায় নিয়ে সাদাফরা বেরিয়ে যেতেই মনের এককোনায় বেজে উঠলো এক স্পষ্ট সুর ---" সে আমার বর!" মনের এই অযাচিত ভাবনায় নিজেই চমকে উঠলো শুভ্রতা। এসব কি ভাবছে সে?

________________

বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে ফোন স্ক্রল করছিলো শুভ্রতা। শেফা ড্রেসিন টেবিলের সামনে বসে রাতের শেষ লোশনটা লাগাচ্ছিলো গায়ে। এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন সায়িদা বেগম। বিছানায় বসে অদূরে সুরে ডাকলেন,

---" শেফা? এদিকে আয় মা।" 

শেফা লোশনের কৌটাটা ড্রেসিন টেবিলের উপর রেখে সায়িদা বেগমের পাশে গিয়ে বসলো। সায়িদা বেগম বিগলিত গলায় বললেন,

---" ওরা এখনই কাবিন করতে চায়। তোর বড় চাচা আর বড় দাদুর মতে সামনের শুক্রবার বাদ মাগরীবে কাবিনের ব্যবস্থা করে হচ্ছে।  তোর কোনো সমস্যা নেই তো, মা?"

কথাটা কানে যেতেই ধপ করে উঠে বসলো শুভ্রতা। মনে মনে বলতে লাগলো, "নো আপু, ছে নো। এই বিয়া করিস না মেরি মা। আমাকে এভাবে ফাঁসাছ না, প্লিজ!  প্লিজ! হে আল্লাহ্ তোমার এই মাসুম বান্দাটাকে এ বারের মতে বাঁচায় দাও। একটু রহম করো। আমি মসজিদে একহাজার টাকা দান করমু আল্লাহ।  প্লিজজজজ। " শুভ্রতার এতো এতো দোয়ায় এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে শেফা লাজুক হাসলো। মেয়ের পজিটিভ সাইন পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়লেন সায়িদা বেগম। কিন্তু শুভ্রতা? শুভ্রতা নাক ফুলিয়ে বসে রইলো। এই মুহূর্তে শেফার চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। একবার শেফার হবু বরের কারণে সাদাফের সাথে জড়িয়ে পড়েছে এখন আবার সেই হাদারামের হবু বউয়ের জন্য ঝামেলায় ফাঁসতে যাচ্ছে। উফফ! শুভ্রতার এতো এতো রাগ কারো চোখে পড়লো না। সায়িদা বেগম মেয়ের গালে আলতো আদর করে বললেন,

---" তিনদিন পরই তো শুক্রবার। পরশু আরাফ দেখা করতে চায়। এর আগে তো কথা-বার্তা হয় নি তোদের। পরশু দু'জন মিলে আলাদা কথা বলার সুযোগ পাবি। যাবি তো মা?" 

শেফা মাথা নিচু করে মৃদু হাসলো। সায়িদা বেগম হাতে চাঁদ পেয়েছেন এমন ভাব নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সায়িদা বেগম বেরিয়ে যেতেই ক্ষেপা বাঘিনীর মতোন শেফার দিকে তাকিয়ে রইলো শুভ্রতা। এই মেয়েটাকে এই মুহূর্তে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। বেয়াদব একটা। বিয়ের জন্য মরে যাচ্ছে। কেন রে? শুভ্রতার বরের ফ্রেন্ড ছাড়া বিয়ে করার মতো আর কোনো ছেলে জুটতো না তোর কপালে? শুভ্রতার এই মুহূর্তে পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কেঁদে কেটে দুনিয়া ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। শুভ্রতার এই পরিকল্পনাটাকেও ভেস্তে দিয়ে বিছানা কাঁপিয়ে তুমুল শব্দে বেজে উঠলো মুঠোফোন। শুভ্রতা বিরক্তি নিয়ে ফোনের দিকে তাকালো। ফোনে "মা" নামটা দেখে আরো একদফা বিরক্ত হলো সে। বিরক্তি নিয়েই ফোনটা রিসিভ করলো,

---" হ্যালো?" 

শুভ্রতার মা, রাদিবা আহমেদ আগ্রহ নিয়ে বললেন,

---" হ্যাঁ রে শুভি? তোর খালামনি বললো শেফার নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।"

---" হ্যাঁ হয়েছে তো?"

রাদিবা আহমেদ খুশি হয়ে বললেন, 

---" বাহ! আলহামদুলিল্লাহ।" 

শুভ্রতা চরম বিরক্ত হলো। সে টেনশনে মরে যাচ্ছে আর আর তার মা খুশিতে নাচানাচি করছেন ব্যাপারটা ঠিক হজম হলো না তার। শক্ত গলায় বললো,

---" আশ্চর্য! এতো খুশি হচ্ছো কেন বুঝলাম না। তোমার আনন্দ দেখে মনে হচ্ছে বিয়েটা শেফা আপুর নয় তোমার ঠিক হয়েছে। এমন কোনো ঘটনা ঘটে নি যার জন্য তোমাকে আনন্দে পাগল হয়ে যেতে হবে, মা।" 

রাদিবা আহমেদ অবাক হয়ে বললেন, 

---" আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি?  আর  শেফার বিয়েতে আমি খুশি হবো না? এটা তোর কাছে আনন্দের ব্যাপার মনে হচ্ছে  না?"

শুভ্রতা স্পষ্ট কন্ঠে বললো,

---" নাহ্। মনে হচ্ছে না। এবার ফোনটা রাখো তো। আমার বিরক্ত লাগছে মা। অসহ্য!" 

মেয়ের হঠাৎ এমন ব্যবহারে হতবাক হয়ে গেলেন রাদিবা আহমেদ। শুভ্রতা কখনো তো এমন অভদ্রের মতো কথা বলে না। তাহলে আজ হঠাৎ কি হলো মেয়েটার? রাদিবা আহমেদ চিন্তিত ভঙ্গিতে ফোন কেটে স্বামীর কাছে দৌঁড়ালেন। স্বামী শাহিনুজ্জামানকে এই মুহূর্তে ঘটনাটা খুলে বলতে হবে তার। অতিরিক্ত পড়াশোনায় মেয়েটা পাগল হয়ে গেলো কি না কে জানে?


উত্তরার চিরচেনা ক্যাফেতে বসে আছে শেফা আর শুভ্রতা। শুভ্রতাকে বেশ কসরত করেই এই অব্দি টেনে এনেছে শেফা। ভার্সিটি শেষ করে ধানমন্ডি থেকে উত্তরা আসতে কিছুতেই রাজি ছিলো না সে। তাও আবার আরাফের সাথে দেখা করার জন্য? নো ওয়ে! অন্যের প্রেমালাপে শুভ্রতার কি কাজ? কিন্তু শেফাকে তা বুঝানো দায়। মুখে যত কিছুই বলুক না কেন আরাফের সাথে একা দেখা করতে খুবই অস্বস্তির সম্মুখীন হচ্ছে সে। তাই একরকম বাধ্য হয়েই সাথে আসতে রাজি হয়েছে শুভ্রতা। ক্যাফেতে এসে পৌঁছানোর পাঁচ মিনিটের মাথায় বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো শুভ্রতা,

---" তোমার হবু বর যে আস্ত একটা হাদা তা আজ আবারও প্রমাণিত আপু।" 

শেফা গরম চোখে তাকালো। মুখ ফুলিয়ে বললো,

---" এ তোর ভারি অন্যায় শুভি। তুই বারবার ওর পেছনে কেন লাগছিস বল তো? তোর হবু দুলাভাইকে অবশ্যই তোর রেসপেক্ট করা উচিত। কি এমন করেছে সে, যার জন্য তুই ওকে হাদা বলছিস?" 

শুভ্রতা অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললো,

---" কি করেছে? তুমি তো দেখছি বিয়ের আগেই বরের প্রতি ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে গেছো আপু। কয়টা বাজে দেখেছো?" 

কথাটা বলে ঘড়ি পড়া বামহাতটা শেফার দিকে এগিয়ে দিলো শুভ্রতা।  ইশারায় ঘড়ি দেখিয়ে যথাযথ যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করলো সে,

---" দেখো, সন্ধ্যা ৭ঃ২০। অলমোস্ট রাত হয়ে এসেছে। এই টাইমে কোন ভদ্রলোক পাত্রীর সাথে গোপন আলাপ সাড়তে চায় বলো?" 

শেফা ক্ষেপা গলায় বললো,

---" তোর সবকিছুতে বাড়াবাড়ি শুভি। "গোপন আলাপ" বলতে কি বুঝাতে চাইছিস তুই? নিশ্চয় কোনো কারণ আছে তাই এই সময়টা সিলেক্ট করেছে ও। তাছাড়া, এমন তো কোনো নিয়ম নেই যে এই সময়ে কারো সাথে দেখা করা যাবে না, আছে কি?"

