এই মুহূর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না কথাটা শোনা মাত্রই আমার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল।
আম্মা তখুনি কান্না শুরু করে দিল।বাড়ি জুড়ে সকলের কান্নার রোল পড়ে গেল.....
সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিল এখুনি লঞ্চঘাটে যাবে।সকলের সাথে আমিও গেলাম।বাসায় শুধু বড়ভাবী,রিনি আর আমার ছোট্ট ছেলেটা রইলো।আমাকে অবশ্য কেউ নিতে চায় নি। সবাই বলেছে আমার ছেলেকে দেখতে, আর কোন দুশ্চিন্তা না করতে। কিন্তু দুশ্চিন্তা না করতে বললেই তো আর দুশ্চিন্তা ছাড়া থাকা যায় না।আমি সকলের সাথে এক প্রকার জোর করেই গেলাম। আদিবের জন্য আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। দোয়া করছি যেভাবেই হোক আদিব যেন ফিরে আসে। টানা তিনদিনের ছুটি থাকায় রাস্তায় অনেক জ্যাম পড়লো।
সন্ধ্যার দিকে সিএনজি-বাসের সংঘর্ষের ফলে বহু মানুষ আহত হয়েছে। সেজন্য অর্ধেক রাস্তা বন্ধ।
আমরা কোনরকম লঞ্চঘাটে পৌঁছালাম। জানতে পারলাম বেশিরভাগ মানুষ উদ্ধার করা হয়ে গিয়েছে।
কাউকে জীবিত অবস্থায় আবার কাউকে মৃত।
একপাশে অনেকগুলো লাশ জড়ো করে রাখা হয়েছে। এখানে আসার পর ভয়ে আমার শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল। চারপাশে মানুষের কান্নার আহাজারিতে আমি নিজেই কাঁদতে ভুলে গেলাম।
মনে হচ্ছিল আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাব।নিজেকে অনেক কষ্টে দাঁড় করিয়ে রাখলাম। আদিবের বড়ভাই আর আমার বড়ভাইয়া দুজনে গিয়ে জড়ো করা লাশের মধ্যে খুঁজলো।সেখানেও আদিবকে খুঁজে পেল না। খোঁজ করে জানা গেল এখনো চার-পাঁচজনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। তাদের কথা শুনে আমাদের সকলের কান্নাটা বেড়ে গেল।
সকলে ধরেই নিলো ওই অজ্ঞাত লোকেদের মাঝে আদিবও আছে। আমার শাশুড়ী এই কথাটা শুনে পাগলের মতো আচরণ করা করল।তিনি রাস্তায় আদিবের বয়সী যাকে দেখছেন তাকেই বলছেন "আমার আদিব মরে নি ;আমার আদিব বেঁচে
আছে।এই তো আমার মানিক"
আমার শ্বাশুড়িকে অনেক কষ্ট করে বাড়ি আনা হলো। বাড়ি আসার পরে দেখি আত্মীয়স্বজন দিয়ে
বাড়ি ভরে গেছে। পুরো বাড়িতে মরা কান্না জুড়ে গেল। সকলে কাঁদছে, কেবল আমিই কাঁদছি না।এমনকি আমার দুধের শিশুটাও কাঁদছে।আর
আমি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছি।আমি বিশ্বাসই
করতে পারছি না আদিব যে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। অনেকেই আমাকে বলছে চিৎকার করে কাঁদতে।কাঁদলে মনটা হালকা হতো। কিন্তু
আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি,আর দুঃস্বপ্নটা ভেঙে গেলে আমি আবার আগের জায়গায় ফিরে যাব।আমার মাথাটা কেমন জানি ভার হয়ে আসছে,চারপাশে অন্ধকার হয়ে এলো। এরপর আর মনে নেই পরে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করি। বড়ভাবী আমার পাশে আছেন। বাবুকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছেন।আমাকে নড়াচড়া করতে
দেখেই বললেন,
--বোন আমার বাবুটা সন্ধ্যা থেকে কষ্ট পাচ্ছে। ওর দিকেও তো তোমার একটু খেয়াল রাখা উচিত। এখন গভীর রাত ওকে একটু বুকে জড়িয়ে আদর করো, ওকে খাওয়াও।যা হবার তা তবেই কেউ আমরা ফিরাতে পারব না। তুমি নিজেকে একটু শক্ত করো।
সত্যিই আদিবের চিন্তায় বাবুর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বাবুকে কোলে নেওয়ার পর বুক ফেটে কান্না আসল। জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদলাম।
.
.
.
