আমার পরিবারের কেউ না আসায় আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বেশ রেগে গেল।
আমার শ্বশুর, আদিব আমাকে রুমে নিয়ে এসে যা বলল তাতে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।আমার দুচোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল। আমার শ্বশুর অনেকটা রেগেই আমাকে বলল,
-- বৌমা মানছি আদিবের সাথে তোমার পরিবার তোমাকে বিয়ে দিতে চায় নি, তাই বলে আমাদের আত্মীয় স্বজনদের সামনে এভাবে মাথা নিচু করাবে।
যেখানে সবাই জানতে চাইছে মেয়ের বাবা, ভাইয়েরা কই, তাদের সাথে পরিচিত হতে চাই সেই আমি কি উত্তর দিব তাদের তুমিই বলে দাও? বিয়েটা যেহেতু হয়ে গিয়েছে সেখানে এতো সিনক্রিয়েট করার কি আছে? যেহেতু তোমার পরিবারই প্রথম নাটক শুরু করেছে তাহলে আমরা বাদ যাব কেনো?
শোনো বৌমা, আজকে তোমার সাথে আদিব তোমাদের বাড়ি যাবে না। আর তুমি তোমার মামাদের সাথে চলে যাও।যেদিন তোমার পরিবার মানবে সেদিন ফিরে এসো এবাড়িতে তার আগে নয়।
কথাগুলো বলে শ্বশুর আব্বা চলে গেলেন। আদিব
স্তব্ধ হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।আমি ওর
দুবাহু ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলাম,
--আমি কি করবো আদিব? বলো...
সবাই আমাকে ভুল বুঝছে। তুমি প্লিজ আমার
সাথে আমাদের বাড়ি চলো, দেখবে সব ঠিক হয়ে
যাবে।
--দেখো তিশা আমার নিজের একটা আত্মসম্মানবোধ আছে। একমাত্র তোমাকে ভালবাসি বলে তোমাকে বিয়ে করেছি, না হলে কখনোই এত অপমানের পর বিয়ের করতাম না।এখন বলতেই পারো, আমি পঙ্গু মানুষ তুমিই আমাকে করুনা করে বিয়ে করেছো।আর তুমি যদি ভেবে থাকো তুমি আমাকে বিয়ে করেছো সেটা আমার সাত কপালের ভাগ্য তাহলে সেটা ভুল। তুমি হয়ত জানো না তিশা
বিয়ের প্রথম থেকেই তোমার বড়ভাই,বাবা আমাকে যা ইচ্ছে তাই অপমান করে যাচ্ছে। তোমার বড়ভাই বলেছে তোমাকে গলা টিপে মেরে ফেলবে তবুও
আমার মত পঙ্গুর কাছে বিয়ে দিবে না। একটা এরপর যখন বিয়ে পুরোপুরি ঠিক হলো তখন আমাকে শর্ত দিলো আমার মতো পঙ্গু ছেলেকে তারা বাড়ির জামাই হিসেবে মানতে পারবে না তাই নিজের বিয়েতে বরযাত্রীতে বর-ই যেতে পারে নি।
--কিহ??? বাবা,বড়ভাইয়া,ছোটভাইয়া ওনারা তোমাকে বিয়েতে যেতে নিষেধ করেছিল?
