2014 সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর জুড়ে নানান পরিকল্পনা করে ঠিক করলাম বিয়েটা রাজা রানীর মতো ধুমধাম করে করতে না পারলে ও চুরি করে হলেও রাজধানীতে করব। অবশ্য নিজেদের মফস্বলে করার মতো সাহস দুজনেরই নাই। ছোট্ট শহরের সবাই আমাদের আলাদা করে চেনে। একসাথে দেখলেই খবর রাস্ট্র হয়ে যাবে। অর্পিতার হাড্ডি একটা ও আস্ত থাকবে না। এরপরে ও রাগ না কমলে আমাকে ধরবে। এই শহরে আমার আত্মীয় স্বজন কেউ নাই যে, হাসপাতালে ভর্তি করাবে। সুতরাং চুরি করে দূরে গিয়ে বিয়ে করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমাদের বুদ্ধিতে তাল মিলিয়ে ছিল কয়েকজন পরিবারের সদস্য। অবশ্য সত্যিকারের পরিবারের সদস্য নয় এরা। ফেসবুকে বেশ ক'জনের একটা ক্লোজড গ্রুপ ছিল। সবাই পরিবারের সদস্যদের মতো, তাই এই গ্রুপের নাম ছিল পরিবার। এই ফেবু পরিবারের ছয় সদস্য ঢাকায় থাকে। তারা বিয়েতে সাহায্য করার জন্য এক পায়ে খাড়া।
অর্পিতার অফিসের একটা কাজ ছিল ঢাকায়। ও এই সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইল। ও ফ্যামিলিতে বলল তার সাথে আরো দুজন নার্স যাচ্ছে। ওর আম্মা আর আপার সামনে থাকা অবস্থায় দুই বান্ধবীকে দিয়ে ফোন করিয়ে বিশ্বাসযোগ্য করল। সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখ রাতে দুজনের একটুও ঘুম হলো না। সারারাত ফোনে পরদিন গাড়িতে কিভাবে উঠব সেই পরিকল্পনা করেই শেষ।
আমাদের বুদ্ধিতে তাল মিলিয়ে ছিল কয়েকজন পরিবারের সদস্য। অবশ্য সত্যিকারের পরিবারের সদস্য নয় এরা। ফেসবুকে বেশ ক'জনের একটা ক্লোজড গ্রুপ ছিল। সবাই পরিবারের সদস্যদের মতো, তাই এই গ্রুপের নাম ছিল পরিবার। এই ফেবু পরিবারের ছয় সদস্য ঢাকায় থাকে। তারা বিয়েতে সাহায্য করার জন্য এক পায়ে খাড়া।
অর্পিতার অফিসের একটা কাজ ছিল ঢাকায়। ও এই সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইল। ও ফ্যামিলিতে বলল তার সাথে আরো দুজন নার্স যাচ্ছে। ওর আম্মা আর আপার সামনে থাকা অবস্থায় দুই বান্ধবীকে দিয়ে ফোন করিয়ে বিশ্বাসযোগ্য করল। সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখ রাতে দুজনের একটুও ঘুম হলো না। সারারাত ফোনে পরদিন গাড়িতে কিভাবে উঠব সেই পরিকল্পনা করেই শেষ।
২২ শে সেপ্টেম্বর চকরিয়া থেকে গ্রীন লাইন এসি বাসের টিকিট কাটলাম দুইটা। পরিকল্পনা অনুযায়ী ও আসল ঠিক রাত নয়টা পনেরো মিনিটে। অর্পিতাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিতে এলো ওর ভাই। ভাইকে বলল এক বান্ধবী ইনানী থেকে উঠবে। আর এক বান্ধবী উর্মি আগে থেকেই ওর স্বামী সহ বাস কাউন্টারে হাজির। ওরা এমন অভিনয় করছে যেন একজন আরেকজনকে ছাড়া এই দুই দিন তিন রাত থাকতে পারবে না। আসলে এই দুজন অর্পিতার সাথে গাড়িতে উঠবে ঠিকই তবে সামনে নেমে যাবে। চকরিয়া পার হয়ে দশ কিলোমিটার গেলেই একটা ইনানী নামক হাইওয়ে রেস্টুরেন্ট আছে, সেখানে গ্রীন লাইন বাস বিশ মিনিটের বিরতি দেয় ওখানে নেমে যাবে। আমি উঠব ওখান থেকে। অর্পিতার ভাই তো ভাই ওর চৌদ্দ গুষ্টি আমাদের সন্দেহ করতে পারবে না।
বিপত্তি বাঁধলো গাড়ি ছাড়ার পর। সুপারভাইজার উর্মির স্বামী ইমনকে ধরলেন
- আপনার টিকিট প্লিজ?