পরদিন পুরো বাড়িতে থমথমে অবস্থা। বাড়ির আত্মীয়স্বজন, আমার বাড়ির সকলে চলে গিয়েছে।বড়ভাবী ছাড়া কেউ আমার সাথে কথা বলছে না।আমার শাশুড়ী কিছুক্ষন পরপর কাঁদছে আমাকে বকছে।আব্বা,আদিবের বড়ভাইও
আমার ওপর বেশ ক্ষিপ্ত। তাদের কথা অনুযায়ী আমি যদি আদিবকে লঞ্চে আসার পরামর্শ না দিতাম তাহলে আজকের এ দুর্দিন দেখতে হতো না। আমি কি কখনো জানতাম, লঞ্চটা ডুবে যাবে....
তাহলে তো কখনোই বলতাম না। বিকেল পর্যন্ত লঞ্চঘাটে অনেক খোঁজাখুজি করেও আদিবের কোন খবর পাওয়া যায় নি। আমি রুমে বসে বাবুকে ঘুম পাড়াচ্ছি আর আদিবের কথা ভেবে ভেবে নিরবে চোখের জল ফেলছি।হুট করে আমার শাশুড়ী রুমে ঢুকলেন। আমার কোল থেকে আমার ছেলেকে এক প্রকার কেড়ে নিলেন। আমি কিছু বুঝে উঠার আগে আমার চুলের মুঠি আমার গালে দুই-তিনটা থাপ্পড় দিয়ে বললেন,
--মুখপুড়ি অপয়া অলক্ষ্মী কোথাকার! আমার ছেলেটাকে খেয়ে এখানে বসে নাটক করছে। তুই আমার ছেলের জীবনে আসার পর আদিবের জীবনে সব অঘটন ঘটে যাচ্ছে। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে এক্সিডেন্টে পা দুটো হারাতে বসেছিল একমাত্র তোর কারনে। আর এখন আমার ছেলেকে খেয়ে ফেললি। কয়দিন পর দেখা যাবে আদিবের ছেলেটাকেও খেয়ে ফেলবি।আর তোকে এ বাড়িতে রাখব না।বের হ....
আমি কিছু বলার আগেই আমার চুল ধরে হিড়হিড় করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে সদর দরজা লাগিয়ে দিলেন, সবাইকে শাসালেন কেউ যাতে দরজা না খোলে।আমি অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কালাম, কেউ দরজা খুলল না। অনেক কাঁদলাম, দরজার বাইরেই বসে রইলাম। শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে।
গতকাল রাত থেকে অনেক ঝাপটা বয়ে গেছে আমার ওপর দিয়ে আমি আর সহ্য করতে পারছি না। রাত নয়টার দিকে আমার শ্বশুর কোন কাজে
বাইরে যাওয়ার জন্য দরজা খুললেন।তাকে দেখামাত্র
আমি তার পা জড়িয়ে অনেক কাঁদলাম। কিছু বলতে পারলাম না।কারণ কান্নার কারনে গলা বসে গেছে।
তিনি আমাকে অগ্রাহ্য করে চলে গেলেন।আর বললেন,
--তোমার শাশুড়ী যা করেছে একদম ঠিক করেছে।
আমার ছেলের এমন অবস্থার জন্য দায়ী একমাত্র তুমি।
আমার ছেলেই নেই তোমাকে রেখে কি করব? আর আদিবের ছেলে আমাদের কাছেই থাকবে।
আমি ওনার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম।মানুষ কুকুরের প্রতিও মায়া দেখায় কিন্তু ওনি আমাকে পা ঝাড়া দিয়ে ফেলে রেখে চলে গেলেন। তবুও আমি গেলাম না।দরজার সামনেই শুয়ে রইলাম। গভীর রাত কয়টা ঠিক আমি জানি না।তবে চারপাশ নিরব।
হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। দেখলাম বড়ভাবী আর ভাই। বড়ভাবী আমাকে জড়িয়ে ধরে
ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
--দেখেছো তোমার মা-টা কতো নিষ্ঠুর! এমন ভাব ধরছে যেন তিনি নিজেই একমাত্র ছেলের শোকে কষ্ট পাচ্ছেন, আর তিশা ওর বউ হয়ে ওর কোন কষ্ট নেই।কোনো মেয়ে কি চায় তার হাজবেন্ড মরে যাক? এটা যে একটা দূর্ঘটনা সেটা তোমরা কেউ বুঝতে চাইছো না। কালকে যাওয়ার সময় তো দেখলাম রাস্তায় এক্সিডেন্ট হয়েছিল সেখানে যদি আদিব থাকতো তখন কি তোমার মা এই মেয়েটার দোষ দিতো পারতো? আর তোমরা... তোমরাও মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে যাচ্ছো, কেউ মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস পাচ্ছ না।
ভাই কিছু বললেন না। চুপ করে ভাবীর কথাগুলো শুনে গেলেন। কথাগুলো বলে ভাবী আর ভাই আমাকে রুমে নিয়ে গেলেন। ঘড়িতে দেখলাম রাত একটা বাজে। আমার ছেলেটা রুশার (ভাবীর মেয়ে) সাথে ঘুমিয়ে আছে।
আমার জন্য ভাবী তাড়াতাড়ি খাবার গরম করে নিয়ে
আসলেন। আমাকে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন,
--মায়া-দয়া বলতে এদের মনের মধ্যে কিছু নেই।
বোন আমার, বড়বোন হিসেবে তোমাকে একটা অনুরোধ করি তুমি কালকে সকালেই তোমার বাপের বাড়ি চলে যাও। এখন হাজার চাইলেও বাবুকে তোমার কাছে দিবে না। কয়দিন পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আম্মাকে বুঝিয়ে বাবুকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিব।
এখন তুমি যতোই এখানে থাকার চেষ্টা করবে ততই তাদের হিংস্র আচরণের শিকার হবে।
ভাবীর কথা শুনে আমি তাকে ধরে কেঁদে ফেললাম।
.........