শুভ্রতা কিছু বলবে তার আগেই স্বচ্ছ কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো আরাফ। শুভ্রতা দরজার মুখোমুখি বসেছিলো। শেফার কথার উত্তর দিতে গিয়ে বেখেয়ালিভাবে দরজার দিকে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার। হঠাৎই সটান দাঁড়িয়ে গেলো সে। শেফা অবাক হয়ে বললো,

---" শুভি? এই শুভি? কি হয়েছে? এভাবে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? "

শুভ্রতা ঘন ঘন ঢোক গিলে ভ্রু জোড়া খানিকটা কুঞ্চিত করে ভয়মাখা চোখে তাকিয়ে আছে। শেফা প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে শুভ্রতার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছন ফিরে তাকালো। আরাফ আর সাদাফকে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে অল্প হাসলো। সাথে সাথেই তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো শুভ্রতা,

---" আপু?ভাইয়া তো চলেই এসেছে। তুমি থাকো, আমি যাই হ্যাঁ? এখানে আমার কি কাজ বলো?" 

কথা শেষ করেই পার্সটা হাতে তুলে নিয়ে পা বাড়ালো শুভ্রতা। ডানহাতে শুভ্রতার ডানহাতটা চেপে ধরে জোর করে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো শেফা,

---" পাগল তুই? এভাবে চলে গেলে কি মনে করবে বল তো? একটু কথা-টথা বলে তারপর যা। প্লিজ।" 

শুভ্রতাকে প্রতিবাদের সুযোগ না দিয়েই সামনে এসে দাঁড়ালো দুই বন্ধু। দুইদিন ব্যাপী সাদাফের পেছনে ঝুলে ঝুলে আজ সন্ধ্যায় তাকে সাথে আসার জন্য রাজি করিয়েছে আরাফ। ক্যাফেতে ঢুকে শুভ্রতাকে দেখে নিজেও খুব একটা কম চমকায়নি সাদাফ। কয়েক সেকেন্ডের জন্য পা'দুটো মাটির সাথে সিটিয়ে গিয়েছিলো তার। নিজেকে সামলে নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এলেও বুকের মাঝে অচেনা এক ধুকপুক শব্দ অল্প বিস্তার জ্বালাচ্ছে তাকে। শুভ্রতা যে খুব বেশি সুন্দরী, তা তো নয়। সাধারণ বাঙালি মেয়েদের মতোই গোলগাল হলদে ফর্সাটে মুখ, চাপা নাক। শুভ্রতার থেকেও কতো শতো সুন্দরী মেয়ের সাথে পরিচিয় আছে সাদাফের,প্রোপোজাল পেয়েছে ,এড়িয়েও গেছে তবুও শুভ্রতার প্রতিই এতো অস্থিরতা কেন? অলৌকিক এক বন্ধনে বেঁধে গেছে বলে? নাকি অন্যকোনো রহস্য? অচিন্তনীয় বিষয়গুলোই চিন্তার ছাঁচে ফেলে একদফা চিন্তা করে নিলো সাদাফ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদু হেসে শেফার দিকে তাকালো। মিষ্টি গলায় বললো,

---" আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন ভাবি?"

সাদাফের মুখে "ভাবি" ডাক শুনে লজ্জায় রাঙা হলো শেফা। মাথা নিচু করে মাথা হেলিয়ে বললো,

---" ভালো আছি, ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?" 

সাদাফ শুভ্রতার পাশের চেয়ারটায় বসলো। শেফার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো,

---" আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনাদের মাঝে হাড্ডি হতে চলে এলাম। তবে,আমার কিন্তু কোনো দোষ নেই ভাবি। আরাফ আমায় জোর করে এনেছে।" 

শেফা হাসলো। আরাফ শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

---"কেমন আছো শুভ্রতা? হবু শালী বলে তুমি করেই সম্মোধন করলাম। রাগ করো নি তো?"

শুভ্রতা ইতস্তত গলায় বললো, 

---" একদমই না ভাইয়া। তুমিটাই সুইটেবল।" 

চারজনকেই নীরবতা ছেয়ে ধরলো। সবার চোখে-মুখেই অস্বস্তির ছাপ। এই অস্বস্তির পরদ উঠিয়ে জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে বলে উঠলো সাদাফ, 

---" তোরা কথা বল আরাফ। আমি বাইরে দিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি। কিছু কেনার ছিলো।" 

এটুকু বলেই উঠে দাঁড়ালো সাদাফ। শুভ্রতাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে হালকা কেশে বলে উঠলো সাদাফ,

---" শুভ্রতা? আব..আপনি কি আমায় হেল্প করবেন? আই মিন, কেনাকাটায় হেল্প করবেন?" 

সাদাফের মুখে নিজের নাম শুনে চমকে উঠলো শুভ্রতা। তটস্থ হয়ে সাদাফের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো দারুন বোকামো করেছে সে। সাদাফ যে আরাফদের স্পেস দেওয়ার জন্যই বেরিয়ে যাচ্ছে তা বুঝে নিজেরও কিছু একটা বাহানা দেওয়া উচিত ছিলো। মনে মনে নিজেকে হাজারটা বকা দিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো শুভ্রতা। শেফার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,

---" তোমরা গল্প করো আপু। রাতের রাস্তাটা বেশ লাগে আমার। আমি বরং উনার সাথে হেঁটে আসি। কেমন?" 

__________________

ক্যাফে থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটছে সাদাফ-শুভ্রতা। দু'জনের মাঝেই বিষাক্ত নীরবতা। সাদাফ পকেটে হাত ঢুকিয়ে চুপচাপ হেঁটে চলেছে। দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির হলেও বেহায়া মনটা শুভ্রতার দিকেই ছুটে চলেছে ক্রমাগত। শুভ্রতার ফর্সা গায়ে কালো জামা, খোলা চুল, গাঢ় কাজলে ঢাকা চোখ  সবই যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তার মন। শুভ্রতার মনে হাজারো অস্বস্তি। সাদাফের জায়গায় অন্য কেউ হলে সহজেই কথা বলতে পারতো সে। নিঃসংকোচে হাঁটতে পারতো কিন্তু কি আশ্চর্য, যার সাথে সংকোচহীন সম্পর্কে বেঁধে আছে তার কাছেই নিঃসংকোচ হতে পারছে না সে। পাঁচ/দশ মিনিট নিঃশব্দ থেকে কিছুটা ফাঁকা রাস্তায় এসে কথা বললো সাদাফ,

---" কেমন আছেন, শুভ্রতা?" 

নীরবতা ভেঙে সাদাফের এই প্রশ্নে চমকে উঠলো শুভ্রতা। বামপাশের চুলগুলো কানে গুঁজে নিয়ে মৃদুস্বরে বললো,

---" ভালো আছি, আপনি?" 

---" আমি সবসময় ভালোই থাকি। আপনি কি খুব বেশি অস্বস্তি ফিল করছেন?এ.." 

সাদাফের কথা শেষ না হতেই একটা গাড়ি শুভ্রতার পাশ কেটে খুব স্পিডে বেরিয়ে গেলো। সাদাফ খুব সাবধানে শুভ্রতার অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। শুভ্রতাকে ফুটপাতের ভেতরদিকে হাঁটতে দিয়ে নিজে রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটতে লাগলো। সাদাফের এই ছোট্ট যত্নটাও যেন শুভ্রতার মনে হাজারো ভালোলাগার পরশ দিয়ে গেলো। আড়চোখে ল্যাম্পপোষ্টের হলদে আলোয় সাদাফকে দেখতে চেষ্টা করলো শুভ্রতা। তবে, দু'জন পাশাপাশি হাঁটতে থাকায় সাদাফের সবটা দেখতে পেলো না শুভ্রতা। চোখে শুধু ধরা পড়লো সাদাফের ফর্সা গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, কালচে লাল ঠোঁট আর কনুই পর্যন্ত ভাজ করে রাখা খয়েরী শার্টের হাতা আর হ্যা, ফর্সা হাতের কব্জির খানিকটা উপরে কুচকুচে কালো তিল। সেই তিলটার দিকেই সম্মোহনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শুভ্রতা। ঘড়ির সাদা বেল্টের খানিক উপরে তিলটাকে এমন নিঃসংকোচে নিজের সৌন্দর্য প্রকাশ করতে দেখে খানিকটা হিংসে লাগলো শুভ্রতার। সাদাফ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে আবারও কথা পাড়লো,

---" আপনি যে অস্বস্তি ফিল করছেন তা বুঝতে পারছি আমি। আপনার অস্বস্তি দেখে আমারও অস্বস্তি লাগছে। আপনার কাজিনের সাথে আরাফের বিয়েটা হয়ে গেলে হয়তো মাঝে মাঝেই মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। তাই বলছিলাম, প্লিজ!  ইজি হওয়ার চেষ্টা করুন। আমাদের সাথে যা ঘটে গেছে তা একটা এক্সিডেন্ট। আপনি অন্যকারো সাথে জড়িয়ে থাকতে পারেন। আর থাকাটাও স্বাভাবিক। আমি এই বিষয়ে কোনো রকম প্রশ্ন করবো না আপনাকে। না কোনো রকম জবাবদিহি চাইবো। আপনার উপর অধিকারও খাটাবো না। আপনি আপনার মতোই চলুন। এতো ভয় বা অস্বস্তির কিছু নেই। নয়তো, ব্যাপারটা ধীরে ধীরে আরো বেশি ক্রিটিক্যাল হয়ে যাবে। আই থিংক, আপনি বুঝতে পারছেন।" 

শুভ্রতা মাথা নাড়লো। সাদাফ হেসে বললো,

---" এখনও অস্বস্তি ফিল করছেন?" 