- ভাই আমিতো টিকিট নিই নি। এ হচ্ছে আমার স্ত্রী আর তার বান্ধবী। মূলত ওর বান্ধবী আর তার স্বামী ঢাকা যাবে। ওর স্বামী আবির একটা কাজে ইনানী আটকে ছিল তাই আর এদিকে আসেনি। আমরা ইনানী পর্যন্ত যাচ্ছি ওদেরকে বিদায় জানাতে।
ইমনের এমন সরল মার্কা চেহারা দেখে সুপারভাইজার বেচারা আর কিছু বললেন না।
ইনানী রেস্টুরেন্টে সাধারণত আমরা কিছু খাই না দাম বেশি রাখে তাই। কিন্তু ঐদিন সবাই মিলে খেলাম আসলে ওর বান্ধবী দম্পতিকে খুশি করলাম। অর্পিতা তারপরও টেনশনে কিছু খেতে পারল না।
আগামীকাল আমাদের বিয়ে রীতি অনুযায়ী আজ রাতে আমাদের গায়ে হলুদ বা মেহেদী রাত হওয়ার কথা। কিন্তু আজ আমরা গাড়িতে নির্ঘুম উতকন্ঠার রাত পাড়ি দিচ্ছি। ও যে একটু পরম নির্ভরতায় আমার কাঁধে মাথা রাখবে সে সুযোগ নেই। গ্রীন লাইন স্ক্যানিয়া গাড়ির সিট এমনিতেই বড়, মনে হচ্ছে একেকজন একেক অঙ্গ রাজ্যে আছি। হতাশ হয়ে আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে চাইল, বিধি বাম, দুই সিটের মাঝখানের হাতলকে মনে হলো চীনের মহা প্রাচীর। একদম ফিক্সড উপর দিকে উঠানো যায় না। শরমে সুপারভাইজারকে ও বলতে পারছি না। এদিকে ওর অবস্থা দেখে শেষমেশ সুপারভাইজারকে ডাক দিলাম।
- কিভাবে সাহায্য করতে পারি স্যার?
আমি হা করার আগেই অর্পিতা বলে দিল
- ব্লাংকেট প্লিজ
এক দৌড়ে যে দুইটা কম্বল দিলেন, দুইটা জোড়া লাগালেও আমার হবে না। লম্বায় হলে প্রস্থে হয় না। প্রস্থে হলে লম্বায় হয় না। এর মাঝে যদি গাড়ির ইন্জিন ও এসির আওয়াজ ছাপিয়ে কারো নাক ডাকার আওয়াজ আসে তাও আবার সামনের সিটে! তাহলে জার্নি টু হেল।
কুমিল্লা এসে একটু দাড়াঁনোর সুযোগ পেলাম। দুজনেই নীচে নামলাম না। যদি অন্য গাড়ির যাত্রীদের মধ্যে পরিচিত কেউ থাকে! তাই টাকা ও পানি কোনটাই বিসর্জন দিতে গেলাম না। জ্যাম মাড়িয়ে সকাল আটটায় যখন মতিঝিল নামি দুজনকেই মনে হচ্ছিল ধ্বংসস্তুপ থেকে বের হওয়া দুই অভিযাত্রী। ফেবু পরিবারের পক্ষ থেকে আমাদের রিসিভ করতে আসা শরৎ হা করে চেয়ে আছে। ইনবক্সে দেয়া ছবির সাথে ভাঙ্গা চুড়া আদলের তেমন মিল নেই।
চকরিয়া থাকতেই অনলাইনে থ্রি স্টার মানের একটা হোটেলে রুম বুকড করছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের আশেপাশেই, হোটেলের নামের পেছনে ইন্টারন্যাশনাল লেখা দেখে ভাবলাম ভালো মানের হবে। হোটেলে গিয়েই পড়লাম বিপদে। উনারা বিয়ের আইডেন্টিটি চায়। অবশ্য দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও স্বাভাবিক ছিল না তাই উনাদের সতর্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। ছোট ভাই শরৎ তার আইডি কার্ড টা দেখাতেই আমাদের ব্যাগ কাঁধে তুলে নিল। ইন্টারন্যাশনাল মানের হোটেলের রুমে ঢুকেই মস্ত ধরা খেলাম। ডাবল খাট নামক যে আসবাব রুম জুড়ে আছে তা কোনভাবেই রেডি মেইড ব্যাচেলর চৌকির চেয়ে বড় হবে না। টেবিল, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, টিভি সব একটা জিনিসে, একের ভিতর অনেক স্টাইলে। কক্সবাজার এর যে কোন স্টার ছাড়া হোটেলের একটা রুম ভেঙ্গে এ ধরনের তিনটা রুম অনায়াসে করা যাবে। ওয়াশ রুমের সমস্যা নিজ গুণে হজম করে বের হলাম অর্পিতার অফিসের কাজে। শরৎ নেমে গেল তার অফিসের সামনে। আমরা ছুটলাম নার্সিং এন্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের দিকে। এই টেবিল সেই টেবিল, এই ফি সেই ফি দিয়ে কাজ শেষ করতে করতে বিকেল পাঁচটা। আবার শরৎ এর হাত ধরে তিনজন মিরপুর বার নাম্বারের বাস ধরলাম।
