> আরশিযুগল প্রেম পর্ব ১, ৫ - ভালোবাসার গল্প - নৌশিন আহমেদ রোদেলা - গল্প - ভালবাসা - লাভ স্টোরি
-->

আরশিযুগল প্রেম পর্ব ১, ৫ - ভালোবাসার গল্প - নৌশিন আহমেদ রোদেলা - গল্প - ভালবাসা - লাভ স্টোরি

বর্ষার মাঝামাঝি সময়। দিন-রাত আঁধার করে আনা বৃষ্টি। রেলস্টেশনের সামনের কিছুটা জায়গাও কর্দমাক্ত। শুভ্রতা একহাতে স্কার্ট সামলে অন্যহাতে ভারি স্যুটকেস নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মনটা ধুকপুক করছে তার। মনে হচ্ছে,  এই বুঝি লাগেজ হাতে পা পিছলে পড়বে সে। খুব সাবধানে কাঁদামাখা জায়গাটুকু পাড় হয়ে রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালো।  গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে গায়ের টপসটাও অনেকটা ভিজে এসেছে তার। স্কার্টটা দু'হাতে ঝেড়ে নিয়ে বামহাতে পড়া ঘড়ির দিকে তাকালো সে ---- ৯ঃ৩০। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী "মহানগর এক্সপ্রেস" স্টেশন ছাড়ার কথা সাড়ে নয়টায়। অথচ এখনও ট্রেন আসার নামগন্ধ নেই। শুভ্রতা বিরক্ত ভঙ্গিতে পিলারে ঠেস দিয়ে বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকালো। কিছুক্ষণের মাঝেই যে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হবে তারই পূর্বাবাস দিচ্ছে প্রকৃতি। ইংরেজিতে এই বৃষ্টিকে বলে "কেটস এন্ড ডগস্"। মুষলধারার বৃষ্টির সাথে কুকুর বিড়ালের কি সম্পর্ক জানা নেই শুভ্রতার। শুভ্রতা কপাল কুঁচকে আকাশের দিকে তাকায়। রাতের অন্ধকার আকাশকে চিরে দিয়ে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সাথে সাথেই চারপাশটা সাদা সাদা আলোয় ভরে উঠছে। এমন একটা ভয়ঙ্কর রাতে একা ঢাকার পথে রওনা দিয়েছে বলে নিজের উপরই রাগ লাগছে তার। শুভ্রতার পুরো নাম --- রৌশিন আহমেদ শুভ্রতা। ঢাকা কলেজের বাংলার প্রফেসার শাহিনুজ্জামান সাহেবের মেয়ে সে। চট্টগ্রামে মামুর বাসায় বেড়াতে এসেছিলো শুভ্রতা। মামুর সাথে রাগ করেই হুট করে বর্ষার রাতে বেরিয়ে এসেছে বাড়ি ফিরবে বলে। কিছুক্ষনের মাঝেই ট্রেন এলো। শুভ্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও ঘড়ির দিকে তাকালো ---- ৯ঃ৪০। স্যুটকেস হাতে ঝটপট ট্রেনে উঠে গেলো শুভ্রতা। বাবা-মা ছাড়া এর আগে কখনো ট্রেনে উঠে নি শুভ্রতা। ছোট থেকেই ট্রেন নিয়ে বেশ ভীতি আছে তার মনে। তার ধারনা ট্রেনে উঠতে গেলেই অসংখ্য মানুষের পিড়াপিড়িতে হাত ছুটে গিয়ে অচেনা মানুষের ভীরে হারিয়ে যাবে সে। শুভ্রতা টিকেট দেখে নিজের সিটটা খুঁজে নিয়ে স্যুটকেসটা তাকে রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ব্যাগ থেকে একটা শাল বের করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বৃষ্টি দেখতে মগ্ন হলো। রাতের বৃষ্টিগুলোর সৌন্দর্য একদমই অন্যরকম। মনে হয় কালো পর্দায় সাদা সাদা মুক্তো ঢেলে দিচ্ছে কেউ। শুভ্রতা ট্রেনের গায়ে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। ঠান্ডায় কেমন একটা তন্দ্রা ভাব হচ্ছে তার।

--- এক্সকিউজ মি? এক্সকিউজ মি, আপু?

শুভ্রতা চোখ মেললো। বৃষ্টি দেখতে দেখতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিলো বুঝতেই পারে নি সে। চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে ডানপাশে তাকালো শুভ্রতা। সাদা টি-শার্টের উপর কালো জ্যাকেট পড়া একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। একহাতে কালো চামড়ার ব্যাগ। অন্যহাতে ভেজা চুলগুলো ঠিক করতে করতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সে। শুভ্রতা তাকাতেই নম্রভাবে বলে উঠলো ছেলেটি,

--- আমার ভুল না হলে আপনি যেখানে বসেছেন সেটা আমার সিট। আমি কি আপনার সিটে বসতে পারি?

শুভ্রতা দ্রুত সিট নাম্বারটা খেয়াল করলো। সিট নাম্বারটা দেখে তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াতে গিয়েই আঘাত পেলো মাথায়। ঠোঁট উল্টে এক হাতে মাথার বামপাশটাই চেপে ধরে ডানহাতে লাগেজ নিতে গিয়ে গায়ের চাদরটাও লুটিয়ে পড়লো। শুভ্রতা অস্বস্তিতে খিটমিট করে দ্রুত কাজ করতে গিয়ে আবারও সবটা গুলিয়ে ফেললো। ছেলেটি ব্যস্ত হয়ে বললো,

--- আপনি অযথা ব্যস্ত হচ্ছেন, আপু। আপনি ধীরে করুন আমার কোনো তাড়া নেই। 

ছেলেটার নিতান্ত ভদ্র কন্ঠে শুভ্রতার খুশিতে গদগদ হয়ে পড়ার কথা থাকলেও তার চোখে-মুখে বিরক্তি। ঘুম ভেঙেই এমন অযাচিত পরিস্থিতিতে পড়ায় ছেলেটার প্রতি অসম্ভব ক্ষেপে আছে সে। অনেক কষ্টে লাগেজটা সরিয়ে নিজের তাকে রেখে সিটে বসতে নিয়েও বাঁধালো এক গন্ডগোল।  সিটের এককোনায় রাখা পানির বোতলটা উল্টে দিয়ে সিটের খানিকটা ভিজিয়ে দিলো সে। ছেলেটা নীরবে সবটা সহ্য করলেও চোখে-মুখে বিরক্তি স্পষ্ট।  ভ্রু- দুটো খানিকটা কুঁচকে আছে।  মুখটাও গম্ভীর।  শুভ্রতা বোতলটা ঝটপট তোলে নিয়ে ওড়নার কোণে পানিটা মুছে দিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললো,

--- সরি!

ছেলেটি গম্ভীর স্বরে বললো,

--- ইট'স ওকে।

ট্রেন ছাড়তে ছাড়তে প্রায়  পনে দশটা বেজে গেলো। ট্রেনের জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছে। শুভ্রতার কাছে ব্যাপারটা ভালো লাগলেও সামনে বসা ছেলেটা ব্যাপারটায় চরম বিরক্ত। ভ্রু কুঁচকে জানালাটির দিকে তাকিয়ে থেকে খানিকবাদে জানালাটা বন্ধই করে দিলো সে। শুভ্রতার ইচ্ছে হচ্ছিলো ছেলেটাকে ধরে টুকরো টুকরো করে রেললাইনে ফেলে দিতে। কিন্তু তা সম্ভব নয় বলে চুপচাপ বসে রইলো। কিছুক্ষণ আগে করা নিজের বোকামীতে নিজেই বিরক্ত হচ্ছে সে। সময়টাকে পিছিয়ে নেওয়ার অপশন থাকলে কিছুক্ষণ আগের সময়টুকু ক্রপ করে পৃথিবী থেকে নাই করে দিতে এক মুহূর্তও ভাবতো না শুভ্রতা। ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজতেই হঠাৎই অজানা ভয় হানা দিতে লাগলো তার মনে। রাতের ট্রেনে কেভিন নেওয়ার মতো বোকামির জন্য আবারও নিজেকে বকতে লাগলো সে। ভেবেছিলো বৃষ্টির রাতে কেভিনে চাঁদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই পৌঁছে যাবে ঢাকা। কিন্তু কেভিনের অংশীদার  যে একটা ছেলেও হতে পারে মাথাতেই আসে নি তার। এই রাত-বিরাত ফাঁকা কেবিনে ছেলেটি যদি তার উপর হামলে পড়ে, তখন কি হবে? শুভ্রতা ভয়ে ভয়ে ছেলেটির দিকে তাকালো। ছেলেটি কানে হ্যাডফোন লাগিয়ে ভ্রু কুঁচকে ল্যাপটপ দেখায় মগ্ন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে খুবই জরুরী কাজে ব্যস্ত সে। শুভ্রতা বেশ কয়েকবার  দোয়া-দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে সিটের এককোনায় জড়োসড়ো হয়ে বসে সন্দেহী দৃষ্টিতে বারবার তাকাতে লাগলো। শুভ্রতাকে সম্পূর্ণ এবোয়েড করাটাকেও কেমন রহস্যজনক মনে হচ্ছে তার। আচ্ছা? ছেলেটা শুভ্রতার ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা করছে না তো? দীর্ঘ দেড়ঘন্টা পর মুখ তুলে তাকালো ছেলেটি। অত্যন্ত নম্র কন্ঠে বললো,

--- আমার একটা কনফারেন্স আছে। আমি কনফারেন্সটা এটেন্ড করলে আমার সাউন্ডে কি সমস্যা হবে আপনার? 