কিন্তু ওনারা যে বলল তুমি বিয়ে করতে আমাদের
বাসায় যেতে পারবে না।
--হ্যাঁ, তোমাকে জানাতে নিষেধ করেছিল।আমাকে বলেছে আমি হুইলচেয়ারে বসে কখনো যাতে তোমাদের বাড়ি না যাই। আমি তাতেও রাজি ছিলাম।
আর আজ তোমার পরিবার কি করলো আমাদের সাথে? মেয়ের বৌভাতে তার পরিবারই আসলো না।এটা কি আমার জন্য অপমান না? এতোকিছুর পরেও তোমার যদি মনে হয়
তোমার সাথে আমার যাওয়া উচিত তাহলে আমি
যাব। আমি জানি আজকে তোমাদের বাড়ি গেলে আজও অপমান করবে তোমার বাবা-ভাইয়েরা।
--না কখনো না,যে বাড়িতে আমার হাজবেন্ডকে
অপমান করে সেই আমিও পা রাখব না। আর
তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি কখনো নিজেকে
পঙ্গু বলে ছোট করবেনা। আমি তোমার সবকিছু জেনেই তোমাকে বিয়ে করেছি।
আমি আদিবের চোখের পানি মুছে দিলাম। আমিও নিজের চোখের পানি মুছে ড্রয়িং রুমে গিয়ে মামাদের
সাথে বাসায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানালাম। তারপর মামারাও চলে গেলেন। শ্বাশুড়ি আম্মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আদর করলো।রুমে এসে
দেখি বড়ভাইয়া,ছোটভাইয়া অনেকগুলো কল দিয়েছে। আমি কল ব্যাক না করে তাদের ব্লক করলাম।ব্লক করার আগে তাদের একটা ম্যাসেজ দিলাম,
- - " তোমরা এতদিন আদিবের সাথে যা করেছো, তাতে তোমরা ঘৃণা পাওয়ার যোগ্য।যদি আমাকে বাসায় নিতে চাও, তাহলে তোমরা নিজে এসে আদিবের পরিবারের থেকে ক্ষমা চেয়ে আমাদের দুজনকে নিয়ে যেও।
যদি তা করতে না পার তাহলে কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করবে না। ভালো থেকো।"
ব্লক করে অনেকক্ষন কাঁদলাম। তাদের সাথে আবার কবে দেখা হবে জানি না।
আমি জানি আমার পরিবারের আত্মসম্মানবোধ অনেক বেশি। তারা কখনোই ক্ষমা চেয়ে আমাদের ফিরিয়ে নিতে আসবেনা।
তাদের প্রতি সকল আশা মাটিচাপা দিয়ে নিজের কাজে মন দিলাম।
.
.
.
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে এর মাঝে। আমার পরিবার থেকে কেউ আসে নি। এমন কি কেউ অন্য নাম্বার দিয়ে
একটাবার কলও করে নি। তাদের কথা না শুনে আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করেছি বলে
এতো ক্ষোভ,এতো রাগ থাকবে!
আদিবের পরিবারের সাথে ভালোই দিন কাটছে। ভেবেছিলাম আমার পরিবারের খারাপ ব্যবহারের
জন্য শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমার সাথে মিশবে না।কিন্তু না,সবাই আমাকে ভীষণ আদর করে ছোট বৌ হিসেবে। আদিবের বাবা-মা, বড় দুই ভাই,ভাবী
আমার ছোট ননদ সবাই আমাকে অনেক
ভালোবাসে। তবে মাঝে মাঝে
আমার পরিবারের কথা, মায়ের কথা বেশি মনে পড়ে।
বিয়ের পর থেকে আশেপাশের লোকজনের কানাঘুষা
বেড়েই চলছে। আমি কেন আদিবকে বিয়ে করলাম?এ নিয়ে লোকজনের মাথাব্যথার কমতি নেই।
তাদের কথা শুনতে শুনতে আমি একপ্রকার হাঁপিয়ে
উঠেছি।
আমি জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে যেকোনো কিছুর
বিনিময়ে হলেও আদিবকে সুস্থ করে তোলা আর লোকজনের মুখ বন্ধ করা।
আদিবকে ডাক্তারের কাছে এসেছি ওর পায়ের চিকিৎসা করাতে। আমার বিশ্বাস একদিন না
একদিন আদিব ঠিকই সুস্থ হবে।নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কিন্তু ডাক্তার রির্পোটগুলো দেখে
যা বলল তা শুনে আমার আশার আলো নিমেষেই
অন্ধকারে ডুবে গেলো.........
আদিবকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছি, ওর পায়ের চিকিৎসা করাতে। আমার বিশ্বাস একদিন না
একদিন আদিব ঠিকই সুস্থ হবে।নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কিন্তু ডাক্তার রির্পোটগুলো দেখে
যা বলল তা শুনে আমার আশার আলো নিমেষেই
অন্ধকারে ডুবে গেলো।
ডাক্তার বলল-- " আপনার হাজবেন্ডের পা দুটো সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এক্সিডেন্টে পায়ের
রগগুলো বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঠিক হওয়ার চান্স ১০% এবং ৯০% ই অনিশ্চয়তার মধ্যে।
আমি হন্তদন্ত হয়ে বললাম-- "১০% চান্স তো আছে? এটাই অনেক। আল্লাহ চাইলে নিশ্চয়ই আদিব সুস্থ হবে।
--হ্যাঁ, যদি পা ঠিক হয় তাহলে বলা যাবে অলৌকিকভাবে। আপনারা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন। পা দুটো ঠিক হলে হতেও পারে।
ওনাকে নিয়মিত ঔষধ খাওয়াবেন,পায়ের বিশেষ
যত্ন নিবেন। মাঝেমধ্যে একটু দাঁড়া করানোরও চেষ্টা
করবেন। ইনশাআল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবে।
--ধন্যবাদ ডক্টর।
আদিবকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে ফিরে আসলাম। ডাক্তারের কথা শুনে আমার মনটা একেবারে ভেঙে গিয়েছে। আদিবের দিকে তাকিয়ে
দেখি ওর মুখটা ভার হয়ে আছে। আদিবের দিকে
তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বললাম,
--আরে বোকা ছেলে, মুখটা এমন ভার করে রেখেছো কেনো? ডাক্তার তো বললই এখনো ১০%
চান্স আছে সুস্থ হওয়ার , তাহলে আর চিন্তা কি?
--তিশা আমার জন্য তোমার কত কষ্ট হয় আমি জানি। আমার সেবাযত্ন করতে হয়,লোকজনের কটুকথা শুনতে হয়।
--আমি কি একবারও বলেছি আমার কষ্ট হয়? আর লোকজন কি বলে তা শুনে আমার কাজ নেই।চলো
ওই যে ফুচকার স্টল আছে সেখানে গিয়ে ফুচকা
খাই।
--না তিশা আমার ভালো লাগছে না।বাসায় চলো।
ওর মুখে হাসি ফুটানোর জন্য আমিও একটু মজা করে বললাম,
--বিয়ের আগে তো কত বলতা, একবার বিয়েটা
হয়ে নেক তারপর আর লুকিয়ে না সকলের সামনে বসে ফুচকা খাব।এখন কি প্রেমিকা নই বলে আমার
কদর কমে গেছে?
--আরে না,চলো... (হেসে দিয়ে)
অনেকদিন পর দুজনে একসাথে বসে তৃপ্তির সাথে ফুচকা খেলাম। সেখানেই বসে বসে আরো কিছুক্ষন
গল্প করে বাসায় চলে আসলাম।
.
.
.
এর মাঝে এক মাস কেটে গেছে। আদিব চাকরীর
প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাশাপাশি অনলাইনে একটা জব করছে। ওর পায়ের যত্ন বিশেষভাবে করছি, যদিও
অবস্থার তেমন উন্নতি নেই।তবে আমিও এত
সহজে হাল ছাড়ার মেয়ে না। আল্লাহর কাছে মনেপ্রানে আদিবের সুস্থতার জন্য দোয়া করছি,আমার বিশ্বাস আল্লাহ আমাকে নিরাশ করবে না।
ঘরের টুকটাক কাজ করছি। আমার ছোট ননদ এসে
বলল, আমার মা নাকি আমাকে দেখতে এসেছে।
মায়ের কথা শুনে চোখে পানি চলে এলো।আমি তাড়াতাড়ি বসার ঘরে গেলাম। গিয়ে দেখি মা বসে আছে। দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। কতদিন মাকে দেখি না,মাকে স্পর্শ করতে পারি না।
আমাকে জড়িয়ে মা-ও কেঁদে ফেললেন। মা আমাকে
বললেন,
--এতো জেদ তোর তিশা? মাকে ছাড়া এতোদিন থাকলি কীভাবে? একটাদিন ফোন পর্যন্ত করলি না।
মাকে জড়িয়েই বাবা,ভাইয়াদের সব কাহিনি বললাম। আমার কথা শুনে মা অনেক অবাক হলেন।আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম,
--মা, যদি বাবা এ বিয়েতে রাজিই না থাকেন তাহলে কেন এতো ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করলেন? তারপর আমার বৌভাতে না এসে শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে তাদের আত্মীয়দের সামনে
মাথা হেট করালেন?