ওখানে আরো পাঁচ ছয়জন আমাদের অপেক্ষায়। মিরপুরে আমাদের বিয়ে হবে। সবাই স্বপ্ন দেখে নিজের গাড়িতে না হোক ভাড়া করা সাজানো কারে করে বিয়ে করতে যাবে। আমরা যাচ্ছি কারের বিকল্প, বিকল্প অটো সার্ভিস এর বাসে। জ্যাম ঠেলে শামুক গতির বাস, বাস ভর্তি বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষ, মানুষের ঘামের বিদঘুটে গন্ধ, সব মিলিয়ে অর্পিতার মাথা ঘুরিয়ে পেট গুলিয়ে বমি করার অবস্থা।
মিরপুর ১২ নামতেই রাত সাড়ে সাতটা। সকাল থেকে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল জেরিন, রনি, ফায়সাল, রিপন, সিয়াম, রাজা আরো দু তিন জন। এ এক অন্য রকম টান। ফেসবুকে পরিচয় অর্পিতার সাথে। ফেসবুকে পরিচয় এই ভাই বোনদের সাথে। বিয়ে ও ফেসবুক পরিবারের মাধ্যমে। কেউ কাউকে আগে দেখিনি। ক্লোজড গ্রুপে গল্প আড্ডা থেকে আত্মার টানে ছুটে আসা। মিরপুর ১২ রনি ভাইয়ের এলাকা। উনি আগে থেকেই কাজী অফিস ঠিক করে রাখছেন। সবাই দল বেঁধে কাজীর দরবারে ছুটলাম। কাজী সাহেব তো আমাদের দেখেই থ! বর কনের কোন ছিটে ফুটা চিহ্ন নেই আমাদের চেহারা বা প্রচ্ছদে। সারাদিন অফিসে ছুটাছুটি করে সোজা কাজী অফিসে। উনি বাস্তবে ফিরে কাজে হাত দিয়েই হাত গুটিয়ে নিলেন। বিরাট সমস্যা বরের জাতীয় পরিচয় পত্রের মূল কপি নেই। ফটোকপি চলবে না। অনেক বুঝালাম, বাড়তি টাকার লোভ দিলাম। না কাজী সাহেব হাজি মানুষ অন্যায় করবেন না। আমি লজ্জা ও অপমানে ছোট হয়ে আছি।
রনি ভাই বললেন মিরপুরে কি কাজীর অভাব আছে নাকি? চলেন।
দুই তিন কাজী দৌড়ে এক কাজী রাজি হলেন।
এবার বেঁকে বসলেন কনে। আমি বা আমরা যতোই বুঝাই উনি পঞ্চাশ হাজার টাকার উপরে কাবিন করাবেন না। যে সময়ে পাঁচ লক্ষ টাকার কমে কাবিন হয় না! সেখানে আমার হবু বৌ পঞ্চাশ হাজার এর বেশি নিবেন না। ওর যুক্তি হলো
- যদি কখনো আমাকে ভালো না লাগে। ভালোবাসা না থাকে। অনেক টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে না পারার ভয়ে কাগজের বৌ বা লোক দেখানো সম্পর্কে আটকে থেকে লাভ নাই। আমাদের সম্পর্ক বাঁধা থাক ভালোবাসার বাঁধনে ।
আলহামদুলিল্লাহ অবশেষে কবুল বলতে পারলাম।
কাগজ কলমের কাজ খাওয়া দাওয়া শেষ করে রুমে যেতে যেতে রাত একটা।
ঠিক পাঁচ বছর পর
অর্পিতার সামনে বসে আছি সমুদ্রের কুল ঘেঁষা একটা রেস্টুরেন্টে। জায়গাটার নাম লাবনী পয়েন্ট না হয়ে লাভ পয়েন্ট দেয়া উচিত। আমাদের প্রথম ডেট এখানেই। সেদিন এই রেস্টুরেন্ট অতো জমকালো ছিল না। দু তলা এমনিতেই ফাঁকা থাকতো। তারপরও সারাদিনের জন্য দু তলায় কোন কাস্টমার উঠতে দিইনি। আজও পুরো ফ্লোর খালি করে রেখেছি। টেবিলের সামনে একটা কেক। কেকের উপরে খুব সুন্দর করে লেখা
5 Years
of
Deliciousness
23 September 2019
প্রথম দেখার মতো এবারও দুজনে অফিস ও পরিবারের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে এসেছি। তখন দুজন। আজ তিনজন। সাথে আমাদের রাজকন্যা ওয়াজিহা। আজ আমাদের পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী। আমাদের বিয়ের কথা মনে আসতেই হাসি পাচ্ছে। কি পাগল ছিলাম আমরা। পাঁচ বছর আগে বিয়ে করতে গিয়েছিলাম পাবলিক বাসে আজ রানী আর রাজকন্যা নিয়ে এসেছি নিজেদের গাড়ি নিয়ে। আজ চিৎকার করে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাতে ইচ্ছে করছে। দুনিয়ার সব মানুষকে জানাতে চাই ভালোবাসার চেয়ে বড় শক্তি আর নেই।
Writer:- কাদের আজাদ