বিয়ের ঠিক একসপ্তাহ আগে রোড এক্সিডেন্টে আমার হবু বর আদিবের পা-দুটো পঙ্গু হয়ে যায়। ডাক্তার বলে দেয়,"পা দুটো ঠিক হবে কি-না, তার নিশ্চয়তা নেই;হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। না হওয়ার চান্সই বেশি। " একথা শুনে আমার পরিবার সরাসরি এ বিয়ে ভেঙে দেয়।
পরিবারের এ সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। আমাদের চার বছর প্রনয়ের পর বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে দুই পরিবারকে মানিয়েছি বিয়ের জন্য।এর মধ্যে আদিবের এক্সিডেন্ট হওয়ায় আমার পরিবার বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে। বড় ভাইয়া সবাইকে বলে বুঝিয়েছে-"আবেগের কারনে তিশা এখন আদিবকে বিয়ে করতে চাইছে সারাজীবন আদিবের সেবা-যত্ন করতে পারবে না। "
সবাই ভাইয়া কথাটাকেই মূল্য দিয়ে আমার বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে।
আমার পরিবারের সিদ্ধান্ত শুনে হাসপাতালের বেডে শুয়েই আমার হবু বর আদিব বলেছ
--তিশা যদি নিজের মুখে একথা বলে তাহলে আমি দ্বিতীয়বার তিশাকে বিয়ে করার দুঃসাহস করব না।
এদিকে আমার ভাইয়া আদিবের মুখের ওপর বলে দিয়েছে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে তিশা বিয়ে করবে না।আমি পড়েছি মহা ফ্যাসাদে।এদিকে আমার ভালোবাসা, আরেকদিকে আমার পরিবার। বড় ভাইয়া আবার আরেক জায়গায় আমার বিয়ে ঠিক করেছে। এতো বড় বিপদের মধ্যে আদিবকে ফেলে
আমি অন্য কারো সংসার করতে পারব না।
অনেক কষ্টে মাকে বুঝিয়েছি।এখন মা সবাইকে বোঝাতে পারলেই হয়। কোনকিছুতেই আমার মন বসছে না। এরমাঝেই বাবা আমার রুমে এলেন।
আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
--মা রে, কোনো বাবা-মা তার সন্তানের খারাপ চায় না।সবাই চায় তার সন্তান সারাজীবন সুখে থাকুক।
আমিও চাই তুইও জীবনে সুখে থাক।তোর মায়ের
থেকে আমি আজ সব শুনলাম। তুই যদি আদিবকে বিয়ে করে সুখী থাকিস তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস ভেবে নিয়েছিস তো?
--হ্যাঁ,বাবা।সব ভেবে-চিন্তেই বলেছি।
--আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে আগের তারিখেই তোদের বিয়ে হবে।আমি আদিবের পরিবারের সাথে কথা বলছি।
বাবার কথা শুনে আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম।
.
.
.