শুভ্রতা অদ্ভুত চোখে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভেবে নিয়ে হাসার চেষ্টা করে মাথা নাড়লো। যার অর্থ --- তার কোনো সমস্যা হবে না। শুভ্রতার উত্তর পেয়ে আবারও ল্যাপটপে মুখ গুজলো ছেলেটি। খানিকবাদেই ইংরেজিতে বকবক করতে লাগলো সে। শুভ্রতা মুখের সামনে একটি বই ধরে বইয়ের উপর দিয়ে আড়চোখে বারবার ছেলেটির দিকে তাকাচ্ছে। ছেলেটির অতি ভদ্র ব্যবহার ঠিক নিতে পারছে না শুভ্রতা।  কথায় আছে "অতি" জিনিসটাই খারাপ। এই ছেলেটার ক্ষেত্রে প্রবাদটা কতটুকু প্রযোজ্য তাই ভাবছে সে।


মাঝরাতে ট্রেন থামলো। গন্তব্যে নয় গন্তব্যের মাঝের কোনো স্টেশনে। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি।  একটু আগেও ঢালা বর্ষায় মুখর হয়েছে প্রকৃতি। ট্রেনের বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিস্তব্ধ রাতটির নিস্তব্ধতাকে চিরে দিতেই কাছের কোনো ডোবায় ডেকে উঠছে ব্যাঙ। প্রায় অাধাঘন্টা হতে চললো ট্রেন ছাড়ার নাম নেই। মাঝরাতে কোনো স্টেশনে এতোক্ষন ট্রেন আটকে রাখার কারণ কি হতে পারে বুঝতে পারছে না শুভ্রতা। সামনে বসা ছেলেটি  হেডফোন কানে দিয়ে সিটে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। শুভ্রতার মনটা কেমন কু’ডাকছে। মাঝরাতে এভাবে ট্রেন থেমে যাওয়ার ব্যাপারটা কিছুতেই হজম হচ্ছে না তার। কই বাবা-মার সাথেও তো রাতের ট্রেনে আসা-যাওয়া করছে সে,এমন তো কখনো হয় নি! শুভ্রতা মুখ কাঁচুমাচু করে জানালাটা হালকা খুলে বাইরে তাকালো। বাইরের অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়লো না তার। খানিকবাদে সামনে বসে থাকা ছেলেটি নড়েচড়ে বসলো। হেডফোনটা কান থেকে নামিয়ে ভ্রু কুঁচকে ঘড়ির দিকে তাকালো। তারপর কি ভেবে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। শুভ্রতারও ইচ্ছে করছিলো বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সাহস করে উঠতে পারলো না । কেবিনে বসেই জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে ব্যাপার বুঝার বৃথা চেষ্টা করলো সে। খাঁ খাঁ করা এই রাতের ভয়াবহতাকে বাড়িয়ে দিতেই যেন থেকে থেকে ডেকে উঠছে গ্রাম্য পোকা আর কোলা ব্যাঙের ছা। শুভ্রতা সিটে গুটিশুটি হয়ে বসে "কোলা ব্যাঙ" নামটা বিরবির করতে লাগলো। একটি ব্যাঙেরই কতো নাম। কোলা ব্যাঙ, সোনা ব্যাঙ আরো কতো কি। এদের আবার বৈজ্ঞানিক নামও আছে -----"Hoplobatrachus tigerinus।" ইংরেজিতে একে বলে --- " Indian bull frog"  শুভ্রতা ভাবে আর অবাক হয়। আচ্ছা? মানুষেরা যে তাদের এমন ভয়ানক ভয়ানক নামে চিন্হিত করে দিয়েছি, কোলা ব্যাঙ মহাশয় কি তা জানে? শুভ্রতার ভাবনার মাঝেই কেবিনে ডুকলো ছেলেটি। কালো চামড়ার ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার উদযোগ করছে সে। শুভ্রতা অবাক হলো। হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে উঠলো, 

--- ক কোথায় যাচ্ছেন, ভাইয়া?

ছেলেটি ব্যাগ কাঁধে তুলে নিতে নিতেই শুভ্রতার দিকে তাকালো। গম্ভীর গলায়ই বললো,

--- একটু আগের ঝড়ে রেললাইনে গাছ ভেঙে পড়েছে। তাতে করে রেললাইনের ক্ষতিও হয়েছে। সামনে এমন সমস্যা আরো আছে কি না জানা নেই কারো। গাছ না সরানো পর্যন্ত ট্রেন চলবে না। তাই যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।

শুভ্রতার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো,  বলে কি? শুভ্রতাকে সম্পূর্ণ অগ্রায্য করে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে গেলো ছেলেটি। শুভ্রতা যেন অকূল পাথারে পড়লো। তাড়াহুড়ো করে ঘড়ি দেখলো সে ---- ১ঃ০৩। এই মাঝরাতে কি এই ট্রেনেই থাকতে হবে তাকে? শুভ্রতা দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। এই ঝড়-বৃষ্টির রাতকে মাথায় নিয়েই ব্যাগ হাতে বেরিয়ে যাচ্ছে অনেকে। চলতি ট্রেনে থাকাটা যতটা না ভয়ের তারথেকে ভয়ের মাঝরাতে থেমে থাকা এই অনিশ্চিত ট্রেনে। শুভ্রতা একা এই অন্ধকার রাতে বেরিয়ে পড়ার সাহস যেমন পাচ্ছে না ঠিক তেমনই একা এই ট্রেনে থেকে যেতেও পারছে না। তারওপর জায়গাটাও অচেনা। কোথায় যাবে সে? শুভ্রতার এতোসব ভাবনার মাঝে তাকে চমকে দিতেই যেন তুমুল শব্দে বাজ পড়লো কোথাও। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় বড় বড় করে লেখা স্টেশনের নামটা চোখে পড়লো তার ----- "আশুগঞ্জ রেলস্টেশন, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া"  হঠাৎ কি মনে করে দৌড়ে কেবিনে গেলো শুভ্রতা। ভারি লাগেজটা নিয়ে ঝটপট ট্রেন থেকে নেমে পড়লো সে। বামহাতে স্কার্টটা হালকা তুলে দৌড় লাগালো ওই ছেলেটার পিছু। কিছুটা কাছাকাছি যেতেই ডেকে উঠলো শুভ্রতা,

--- এইযে ভাইয়া? শুনছেন? একটু দাঁড়াবেন প্লিজ?

ছেলেটি থমকে দাঁড়ালো। এদিক ওদিক তাকিয়ে পেছনে তাকাতেই শুভ্রতাকে দেখতে পেলো সে। অন্ধকারে ছেলেটির চেহারা দেখা গেলো না। শুভ্রতা হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

--- আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

ছেলেটি বললো,

--- তখনই তো বললাম। বাড়ি ফেরার চেষ্টা চালাচ্ছি।

--- না তা নয়। আপনি কোন শহরে যাচ্ছেন সেটা জিগ্যেস করছিলাম। কোথায় যাচ্ছেন?

--- ঢাকায়।

ছেলেটির উত্তর পেয়ে শুভ্রতা খুশি হলেও ছেলেটির বিরক্তিভাবটাও বেশ বুঝতে পারলো সে। মনের মাঝে অস্বস্তি আর ভয় কাজ করলেও অনুরোধ গলায় বলে উঠলো শুভ্রতা,

--- আমিও ঢাকায় যাবো। আমাকে সাথে নিবেন প্লিজ?

শুভ্রতার কথায় ছেলেটির মুখের ভাব কেমন হলো অন্ধকারে তা চোখে পড়লো না শুভ্রতার। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ছেলেটি শান্ত গলায় উত্তর দিলো,

--- এই জায়গাটুকু সেইভ নয়। তাছাড়া এখন অনেক রাত। আপনি আমার সাথে থাকলে অনেক বিপদে পড়তে হতে পারে। আই থিংক, বুঝতে পারছেন? তাই, সরি! 

শুভ্রতা আকুতি নিয়ে বললো,

--- প্লিজ! দেখুন আপনি আমার সহযাত্রী। তাছাড়া এজ আ পারসন , একটা মেয়েকে এভাবে ফেলে যেতে পারেন না। আমি একা এসেছি। আপনাকে যা একটু চিনি আর সবাই অপরিচিত। এতো রাতে ট্রেনে থেকে যাওয়াটাও তো রিস্ক বলুন। প্লিজ! 