শুভ্রতা আড়চোখে তাকালো। হালকা হেসে বললো,

---" হালকা। তবে,ধীরে ধীরে কেটে যাবে।" 

সাদাফ ঠোঁট টিপে হাসলো। শুভ্রতার বলতে ইচ্ছে হলো, "আরেকবার হাসুন না প্লিজ!" আচ্ছা? এই লোকটা এতো সুন্দর করে হাসে কেন?কেন? কিছুটা সামনে এগুতেই ফুসকার স্টল চোখে পড়লো। সাদাফ আড়চোখে শুভ্রতাকে দেখে নিয়ে বললো,

---" ফুসকা খাবেন?" 

শুভ্রতা মুখে হাসি ফুটিয়ে চট করে বলে উঠলো, 

---" অবশ্যই।" 

কথাটা বলে ফেলেই জিব কাটলো শুভ্রতা। সাদাফের কথাটা একদমই মনে ছিলো না তার। জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো,

---" না মানে...আসলে....!" 

সাদাফ হেসে ফেললো। ঠোঁট টিপে হেসে বললো,

---" চলুন,ম্যাডাম।" 

নিজেকে হাজারখানেক বকা দিয়ে সাদাফের পেছন পেছন ফুসকার স্টলের সামনে দাঁড়ালো শুভ্রতা। সাদাফ এক প্লেট ফুসকার অর্ডার করতেই ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো শুভ্রতা, 

---"এক প্লেট কেন?" 

---"আমি ফুসকা খাই না।" 

---" তাই বলে আমি একা একা খাবো? চলুন, আমিও খাবো না।" 

সাদাফ তাড়াহুড়ো করে বললো,

---" তা কেনো হবে? অর্ডার তো দেওয়া হয়ে গেছে শুভ্রতা। তাছাড়া আমি ঝাল তেমন খেতে পারি না। আপনি খান, সমস্যা নেই।" 

শুভ্রতা স্পষ্ট গলায় বললো,

---" বললাম তো খাবো না। চলুন।" 

সাদাফ শুভ্রতার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

---" আচ্ছা,বেশ। চলুন আমিও খাচ্ছি। " 

শুভ্রতা সামনের দিকে হাঁটা দিয়ে বললো,

---" বললাম তো খাবো না।" 

সাদাফ ফুসকা ওয়ালাকে অযথা এক প্লেটের দাম দিয়ে শুভ্রতার পেছনে ছুটলো। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো,

---" আপনি খুব জেদি শুভ্রতা।" 

শুভ্রতা হেসে বললো,

---" জানি। শেফা আপু বলে আমার বরের কপালে দুঃখ আছে। জেদী বউয়ের বররা বেচারা টাইপের হয়।" 

সাদাফ হুট করেই বলে ফেললো,

---" তবে কি আমাকে বেচারা টাইপ মনে হয়?" 

সাদাফের এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো শুভ্রতা। সাদাফও নিজের অস্বস্তিকর প্রশ্নটা বুঝতে পেরে অন্যদিকে চোখ ঘুরালো। শিট! কি সব বলছে সে। এরপর দু'জনেই চুপ। তাদের এই নিশ্চুপতা কাটিয়ে ফোন বেজে উঠলো তুমুল শব্দে। সাদাফ নিজের ফোনটা চেক করে নিয়ে বললো,

---" আমারটা তো নয়। হয়তো আপনার ফোন বাজছে, শুভ্রতা।" 

শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ফিসফিস করে উঠলো শেফা,

---" এই কই তুই? সাদাফ ভাইয়ের সাথে প্রেম করতে লেগে গেছিস নাকি? তাড়াতাড়ি আয় না, প্লিজ। আমার প্রচুর লজ্জা লজ্জা লাগছে।" 

শুভ্রতা ছোট্ট করে বললো,

---"হু।"


ঘড়ির কাটা ছুটে চলেছে নিঃসংকোচ। রাতের অন্ধকারটাও গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে চলেছে। ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় জমাট বেঁধেছে একঝাঁক জংলী কুয়াশা। সাত তলার ওপর থেকে আলো আর কুয়াশার সেই অদ্ভুত খেলাই দেখছে সাদাফ। চারদিকে বিষাক্ত নীরবতা। সেই নীরবতা কাটিয়ে জমাট অন্ধকারের কালো কাঁথায় গা ঢেকে, থেকে থেকেই অদ্ভুত কর্কশ কন্ঠে গুঙিয়ে উঠছে রাস্তার পাশের ওই ল্যাংড়া কুকুরটা। তার সাথে সাথে গুঙিয়ে উঠছে সাদাফের মন। রাতের এই অন্ধকার আকাশে উদ্দেশ্যহীন বিচরণ করে একটা কথায় ভাবছে সাদাফ, এই যান্ত্রিক শহরে রাতটা কি ভীষণ ভয়াবহ। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে কফির কাপে চুমুক দিলো সাদাফ। ব্যালকনির এক কোণে রাখা ইজি চেয়ারটাই গা এলিয়ে দিয়ে আবারও অন্ধকার আকাশে চোখ রাখলো। আকাশটাকে আকাশ নয় মস্ত এক কালো চাদর বলে বোধ হচ্ছে আজ। আর সেই কালো চাদরে অসাবধানতায় হঠাৎ  ছিটকে পড়া সাদা রঙের মতো থোকা থোকা তারার মেলা। তারাগুলোকেও আজ ঠিক তারা বলে মনে হচ্ছে না সাদাফের। মনে হচ্ছে, ওগুলো তারা নয় শুভ্রতার হাস্যোজ্জল ঝকঝকে দাঁত। হঠাৎ চমকে উঠে আড়চোখে তাকানো মায়াবী চোখের অদ্ভুত শুভ্রতা। ওই চাঁদটাও চাঁদ নয় শুভ্রতার কপালে পড়া টিপ। আর জমাট অন্ধকারগুলোও অন্ধকার নয় শুভ্রতার মেঘবরণ চুল। আজ এই আকাশটাও আকাশ নয়....সমস্তই শুভ্রতার মায়াবী মুখ! কথাগুলো ভেবেই চোখ বুজে সাদাফ। হঠাৎই চমকে উঠে চোখ মেলে তাকায় সে। ছি! কি সব ভাবছে সে? কোনো মেয়েকে এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাবাটা যে অন্যায় বৈ কিছু নয়। ব্রেনের সেই ন্যায়পরায়নতায় ক্ষেপে যায় সাদাফের মন। তুমুল প্রতিবাদ করে বলে, " একদমই অন্যায় নয়। একদমই না। শুভ্রতা তো বাকি মেয়েদের মতো অন্য মেয়ে নয়। সে তো তারই স্ত্রী। ধর্মের গুণে স্ত্রী।" মনের কথাটাকে ঠিক পাত্তা দেয় না সাদাফ। যে সম্পর্কটার কোনো ভিত্তিই নেই সেই সম্পর্কটাকে অযথা টেনে কি লাভ? সাদাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। কফি কাপটাকে টেবিলের উপর রেখে একঝাঁক অলসতা নিয়ে নেতিয়ে পড়লো বিছানায়। আজ সন্ধ্যায় শুভ্রতাকে ডিবোর্সের কথাটা বলতে গিয়েও বার কয়েক আটকে গিয়েছে সে। কেনো জানি গলা ডেঙিয়ে শব্দটাকে জিহ্বা পর্যন্ত আনতেই পারে নি সে। বারবার মনে হয়েছে, যেমন চলছে চলুক না। কি দরকার আগ বাড়িয়ে ঘাটতে যাওয়ার? কিন্তু তা বললে কি চলে? শুভ্রতাকে তো মুক্তি দিতে হবে তার। এই অদ্ভুত সম্পর্কের বেড়াজালে জড়িয়ে থেকে পিষ্ট হয়েই বা কি লাভ? কোনো লাভ নেই। কিচ্ছুটি না। 

___________________

ঘড়িতে একটার ঘন্টা বাজতেই চমকে উঠলো শুভ্রতা। বারকয়েক এপাশ ওপাশ করে কম্বলে মুখ লুকিয়ে চুপ করে পড়ে রইলো খানিক্ষন। তারপর আবারও পাশ ফিরলো। মুখ দিয়ে "চ" এর মতো শব্দ করে বিরক্তি প্রকাশ করেই উঠে বসলো। ডানপাশের দেয়ালে তাকিয়ে ঘড়ি দেখলো ---- ১ঃ১৫। এই মধ্যরাতেও ঘুম নামক জিনিসটা ধরা দিচ্ছে না শুভ্রতার চোখে। বারবার মনে হচ্ছে সাদাফের কথা। তাদের এই সম্পর্কের ভবিষ্যতের কথা। কিভাবে কি হবে এবার?ঠিক কোথায় গিয়ে ঠেকবে তারা?আচ্ছা? সাদাফের কি গার্লফ্রেন্ড আছে? নিশ্চয় আছে। এমন একটা ছেলের গার্লফ্রেন্ড থাকবে না এমনটা ভাবাও একধরনের বোকামো। আচ্ছা?সাদাফের গার্লফ্রেন্ডের নাম কি পৃথা? সেদিন রাতে এই মেয়েটার নামটাই তো বলেছিল সাদাফ। নিজের এমন ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হলো শুভ্রতা। ফু দিয়ে সামনের চুলগুলো উড়িয়ে নিয়ে জোরে জোরে বললো,