অবশেষে আমার জীবনে বিয়ের দিনটা ঘনিয়ে এলো। পার্লার থেকে মেয়েরা এসে আমাকে বৌ সাজাচ্ছে।আমরা মনটা আজকে অনেক খারাপ।আজকে সবাইকে ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাব।এ কয়টা দিন বড়ভাইয়া-ছোটভাইয়া কেউ আমার সাথে কথা বলে নি। বাবাও প্রয়োজন ছাড়া কোন কথা বলে নি। তবে বিয়ের অনুষ্ঠানের ডেকোরেশনে কোন কমতি রাখে নি। পরিবারের সকলের ইচ্ছে ছিল, তাদের একমাত্র মেয়ের বিয়ে অনেক ধুমধাম করে দিবে। বিয়েটা আমার ইচ্ছাতে হলেও তারা কোনকিছুর কমতি রাখে নি।আত্মীয়-স্বজন,পাড়া-প্রতিবেশীরা আমাকে নিয়ে কানাঘুষা করছে- দুনিয়ায় এতো ছেলে থাকতে আমি কেনো সেচ্ছায় পঙ্গু ছেলেকে বিয়ে করছি।আরো অনেক হাবিজাবি কথা-বার্তা।
বরযাত্রী চলে এলো। কিন্তু আমার বর এলো না। সকলের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে আমাকে বিদায় দেওয়া হলো।আমি দুই ভাইয়াকে জড়িয়ে অনেকক্ষন কাঁদলাম। এতোদিন তারা আমার সাথে কথা না বললেও বিদায়ের বেলায় আমাকে ধরে তারাও অনেকক্ষন কাঁদলো। বর ছাড়াই আমি বিয়ের গাড়িতে উঠলাম। আমিই মনে হয় একমাত্র মেয়ে,যে কিনা বর ছাড়াই শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি।
আর পাঁচটা মেয়ের মতো আমারও খুব স্বপ্ন ছিল,
ঘোড়ায় চেপে বর আসবে।বিয়ে করে ঘোড়ায় চড়ে শ্বশুরবাড়ি যাবো।কিন্তু আমার স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেল।
শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর শ্বাশুড়িমা আমায় বরণ করে ঘরে তুললেন। বসার ঘরে ঢুকে দেখি আদিব হাসিমুখে শেরওয়ানী-পাগড়ী পড়ে হুইলচেয়ারে
বসে আছে। আমায় দেখে একটা মুচকি হাসি দিল।
ওর হাসি দেখে আমারও অনেক খুশি লাগলো।
এরপর কাজি এসে আমাদের বিয়ে পড়ানো শুরু করলো। তিনবার কবুল পড়ে দুজন একই বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলাম।
এরপর চললো আমাদের কয়েক দফা ফটোসেশান। ছবি তোলা শেষে ফ্রেশ হয়ে দুজনেই বাসরঘরে গেলাম।
ঘরে ঢুকেই আদিবের পা ধরে সালাম করলাম। আদিব হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
--আরে,,আরে,, কি করছো তুমি?পায়ে হাত দিচ্ছো কেনো?
আমি মুখ ভেংচে উত্তর দিলাম,
--কেনো সিনেমায় দেখো নি বাসরঘরে বরকে বৌ সালাম করে?
আমার কথা শুনে আদিব হাহা করে হেসে দিলো।তারপর আমার হাত দুটো ধরে বললো,
--চারবছর ধরে আমাকে যেমন ভালোবাসছো আগামী দিনগুলোতেও ঠিক সেরকমই ভালোবেসো...
আমাকে কখনো একা করে যেও না। তুমি ছাড়া আমি যে আমি যে বড্ড অসহায়।
--তুমি এতোদিন আমাকে এই চিনেছো?
--না..না..আমি তা বলি নি।মাঝে মাঝে দেখি এত বছরের ভালোবাসার বিয়ের পরও ভেঙে যায় সামান্য থেকে সামান্যতম কারনে।
আর তার ওপর আমি হচ্ছি পঙ্গু, সকলের বোঝা।
খেয়াল করলাম কথাগুলো বলতে বলতে আদিবের
চোখে পানি এসে পড়েছে। সাবধানে আমার কাছ থেকে পানি আড়াল করতে চাইছে।আমিও না দেখার ভান করে ওকে বললাম,
--আমাকে যখন কেউ বিশ্বাস করে,ভরসা করে
তখন আমি তাকে বিশ্বাসের মূল্য রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। আর কখনো নিজেকে তুমি পঙ্গু বলবেনা
তুমি আমার হাজবেন্ড, আমার মাথার তাজ।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি তোমার সাথে কাটাতে
চাই।
.
.
.
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দুজনেই ফ্রেশ হয়ে নিচে নাস্তা করতে গেলাম। সেখানে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম ননদী দেবরদের সাথে। পাশের বাড়ির কিছু মানুষ আমাকে দেখতে আসছে। নতুন বউ বলে কথা। সবাই বেশ ভালো কথা, দোয়া করছিল আমরা যাতে অনেক সুখী হই,সারাজীবন একসাথে থাকি।এসব কথা শুনে বেশ ভালোই লাগছিল। কিন্তু একজনের কথা শুনে আমি পুরোই থ! মানুষের চিন্তা ভাবনা এতো নিচু হয় কীভাবে? সম্পর্কে তিনি আমার দূরসম্পর্কের চাচী শাশুড়ী। তিনি আমাকে বলেন,
--দেখতে মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর তুমি বৌমা। শুনলাম তোমার বাপের বাড়িও অনেক ধনী।তা আদিবের মতো পঙ্গু ছেলেকে বিয়ে করলা কেন?
ওতো কোন ভালো চাকরিও করেনা। পঙ্গু হওয়ার পর মনে হয় চাকরীটাও গেছে। ওর বাপ-ভাইয়ের টাকায় আর কয়দিন চলবা?
আমার তো মনে হয় তোমারও কোন সমস্যা আছে?
নাহলে তোমার বাপ-মা জেনেশুনে পঙ্গু ছেলের কাছে এতো সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে দেয়?
ওনার কথা শুনে আমার রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। মনে চাচ্ছে মুখের ওপর উত্তর দিয়ে দিই। কিন্তু ভদ্রতার জন্য কিছু বললাম না। প্রথমত,তিনি বয়স্ক, দ্বিতীয়ত আমি ঘরের নতুন বউ।নিজেকে শান্ত রাখলাম।আমার পাশ থেকে আদিব উত্তর দিল,
--চাচি আপনি ঠিকই ধরেছেন।আর ওর সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই।কারন আপনাদের বৌমা বোবা-বধির আপনার কথা শুনলেও বুঝবে না।
মা এজন্যই এমন আমার জন্য এমন বৌ এনেছে যাতে আমার সেবাযত্ন করতে করতে বিরক্ত হলেও
মুখে যাতে বলতে না পারে।
আদিবের মুখে এমন উত্তর শুনে আমি ভীষণ হাসি পেলো। আদিবের কথা শুনে চাচি ক্ষেপে গিয়ে বললেন,
--আমার সাথে তুই মশকরা করিস? তোর বৌ যে বোবাকালা না তা আমি জানি। কাল বিয়ে করতে না করতে আজই বৌয়ের চামচামি করছিস, না জানি কয়েকদিন পর তোর মায়ের কি হয়?
--এখানে চামচামির কি দেখলেন চাচি? আপনি তিশাকে প্রশ্ন করছিলেন,ওর উত্তরটা আমি দিয়ে দিলাম।
-- বৌ নিয়ে এত বাহাদুরি করিস না,দেখিস তোর এত সুন্দর বউ তোকে রেখে পরপুরুষের সাথে ভাগবে।
--চাচি মুখ সামলে কথা বলেন।(রেগে গিয়ে)
আদিব আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল আমি চোখের ইশারায় নিষেধ করলাম। এরপর শাশুড়ীমা এসে আমাদের রুমে পাঠিয়ে দিল বৌভাতের জন্য রেডি হতে। বৌভাত খুব বেশি বড় করে হবে না।ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে ঘরোয়াভাবে হবে।
সাজগোজ করে আমাদের দুজনের রেডি হতে
হতে দুপুর হয়ে গেলো। আমাদের বাড়ি থেকে
বাবা, দুই ভাইয়া কেউ আসলো না।আমাদের নেওয়ার জন্য শুধু মেজ মামা,ছোট মামা, ফুপা আর কয়েকজন বাচ্চা পাঠিয়েছে।
আমার পরিবারের কেউ না আসায় আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বেশ রেগে গেল।
আমার শ্বশুর, আদিব আমাকে রুমে নিয়ে এসে যা বলল তাতে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।আমার দুচোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল।
চলবে...
Writer:- নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)