ছেলেটি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো। বিরক্তিতে সারা শরীর শিরশির করছে তার। নিজের মনে বিরবির করে বললো,"আজাইরা ঝামেলা"। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললো,

--- আচ্ছা, চলুন। 

শুভ্রতা খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,

--- থেংক্স।

ছেলেটি কিছু বললো না। একে তো মাঝরাত তারওপর টিপটিপ বৃষ্টি। এমন একটা রাতে রাস্তাঘাটে মানুষ তো দূরের কথা দু'একটা গাড়িও চোখে পড়া দায়। গাছের পাতা বেয়ে পড়া বৃষ্টির পানির শব্দ আর দু'জনের পায়ের ছপছপ আওয়াজ যেন রাতটিকে আরো রহস্যময় আর ভৌতিক করে তুলছে ক্রমাগত। শুভ্রতার মনে হাজারও প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। অচেনা অজেনা এক ছেলের সাথে এমন নিস্তব্ধ একটি রাতে অচেনা রাস্তায় হেঁটে চলেছে ভাবতেই শরীর শিউরে উঠছে তার। শুভ্রতার মা রাদিবা আহমেদের জ্ঞান হারানোর জন্য এই ছোট্ট খবরটুকুই যথেষ্ট। শুভ্রতা ছেলেটিকে ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। এই মাঝামাঝি ধরনের ফিলিংসটা খুবই বাজে। এতে  না বিশ্বাস করে মনকে আত্মস্থ করা আর না অবিশ্বাস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলা যায়, "ছেলেটা খারাপ! ভয়ানক খারাপ।" শুভ্রতার ভয় আর আতঙ্ককে আরো একচোট বাড়িয়ে দিতেই কোন এক গলির ভেতর থেকে ডেকে উঠলো এক কুকুর। নিস্তব্ধতার মাঝে হঠাৎ এমন শব্দে চমকে উঠে ছেলেটির দিকে কিছুটা চেপে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলো শুভ্রতা। পরিচিত কেউ হলে নির্ঘাত শক্ত করে হাত চেপে ধরতো শুভ্রতা। কিন্তু এ তো অপরিচিত এক যুবক! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলে উঠলো শুভ্রতা,

--- ককোথায় যাচ্ছি আমরা?

ছেলেটি শান্ত গলায় বললো,

--- একজন বললো সামনে একটা বাজার আছে। ওখানে সিএনজি পেলেও পেতে পারি। আমরা এখন বাজারের দিকেই এগুচ্ছি। সাবধানে...সামনে গর্ত আছে।

শুভ্রতা গর্ত খেয়াল করলো। তারপর নিচু গলায় বললো,

--- আর কতক্ষণ হাঁটতে হবে?

--- জানি না। মনে হয় চলে এসেছি। চলুন দেখি...

কয়েক মিনিট হাঁটার পর বাজারে গিয়ে পৌঁছালো তারা। কিন্তু এই অন্ধকার বর্ষার রাতে  বাজারটাকে ঠিক বাজার বলে বোধ হচ্ছে না। সব দোকানপাটের শাটার নামানো। চারদিকে মানুষের ছায়াটা পর্যন্ত নেই। ব্রেঞ্চের নিচে, কাগজ দিয়ে পেঁচানো ঠেলা গাড়ির ওমে শুয়ে থাকা একটা দুটো কুকুর শুধু মাথা উঁচিয়ে ডেকে উঠলো। দু'বার ডেকে আবারও গলা নামিয়ে আরাম করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। শুভ্রতার নিজের গালেই চড় লাগাতে ইচ্ছে করছে । কি দরকার ছিলো এই রাতে বাসা থেকে বের হওয়ার? বিরক্তিকর!  কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই একটা সিএনজির দেখা মিললো তাদের। ছেলেটি হাত উঁচিয়ে সিএনজি থামতে বলে ড্রাইবারের দিকে এগিয়ে গেলো। সিএনজির উপর দুই হাত রেখে খানিকটা ঝুঁকে গিয়ে বললো,

--- মামা, ঢাকা যাবা?

--- না মামা। এই রাইতে ওতোদূরের ট্রিপ লইতাম না। তারওপর ঝড় বৃষ্টি। 

--- মামা যাও না একটু কষ্ট করে। তিন ডাবল ভাড়া দিবোনি মামা। তাও চলো।

--- না মামা। হয়তো না। সামনে চেকপোস্ট আছে। পুলিশে আটকাইবো। আমার কাগজ পত্রও ঠিক নাই। নয়তো দিয়াইতাম মামা।

--- এটা কোনো কথা? আচ্ছা এখানে কি বাস সার্ভিস কিছু পাবো মামা? 

--- না এই রাইতে তো পাইবেন না। এমুন ঝড়ের রাইতে বের হইছেন কেন? এখন কোনো গাড়িই ঢাকা যাইতো না। তাও দেখেন... পাইলেও পাইতে পারেন।

ছেলেটি হালকা হেসে বললো,

--- আচ্ছা, ধন্যবাদ মামা৷ তুমি যাও।

সিএনজি ড্রাইভার চলে যেতেই ছেলেটি শুভ্রতার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় ছেলেটির কপালের চিন্তার ভাজটি স্পষ্ট দেখতে পেলো শুভ্রতার। আবারও বিদ্যুৎ চমকিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। দু'জনেই দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো একটি দোকানের দাওয়ায়। দোকানের ভাঙাচোরা অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দোকানটা একটি চায়ের স্টল। এদিক সেদিক চোখ ঘুরিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো শুভ্রতা। শীতে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সে। এমন একটা বাজে পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়ে নি সে। এই ছেলেটা যদি এখন ওর ওপর হামলেও পড়ে তবুও কিছুই করার নেই শুভ্রতার। ভয়ে, অসহায়ত্বে পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। ডান হাতে বামহাতের বাহু ঘষতে ঘষতে কাঁপা গলায় বলে উঠলো শুভ্রতা,

--- এখন কি হবে? কিভাবে যাবো আমরা?

ছেলেটির সহজ স্বীকারোক্তি, 

--- জানি না। (একটু থেমে) আপনার বেশি ঠান্ডা লাগলে আমার জ্যাকেটটা নিতে পারেন।

শুভ্রতা হাসার চেষ্টা করে বললো,

--- থেংক্স বাট লাগবে না।  আমি ঠিক আছি।

আরো কিছুক্ষণ নীরবে বৃষ্টির শব্দ শুনলো দু'জন। টিনের চালে ঝনঝন করে বেজে চলেছে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা। দু'জনের মনেই উদ্বেগ, "বাড়ি কি করে ফিরবো এবার?" প্রায় আধাঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর নিজের ফোনটা বের করে কাউকে ফোন লাগালো ছেলেটি। দু'বার রিং হওয়ার পর ফোনটা রিসিভ হলো,

--- হ্যালো, আরাফ?

ওপাশ থেকে ঘুমুঘুমু গলায় বলে উঠলো কেউ,

--- হ। কে?

--- আমি সাদাফ। এই তুই না ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার? 

--- হ। কেন বল তো? এই রাইতে তুই জাস্ট এই কথা জিগানোর জন্য ফোন দিছিস? 

--- অলওয়েজ বেশি কথা না বললে চলে না তোর? এনিওয়ে, এখন তুই কই? ঢাকায় নাকি ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায়?

--- ঢাকায় আছি দোস্ত। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া যাই না প্রায় পাঁচমাস হইলো। কিন্তু কাহিনীডা কি?

--- আরে আশুগঞ্জ এসে ট্রেনে প্রবলেম হইছে। নেমে আসছি ভাবলাম সিএনজি নিয়ে চলে আসবো ঢাকায়। এখন তো সিএনজির চুচাও চোখে পড়তেছে না। তারওপর এই বৃষ্টি! 

আরাফ উদ্বেগমাখা গলায় বললো,

--- এখন কই আছিস তুই?

--- বুঝতাছি না। মনে হয় আশুগঞ্জ বাজারে। 

--- হায় আল্লাহ! অতো রাতে তো ওইখানে সিএনজি পাবি না দোস্ত। তারওপর বলতেছিস বৃষ্টি। 

--- তোরে সমস্যা বলতে বলি নাই ব্যাটা, সমাধান বল। কি করবো এখন?

--- আমি ওইখানে থাকলে না হয় কিছু করতে পারতাম। এইখান থেকে তো কিছু করতে পারতাছি না দোস্ত। 

--- আচ্ছা ঠিক আছে। ফোন রাখ!

কথাটা বলেই ফোন কাটলো সাদাফ। শুভ্রতা আড়চোখে অন্ধকারে ঢাকা ছেলেটিকে দেখছে।  ও ভাবতেই পারে নি ছেলেটি এতো কথা বলতে পারে। শুরু থেকেই কেমন গম্ভীর গম্ভীর ভাব! 


"আপনি বরং পাশের ব্রেঞ্চটাই বসুন। কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকবেন?" 

শুভ্রতা জবাব দিলো না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে রাখা আধভেজা ব্রেঞ্চটাতে বসে পড়লো। ডানহাতে বামহাতের বাহু ঘষতে ঘষতে মিন মিন করে কিছু একটা বললো কিন্তু সেই কন্ঠ সাদাফের কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। পৌঁছানোর কথাও নয়। বৃষ্টির এমন ঝংকারে চিৎকার করে বলা কথাও যেখানে কানে পৌঁছানো দায় সেখানে শুভ্রতার বিরবির কান পর্যন্ত পৌঁছাবে না এটাই স্বাভাবিক। শুভ্রতা এবার গলা পরিষ্কার করে চেঁচিয়ে বললো,

---" আমরা কি ঢাকা থেকে অনেক বেশি দূরে আছি, ভাইয়া?" 

সাদাফ ঘুরে তাকালো। অন্ধকারে কারো মুখই স্পষ্ট নয়। গলা উঁচিয়ে বললো,

--- " ঢাকা থেকে ৯০ কি.মি. দূরে আছি। খুব বেশি দূরে বলতে পারি না।" 

--- "আচ্ছা? এখানে কোনো হোটেল নেই?" 