---" এতো কেন ভাবছি আমি?উনার গার্লফ্রেন্ড থাকলেই আমার কি? কিচ্ছু না, আমার কিচ্ছু না।" 

কিন্তু মুখের সেই কথা মন পর্যন্ত পৌঁছালো না। সাদাফের হাসিমাখা মুখটাই চোখের সামনে ভেসে উঠলো হঠাৎ। পাশে রাখা বালিশটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বিছানায় ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করলো শুভ্রতা। সবকিছুকে ছাপিয়ে সাদাফের প্রতি এক গভীর টান অনুভব করছে সে। সাদাফের ঘন ভ্র'জোড়ার নিচে  বুদ্ধিদিপ্ত গম্ভীর দুটো চোখ, গভীর চোখে তাকানো, কথার তালে তালে ঠোঁট বেঁকিয়ে  হাসা সবই যেন গভীর থেকে গভীর শিকড়ে আবদ্ধ করছে তাকে। প্রথম যেদিন ট্রেনে দেখা হয়েছিলো সেদিনও সাদাফকে খেয়াল করেছিলো শুভ্রতা। বেশ ভালোভাবেই খেয়াল করেছিলো  কিন্তু এতোটা ভালো তো লাগে নি তখন। সবকিছু খুবই স্বাভাবিক লেগেছিল তার। তাহলে আজ কেন সাদাফের ছোট ছোট বিষয়গুলোতেই মুগ্ধ হচ্ছে শুভ্রতা। সাদাফের খুব স্বাভাবিক অভ্যাসগুলোকেই কেন অস্বাভাবিক সুন্দর লাগছে তার। সাদাফকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ বলে গর্ব হচ্ছে কেন? এ কেমন অদ্ভুত আকর্ষণ তার? 

রাতের অন্ধকার আর হাড় কাঁপানো শীত কাটিয়ে উজ্জল রোদে হেসে উঠেছে ব্যস্ততার শহর ঢাকা। রাস্তাঘাটে ব্যস্ত পায়ে হেঁটে চলেছে কর্মব্যস্ততায় ব্যস্ত মানুষ। রাস্তাগুলো যানবহনের গর্জনে আবারও হয়ে উঠেছে চঞ্চল। এই ব্যস্ততাময় অস্থির সকালে শরীরের আগাগোড়া ঢেকে নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে ঘুমুচ্ছিলো শুভ্রতা। ঠিক তখনই মাথা থেকে কম্বলটা সরিয়ে নিয়ে ডানহাতের বাহু ধরে প্রচন্ড জোরে ঝাঁকি দিলো কেউ। শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে আধো আধো  চোখে তাকালো। ঘোলাটে দৃষ্টিতে রাদিবা আহমেদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বালিশ দিয়ে মুখটা আড়াল করে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো। রাদিবা আহমেদ বালিশটা সর্বশক্তি দিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে বললো,

---"শুভি? এই শুভি? ওঠ বলছি। ওঠ!" 

শুভ্রতা বিরক্তিতে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, 

---"প্লিজ মা। যাও তো। আজকে আপাতত ঘুমোতে দাও আমায়। উফফ...প্রত্যেকটা দিন এমন যন্ত্রণা একদম ভালো লাগে না। শুক্রবারটা তো  ছাড়ো!" 

---" এতো ঘুম কই পাস তুই, হ্যাঁ?তোদের বয়সে সেই ভোর রাতে বিছানা ছাড়তাম আমরা। আর তুই দেখ, দশটা বাজতে চললো তবু ঘুমুচ্ছিস। এমন অলস মেয়েকে দিয়ে কি করবো আমি। কি হলো? উঠছিস না কেন?" 

শুভ্রতা এবার চেঁচিয়ে ওঠে বললো,

---" উফফ মা! যাও তো। প্রত্যেকটা দিন তোমার এইসব আজাইরা বানী শুনতে একদম ভালো লাগে না আমার। দয়া করে একটু ঘুমুতে দাও। আজ ভার্সিটিও নাই তাহলে এতো কেন চেচাচ্ছো বলো তো?"

---" একা একা উঠে গেলেই তো আর চেঁচাতে হয় না। এতোবেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকলে চেঁচাবো না তো আদর করবো? লাট সাহেবের মেয়ে হয়ে গেছিস তুই। বাপের আদরেই এতোটা বিগড়েছে মেয়েটা। এক্ষুনি ওঠবি তুই। এমন ধিঙি মেয়ে নাকি বেলা দশটা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমায়। ছি!  ছি! মানুষ শুনলে কি বলবে শুনি? কি হলো, উঠলি না এখনও?"

বিরক্তিতে কিরমির করে ওঠে বসলো শুভ্রতা। রাগে শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে তার। প্রতিটা সকালে মায়ের মুখের এমন সুধাবাণীতে অতিমাত্রায় বিরক্ত সে। দিন দিন মায়ের এই অত্যাচার চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একমাত্র এই কারণটার জন্য মাঝে মাঝে সন্ন্যাসী  হয়ে দেশান্তর হতে ইচ্ছে করে শুভ্রতার। যে জীবনে শান্তিতে দু'দন্ড ঘুমোনো যায় না সে আবার কেমন জীবন?শুভ্রতার এতোসব ভাবনার মাঝেই কম্বল টেনে ভাঁজ করতে লাগলেন রাদিবা আহমেদ। মেয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললেন,

---" মুখ ফুলিয়ে বসে না থেকে ফ্রেশ হয়ে আয় যা। নাস্তা করে ঝটপট রেডি হয়ে নিবি। এভাবে থম মেরে বসে থাকলে দিবো এক চড়।" 

শুভ্রতা মুখ ফুলিয়ে বললো, 

---" রেডি হবো মানে? রেডি হবো কেন?" 

রাদিবা আহমেদ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

---" আজ যে শেফার বিয়ে, ভুলে গেছিস? কাল রাতেও না কতো শতো গল্প করলি আর সকালে ওঠেই ভুলে গেলি?" 

শুভ্রতা বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো,

---" ওহ্! মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো।" 

রাদিবা আহমেদের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ওয়াশরুমে ঢুকলো শুভ্রতা। রাদিবা আহমেদ কপাল কুঁচকে বিছানা ঝাড়লেন। কম্বল আর বালিশগুলো ঠিক জায়গায় গুছিয়ে রেখে ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। দরজায় দুটো থাপ্পড় দিয়ে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

---"শুভি? এই শুভি?" 

শুভ্রতা ব্রাশ করছিলো। মুখে ব্রাশ নিয়েই অস্পষ্ট উত্তর দিলো,

---"হু।" 

---"আমি রান্না ঘরে যাচ্ছি। তোর বাবা বাজার থেকে ফিরলে একটা ভালো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে এপয়েন্টমেন্ট করে রাখতে বলিস তো। আমি বলতে ভুলে যাবো।" 

সাইকিয়াট্রিস্টের নাম শুনে ভ্রু কুঁচকালো শুভ্রতা। তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে মুখ থেকে ব্রাশটা বের করে বললো,

---" সাইকিয়াট্রিস্ট? সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে কি হবে মা? এনি হাও, তুমি কি মানুষিকভাবে অসুস্থ মা? আমি আগেই বুঝেছিলাম নয়তো রাতভোরে এভাবে চেঁচামেচি করে ঘুম ভাঙে কেউ? নির্ঘাত কোনো গলদ আছে।" 

রাদিবা আহমেদ খোঁপাটা শক্তহাতে বাঁধতে বাঁধতে বললেন,

---"একটা থাপ্পড় বসাবো। ফাজলামো করিস? আমি অসুস্থ হতে যাবো কেন? সাইকিয়াট্রিস্ট তো তোর জন্য খুঁজছি।" 

শুভ্রতা অবাক চোখে তাকালো। সবিস্ময়ে বললো,

---" আমার জন্য? মা? আমাকে কি তোমার পাগল মনে হয়?" 