সকালে আমি ভাবীর রুমে বসে আছি।ভাই-ভাবী ছাড়া কেউ জানে না আমি যে এ বাড়িতে আছি।সকলে জানে আমি চলে গেছি।ভাবী বারবার আমাকে অনুরোধ করছে আমি যাতে আমার ভাইয়াদের কল করে আমাকে নিয়ে যেতে বলি। ছোটভাইয়া অবশ্য কল দিয়েছিল ভোরে আদিবের কোন খবর পাওয়া গেছে কি না জানতে!
আমার শ্বশুরবাড়িতে যে এতো কাহিনি হয়েছে সেগুলো বলি নি।শুনলে সাথে সাথে এসে আমাকে
নিয়ে তো যাবেই সাথে বাড়িসুদ্ধ সবাইকে কথা শুনিয়ে যাবে এই ভয়ে আমি কিছু বলি নি।আমি চাই না
এই শোকের সময় আমার জন্য আবার নতুন কোন ঘটনা ঘটুক। এই দুইটা দিনে আমার জীবনটা পুরোই ওলট-পালট হয়ে গেল।বারবার আদিবের সাথে বলা শেষ কথাগুলো কানে বাজছে-"আমি লঞ্চে উঠতে ভয় পাই। সাঁতার জানি না।"
হঠাৎ করেই আমার ফোনটা বেজে উঠল। দেখলাম আননোন নম্বর থেকে কল এসেছে। মন-মেজাজ এমনিতেই ভালো ফোনটা ধরার কোন ইচ্ছে ছিল না।
তবুও কলটা রিসিভ করলাম। রিসিভ করার পর
ওপর প্রান্তে থাকা লোকটা আমাকে আদিবের খবর জানালো......
হঠাৎ করেই আমার বেজে উঠল। দেখলাম আননোন নম্বর থেকে কল এসেছে। মন-মেজাজ এমনিতেই ভালো ফোনটা ধরার কোন ইচ্ছে ছিল না।
তবুও কলটা রিসিভ করলাম। রিসিভ করার পর
ওপর প্রান্তে থাকা লোকটা আমাকে আদিবের খবর জানালো......
--আসসালামু আলাইকুম, আপনি কি আদিব সাহেবের ওয়াইফ?
--জ্-জ্বি! কেনো? আদিবের কোন খবর পেয়েছেন?
--হ্যাঁ,আদিব এখন হাসপাতালে ভর্তি। আপনি কেমন ওয়াইফ উনার? দুইদিন ধরে হাজবেন্ড হাসপাতালে
রোড এক্সিডেন্ট করে মৃত্যুর সাথে লড়ছে আর আপনাদের কোন খবর নেই।আপনি হাসপাতালের ঠিকানা টেক্সট করে দিচ্ছি আপনারা এখুনি আসুন।
--হ্যাঁ..হ্যাঁ অবশ্যই।আমরা এখুনি আসছি।
ফোনটা রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আল্লাহর কাছে অনেক অনেক শুকরিয়া আমার আদিব বেঁচে আছে। আমি তাড়াতাড়ি আম্মাকে ডাকতে গেলাম।
আম্মাকে ডাক দিতেই আম্মা তেড়ে এলেন।
--মুখপুড়ি তুই এখনো যাস নি? আর তোর ওই মুখে আম্মা বলে ডাকবি না...
--আম্মা আপনার ছেলে বেঁচে আছে।হাসপাতাল থেকে একজন কল করে বলেছে।রোড এক্সিডেন্ট করে দুইদিন ধরে ও হাসপাতালে আছে।আমাদের এখুনি যেতে বলেছে।
(তাড়াহুড়ো আম্মাকে কি বললাম নিজেও জানি না)
-- রোড এক্সিডেন্ট? ও কি তাহলে লঞ্চে করে আসে নি?
--জানি না আম্মা, আপনারা তাড়াতাড়ি রেডি হোন।আব্বাকেও গিয়ে বলুন।
আমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বাবুকে দিয়ে ভাবীর কাছে দিয়ে গেলাম।আদিবের বড়ভাই,আমি,আম্মা,আব্বা সকলে মিলে হাসপাতালে গেলাম। হাসপাতালে যাওয়ার পর ওই লোকটা আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
--আপনার ছেলে যে এখানে এক্সিডেন্ট করে দুইদিন ধরে পড়ে আছে সেই খেয়াল আছে। ছেলের প্রতি কি কোনো দরদ নেই? দুইদিন পর আজ ওনার জ্ঞান ফিরেছে।ওনার থেকে নাম্বার নিয়ে ওনার ওয়াইফকে কল করলাম।(কিছুটা রাগী সুরে)
আব্বা বললেন,
--আসলে আমরা জানতাম আদিব লঞ্চ দিয়ে আসবে। তো লঞ্চ ডোবার ঘটনা শোনার পর থেকে লঞ্চ ঘাটেই সবসময় যোগাযোগ রেখেছি। আপনি আমাদের যে উপকার করলেন তার ঋন কোনদিন শোধ করতে পারব না।চিরকৃতজ্ঞ আমরা। আপনি যে না থাকলে কি হতো?
লোকটির হাত ধরে আমার শ্বশুর কথাগুলো বললেন।
-- ওহহ,আচ্ছা এই ঘটনা। সরি না জেনেই আপনাদের কতো কথা বলে ফেললাম। আসলে দুইদিন হয়ে গেছে অথচ আপনারা কোনো খবর নেন নাই।আমার ছোটভাইও আপনার ছেলের সাথে এক্সিডেন্ট করেছিল। ওর সাথে আপনার ছেলেকেও আমরা হাসপাতালে নিয়ে আসি। আপনার ছেলে মাথায় অনেক আঘাত পেয়েছিল।প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তারপর কত কষ্ট করে রক্ত জোগাড় করে
ওনাকে রক্ত দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর রহমতে এখন আগের চেয়ে সুস্থ।
--আপনাকে কি বলে যে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবো বুঝতে পারছি না। তা আপনার ছোটভাই ভালো আছেন?
--জ্বি, আল্লাহর রহমতে ভালো আছে।আজকে আমার ভাইকে নিয়ে যাব।আর আপনারা এমন করে বলবেন না, আদিবও তো আমার ভাইয়ের মতো।
আমরা আদিবের সাথে দেখা করতে গেলাম। আদিবকে দেখে বেশ সুস্থ মনে হলো। ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানা গেল আজকে চাইলেই আমরা আদিবকে নিয়ে যেতে পারি।আমরাও আর ওকে হাসপাতালে রাখলাম না। হাসপাতালের বিল দেওয়ার সময় ওই লোকটার ভাইয়েরটাও আব্বা দিলেন। লোকটা অনেক না করলেন।
আব্বা বললেন,
--আরে আপনারাও তো আমার ছেলের মতো। আমাদের এতবড় উপকার করল আপনার জন্য সামান্য এটুকু করতে পারব না।
--না,আঙ্কেল ধন্যবাদ। আমাদের বিল দেওয়া লাগবে না। উপকার করে যদি তার বিনিময়ে কিছু নিই তাহলে এ উপকারের কোনো মূল্য নেই।আপনি আমাদের জন্য মন থেকে দোয়া করবেন এটাই আমার চাওয়া।
লোকটার কথা শুনে আমরা সবাই রীতিমতো মুগ্ধ। বর্তমান যুগেও এমন ভালো মানুষ আছে? অবশ্য ভালো মানুষ আছে বলেই দুনিয়া টিকে আছে।
আব্বা অনেক জোরাজোরি করে হাসপাতালের বিল দিয়ে আসলেন।
............
বাড়ি আসার পর আদিবের কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনলাম।
--তিশার কথা শুনে আমি লঞ্চঘাটে যাই লঞ্চ দিয়ে আসার জন্য।এমনকি লঞ্চে উঠেও যাই। কিন্তু লঞ্চে এত বেশি মানুষ ছিল যে আমার মনের ভিতর আরো ভয় ঢুকলো,যদি বেশি মানুষের জন্য লঞ্চ ডুবে যায়।এমনিতেও তো আমি নৌপথে যাতায়াত করতে অনেক ভয় পাই।লঞ্চ ছাড়ার পাঁচ মিনিট আগে আমি নেমে যাই।ভাবলাম জীবনের মূল্য থেকে সময়ের মূল্য বেশি হতে পারে না। বাড়ি যেতে দেরী হলে হোক,তিশাকে আমি মানিয়ে নেব। আমি তখনি সিএনজি নিয়ে রওনা দিই।কিন্তু আমার কপালে যে দূর্ঘটনা লেখা সেটাকে তো আর ফিরাতে পারব না।
সিএনজি-বাসের এক্সিডেন্ট হলো।আমি মাথায় প্রচন্ড আঘাত পাই।অনেক রক্তক্ষরন হয়।আমার ফোনটাও ভেঙে যায়।যার কারণে তোমরা কল করে দেখছো বন্ধ। এরপরের কাহিনি তো তোমরা জানোই।
-- লঞ্চ ডোবার কাহিনি শোনার পর আমরা চারচত্তর রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যে শুনলাম কিছুক্ষন আগে এক্সিডেন্ট হয়েছে সেইখানেই কি....(তিশা)
--হ্যাঁ।
আদিবের কথা শোনার পর আব্বা-আম্মা আমাকে বললেন,
--বৌমা আমরা তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। আসলে
ছেলের শোকে মাথা ঠিক ছিল না। তোমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।তুমি আমাদের মাফ করে দিও।
তাদের আসল রূপ আমার দেখা হয়ে গিয়েছে।
একটা মেয়ে কখনোই চায় না তার স্বামী মারা গিয়ে সে বিধবা হোক।তবুও সকলে মেয়েদের ওপরই সব দোষ দেওয়ার চেষ্টা করে। আজ বুঝতে পারলাম সেদিন বিয়ের আগে যদি আদিবের জায়গায় আমার পায়ের সমস্যা হতো তারা কখনোই আমাকে বাড়ির বৌ বানাতো না। আমার জন্মদাতা বাবা ভুল কিছুই বলেন নি।আমি কিছুই বললাম না মাথা নিচু করে রইলাম।
আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা শুনে আদিব অনেকটাই রেগে গেল।পুরো কাহিনি শুনলে না জানি কোন কান্ড ঘটায়। আমি কিছু বলার আগেই আদিব বলে উঠল,
--আমি মরে গেছি শুনেই তিশাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলে! বাহ্।
আমার মরালাশ দেখা পর্যন্ত বাড়িতে রাখলে না।
ছিহ্!! তোমাদের ওপর আমার ঘৃণা হচ্ছে। যে মেয়েটা আমার মতো পঙ্গু ছেলেকে বিয়ে করে লোকজনের কথা শুনলো, আমাকে সেবা করে ভালো করে তুললো তার সাথে তোমরা এই ব্যবহারটা কীভাবে করলে? উপকারকারীর প্রতি এতো অকৃতঘ্ন হলে কি করে?তোমাদের বিবেকে কি এতটুকু বাঁধল না।
--থাক আদিব এসব কথা বাদ দাও।তোমার শরীরটা বেশি ভালো না তার ওপর এমন উত্তেজিত হয়ে কথা বলা উচিত না। আগে সুস্থ হয়ে নাও (বড়ভাবী)
--তাই বলে আব্বু -আম্মু তিশার সাথে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবে....(আদিব)
--থাক, আদিব বাদ দাও।তোমাকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে পেয়েছি এটাই অনেক।(তিশা)
.
.
.
বাবু হওয়ার পর থেকেই অনেক ঝামেলা লেগে আছে তাই ঠিকমতো নামটাও রাখি নি। আজকে বাবুর নাম রেখেছেন আমার শাশুড়ী। আদিবের নামের সাথে মিলিয়ে সাদিব। আমার পরিবারের সবাইকে এবাড়িতে দাওয়াত করা হয়েছে। আজ দুই পরিবারের মধ্যে নেই কোনো রাগ, ক্ষোভ, বিবাদ।আছে শুধু ভালোবাসা আর সম্মান। জীবনের প্রতিটি দিন সকলের সাথে এভাবেই আনন্দে কাটাতে চাই।
(সমাপ্ত)...
Writer:- নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)