সাদাফ শুভ্রতার অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝাপসা মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। খানিক নীরব থেকে বললো,

--- " উপজেলা শহর যেহেতু হোটেল তো অবশ্যই আছে। কিন্তু কোথায় আছে সেটা বলতে পারছি না। কোথায় দাঁড়িয়ে আছি তাই তো বুঝতে পারছি না।" 

সাদাফ বিরক্ত নিয়ে ব্রেঞ্চের এককোণে মাথা নিচু করে বসলো। রাগে শরীরটা রিরি করলেও বেশ শান্ত হয়ে বসে আছে সে। ঝড়ের জন্য লোডশেডিং হচ্ছে। সারা শহর অন্ধকারে ঢাকা। গুগল ম্যাপেও নিজেদের অবস্থান বুঝতে পারছে না সাদাফ। নেটওয়ার্কের খুবই বাজে অবস্থা। তারওপর ফোনের চার্জও প্রায় শেষের দিকে। নিজে একা থাকলে এতোটা ভাবতে হতো না তাকে কিন্তু সে একা নয়। সাথে আছে একটি মেয়ে! অপরিচিত হলেও মেয়েটিকে সেইভ রাখার দায়িত্ব এখন তার। সাদাফ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। প্রায় সাথে সাথেই বৃষ্টির শব্দের সাথে পাল্লা দিয়ে বেজে উঠলো তার ফোন। ফোনের স্ক্রিনে আরাফের নাম ভাসতে দেখে ফোনটা রিসিভ করলো সে। 

---" হ্যালো?"

---" সাদাফ?" 

---"হুম" 

---" কিছু ব্যবস্থা করতে পারছিস?" 

---"না। এই বৃষ্টির মাঝে কি ব্যবস্থা করতে বলিস আমায়? বিরক্ত না করে ফোনটা রাখ।"

---" আরে রাগিস কেন? শুন তো! তুই কি কোনোভাবে রায়পুরা পর্যন্ত আসতে পারবি? রায়পুরায় আমার দুলাভাই আর বড় আপা থাকে। আজ রাতটা ওদের ওখানে কাটিয়ে কাল সকালে বাস ধরে চলে আসবি। পারবি না?" 

--- "আশুগঞ্জ থেকে কতটুকু দূরে? তাছাড়া এখানে তো গাড়িঘোড়া কিছু নাই। তারওপর মুশলধারায় বৃষ্টি, কেমনে যাবো?" 

--- "বেশি দূরে না। ৩৩/ ৩৪ মিনিট লাগবে। আশুগঞ্জ থেকে ২২ কিলোর মতো হবে। একটু ট্রাই করে দেখ। সিএনজি টিএনজি পাইয়া যাইতেও পারিস। এমনে কতক্ষণ খাড়ায় থাকবি? দুলাভাইয়ের বাসায় গিয়া আজকের রাতটা কাটিয়ে কাল সকালে চলে আসলি।" 

কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো সাদাফ।হঠাৎ করেই শুভ্রতার কথা মনে পড়লো তার। শান্ত গলায় বললো,

---" আরেকটা সমস্যা দোস্ত। আমি একা নই সাথে মেয়ে আছে।" 

আরাফ যেন আকাশ থেকে পড়লো। ফোনের ওপাশ থেকে সন্দেহী গলায় বললো,

--- "মাইয়া? কোন মাইয়া? পৃথা?" 

---" আরে! পৃথা হইলে কি মেয়ে বলতাম? নাম ধরেই তো বলতাম। আর ওরে নিয়ে আমি ঢাকা আসবো কেন? তারওপর সামনে ওর এক্সাম না?"

আরাফ এবার চেঁচিয়ে উঠলো,

--- "তাইলে কোন মাইয়া? এমনে তো খুব পার্ট নাও মামু, তো এখন কি? রাইত-বিরাইতে মাইয়া লইয়া ঘুরা বেড়াও? তলে তলে ট্যাম্পু চালাও মিয়া?" 

সাদাফ বিরক্তি নিয়ে বললো,

---"ফালতু কথা বন্ধ কর।এসব কিছু না। ট্রেনের এক কেবিনেই ছিলাম। মাঝরাতে ট্রেনে একা একটা মেয়ে থাকাটা রিস্ক না? তাই আমার সাথেই নেমে এসেছে এখন তো..."

আরাফ আগ্রহ নিয়ে বললো,

---" নাম কি দোস্ত? দেখতে কেমন? প্রেমে পড়ছো নি?"

সাদাফের ভ্রু কুঁচকে এলো। আরাফকে ফোন দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে তার। বিরক্তি নিয়ে বললো,

--- "ফোন রাখ ডাফার। তোর হেল্পের দরকার নাই আমার।"

আরাফ ক্ষুন্ন মনে বললো,

---"চেতোছ কেন? আচ্ছা যা বলা লাগবো না। ফিরে বলিস। এখন রায়পুর যাওয়ার ব্যবস্থা কর। আমি দুলাভাইরে বইলা দিতাছি।" 

সাদাফ ফোন রেখে উঠে দাঁড়ালো। শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

---"আপনি এখানেই বসুন আমি আরেকটু এগিয়ে দেখি সিএনজি টিএনজি পাই কি না। এখান থেকে রায়পুরা যেতে পারলে একটা থাকার ব্যবস্থা হবে। আপনার কোনো সমস্যা নেই তো?"

শুভ্রতা কি বলবে বুঝতে পারছে না। "হ্যাঁ" বলবে নাকি "না" বলবে তা নিয়েও বিরাট সমস্যা। সাদাফ ওর উত্তরের অপেক্ষা না করে ঘড়িটা খুলে ব্রেঞ্চের উপর রেখে বৃষ্টি মাথায় বেরিয়ে গেলো। কোথায় গেলো কে জানে?সাদাফ বের হওয়ার খানিকবাদেই ঠান্ডা,ভয় আর দুশ্চিন্তায় মর মর অবস্থা শুভ্রতার। এতোক্ষন শুধু বাড়ি ফেরার টেনশন থাকলেও এখন তারসাথে যোগ হয়েছে ভূতের টেনশন। চারপাশে বৃষ্টির শব্দ ছাড়া কিছুই কানে আসছে না। অন্ধকারে নিজের হাত দেখাটাও যেখানে দুষ্কর সেখানে শুভ্রতার মনে হচ্ছে তার পাশেই হয়তো কেউ দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্রী চোখদুটো দিয়ে তারদিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। এক্ষুণি ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে হামলে পড়াবে তার উপর। শুভ্রতা ঢোক গিলে। কাঁপা কাঁপা বুক নিয়ে পাশে তাকায়। অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না তার। তবুও ভয়, প্রচন্ড রকম ভয়! শুভ্রতা মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়তে থাকে।দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে বিরবির করে সে,

--- "হে মা'বুদ! হে রক্ষাকর্তা! এবারের মতো বাঁচিয়ে দাও। আই প্রমিস আর জীবনেও এমন বোকামো করবো না আমি। প্লিজ! প্লিজ! এবারই শেষ।" 

শুভ্রতার এবার কান্না পাচ্ছে। ট্রেনে থাকতে শেষ কথা হয়েছিলো বাসায়। না জানি কতো চিন্তা করছে মা। এই অন্ধকারে ফোনটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ছেলেটা কোথায় গেলো কে জানে? শুভ্রতার মনে হচ্ছে ঘড়ির কাটা ঘুরছে না। একদম স্থির হয়ে উৎসাহী চোখে শুভ্রতার করুণ পরিণতি দেখছে আর মুখ টিপে হাসছে। শুভ্রতার "ফারদিন হাসান" নামক ছেলেটিকে কেঁচোয় ভরা ডোবায় ডুবিয়ে মারতে ইচ্ছে করছে। একমাত্র এই ব্যক্তিটির জন্যই এতোটা করুণ অবস্থা তার। এই ছেলে তাকে দেখতে এসেছিলো বলেই তো মামুর সাথে রাগ করে বেরিয়ে এসেছে সে। কি দরকার ছিলো তাকে দেখতে আসার?আর দেখতে যদি আসতেই হতো তাহলে রাতে কেন? দিনে আসতে পারলো না? তাহলে তো দিনের বেলায় রাগ করে ব্যাগ উঠিয়ে চলে আসতো শুভ্রতা। এমন সময় জ্ঞানহীন একজন মানুষ কি করে প্রফেসার হয় বুঝে উঠতে পারে না শুভ্রতা। বেয়াদব একটা! ভয়ে যখন স্ট্রোক করবে করবে অবস্থা ঠিক তখনই কারো ডাক কানে এলো তার। রাস্তায় একটা সিএনজি থেকে তাকে উদ্দেশ্য করেই ডাকছে কেউ। শুভ্রতার ভয়টা শিরায় উপশিরায় ছুটতে লাগলো ক্রমাগত। শুভ্রতার সাড়াশব্দ না পেয়ে সিএনজি থেকে নেমে তার সামনে এসে দাঁড়ালো কেউ।বললো, 

---" কখন থেকে ডাকছিলাম সাড়া দিচ্ছিলেন না কেন? দ্রুত চলুন। অনেক কষ্ট একটা সিএনজি জোগার করেছি।" 

শুভ্রতা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,

--- "এই সিএনজি ঢাকা যাবে?"

সাদাফ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘড়িটা পকেটে পুড়ে ভেজা চুপচুপে শরীর থেকে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,

---" নাহ। রায়পুরা পর্যন্ত যাবে। ওখানে আমার বন্ধুর দুলাভাইয়ের বাসা।প্লিজ তাড়াতাড়ি চলুন।"

কথা শেষ করে শুভ্রতার লাগেজটাও নিজের হাতে তুলে নিয়ে সিএনজির দিকে এগিয়ে গেলো সে। শুভ্রতা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ছুটে গিয়ে উঠে পড়লো সিএনজিতে। সাদাফের গা বেয়ে জল গড়াচ্ছে। ঠান্ডাটা বোধহয় এবার লেগেই যাবে। সিএনজির দুই ধারেই পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে। বাতাসের তেজে পর্দা সরে গিয়ে বারবারই ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে শরীর।অন্ধকারে দুটো পর্দার আড়ালে বসে আছে অচেনা দু'জন মানুষ। কি একটা দমবন্ধকর পরিস্থিতি!  না আছে মুখে কোন কথা। আর না আছে বলার কোন ইচ্ছে। দু'জনেই দুশ্চিন্তায় অস্থির। প্রায় আধাঘন্টা- চল্লিশ মিনিট পর রায়পুরা গিয়ে পৌঁছালো তারা। আরাফ যে রাস্তায় দাঁড়াতে বলেছিলো সেখানেই একটা ভাঙা ঘরের কাছে দাঁড়ালো ওরা। বৃষ্টি অনেকটাই কমে এসেছে এখন। দু-একটা ফোটা পড়ছে মাত্র। সাদাফ ভাড়া মিটিয়ে আরাফকে কল করলো কিন্তু  রিসিভ হলো না। দু-তিনবার ট্রাই করার পর বিরক্ত হয়ে পড়লো সাদাফ। আরাফ এতোটা কেয়ারলেস কি করে হতে পারে ভাবতে পারছে না সে। প্রায় দশমিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো শুভ্রতা,

---" কি হয়েছে?  আমরা এখন কোথায় যাবো?"

সাদাফ সোজাসাপ্টা জবাব দিলো,

--- "জানি না।"

শুভ্রতার চোখ কপালে উঠে গেলো। বিস্ময় নিয়ে বললো,

--- "মানে? জানেন না মানে কি? আমরা এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবো এখন? মনে হচ্ছে জায়গাটা গ্রামের দিকে।"

সাদাফ জবাব দিলো না। আবারও ফোন লাগালো আরাফকে এবার ফোনটাই বন্ধ। এই মুহূর্তে  আরাফকে ধরে ইচ্ছে মতো পেটাতে ইচ্ছে করছে সাদাফের। একটা মানুষ এতোটা কেয়ারলেস কি করে হতে পারে? সাদাফরা যে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশের ঘরের জানালাটা খুলে গেলো হঠাৎ। কেউ একজন তীক্ষ্ণ আলো ছুঁড়ে দিয়ে বললো,

--- "কেডায় কতা কয়? কে ওইহানে? হাশমত?"

সাদাফ-শুভ্রতা উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। কি বলবে গুছিয়ে নেওয়ার আগেই বাইরের দরজাটা খুলে বেরিয়ে এলো একটি লোক। টর্চের আলো লোকটির বিপরীতে হওয়ায় লোকটির মুখ দেখতে পারলো না তারা। লোকটি গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলো, 

--- "আব্বা? হাশমত না একটা মাইয়া আর একটা পোলা খাড়ায় আছে। চিনতাছি না। ও ব্যাটা বাড়ি কই?মাইয়া মানুষ লইয়া রাইতের বেলা এইখানে দাঁড়ায় আছো কেন? মতলব কি?"

সাদাফ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,

--- "আসলে আমরা ঢাকা যাচ্ছিলাম। গাড়িটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আটকে পড়েছি। এই রাতে তো গাড়িও পাওয়া যাচ্ছে না তাই এখানে দাঁড়িয়ে আছি।"

সাদাফের কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হলো কি না বুঝা গেলো না। লোকটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। টর্চের আলো ওদের মুখে ফেলে ভালো করে পর্যবেক্ষন করতে লাগলো। ততক্ষণে আরো দুজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। তাদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ। বৃদ্ধ লোকটি বললো,

--- "তা তোমার সাথে মাইয়াটা কিডা? ভাগাইয়া লইয়া আইছো নাকি?"

সাদাফ স্পষ্ট গলায় বললো,

---" না। ভাগিয়ে আনবো কেন? ও আমার বউ। "

লোকটির চোখে-মুখে সন্দেহ। সন্দেহী গলায় বললো,

--- "কিন্তু মাইয়ার গায়ে তো বিয়াত্তের কোনো চিন্হ নাই। নাকফুল, চুড়ি কিছুই তো নাই।"

সাদাফ নির্লিপ্ত গলায় বললো,

--- "এখন কি মেয়েরা এসব মানে চাচা?"

--- "তাও ঠিক।" 

--- "চাচা আজকের রাতটা কি থাকা যাবে এখানে? আশেপাশে হোটেল টাইপ কিছু আছে?" 

--- "হোটেল তো শহরের মাইধ্যে এইহানে পাইতা না। তয় আমাগো বাড়ি থাকতে পারো। স্বামী-স্ত্রী যখন তখন আর সমস্যা নাই।"

সাথে সাথেই পাশে থেকে বলে উঠলো কেউ,

--- "মামা? এখনকার মানুষ কি বিশ্বাস করুন যায়?বিয়া আসলেই হইছে কিনা কেডা জানে? থাকতে দিয়া যদি ঝামেলায় পড়েন। আপনি হইলেন হাজী মানুষ!  মানসম্মান আছে না? 

লোকটি এবার চিন্তায় পড়ে গেলো। খানিক চুপ থেকে বললো,

--- "তয় কি করতাম? এই পোলাপাইন দুইডা এই রাইতে কই যাইবো? আল্লাহর দুনিয়ায় বিপদে মানুষরে সাহায্য না করলে আল্লায় বেজার হবো।"

ছেলেটি এবার ফিসফিস করে বলে উঠলো, 

--- "মামা? আমি কই কি? আপনি তো কাজী। এককাম করেন, হেগোর আবার বিয়া পড়ায় দেন। কোনো ঝামেলা হইলে তো প্রমাণ দিতে পারবেন যে হেতিরা জামাই বউ।"

লোকটির কথায় চমকে উঠলো সাদাফ-শুভ্রতা। এসব কি বলছে এরা? লোকটিকে ঠাডিয়ে চড় বসাতে ইচ্ছে করছে সাদাফের। এমন ফালতু আর বলদ মার্কা আইডিয়া দেওয়ার জন্য লোকটিকে গুণে গুনে দু'শো থাপ্পড় দেওয়া উচিত। শুভ্রতা একদম "থ" মেরে দাড়িয়ে আছে। কি হচ্ছে?  কেন হচ্ছে?  সবই যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে তার। তবে বৃদ্ধ লোকটির গলা খুশি খুশি। ভাগ্নের আইডিটা চমৎকার লেগেছে তার। 

--- "ভালা বলছো মিজান। তোমরা ঘরে আহো। আলামিনের মা? ও আলামিনের মা? মেহমান আইছে সমাদর করো। " 

সাদাফ ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। এর থেকে ওই ভাঙা চায়ের দোকানে ঝিম ধরে বসে থাকাটাও ভালো ছিলো। কেন যে এই আরাফকে ভরসা করতে গেলো ও! তাকে এমন বিপদে ফেলো নির্ঘাত নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে ফাজিলটা। 

_____________

একটা শক্ত চৌকিতে বসে আছে সাদাফ। তার থেকে একটু দূরেই গুটিশুটি হয়ে বসে আছে শুভ্রতা। বৃদ্ধ লোকটি কিসব খাতাপত্র নিয়ে বসেছেন তাদের বিয়ে পড়াবে বলে। সাদাফ অনেকবার বলেছে এসবের দরকার নেই। কিন্তু কে শুনে কার কথা? এদিকে শুভ্রতা কেঁদে দিবে দিবে অবস্থা। রাগ জিনিসটা যে খুবই খারাপ আর রাগ করে নেওয়া সিদ্ধান্তটা যে তার থেকেও ভয়ানক খারাপ তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে শুভ্রতা। হাজারবার বোঝানোর পরও বদ্ধপরিকর বৃদ্ধ গম্ভীর গলায় জিগ্যেস করলেন,

--- "তোমার নাম কি বাবা? পুরো নাম?"

সাদাফ বাধ্য হয়ে বললো, 

---" রাফাত আল সাদাফ" 

বৃদ্ধ এবার শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বললো,

---" তোমার নাম কি মা?"

শুভ্রতা উত্তর দিলো না। বৃদ্ধের কন্ঠ তার কান পর্যন্ত পৌঁছালোই না। তিনবার জিগ্যেস করার পর অসহায় মুখে বললো,

---"রৌশিন আহমেদ শুভ্রতা" 

শুভ্রতার নামটা এই প্রথম শুনলো সাদাফ। এতোটুকু সময় একসাথে থাকার পরও কেউ কারো নামটুকু জিগ্যেস করার সময় পায় নি বা প্রয়োজন বোধ করে নি। শুধু নাম কেন? শুভ্রতার চেহারাটাও তেমন ভালো করে খেয়াল করে নি সাদাফ। বৃদ্ধের কথায় ভাবনার সুতো ছিঁড়লো সাদাফের, 

--- বাবা? দেনমহর কতো লেখুম? ১০১ টাকায় লেখি। চলবো?

শেষ পর্যন্ত জোরে পড়ে বিয়েটা হয়েই গেল। কবুল বলার সময় শুভ্রতার গলা চেপে আসছিলো। মনে হচ্ছিলো গলায় কোনো ধারালো ছুরি ধরে আছে কেউ। বৃদ্ধ লোকটির কথার তোড়ে তৎক্ষনাৎ ১০১ টাকা দেনমোহর পরিশোধ করতে হলো সাদাফের। দেনমোহর দিতে গিয়ে শুরু হলো আরেক বিপত্তি। ১০০ টাকা আছে কিন্তু এক টাকা তো নাই। এখন উপায়? বৃদ্ধ পড়লেন মহাদুশ্চিন্তায়। সবশেষে বৃদ্ধের ভাগ্নের থেকে দশ টাকার পরিবর্তে এক টাকা নিয়ে দেনমোহর পরিশোধ করলো সাদাফ। শুভ্রতার এই মুহূর্তে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। তার মা ঠিকই বলে তার মতো স্থুলবুদ্ধি সম্পন্ন মেয়ে কোনো একদিন স্বেচ্ছায় ভয়ানক ধরনের বিপদে পড়বে। লেগে গেলো তো কথা? 


জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রতা। টিনের জানালাটা বাতাসের তান্ডবে অদ্ভুত রকম শব্দ করে চলেছে সেই কখন থেকে। কিন্তু সেই শব্দ কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না শুভ্রতার। দৃষ্টি বৃষ্টিহীন অন্ধকারে স্থির। মাথায় চলছে হাজারো প্রশ্ন। কি হবে এরপর? এই ইন্সিডেন্টের বিয়ের কথাটা কোনোভাবে মা-বাবার কানে গেলে তারা কি ছেঁড়ে কথা বলবে তাকে? সারাজীবন ব্যাপী দিয়ে আসা স্বাধীনতায় তারা কি আফসোস করবে না? তাছাড়া,ছেলেটাই বা কি করবে এবার? সুযোগ পেয়ে হামলে পড়বে না তো তার ওপর। স্বামীর অধিকারের প্রশ্ন তুলে জোরজবরদস্তি করবে না তো?শুভ্রতার ভাবনার মাঝেই ভেতরে ঢুকলো সাদাফ। হাতে ভেজা কাপড়। মাত্রই ভেজা কাপড় বদলেছে সে। একহাতে দরজায় ছিটকানি দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই কথা ছুঁড়লো শুভ্রতা,

---"দেখুন,বিয়ে হয়েছে মানে যে স্বামীর অধিকার ফলাতে আসবেন তা কিন্তু হবে না। আমি এই বিয়ে মানি না। সো আমার আশেপাশে আসার চেষ্টাও করবেন না।"

একদমে কথাগুলো বলে থামলো শুভ্রতা। সাদাফ ভেজা কাপড়গুলো টিনের বেড়ার সাথে ঝুলানো দড়িটাতে মেলে দিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকালো। ঘরের এককোণে একটা চার্জার লাইট জ্বালানো। ঘরময় আবছা মৃদু অন্ধকার। সাদাফ ভ্রু কুঁচকে "বুঝতে পারে নি" এমন ভাব নিয়ে বললো,

---"মানে?"

শুভ্রতা এবার সরাসরি তাকালো। আলো আধারীতে দু'জনের মুখই অস্পষ্ট। শুভ্রতা শক্ত গলায় বললো,

---" মানেটা খুবই সহজ। আপনি আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না। নয়তো ব্যাপারটা ভালো হবে না।"

সাদাফের মেজাজ এমনিতেই তেতে ছিলো। শুভ্রতার কথায় রাগটা এবার ষোল কলায় পূর্ণ হলো। কপট রাগ নিয়ে বললো,

---" অদ্ভুত! আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনাকে ছোঁয়ার জন্য আমি নেচে বেড়াচ্ছি।"

শুভ্রতা আগের মতোই শক্ত গলায় বললো, 

---"অবশ্যই নেচে বেড়াচ্ছেন। একমাত্র আপনার জন্য এতোসব কাহিনী হয়ে গেলো। কি দরকার ছিলো আমাকে বউ বলার? সত্যিটা বললে আজ এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।"

---" বউ বলার যথেষ্ট কারণ ছিলো শুভ্রতা। গ্রামের লোকেরা ব্যাকডেটেড হয়। এতো রাতে একা একজোড়া ছেলে-মেয়েকে নিশ্চয় ভালো চোখে দেখতো না ওরা। তাছাড়া আপনি আমার কোনো রিলেটিভও নন। তখন, আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন ছিলো। স্বামী-স্ত্রী না বলে যদি বলতাম অপরিচিত সহযাত্রী তাহলে তারা সাহায্য তো দূর উল্টো সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতো। তাছাড়া আমি কি জানতাম যে ওরা এমন একটা অ্যাকশন নিবে?"

---"তখন নয় জানতেন না বা বুঝতে পারেন নি। কিন্তু যখন বিয়ের কথা বললো তখন তো এটলিস্ট সত্যটা বলতে পারতেন।"

সাদাফ বিরক্ত গলায় বললো,

---"হ্যাঁ তাই তো। একবার বলি স্বামী-স্ত্রী তো আরেকবার স্বামী-স্ত্রী নই। তাহলে ব্যাপারটা কি বিশ্বাসযোগ্য হতো? তখন দেখা যেত আমাদের সব কথায় অবিশ্বাস করছে তারা। তাছাড়া বিয়েটা আমিও ইচ্ছে করে করি নি। ওদেরকে বোঝানোর চেষ্টাও করেছি বাট কাজে না লাগলে আমি কি করতে পারি?"

শুভ্রতা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আবারও জানালার বাইরের অন্ধকারের দিকে চোখ রাখলো। তর্ক করার ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটাই নেই তার। মৃদু গলায় প্রশ্ন করলো,

---"এখান থেকে ঢাকা যাওয়ার উপায় কি?"

সাদাফ বিছানার এক কোণায় বসে বললো,

---"বাড়ির সাথেই তো রাস্তা। উনারা বললো রাস্তা থেকে অটোরিকশা দিয়ে বাস স্টেন্ড পর্যন্ত গেলে ওখান থেকে বাস ধরে ঢাকা। ঢাকার বাস নাকি এভেইলএবল।" 

শুভ্রতা ছোট্ট করে জবাব দেয়,

---"ওহ্" 

সাদাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

---" চাইলে বিছানায় ঘুমাতে পারেন আপনি। চিন্তা করবেন না, আমি বিছানায় শুবো না। ঘরের কোণে একটা পাটি গুটানো আছে। আমি ওতেই ম্যানেজ করে নিবো।" 

শুভ্রতার উত্তরের অপেক্ষা না করে গুটানো পাটি মেঝেতে বিছিয়ে নিলো সাদাফ। বিছানা থেকে একটা কাঁথা আর একটা বালিশ নিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে সটান শুয়ে পড়লো সে। সাদাফের ঠান্ডার ধাঁচ ভালো না। একবার ঠান্ডা লেগে গেলে দীর্ঘদিন জ্বরে ভুগতে হয় তাকে। এই জ্বর আর ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে এই মুহূর্তে এন্টিবায়োটিক, এক কাপ কড়া কফি আর চমৎকার একটা ঘুম প্রয়োজন তার। ভ্রমণপ্রিয় সাদাফের কাছে মেডিসিন থাকলেও কফি খাওয়ার জোগার নেই। তাই কফির আশা বাদ দিয়ে চমৎকার একটা ঘুমের প্রস্ততিতে মেতে উঠলো সে। কিন্তু শুভ্রতার চোখে ঘুম নেই। এখনোও জানালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে। অযাচিত এক পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় লাগছে তার। যেভাবেই হোক এখান থেকে বের হতে হবে তাকে। নয়তো বাবা-মার সামনে দাঁড়ানোর সাহসটুকুও যোগাতে পারবে না সে। বিয়ে নামক ঝঞ্জাট থেকে বাঁচতে, মুক্তপাখির মতো উড়তেই মামুর বাসা থেকে একরকম পালিয়ে এসেছে শুভ্রতা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বিয়ে নামক ঝঞ্জাটেই বাঁধতে হলো তাকে। 