রাদিবা আহমেদ তাড়াহুড়ো করে বললেন,

---" আরে! তা কেন মনে হবে। কিন্তু আজকাল কিসব হচ্ছে না তোর সাথে? হুটহাট রেগে যাচ্ছিস, কেমন শুকিয়ে শুকিয়ে যাচ্ছিস, সবকিছু কেমন ভুলে ভুলেও যাচ্ছিস। না জানি মাথায় কিসব গোন্ডগোল পাকিয়েছিস। দু'দিন বাদে না পাগলই হয়ে যাস। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ভালো জানিস না? তাই তুই পাগল হওয়ার আগেই পাগলামো প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা করছি।" 

শুভ্রতা কপাল কুঁচকে বললো,

---" ইউ আর জাস্ট ইম্পসিবল,মা।" 

খাবার টেবিলে বসে রুটি চিবুচ্ছে শুভ্রতা। এমন সময় মাথায় চাটি মেরে ধপ করে পাশের চেয়ারে বসে পড়লো শুভ্রব। শুভ্রতা চেঁচিয়ে ওঠে বললো,

---" মা? দেখো ভাইয়া মারছে।" 

---" মা দেখো ভাইয়া মারছে।" 

ঠোঁট উল্টিয়ে শুভ্রতাকে ভেঙালো শুভ্রব। শুভ্রবের পিঠে ধপ করে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে আবারও চেঁচিয়ে উঠলো শুভ্রতা,

---" মা? ও মা? দেখেছো? তোমার ছেলে কিভাবে  ধুমধাম করে মারছে আমায়। তুমি কিছু বলবা,  ওকে? জীবনেও তো আমার সাইড নাও না তুমি। 
ছেলেই তো তোমার সব।" 

শুভ্রব শুভ্রতার কান টেনে ধরে বললো,

---" হারামি মাইয়া। এতো কূটনীতি কই থেকে শিখিস তুই?" 

---" মা....." 

দুই-ভাই বোনের চেঁচামেচিতে চামচ হাতেই বেরিয়ে এলেন রাদিবা আহমেদ। চামচ উঁচিয়ে বললেন, 

---" আরেকটা শব্দ হলে দুটোর পিঠেই বসাবো বলে দিলাম। শুভ্রব? এতো বড় বোনের গায়ে হাত তোলাটা কোন ধরনের অসভ্যতা? দিন দিন বেলেহাজ হয়ে পড়ছো তুমি। খবরদার, এমনটা যেন আর না দেখি।" 

কথা শেষ করে দু'জনের দিকে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রান্না ঘরে ঢুকে গেলেন রাদিবা আহমেদ। সাথে সাথেই দুষ্টু হাসি দিয়ে মুখ ভেঙালো শুভ্রতা। শুভ্রব রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,

---"শেফার বিয়েটা হতে দে খালি তারপরই তোর পালা। ডিরেক্ট শশুর বাড়ি ফেলে আসবো তোকে। মোষ্ট দজ্জাল শাশুড়ী দেখে বিয়ে দেবো তোকে। যে তোকে সকাল - বিকেল পেটাবে। আহা! কি শান্তি!" 

শুভ্রতা আরেক টুকরো রুটি মুখে পুড়ে নিয়ে বললো, 

---"এহহ্ বললেই হলো? আমারটা না ভেবে নিজেরটা ভাব। তোর বউটা পুরো পেত্নী হবে দেখিস। দিন রাত জ্বালাতে জ্বালাতে কয়লা করে ফেলবে তোকে।" 

শুভ্রব আরো কিছু বলবে তার আগেই থালা হাতে ডাইনিং এ এলেন রাদিবা আহমেদ। মাকে আসতে দেখেই দু'জনে ভদ্র ছেলে মেয়ের মতো খাওয়ায় মন দিলো। রাদিবা আহমেদ শুভ্রবের প্লেটে রুটি তুলে দিতে দিতে বললো,

---" ছেলে পক্ষ থেকে ক'জন আসবে রে শুভ্রব?কিছু কি বলেছে ওরা?" 

রুটির টুকরো ঝুলে ডুবাতে ডুবাতে বলে উঠলো শুভ্রব,

---" বড় খালু তো বললো দশজনের মতো আসবে। ছেলের দুই মামা, দুই বোন, দুই বোন জামাই,ছেলের বড় চাচা, মা, ছেলের একটা বন্ধু আর ছেলে নিজে। এই কয়েকজনই।"

রাদিবা আহমেদ চিন্তিত গলায় বললো,

---" দশজন কমই তো, তাই না রে? তবুও এই দশজনের খাবার রাঁধতেই জান বেরিয়ে যাবে বড় আপার তাছাড়া আমরা, মেজো আপারা আর বড় আপার বাড়ির লোকেরা তো আছেই। সব মিলিয়ে প্রায় ত্রিশ জনের মতো হয়ে যাবে। তাই না? 

শুভ্রব মাথা নাড়লো। কিন্তু গলায় খাবার আটকে গেলো শুভ্রতার। "ছেলের বন্ধু" --- ছেলের বন্ধু তো সাদাফ। তবে কি আজ আবারও দেখা হতে চলেছে তাদের?ভাবতেই শরীরব্যাপী শীতল শিহরণ বয়ে গেলো শুভ্রতার। বুকের ওঠানামা বেড়ে গেলো বহু গুন। শরীর-মন নিদারুণ অস্থিরতায় অস্থির হয়ে উঠলো। নিজের এই অতিরিক্ত আবেগ সাদাফের সামনে  প্রকাশ পেয়ে যায় সেই ভয়ে নিজেকে খানিকক্ষণ বকলোও সে। কিন্তু, মন কি আর বারণ শুনে? নিজের স্বেচ্ছায় উড়ে বেড়ানোটাই যে তার ব্রত। বারবার বেহায়া হয়ে লজ্জায় রক্তিম হওয়াটাই যে তার জেদ! 

___________________

বিকেল পাঁচটা। শেফাদের ড্রয়িং রুমে সবার সাথেই বসে আছে সাদাফ। মুখ দেখে বোঝা না গেলেও আরাফের প্রতি চরম রকম বিরক্ত সে। এখানে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও ছিলো না তার। তবুও প্রতিবারের মতো আরাফ আর আরাফের মামার জোড়াজুড়িতে আসতে বাধ্য হয়েছে সে। দিনটা শুক্রবার বলে কাজের বাহানা দিয়ে পাড় পাওয়াটাও হয়ে ওঠে নি সাদাফের। আরাফের এমন লিমিটলেস বাড়াবাড়িটা কখনোই সহ্য হয় না তার। সাদাফ যখন তার বিরক্তির প্রহর গুণতে ব্যস্ত ঠিক তখনই পর্দার আড়াল থেকে তাকেই লক্ষ্য করতে ব্যস্ত দুটো চোখ। সাদাফের ফর্সা গায়ে হালকা গোলাপী পাঞ্জাবি, ক্রিম কালারের জিন্স, কপালের ওপর পড়ে থাকা মসৃন চুল, গম্ভীর চোখের এদিক-ওদিক চাহনী সবই যে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে কেউ তা হয়তো সাদাফের দৃষ্টির মধ্যেই পড়ে নি। সাদাফের কালচে লাল ঠোঁটের প্রসারিত হাসির রেখায় যে কেঁপে উঠছে কারো বুক সে কম্পনটাও হয়তো ঠাহর করতে পারে নি সাদাফ। বেখেয়ালি মনে পাঞ্জাবীর হাতা গুটানোর মতো সাধারণ দৃশ্যটাও যে কারো কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর দৃশ্য বলে বোধ হচ্ছে, তার বেখেয়ালীপনায় করা ছোট্ট কাজটাকেও যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরে অন্তর্ভুক্ত করে চেঁচিয়ে মরছে কারো মন সে খবরটাও তার পর্যন্ত পৌঁছায় নি। সবই রয়ে গেছে ওই পর্দাটুকুর আড়ালে। খুব গোপনে, এক টুকরো লাজুক হাসির অন্তরালে। ইশ! এতেই না কতো সুখ! বুকের কতো ধুকপুক! কতোই না অস্থিরতা মাখা ভয়! 


শেফার কাবিন উপলক্ষে বাড়িতে হুলস্থুল কান্ড। এককালে শেফারা রক্ষণশীল পরিবার বলেই খ্যাত ছিলো। কালের প্রবাহে সেই খ্যাতিটা খানিক মিইয়ে গেলেও সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যায় নি। তারই রেশ ধরে এ যুগে এসেও বাড়ির ছোট খাটো ব্যাপারেও উপচে পড়ে আত্মীয়দের ভীর। শেফার বড় চাচা,ছোট চাচা, বড় ফুপু, খালা, মামা এমনকি তাঁদের শশুড় বাড়ির লোকেরাও বাদ পড়ে না এতে। এবারও তাই হলো। বরপক্ষ থেকে মাত্র দশজন এলেও কনেপক্ষের নিকটাত্মীয় মিলেই হয়ে গেলো প্রায় পঞ্চাশ জন। উত্তরার অত্যাধুনিক ফ্ল্যাটে পঞ্চাশজন মানুষের বসবার, খাওয়ার যোগান দেওয়াটা অসম্ভব না হলেও বেশ কঠিনই বটে। ড্রয়িংরুমসহ বাসার চার চারটা বেডরুমেই ছেলে, বু্ড়ো,বাচ্চা আর মহিলাদের নিয়ে গিজগিজে ভীর। বাচ্চাদের চিল্লাচিল্লি, মুরব্বিদের গল্প, মহিলাদের ফিসফিস সব মিলিয়ে বাসায় যেন এক দমবন্ধকর অবস্থার সৃষ্টি। এই দমবন্ধকর পরিবেশের এক কোণে সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে সাদাফ। চারপাশের চিল্লাচিল্লি আর অতিরঞ্জিত বাড়াবাড়িতে অসম্ভব রকম বিরক্ত সে। সামান্য একটা কাবিনের জন্য এতো আলোড়নের কি প্রয়োজন বুঝতে পারছে না সাদাফ। দেড় ঘন্টা যাবৎ এই অস্থির পরিবেশে মিথ্যা হাসি নিয়ে ঠাঁই বসে থাকাটাও সাদাফের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ। মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ! "অতিরঞ্জিত" শব্দটা সাদাফের স্বভাব বিরোধী। অতিরিক্ত উশৃংখলতা, অতিরিক্ত চেঁচামেচি কিছুই পছন্দ নয় তার। তার পছন্দ পাহাড়,মেঘে ঢাকা গোমট আকাশ। ছোট বেলা থেকেই পাহাড়ের প্রতি অদ্ভুত টান তার। বাবা বন বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকতা হওয়ায় পাহাড়ের সাথে সম্পর্ক গড়ার সুযোগটাও হয়েছে বেশ। চারদিকে নিস্তব্ধ গাছপালা, পাহাড়ি মাটির গন্ধ, বেপরোয়া ঝর্ণা তারসাথে মেঘলা আকাশ। আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে দাঁড়ালো সাদাফ। আরাফকে ইশারায় আশেপাশেই আছে বুঝিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদের দরজার কাছাকাছি আসতেই কানে এলো নারীকন্ঠের সূক্ষ্ম আওয়াজ। সাদাফ থমকে দাঁড়ালো। কপাল কুঁচকে কিছু একটা ভেবে দরজা পেরিয়ে ছাঁদে পা রাখলো। ছাঁদের দক্ষিণ দিকের রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। পাঞ্জাবির উপরের দুটো বোতাম খুলে হাতদুটো ভাঁজ করে তারায় পূর্ণ ঝকঝকে আকাশের দিকে তাকালো সে। ভেতরের গোমট ভাবটা বাইরের ঠান্ডার ছোঁয়ায় খানিকটা কেটে যেতেই সিগারেট ধরালো সাদাফ। সিগারেটে কয়েক টান দিতেই কানে এলো কারো খিলখিল হাসির শব্দ। আবারও ভ্রু কুঁচকে এলো সাদাফের। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে চোখ ফিরিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। কাউকে দেখতে না পেলেও পরিচিত নারী কন্ঠ কানে ভেসে এলো তার। আধ জ্বলা সিগারেটটা পা দিয়ে পিষে ফেলে ডানদিকে মাথা হেলিয়ে ছাঁদের ওপাশে চোখ রাখতেই ফোনে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলো শুভ্রতা। 

----" টেইক ইট ইজি জানু। এতো মন খারাপ করতে হবে না সোনা। আরে, আমি....." 

এটুকু বলতেই সামনে কোনো পুরুষের অবয়ব দেখে থমকে গেলো শুভ্রতা। আধো অন্ধকারে, কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই সামনে দাঁড়ানো লোকটি যে সাদাফ তা আবিষ্কার করলো শুভ্রতা। অপ্রত্যাশিতভাবে সাদাফের মুখোমুখি হওয়ায় খানিকটা অপ্রস্তুত হলো সে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে "পরে কথা বলছি" বলে ফোনটা কেটে মুচকি হাসলো সে। সাদাফও সূক্ষ্ম ঠোঁট মেললো। তারার মিটমিট আলোতে সেই সূক্ষ্ম হাসি ঠিক চোখে পড়লো না শুভ্রতার। ডান কাঁধের ওড়নাটা আরো খানিকটা টেনে দিয়ে অস্বস্তিভরা পায়ে  দু- একপা এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো শুভ্রতা,

---" আপনি এখানে?"

সাদাফ হাসিমুখে জবাব দিলো,

---" এমনি। অনেকক্ষণ যাবৎ বসে আছি তাই ভাবলাম একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি। কিন্তু আপনি এখানে? রাতের বেলা একা ছাঁদে?"

শুভ্রতা হাসার চেষ্টা করে বললো,

---" একটা ফোনকল এটেন্ট করতে এসেছিলাম। নিচে যা অবস্থা তাতে তো..."

এটুকু বলতেই আবারও ফোন বেজে উঠলো শুভ্রতার। ফোন ধরে রাখা হাতটা রেলিঙের উপর থাকায় সাদাফের বেখেয়ালি চোখটা আটকে গেলো স্ক্রিনে। স্ক্রিনে "অর্পন" নামটা দেখেই চোখ ফেরালো সে। শুভ্রতা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ফোনটা রিসিভ করে নিচু গলায় বললো,

---" বললাম তো পরে ফোন দিবো। পরে মানে পরে, ওকে?"

শুভ্রতার মৃদুস্বর কানে আসতেই চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সাদাফ। একটু আগে তাহলে ওসব বলে সম্বোধন করা মানুষটি অর্পনই ছিলো? অর্পন কি শুভ্রতার স্পেশাল কেউ? এতটুকু ভাবতেই মাথা ঝাড়লো সাদাফ। শুভ্রতার পার্সোনাল লাইফে কে আছে বা কে নেই সেটা তার দেখার বিষয় নয়। কখনোই নয়। ফোন কেটে অপ্রতিভ হেসে বলে উঠলো শুভ্রতা,

---" সরি! আ..তো, নিচে যাবেন এখন?"

সাদাফ মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে বললো,

---" উহুম! নিস্তব্ধতা ভালো লাগছে।" 

শুভ্রতা হালকা হাসলো। একরাশ অস্বস্তি নিয়ে সাদাফ থেকে খানিকটা দূরত্বে এক হাতে ভর দিয়ে রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। আকাশে চোখ রেখে হুট করেই প্রশ্ন করলো,

---" আপনি কি সবসময়ই কম কথা বলেন?" 

সাদাফ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মৃদু হেসে বললো,

---" না তো। কম কথা বলি না তবে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই বলি।" 

শুভ্রতা আড়চোখে তাকালো। ছেলেমানুষি গলায় বললো,

---" আপনার প্রয়োজনটাই হয়তো খুব সীমিত। মাঝে মাঝে মন হয় গুণে গুণে কথা বলছেন। একটা শব্দ বেশি বলে ফেললোও বিরাট লস।" 

সাদাফ হাসলো। সাদাফের হাসির মৃদু ঝংকারটা শুভ্রতার কানে যেতেই সচেতন চোখে তাকালো সে। আধো অন্ধকারে সাদাফের হাসি মুখটা দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে কপাল কুঁচকালো শুভ্রতা। সাদাফ ঠোঁটে হাসি মেখে বললো,

---" মানুষভেদে প্রয়োজনের আকার পরিবর্তন হয় শুভ্রতা। তাছাড়া, মানুষভেদে প্রয়োজনের সীমাবদ্ধতাও থাকা প্রয়োজন। সীমার বাইরে চলে যাওয়াটা আসলেই কিন্তু বিরাট লস।"

শুভ্রতা ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। মাথা দুলিয়ে বললো,

---" গুরুগম্ভীর কথাবার্তা! আপনারা বড়রা সবসময় এমন সাধুভাষা টাইপ কথা কেন বলেন, বলুন তো? এসব কথাবার্তার অর্ধেক অর্থ আমার মাথার উপর দিয়েই যায়।" 

সাদাফ আমোদিত গলায় বললো,

---" আমরা বড়রা? তারমানে আপনি বড়দের মাঝে পড়ছেন না? আপনি ভীষণ ছোট বুঝি?"

শুভ্রতা বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো,

---" অবশ্যই ছোট। ভীষণ ছোট না হলেও সীমিত আকারের ছোট।" 

শুভ্রতার মুখে এমন কথা শুনে হেসে ফেললো সাদাফ। সাদাফের হাসিতে খানিক বিব্রতবোধ করলো শুভ্রতা। বোকা বোকা গলায় বললো,

---" এতে হাসির কি হলো? আমি বুঝাতে চাইছিলাম যে, আমি মোটামুটি ধরনের ছোট।" 

সাদাফ হাসি চেপে মজার ছলে বললো,

---" ও আচ্ছা, বুঝলাম। তো, কোন ক্লাসে পড়েন? না মানে, মোটামুটি ছোটরা তো সাধারণত ইন্টার ফাস্ট ইয়ার বা সেকেন্ট ইয়ারে পড়ে। আপনি কোন ইয়ার?"

---" সেকেন্ড ইয়ার।" 

শুভ্রতার উত্তরে কেশে উঠলো সাদাফ। অবাক চোখে তাকালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের বিস্ময়টা চেপে নিয়ে বিরবির করে বলে উঠলো ,

---" সত্যিই? আপনাকে এতোটা ছোটও ভাবি নি আমি। মনে হচ্ছে বাল্যবিবাহ করে ফেলেছি।" 

সাদাফের কথাগুলো বুঝতে না পেরে কপাল কুঁচকে বলে উঠলো শুভ্রতা,

---" জি?" 

---" কিছু না। বলছিলাম, এবার সেকেন্ড ইয়ার হলে তো নেক্সট ইয়ার এক্সাম তাই না? পড়াশোনা কেমন চলছে? এইচএসসি এক্সামটা কিন্তু ক্যারিয়ারের ফার্স্ট পিলার। অল দ্যা বেস্ট।" 

শুভ্রতা মুখ গোমরা করে বললো,

---" আমি বিবিএ সেকেন্ড ইয়ার।"

সাদাফ এবার অদ্ভুত চোখে তাকালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদু হেসে বললো,

---" নাও পার্ফেক্ট।" 

---" মানে?" 

সাদাফ উত্তর না দিয়ে বললো,

---"অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। চলুন নিচে যাওয়া যাক। সবাই খুঁজছে হয়তো।" 

কথা শেষ করে  দরজার দিকে এগিয়ে গেলো সাদাফ। দরজার কাছাকাছি গিয়ে একপাশে চেপে দাঁড়িয়ে শুভ্রতাকে যাওয়ার রাস্তা করে দিলো সে। শুভ্রতা সামনে সামনে হাঁটছে আর তার পেছনে হাঁটছে সাদাফ। সিঁড়ির লাইটগুলো হাতের ডানপাশে হওয়ায় দু'জনের ছায়াটা গিয়ে পড়ছে বামপাশের দেয়ালে। ছায়াতে দু'জনকে খুব কাছাকাছি দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে,দুটো মানুষ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে ওই কালো প্রতিচ্ছবিটির আড়ালে। শুভ্রতা গভীর মনোযোগে ছায়াগুলো খেয়াল করছে। উঁচুনিচু সিঁড়ি পাড়ি দেওয়ার সময় মনে হচ্ছিলো দুটো ভালোবাসাময় আত্মা নেচে বেড়াচ্ছে ওই দেয়ালে। কথাগুলো ভেবে নিজে নিজেই চমকে উঠছিলো শুভ্রতা। মনের ভেতর চলা কথাগুলো সাদাফের কান পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে পড়ছিলো বারবার। মনকে একবার বকছিলো তো আবারও একই ভাবনায় মত্ত হচ্ছিলো। হঠাৎ করেই কারো ডাকে ঘোড় কাটলো শুভ্রতার,

---" শুভ্রতা? ঠিক আছেন? এভাবে দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন? শুভ্রতা?"

শুভ্রতা হকচকিয়ে তাকালো। এসব ছাইপাঁশ ভাবতে গিয়ে কখন যে সিঁড়ির মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে পড়েছে খেয়ালই ছিলো না তার। ইশ! সাদাফ কি ভাবছে কে জানে? কথাগুলো ভেবে সাদাফের দিকে না তাকিয়েই এক দৌঁড়ে বাকি সিঁড়িগুলো পাড় করে ভেতরে ঢুকে গেলো শুভ্রতা। শুভ্রতার এমন অদ্ভুত আচরণে বেশ অবাক হলো সাদাফ। কিছুক্ষণ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থেকে স্বাভাবিকভাবেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সে। নিজের মনে  সিঁড়ির বাকি  ধাপগুলো পাড়ি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। ততক্ষণে কাবিনের শেষ কাজগুলোও সমাধা হয়ে গেছে প্রায়। সাদাফ ধীর পায়ে আরাফের পাশে সোফায় গিয়ে বসতেই মুখ ফুলিয়ে গো গো করে বলে উঠলো আরাফ,

---" কই গেছিলি তুই? ফ্রেন্ড হিসেবে আমার পাশে থাকাটা তোর বন্ধুগত কর্তব্য অথচ প্রয়োজনের সময়ই তুই নাই। তোর কোনো ধারনা আছে কতোটা নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম আমি? জীবনের প্রথম বিয়ে আমার অথচ তুই পাশে নাই...." 

আরাফকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো সাদাফ,

---" চিন্তা করিস না। তোর জীবনের প্রথম বাসর রাতে অবশ্যই তোর পাশে থাকবো আমি। বন্ধুগত কর্তব্যটা সেদিন পালন করবোই করবো। সেদিন তো তুই আরো বেশি নার্ভাস থাকবি। তাই না দোস্ত?" 

আরাফ অসহায় চোখে তাকালো। সাদাফের এই অভ্যাসটা মোটেও ভালো লাগে না তার। আরাফ কিছু বললেই কথার মারপেঁচে তাকে থামিয়ে দেওয়াটা যেন সাদাফের চাই-ই চাই। সবসময় এমন করাটা কি সাজে সাদাফের? একটা দিনও কি চুপচাপ আরাফের কথাগুলো গিলে নিতে পারে না সে? আরাফ গম্ভীর মুখে বসে রইলো। যদিও জানে তাতে সাদাফের কোনো ভাবাবেগ হবে না তবুও গম্ভীর মুখে বসে রইলো সে। সাদাফ পাত্তা না দিলেও এই সময়ে মন খারাপ করাটা তার নৈতিক দায়িত্ব! 


"বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে, 
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ --
আমার বাড়ি আসে সই গো,
বসন্ত বাতাসে।" 

বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা নেওয়ার সময়ই পাশের  দোকান থেকে গানটির মৃদু সুর ভেসে এলো সাদাফের কানে। আজ পহেলা ফাল্গুন। চারদিকে রৌদ্রজ্জ্বল সকালের আলতো স্পর্শ। সেই স্পর্শে মাখামাখি হয়ে গায়ে বাসন্তী রঙের শাড়ি জড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোরীরা। মাথার খোঁপাটা গাঁদা-পলাশে আগাগোড়া মোড়া। কেউবা আবার ভালোবাসার মানুষটির হাতে হাত রেখে প্রেম নিবেদনে ব্যস্ত। শহরজুরে বসন্ত উৎযাপনের এতো হৈচৈ এর মাঝেও সাদাফ নিশ্চুপ।আত্মভুলা সাদাফের এই বিশেষ দিনটির কথা মাথাতেই ছিলো না। রিকশায় ওঠে রাস্তার মোড়ে মোড়ে রমনীদের বাসন্তী,লাল,হলুদ রঙের শাড়ি আর ফুলে ফুলে সেজে থাকতে দেখেই পহেলা ফাল্গুনের কথা মনে পড়লো সাদাফের। চারপাশে সচেতন চোখে তাকালো। বনানীর এই বিশাল রাস্তার কোনো কোনেই ফোটা ফুল চোখে পড়লো না তার। গাছে ফোটা ফুল! সাদাফ নিজের মনে হাসলো।ছেলে-মেয়েদের এতো সাজুগুজু আনন্দ দেখে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো সেও স্বীকার করতে বাধ্য হলো ---- ‘ফুল ফুটুক, আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত’। অসিফে পৌঁছে নিজের ডেস্কে বসে কাজে হাত দিতেই কোথা থেকে ছুটে এলেন আবির সাহেব। সাদাফ একবার চোখ তুলে তাকালো। আবির সাহেবকে ভেতরে আসার অনুমতি দিয়ে আবারও হিসেবের খাতায় মন দিলো সে। আবির সাহেব হন্তদন্ত করে ভেতরে ঢুকেই বলে উঠলেন, 

---" সাদাফ সাহেব? আজকে পহেলা ফাল্গুন মনে আছে তো?" 

সাদাফ ফাইল থেকে চোখ উঠিয়ে মাথা নেড়ে বললো,

---" হ্যাঁ। মনে আছে।" 

আবির সাহেব খুশিতে গদগদ হয়ে চেয়ার টেনে বসলেন। অনেকটা ফিসফিস করে বললেন,

---" বসন্ত মানেই পূর্ণতার দিন। ভালোবাসার দিন। এই দিনটা উদযাপন না করলে চলে বলুন? ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে এবার বিরাট উদযাপন হবে বুঝলেন? যাবেন নাকি একবার? চলুন না যাই।" 

আবির সাহেবের শেষ বাক্যটা অনেকটা অনুরোধের মতো শোনালো। সাদাফ মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে কচুপাতা রঙের শার্টের কব্জির কাছের বোতামগুলো খুলে হাতা গোটাতে গোটাতে বললো,

---" আপনি যান আবির সাহেব। ওসব ভীর ঠেলে অনুষ্ঠান দেখার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তাছাড়া,প্রচুর কাজও জমে আছে হাতে।" 

আবির সাহেব টেবিলের উপর খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন,

---" একদিন একটু কম কাজ করলে কিই বা হবে সাদাফ সাহেব? এমনিতেও এমডি স্যারের ভালো নজরেই আছেন আপনি। এ বছর আবারও প্রমোশন হবে আপনার। বছরে দু-একদিন তো ছুটি কাটানো উচিত বলুন।" 

সাদাফ হেসে বললো,

---"বছরে দু'-একদিন নয় প্রায় দু সপ্তাহের মতো ছুটি কাটাই আমি। বর্ষাকালে হুটহাট পাহাড়ে ঘুরতে চলে যাওয়াটা তো ছুটির মধ্যে পড়ে। তাই কাজগুলো আগে থেকে গুছিয়ে রাখাটা ভালো। আপনি বরং যান...আমি আমার কাজগুলো শেষ করবো ভাবছি।" 

আবির সাহেব মুখ গোমরা করে বললো,

---" প্লিজ সাদাফ ভাই। চলেন না। আপনার ভাবিকে কথা দিয়েছি যে আজ বিকেলে ওকে নিয়ে রবীন্দ্র সরোবরে যাবো। পরশোই তিনদিন ছুটি কাটিয়েছি আজ আবারও হাফ ডে ছুটি চাইলে বস রেগে ফায়ার হবেন নির্ঘাত। আপনাকে তো কিছুই বলে না। আপনি গেলে আপনার দোহাই দিয়ে আমিও একটু ছুটি পাই আরকি। প্লিজ ভাই। নতুন বিয়ে করছি সমস্যাটা বুঝুন একটু।" 

সাদাফ স্থির দৃষ্টিতে তাকালো। কলিগদের এমন উদ্ভট ঝামেলায় বরাবরই বিরক্ত হয় সে। রবীন্দ্র সরোবর জায়গাটা তার কাছে খুব একটা খারাপ লাগে না। আশেপাশে গাছপালা আছে প্রচুর। কিন্তু আজকের দিনে সেই শান্তিটা কিছুতেই পাবে না সাদাফ। তাই কাজ ছেড়ে সেখানে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও তার নেই। তবুও রাজি হলো। আবির সাহেবের অনুরোধের ফোয়ারায় রাজি হতে বাধ্য হলো। 

__________________

সকাল থেকেই বন্ধু বান্ধবদের ফোন কলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে শুভ্রতা। সেই ভোর ছয়টা থেকে চলে আসছে তাদের হাজারও পরিকল্পনা। ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরের বসন্ত উদযাপনে পাঁচ বান্ধবী মিলে দলীয় গান পরিবেশন করবে তারা। তা নিয়েই পাঁচ জনের আকাশ ছোঁয়া উত্তেজনা। যদিও শুভ্রব সেই সকাল থেকেই ভেঙিয়ে চলেছে --- "তোদের সব কটার হলো কাকের মতো গলা। কোকিলের অনুষ্ঠানে তোদের মতো কাকদের মানায় না। দয়া করে কোমলমতি শিশুদের রেহাই দে।" শুভ্রতা বেশ কয়েকবার "মা! মা! " বলে চেচিয়ে উঠলেও এখন তেমন একটা মাথা ঘামাচ্ছে না। এর আগে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে লাস্ট স্টেজ পার্ফমেন্স করেছিলো সে। তারপর আর ইচ্ছে বা সুযোগ কোনোটাই হয়ে উঠে নি। আজ আবারও তিন-চারবছর পর!  ভাবতেই উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে আসছে শুভ্রতার। শুভ্রতা সারা বিছানায় হলুদ,বাসন্তী, লাল শাড়ি আর গহনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পর্যবেক্ষন করে চলেছে। এক হাত কোমরে রেখে রুমের এককোণা থেকে অন্যকোণায় পায়চারী করছে। দুই তিনবার রুমময় পায়চারী করার পর ফোনের ভাইব্রেশনে দাঁড়িয়ে পড়লো শুভ্রতা। একগাদা শাড়ি সরিয়ে ফোন খুঁজে বের করে অস্থির পায়ে আবারও হাঁটতে লাগলো সে। ওপাশ থেকে অলস গলায় বলে উঠলো শেফা,

---" ফোন দিয়েছিলি শুভি? সরি রে, ঘুমিয়েছিলাম।" 

---" ফোনে কথা বলতে বলতে রাত ভোর করে ঘুমালে দশটা পর্যন্ত পড়ে পড়ে না ঘুমিয়ে আর কি করবে আপু? জামাই পাইয়া এখন এই ইনোসেন্ট বোনটাকে ভুলে গেছো তুমি আপু?" 

শেফা ভ্রু কুঁচকে বললো,

---" ধুর! কি সব বলছিস। জামাই জামাইয়ের জায়গায় আর তুই তোর জায়গায়। এনিওয়ে, কেন ফোন দিয়েছিলি সেটা বল।" 

শুভ্রতা এবার শান্ত হয়ে বসলো। চিন্তিত গলায় বললো,

---" বাসন্তী রঙের ব্লাউজ আছে তোমার আপু? সবাই মিলে প্ল্যান করেছি বাসন্তি পাড় লাল শাড়ি পড়বো। অথচ, এন্ড মোমেন্টে এসে দেখি বাসন্তী রঙের ব্লাউজ গায়েব। কি ভয়ানক অবস্থা ভাবতে পারছো? তার ওপর তিনটাই অনুষ্ঠান। তোমার আছে নাকি আপু?" 

শেফা খানিক ভেবে বললো,

---" তা তো আছে। কিন্তু আমারটা কি তোর হবে? তুই যা হ্যাংলা পাতলা মানুষ!" 

শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে বললো,

---" সমস্যা নেই৷ আমি ঠিক করে নিবো।" 

---" তোর সমস্যা না হলে আমারও সমস্যা নেই। এসে নিয়ে যা।" 

---" আমি এতোদূর যেতে পারবো না। তুমি তো অনুষ্ঠান দেখতে আসবেই। রবীন্দ্র সরোবর থেকে আমাদের বাসা তো বেশি দূরে নয়। তুমিই একটু দিয়ে যাও না, প্লিজ! প্লিজ!" 

শেফা অবাক হয়ে বললো,

---" আরে! উত্তরার মুক্তমঞ্চেও তো অনুষ্ঠান হবে। এখানে রেখে অতোদূরে ধানমন্ডি কেন যাবো বল তো?" 

শুভ্রতা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে খানিক ভাবলো। মুহূর্তেই দুষ্টু হাসি খেলে গেলো তার ঠোঁটে। বিছানায় আরাম করে বসে বললো,

---" আপুউউ?? প্রেম করার জন্য ধানমন্ডি লেকের মতো দারুন জায়গা কি আর আছে? কাবিন হয়েছে মাত্র তুলে নিয়ে যেতে প্রায় সাত/আট মাস। চুটিয়ে প্রেম করার মতো এতো বড় সুযোগ হাতছাড়া করবা তুমি? আমি তোমার ছোট হলেও ছোট বোনের কথাটা একটু ভেবে দেখো। এই বিষয়ে তোমার থেকে আমিই বেশি অভিজ্ঞ আপু। আমার সব কটা ফ্রেন্ড প্রেম করে। ভাবো...ভাবতে ভাবতে এতো সুন্দর একটা আইডি দেওয়ার জন্য ব্লাউজটাও আমার পর্যন্ত পৌঁছে দাও, কেমন? এডভান্স থেংকিউ। বাই।" 

নিজের কথা শেষ করেই ফোন কাটলো শুভ্রতা। শেফা যে আসবে তা বেশ ভালো করেই জানে শুভ্রতা। শেফা খানিকটা বোকা টাইপের মেয়ে। একটা কিছু ওর মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া গেলে তা সহজে বের হয় না মাথা থেকে। শুভ্রতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ালো। দূরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা প্রেমীযুগলদের দেখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটে। ছেলেদের গায়ে পড়া বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি দেখে হঠাৎই সাদাফের কথা মনে পড়লো তার। মনের এক কোণে সাদাফকে দেখার সূক্ষ্ম ইচ্ছে মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো। আচ্ছা? বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবিতে কেমন লাগবে সাদাফকে? এই রঙের পাঞ্জাবির সাথে ঘন চুলগুলো কিভাবে গোছাবেন উনি?সবসময়ের মতোই? নাকি একটু অন্যরকমভাবে? এসব ভাবনায় সাদাফকে দেখার ইচ্ছেটা তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হওয়ার আগেই বান্ধুবীর ফোনের তেজে ছুটে গেলো সেই ভাবনা। মনের এককোণে হারিয়ে গেলো সেই নাম। অজানা অনুভূতি নামক মারাত্মক টানগুলো গুটিগুটি পায়ে জোরো হতে লাগলো অজানা ভালো লাগায়।  

________________

বিকেল তিনটা। ধানমন্ডি লেকের ধারের রবীন্দ্র সরোবরটি সেজে উঠেছে এক নতুন সাজে। বিভিন্ন বয়সী মানুষের আনন্দের জোয়ার যেন লেগে আছে প্রতিটি সবুজ ঘাসে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাদাফও সামিল হয়েছে তাতে। একা আসে নি এসেছে ভার্সিটি লাইফের প্রিয়মুখ বন্ধুদের সাথে। প্রতিবারই "না না " করতে করতে এবার যে রাজি হয়েছে সাদাফ তাতেই যেন খুশির বাঁধ মানছে না তাদের। সাদাফের বন্ধুদের মধ্যে একজন রবীন্দ্র সরোবর বসন্ত উৎযাপন কমিটির সদস্য হওয়ায় অনুষ্ঠানে যুগ দেওয়ার উৎসাহটা আরো বহুগুণ বেড়ে গেছে তাদের। আবারও অনেকদিন পর, ভার্সিটির সেই প্রাণোচ্ছ্বল যুবকের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে তারা। রাকিবের পকেট পুরে আছে লাল আবিরের প্যাকেট। দুষ্টুমি করার হাজারো পদ্ধতি এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের মাথায়। অথচ তাদের মধ্যে অধিকাংশই আজ বিবাহিত।



Writer:- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner