গিয়েছিলাম পম্পার বিয়ের অনুষ্ঠানে।বিয়ের সাজে বেনারসী পরে পম্পাকে বেশ সুন্দর লাগছেও।অনেকেই পম্পার বেনারসীটার প্রশংসা করছে দেখলাম।পম্পা হলো রেখা পিসির মেয়ে।রেখা পিসি আমাদের পাড়াতেই থাকে।রেখা পিসির সাথে আমাদের বাড়ির সম্পর্কটা বেশ ভালো।আমার মায়ের যখন হাত ভেঙে গিয়েছিল তখন রেখা পিসি আমাদের বাড়িতে তিন মাসের জন্য কাজে এসেছিল।তাও প্রায় বছর দশেক আগে।সেই থেকে রেখা পিসির সাথে আমাদের একটা ভালো সম্পর্ক।মাঝে মধ্যেই সময় পেলে রেখা পিসি আমাদের বাড়ি চলে আসে।মায়ের সাথে গল্প করে।স্বামী মারা যাওয়ার পর রেখা পিসি একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়িতে চলে আসে।তারপর থেকে আর শ্বশুর বাড়ি যায় নি।অন্যের বাড়িতে কাজ করেই সংসার চালিয়ে যাচ্ছে আজও। তার মধ্যে থেকেই মেয়েকে পড়াশোনাও করিয়েছে।
যাইহোক বিয়েতে খুব বেশি লোকজনকে নিমন্ত্রণ করতে পারে নি রেখা পিসি।পাড়ার কিছু লোকজন আর বর যাত্রী নিয়েই অনুষ্ঠান।আমরা সন্ধ্যে থেকেই আছি।রেখা পিসি অবশ্য আগে থেকেই আমাকে বলেছিল,
---বাবু!নিজের দাদার মতোই একটু দেখাশোনা করো।জানই তো আমি একা মানুষ।
ছোটো থেকেই আমাকে বাবু বলে ডাকে রেখা পিসি আর তুমিই করে বলে।যত ছোটোই হোক রেখাপিসি কাউকেই তুই করে বলে না।
রেখা পিসির কথা মতোই দেখাশোনা করছি সব।বর আর বর যাত্রী এসে গেছে তখন।সেই সময় দুজন মহিলার মধ্যে কথোপকথন আমার কানে এলো।দুজনের কেউই আমাকে চেনে না।অথচ আমি এই দুজনের একজন মহিলাকেকে চিনি,রেখা পিসি যার বাড়িতে রান্নার কাজ করে।উনি ফ্ল্যাটে থাকেন।উনি এবং ওনার হ্যাজব্যাণ্ড দুজনেই ভালো চাকরিও করেন।তা ওই মহিলাকেই বলতে শুনলাম,
---আমি ওই একটা ছাপা শাড়ি দিয়ে দিয়েছি।আমাদের এখন হাত খালি সেটা আগে থেকেই শুনিয়ে রেখেছি।তা না'হলে কী না কী চেয়ে বসত।কী আর দেব বল তো!এমনিতেই তো মাস গেলে তিন হাজার টাকা নেয়। আমার কত্তা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল,রেখার মেয়ের বিয়েতে কী দেবে গো।ভালো কিছু তো একটা দিতে হবে।আমাদের বাড়িতে এতদিন রান্না করছে।আমি বললাম, ছাড়ো তো।ওরা ভালো জিনিসের কি মূল্য বোঝে!তিন মাস পর আবার দুর্গা পুজো।তখন ভালো শাড়ি দিতে হবে আবার।
---যা বলেছো।ও ঠিকই আছে।আমার বাড়িতে শুধু বাসনটা মেজে দেয়।হাজার টাকা দিই।তাও বলে মাইনে বাড়াতে হবে।এদিকে রেখার মেয়ে পম্পার বেনারসীটা দেখেছো?বেনারসীটা বেশ দামী বলেই মনে হলো।এদের এই সব বাহাদুরি ভীষণ।চাল চুলো নেই তাও আবার...
---সব জিনিস সবাইকে মানায় না।একদিন একটা দামী বেনারসী পরলেই তো আর স্ট্যাটাস মেইনটেন হয় না।আদিখ্যেতা যত সব!
---তবে যাই বলো ওই বেনারসীটা পরে ওকে খারাপ লাগেনি।আমার এত দামী বেনারসী তবুও কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছে ওই বেনারসীর কাছে।
কথা গুলো শুনে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। গরীবের বেনারসীর কাছে দামী শাড়িটা ম্যাড়মেড়ে লাগছে!তা আবার হয় নাকি।অথচ ওনারা আসার পর থেকে রেখা পিসি ওনাদের এত আপ্যায়ন করে চলছে নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না।দাদাবাবু আর বৌদিমণির আপ্যায়নের যেন কোনো ত্রুটি না হয় সেদিক দিয়ে রেখা পিসিকে সচেতন থাকতে দেখেছি।রেখা পিসির দু কামরা টিনের চালের ঘরে ওনাদের পদধূলি পড়াতে রেখাপিসি যেন ধন্য হয়ে গেছে।অথচ ওনাদের মানসিকতা আমাকে বেশ ভাবিয়ে ছিল।
যাইহোক বিয়ের পর্ব মিটে গেছে।খাওয়া দাওয়াও প্রায় সকলেরই হয়ে গেছে।বাড়ি ফিরে আসব।তাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।মা বাড়ির ভিতরে রেখা পিসির সঙ্গে দেখা করতে গেছে।বাড়ি চলে আসব, তাই মা বলল, তোর রেখা পিসির সঙ্গে দেখাটা করে আসি। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে মা এর জন্য অপেক্ষা করছি।দেখি ছয় সাতজন মহিলা বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে।একজনকে বলতে শুনলাম,
--এই আমার টাকাটা নিয়ে নাও সরমা দি।আমি আবার দু দিন থাকব না।তা প্রত্যেকের ভাগে কত করে পড়লো?
---ন'শো পঁচাত্তর।
দেখলাম টাকাটা দিতে দিতেই ওই মহিলা বলে উঠলো,
---বেনারসীটা পরে পম্পাকে বেশ মানিয়েছে।সরমা দি তোমার পছন্দ আছে বলতে হয়।
---বিয়েতে দেব।একবারই তো আমরা দিচ্ছি।ভালো জিনিসটা না দিলে চলে।
সকলেই বলে উঠল,
---ঠিকই তো।
একটু এগিয়ে এসে দেখলাম ওরা সকলেই পরিচিত।মানে মুখ চেনা।রেখা পিসি যে আবাসনে কাজ করে ওদের মধ্যে দু এক জন ওই আবাসনেই কাজ করে।বাকিরা অন্য বাড়িতে কাজ করে।সেই সূত্রেই ওনারা রেখা পিসির পরিচিত।পম্পার বিয়ের বেনারসীটা ওরাই দিয়েছে সেটা বুঝতে আর বাকি রইল না।
বুঝলাম কোনো একটা বড়ো জিনিস বা দামী জিনিস দিতে গেলে বড়ো লোক হতে হয় না।অনেক টাকা পয়সাও থাকতে হয় না।প্রয়োজন একটা বড়ো মনের।মানসিকতাই চিনিয়ে দেয় কার মন কত বড়ো, আর কে কত ছোটো।
সমাপ্ত
Writer:- সরজিৎ ঘোষ