-- তোর বয়স বেশি হয় নি তাই তুই অত বুঝিস না। আমরাও কিন্তু তোকে বিয়ে দিয়ে কম কথার সম্মুখীন হই নি। মানুষের কথা তীরের চেয়েও বিষাক্ত। মানুষের কথা তো আর আমরা আটকে রাখতে পারব না।
তোর বাবা ভেবেছিল তোর সাথে আদিবের বিয়ে না হলে তুই যদি আবার নিজের ক্ষতি করে বসিস তাই এ বিয়েতে মত দিয়েছিল। কিন্তু যখন লোকজন, আত্মীয় স্বজন তোকে নিয়ে খারাপ কথা বলছিলো-
তুই কেনো আদিবকে বিয়ে করছিস?কোন স্বার্থে? কোন লোভে? আরো নানা বাজে কথা। তখন তোর
বাবা রেগে গিয়ে সব দোষ আদিবের ওপর দিলো।
তিয়াশ (তিশার বড়ভাইয়া) ক্ষেপে গিয়েছিল। তাদের
ধারণা, আদিব আর ওর পরিবারের প্ররোচনায় তুই
ওদের পঙ্গু ছেলেকে বিয়ে করতে চাইতিস। তবে আদিবের সাথে খারাপ ব্যবহার করা মোটেও ভালো হয় নি।
-- মা,কারো প্ররোচনায় পড়ে আমি বিয়ে করি নি।তুমি অন্তত একথা বলো না।
-- তোর বাবা তো এটাও বলছে আজ যদি আদিবের জায়গায় আমার মেয়ে পঙ্গু হতো তাহলে কি
ওরা মেনে নিতো? কোনোভাবেই মেনে নিতো না।
তাহলে তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাদের ওপর রেগে থাকার কোনো কারণ নেই। তবে আদিবের আমাদের পরিবার সত্যিই অনেক খারাপ ব্যবহার করছে।
যাইহোক, তুইও আর রাগ করে থাকিস না,আজ বাড়ি চল।তোর বাবা- ভাইয়েরাও ভেতরে ভেতরে কষ্ট
পাচ্ছে। তোকে দেখলে অনেক খুশি হবে।
--না,মা। সেদিন যাই নি আর আজও যাব না। যেদিন বাবা-ভাইয়া আসবে সেদিন আমি ঠিকই যাব তার আগে না।
--তোর বাবা-ভাই কখনোই.....
মা আর পুরো কথাটা শেষ করতে পারলেন না, এর মধ্যেই আম্মা চলে আসলেন, সাথে দুই ভাবী নাস্তা
নিয়ে আসলেন।আমার শ্বাশুড়ি কোনোরকম কুশল
বিনিময় করে গেলেন। বুঝলাম মায়ের ওপর তিনিও
রেগে আছেন। ভাবীরা আবার মায়ের সাথে অনেকক্ষন গল্প করলেন তারপর আদিবের সাথেও কিছুক্ষন কথা বলে দুপুরের দিকে মা চলে গেলেন।
অনেকবার খাওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম
কিন্তু মা না খেয়েই চলে গেলেন। যাওয়ার সময় আমার জন্য মা শাড়ি আর ওর জন্য পাঞ্জাবি দিয়ে গেল।
আদিবের হাতে দিতেই ও পাঞ্জাবি খাটের ওপর কিছুটা ছুড়ে রাখল।আমি ওর দিকে তাকাতেই
আমার চোখের ভাষা বুঝে বলল,
--আমার অনেক পাঞ্জাবি আছে।এখন এটা পরব না।রেখে দাও।
আমি ওর কথা স্পষ্টই বুঝলাম, আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, রাগ আমার বাবা-ভাইয়ের ওপর থাকতে পারে।মায়ের উপহার দেওয়া পাঞ্জাবিটাকে এভাবে অবমাননা করা উচিত নয়।
আমার কথা শুনে ও কোন উত্তর দিল না।একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল।
পরিবারের জন্যও আমার ভেতরটাও যে পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে সেটা তো কেউ বুঝতে পারছে না।
.
.
.
বিকেলে ছাদ থেকে জামাকাপড় এনে রুমে আসতেই
আদিবকে দাঁড়াতে দেখে আমি খুশিতে একটা চিৎকার দিলাম।কিন্তু আমার খুশিটা বেশিক্ষন স্হায়ী হলো না......
চলবে...
Writer:- নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)