___________

সারারাতের ঝড়-বৃষ্টির পর সকালটা যেন সোনালী আলোয় মেতে উঠেছে। গাছগাছালি গুলো সারারাতে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে সূর্যের নরম আলোয় নিজেদের স্নিগ্ধ রূপ দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পাখির কিচিরমিচির আর মানুষের ব্যস্ত কথাবার্তার কলরবে ঘুম ছুটে গেলো সাদাফের। আড়মোড়া ভেঙে চোখ পিটপিট করে তাকালো। ডানপাশের টিনের জানালাটা খোলা। সেদিক থেকেই রোদের ঝিলিক এসে লাগছে তার চোখে। জানালার বাইরে ঝকঝকে নীল আকাশে কয়েক সেকেন্ড দৃষ্টি নিবদ্ধ করে উঠে বসে সাদাফ। সচেতন চোখে বিছানার দিকে তাকায় ---- বিছানা ফাঁকা। সাদাফের কপাল কুঁচকে আসে। বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে সময় দেখে ---- ৮ঃ২০। গ্রামের ঘড়িতে আটটা মানেই অনেক বেলা। সাদাফ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। দরজার ছিটকানি খোলা। সাদাফ সতর্ক চোখে এদিক ওদিক তাকায়। কাঁথা আর বালিশটা বিছানায় তুলে রেখে পাটি গুটিয়ে দরজার পাশে রাখে সে। মনে মনে শুভ্রতাকে খুঁজে। কোথায় গেলো মেয়েটা? দড়িতে শুকাতে দেওয়া কাপড়গুলো গুছিয়ে ব্যাগে রাখতে গিয়ে ব্যাগের পাশেই ভাজ করা কাগজ চোখে পড়ে তার। কাপড়গুলো ব্যাগের পাশে রেখে কৌতূহল নিয়ে কাগজটা মেলে সাদাফ। চিঠিটা শুভ্রতার। ডায়েরির রুল টানা কাগজের মাঝ বরাবর তিনটা মাত্র লাইন,

" আমাকে এই পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। বাকি রাস্তাটুকুর দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। আপনাকে ওই লোকগুলোকে আবারও জবাব দিতে হবে জানি। আশা রাখছি সামলে নিবেন।"

এক পলকে তিনটি লাইন পড়ে নিয়ে আগের জায়গাতেই কাগজটা রেখে দিলো সাদাফ। শুভ্রতা চলে গিয়েছে জেনে কোনো ভাবাবেগ হলো না তার। যেন এমনটায় আশা করেছিলো সে। শুভ্রতার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে কাপড়গুলো ব্যাগে গুছিয়ে রাখতে রাখতে এই লোকগুলোকে কিভাবে ম্যানেজ করা যায় তাই ভাবছে সাদাফ। "মিথ্যা" খুবই ক্রিটিক্যাল একটি পার্ট। সত্যের মতো হুট করে থমকে দাঁড়াতে পছন্দ করে না মিথ্যা। সে আপন গতিতে এগিয়ে যায়। একবার মিথ্যা বললে সেই মিথ্যাকে শক্তপোক্ত করতে গুটি গুটি অসংখ্য মিথ্যের জন্ম দিতে হয়। তারপর সরে যেতে হয় সত্য থেকে অনেক দূরে। ব্যাগ গুছানো শেষ করে জানালা ভেদ করে আকাশের দিকে তাকায় সাদাফ। কি একটা অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে সে আর শুভ্রতা। কয়েকঘন্টার পরিচয়ে না চাইতেও স্বামী-স্ত্রীর মতো পবিত্র বন্ধনে বেঁধে গেছে তারা। অথচ,শুভ্রতার চেহারাটা ঝাপসাভাবেও মনে পড়ছে না সাদাফের। হয়তো কখনো পড়বেও না। দ্বিতীয়বারের মতো দেখাও হবে না আর। তাদের এই সম্পর্কের কথা জানতেও পারবে না কেউ। পৃথিবীর বুকেই রাতের অন্ধকারের সাথে ধামাচাপা পড়বে সব। কি অদ্ভুত এই পৃথিবী, কতোই না অপ্রকাশ্য, গোপন গল্প ধেবে আছে তার বুকে।সাদাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে তাকে। 


মাঘের মাঝামাঝি। শীতের তান্ডব শেষ হয়ে ফাল্গুনী রঙে সাজতে প্রস্তুত প্রকৃতি। তবে ঢাকায় গ্রীষ্ম,বর্ষা,শীত ---- এই তিন ঋতু ভিন্ন অন্যকোনো ঋতু বোঝার উপায় নেই। পহেলা ফাল্গুনে বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ে রাস্তাঘাট,পার্ক,রেস্টুরেন্টে মেয়েদের বহর না ছুটলে ফাল্গুন মাসের খোঁজটাও ঠিকঠাকভাবে জুটে না সাদাফের। বনানীর আট তলা এপার্টমেন্টের সাত তলায় বসে ফাগুনের সুবাসটাও খুব একটা পায় না সে। অফিসের এতো ঝঞ্জালের ভীরে ঋতু গুণার সময় আছে নাকি তার? তবুও বর্ষাটাকে বেশ মনে পড়ে। এই বর্ষার এক রাতেই তো ঘটে গেলো অদ্ভুত এক ঘটনা। কাজের অবসরে দু -তিন মাস অন্তর হুটহাট সেই রাতটার কথা মনে পড়ে সাদাফের। খানিকবাদে ভুলেও যায়। মাঝেমাঝে নিজের মনে হাসে আর ভাবে, তারও একটা বউ আছে। অন্ধকারে ঢাকা বউ! শীতের সকালের মিষ্টি আমেজ কাটিয়ে কম্বল ঠেলে উঠে বসলো সাদাফ। কাঁচের জানালা ভেদ করে সোনালী রোদ এসে পড়ছে মেঝেতে। চারকোণা আকারের রোদ। রোদের এই চারকোনা রূপের কারণটা ঠিক ধরতে পারলো না সাদাফ। বিছানা গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। আড়চোখে ড্রয়িংরুমের ঘড়িতেও চোখ বুলালো ---- ৭ঃ২০। তাড়াহুড়ো করে চায়ের পানি গরম দিয়ে ডিমের অমলেট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কড়াইয়ে তেলটা গরম হয়ে আসতেই কোকিলের ডাক কানে এলো। একবার,দুবার, তিনবার। কোকিলের ডাক কানে যেতেই দরজার দিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সাদাফ। দরজার কলিংবেলের আওয়াজটা শুনে মাঝে মাঝে নিজেই কনফিউজড হয়ে পড়ে সে। অবিকল সত্যিকারের কোকিল! দরজা থেকে চোখ ফিরিয়ে দক্ষ হাতে অমলেট করা শেষ করলো সে। চুলো নিভিয়ে দরজার দিকে এগোলো। দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো আরাফ। সাদাফ দরজা খুলতেই দাঁত কেলিয়ে হাসলো সে। সাদাফ বিরক্তি নিয়ে সরে দাঁড়ালো। ব্রেকফাস্ট রেডি করতে করতে বললো,

---" কাহিনী কি? এত্তো সক্কাল সক্কাল আমার বাসায় হানা দেওয়ার একজেক্ট কারণটা কি?"

আরাফ দাঁত বের করে হাসলো। হাসার সাথে সাথেই বামদিকের অসম্ভব ত্যাড়াব্যাকা দাঁতগুলো মুহূর্তের জন্য ঝিলিক দিয়ে উঠলো। হাতে একটা পাকা টমেটো তুলে নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বললো, 

---" অফিস যাবি নাকি দোস্ত?" 

সাদাফ স্থির দৃষ্টিতে তাকালো।সাদাফ যে সাড়ে আটটার মধ্যে অফিসের জন্য বেরিয়ে যায় , আরাফ তা জানে। নিশ্চয় এই কথাটা বলতে এতো সকালে বাসায় আসে নি সে? সাদাফের চাহনী দেখে খানিক হাসার চেষ্টা করলো আরাফ। তবে লাভ বিশেষ হলো না। সাদাফকে সে ভালো করে জানে, এভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলতে গেলেই ক্ষেপে যায় সে। তারপর তার হাতের সেই মাইর। উফফ! পুরাতন স্মৃতি আওড়িয়ে আসল কথা পাড়লো সে,

---" আসলে দোস্ত। আজ সন্ধ্যায় কি তুই ফ্রী?" 

সাদাফ ভ্রু নাচিয়ে বললো,

---" কেন বল তো?" 

---" না মানে। আম্মা আসছে।"

সাদাফ ভ্রু কুঁচকে বললো,

---" তোর মা আসছে তো আমি কি করতাম?"

আরাফ ইতস্তত গলায় বললো,

---" না মানে। মেয়ে দেখতে যাবো।" 

সাদাফ বাঁকা হেসে বললো, 

---" বিয়ে করবি নাকি মামু?"

আরাফ লাজুক হাসি দিয়ে বললো,

---" বিয়ার বয়স হইছে না? এখনও বিয়ে না করলে তো ঝামেলা। তুমি তো মামা বিয়ের নামটাও মুখে নেও না। তোমারে ফলো করতে গেলে তো নির্ঘাত চিরকুমার থাকা লাগবো দোস্ত।" 

সাদাফ মৃদু হাসলো। চেয়ার টেনে বসে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিতে নিতে বললো,

---"বেশ তো, কর বিয়ে।" 

তাড়াহুড়ো করে সাদাফের মুখোমুখি বসলো আরাফ। মুখ কালো করে বললো,

---" বিয়ে কর বললেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না। বিয়ে করতে হলে আগে মেয়ে দেখতে হয়, পছন্দ করতে হয় তারপর না বিয়ে। আমি কিছু জানি না তুই আমার সাথে মেয়ে দেখতে যাচ্ছিস, ব্যস। বুঝিসই তো দোস্ত, ফার্স্ট টাইম! মেয়ের সামনে গিয়ে নার্ভাস হয়ে গেলে ঝামেলা না?" 

সাদাফ ভ্রু কুঁচকে বললো,

---" বাসর ঘরেও তো ফার্স্ট টাইমই যাবি তখন নার্ভাস লাগবে না? নাকি তখনও সাথে নিবি আমায়?" 

আরাফ আমতাআমতা করে বললো,

---" পেঁচাও কেন দোস্ত? তুমি আমার জন্য এইটুকু করতে পারবা না? তোর জন্য সারাটা জীবন কতো কিছু করছি আমি। আর আজ..."

সাদাফ কপাল কুঁচকে বললো, 

---" হইছে আর সেন্টি খায়ও না, মামা। তুমি আমার জন্য বহুত করছো। আমারে বিপদের মধ্যে ফেলে নাক ডেকে ঘুমাইছো তা কি ভুলে গেছি আমি? কেয়ারলেস!" 

আরাফ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। মুখটা ছোট করে বললো, 

---" ওমন করোছ কেন? সেইদিন এলার্জির টেবলেট খেয়েছিলাম বলেই না ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নয়তো তোরে বিপদে রেখে কি আমি ঘুমিয়ে পারতে পারি, বল?তাছাড়া সেই ৭/৮ মাস আগের কথা এখন কেন টানছিস বল তো?" 

সাদাফ জবাব দিলো না। ব্রেকফাস্ট শেষ করে রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,

---" অফিসে কাজের চাপ। ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে যাবে।" 

সাদাফের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে নাছোড়বান্দা গলায় বলে উঠলো আরাফ,

---"প্লিজ দোস্ত। চল না। একটু ম্যানেজ কর। দোস্ত..."

সাদাফ বিরক্ত গলায় বললো, 

---" তুই ভালো করেই জানিস মেয়ে দেখা বিষয়টা একদমই পছন্দ নয় আমার। তারপরও জোর করছিস কেন, বল তো?" 

আরাফ বাচ্চাদের মতো মুখ করে বললো,

---" তোর জন্য তো আর দেখতে যাচ্ছিস না। যাচ্ছিস তো আমার জন্য..."

সাদাফ অফিসের শার্ট গায়ে জড়াতে জড়াতে বললো,

---" পারবো না।" 

---" আম্মাও তোকে সাথে নিতে বলছে সাদাফ। আম্মা তোরে ছাড়া যাবে না দেখিস।" 

সাদাফ টাইয়ের নাট বাঁধতে বাঁধতে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললো। ডানহাতের কব্জিতে বড় ডায়ালের ঘড়িটা পড়তে গিয়ে বললো,

---" মেয়ের বাড়ি কই? কয়টাই যেতে হবে?" 

আরাফ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

---" বেশি দূর না তো...এইযে উত্তরা মডেল টাউনের পাশেই বাসা। সাতটা নাগাদ গেলেই চলবে। ডিনারের দাওয়াত দিয়েছে ওরা।" 

সাদাফ অদ্ভুত চোখে তাকালো। বিস্মিত গলায় বললো,

---" উত্তরা? বনানী থেকে উত্তরা খুব কাছে মনে হচ্ছে তোর? ডাফার একটা।" 

আরাফ বোকা হাসি হাসলো। জানালার কাঁচ ভেদ করে আসা রোদে আবারও ঝিলিক দিয়ে উঠলো তার বাঁকা দাঁত।

____________________

কলিংবেলের প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো শেফার। ঘুমুঘুমু চোখটা কয়েকবার পিটপিট করে আবারও উপুর হয়ে শুয়ে পড়লো সে। খানিকবাদে আবারও সেই বিরক্তিকর শব্দ। শেফা বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে বিছানায় উঠে বসলো। গায়ের টি-শার্টটা টেনে ঠিক করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো সে। এলোমেলো চুলগুলোকে হাতখোপা করতে করতে দরজার ফুটোই চোখ রাখলো। ফুটো থেকে চোখ সরিয়েই তাড়াহুড়ো করে দরজা খুললো শেফা। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ২০/২১ বছরের তরুনী। গায়ে লেমন কালারের টপস আর ব্ল্যাক স্কার্ট। গলায় ঝুলছে বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রনে তৈরি পাতলা ওড়না। গায়ে জড়ানো কালো রঙের শাল। মেয়েটাকে দেখেই উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠলো শেফা। দু'হাতে শক্ত করে চেপে ধরে বললো,

---" হোয়াট আ প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ শুভ্রতা। তুই হঠাৎ?"

শুভ্রতা মৃদু হেসে বললো, 

---" উফফ্ আপু। মেরে ফেলবে নাকি? ছাড়ো তো।" 

শেফা শুভ্রতাকে ছেড়ে সরে দাঁড়াতেই ভেতরে ঢুকলো শুভ্রতা। কাঁধের ব্যাগটা সোফায় রাখতে রাখতে বললো,

---" খালামনি কই আপু?" 

শেফা সোফায় পা তুলে আরাম করে বসলো। শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,

---" মা তো ছোট ফুপির বাসায় গেছে। দুপুরের দিকেই চলে আসবে। ছোট খালামনি কেমন আছে রে?"

শুভ্রতা গায়ের শালটা খুলে রাখতে রাখতে বললো,

---" সবাই ভালো আছে। আগে বলো ব্রেকফাস্টে কি আছে। প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে, আপু । না খেয়েই বেরিয়ে এসেছি, বুঝলে?তাড়াতাড়ি খেতে দাও তো... "

শেফা সন্দেহী চোখে তাকালো। আগ্রহ নিয়ে বললো,

---" না খেয়ে বেরিয়ে এসেছিস মানে? পালিয়ে এসেছিস নাকি?" 

শুভ্রতা কঠিন চোখে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো,

---" পালাবো কেন? আর পালালে ঢাকার বাইরে না গিয়ে ধানমন্ডি থেকে উত্তরায় কেন আসবো? তাও আবার বড় খালামনির কাছে? পাগল?" 

শেফা হেসে বললো,

---" তোর তো পালিয়ে বেড়ানোর ধাঁচ আছে, তাই বললাম। বিয়ে করবি না বলে এতো দৌড়াদৌড়ির কি আছে? এর থেকে একটা ছেলে পছন্দ করে বিয়ে করে ফেললেও তো পারিস। ছোট খালু যেমন মানুষ তোকে কিচ্ছুটি বলবে না।" 

শুভ্রতা প্রতিউত্তরে নিশ্চুপ বসে রইলো। শেফা আরেকটু আরাম করে বসে সামনের দিকে সামন্য ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বললো,

---" সত্যি করে বল তো, তোর কি সত্যিই কোনো বিএফ নেই ? মানে সেইম এইজ রিলেশনশিপ টাইপ কিছু?" 

শুভ্রতা মুখ বাঁকিয়ে বললো,

---" তুমি একটু বেশিই ভাবো আপু।" 

শেফা হতাশ গলায় বললো,

---" তো? বারবার পালাস কেন?"

---" বারবার কোথায় আপু? সেই তো সাত/আট মাস আগে মামুর সাথে রাগারাগি করে চলে এলাম। তারপর আর কবে পালিয়েছি আমি?" 

---" এরপর বিয়ের কথা হয়নি বলেই পালাস নি। নয়তো ঠিক পালাতি। ওটা নিয়ে দু'দুবার এ কান্ড করেছিস তুই। কি লাভ হয় বল তো? আমি হলে তো নেচে নেচে বিয়ে করে ফেলতাম।" 

শুভ্রতা মৃদু হেসে বললো,

---" আম্মুর জন্যই তো এমনটা হয়। বাবা তো চাইছে না বিয়ে দিতে। তাহলে এতো বাড়াবাড়ি কেন? তাছাড়া, আমার ইচ্ছে পুরো বাংলাদেশ চষে বেড়ানোর। স্বাধীন চোখে সবটা দেখা। এইসব আবালদের বিয়ে করে দু'তিন বছরে দুই তিনটা বাচ্চা ফুটিয়ে চুলো গুঁতোতে বলো আমায়? কখনো নয়। নেভার।"

শেফা হেসে ফেললো। শুভ্রতাকে বেশ বোকা বলে মনে হয় তার। এতো ভালো ভালো পাত্রকে কেউ এই ঠুনকো কারণে রিজেক্ট করে? শেফা তো কখনো করতো না। কি আছে এই বাংলাদেশে? যা দেখার জন্য এতো পাগলামো শুভ্রতার। "প্রকৃতি" নামক ভারি শব্দটা বোধগম্য হয় না শেফার। তারকাছে তো বিয়ে,বর, বাচ্চা এই নিয়েই জীবন। সুখী জীবন! এবার একটা মনের মতো ছেলে পেলেই হলো তার। আর কি চাই? শেফার ভাবনার মাঝেই বলে উঠলো শুভ্রতা,

---" শীতের শেষের দিকেও কি ভীষণ ঠান্ডা পড়েছে দেখেছো,আপু? রাস্তায় যা একটু রোদ আছে ঘরে তো একদম কাঁপা-কাঁপি অবস্থা।  আচ্ছা? খালামনি হঠাৎ জরুরি তলবে ডেকে পাঠালো কেন বলো তো? সিরিয়াস কিছু?"

শেফা অবাক হয়ে বললো,

---" মা ডেকে পাঠিয়েছে তোকে?" 

শুভ্রতা মাথা নেড়ে বললো,

---" কেন, জানো না তুমি?" 

---" না তো। আমায় তো কিছু বলে নি। সকাল থেকে তো বাজারপাতি নিয়েই ব্যস্ত ছিলো। কাহিনী কি বল তো?"

শুভ্রতা হতাশ চোখে তাকালো। 


Writer:- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner