ক'দিন ধরেই শরীরটা ভালো যাচ্ছে না সুজাতার।কোমরের ব্যথাটাও বেড়েছে এদিকে।আজ কাল কি যেন সব চিন্তা করে।একমনে কোনো একটা জিনিসের দিকে তাকিয়ে থাকে তো তাকিয়েই থাকে।টাইমে ওষুধটাও ঠিক করে খায় না।আবিরের সাথে এই নিয়ে ঝামেলাও হয়।অফিস থেকে ফিরে আবির মায়ের ঘরে এসে আগে খোঁজ নিয়ে যায় মা ঠিক মত ওষুধ খেয়েছে কিনা।এই তো সেদিন ওষুধ খায়নি বলে কি ঝামেলা।ওষুধের পাতাটা দেখিয়ে আবির বলে উঠল,
"মা তুমি আজও ওষুধ খাওনি?"
"ভুলে গেলে কি করব?"
"ওষুধ না খেলে চলবে কি করে?তুমিও নিজেও টাইম মত খাবে না,নন্দিনীও যে দায়িত্ব নিয়ে তোমাকে ওষুধটা খাওয়াবে তুমি সেটাও করতে দেবে না।"
"আমি তো আর বাচ্চা মেয়ে নয় যে নিজে করতে পারব না।এই সামান্য ওষুধটা নিজে নিয়েই খেতে পারি আমি।কিন্তু ভুলে গেলে কি করব।"
আবির আজও বুঝে উঠতে পারেনি নন্দিনীর সঙ্গে সুজাতার সম্পর্ক ঠিক কেমন?নন্দিনী মানে আবিরের বৌ।যত দিন যায় সুজাতা দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে আবিরের কাছে।তবে সুজাতার সাথে কথায় পেরে ওঠা মুশকিল।সঠিক কথা বোঝাতে গেলেও কিছু না কিছু একটা বুঝিয়েই দেয়।আবির ভালো কিছু কথাও বলতে গেলেই এমন সেন্টু দিয়ে কথা বলবে আবির চুপ করে যায়।সুজাতা তখন বলে,
"হ্যাঁ এখন তো তুই-ই বলবি।তোর বাবা আমাকে কখনো ধমক মেরে কথা বলত না।শেষে কিনা পেটের ছেলের কাছে এত কথা শুনতে হচ্ছে।"
বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মায়ের আচার আচরণটা একটু বদলেছে সেটা বুঝতে পারে আবির।কোন কথার কি যে মানে করে বসে কখন কে জানে?মন ভালো থাকলে অনেক কথা বলে,তা নাহলে নিজের মতই চলে সুজাতা। সুজাতার এই নিজের মত করে চলাটা ছোটো থেকেই দেখে এসেছে আবির।
সুজাতা বিছানায় বসে গল্পের বই পড়ছে।টিভি থাকলেও সিরিয়াল দেখাটা সুজাতার ঠিক পছন্দ নয়।তবুও খেতে বসে ওই যত টুকু চোখ যায়।রাতে ন'টা থেকে পর পর দুটো সিরিয়াল দেখে নন্দিনী।টিভির দিকে চোখ না দিলেও কানে কথা গুলো আসে সুজাতার।মাঝে মাঝে গজগজ করতে করতে নিজের মনেই বলে,"সিরিয়ালে কি যে সব দেখে।বাড়িতে বৌ থাকতে আরো একটা বৌ।যত সব নোংরামো।এসব দেখেই তো উচ্ছন্নে যাচ্ছে।" সুজাতার এমন কথায় নন্দিনী অত গুরুত্ব দেয় না।হেসেই বলে দেয়,'তবুও তো সবাই দেখছে বলুন।'
নন্দিনী সুজাতার ঘরে আসে।সন্ধ্যের পর এই গল্প বই পড়ার নেশাটা আজকাল বেড়েছে সুজাতার।শাশুড়ির কাছে এসে বলে,
"এতটা পড়া হয়ে গেছে?দুদিনেই তো পড়া শেষ করে ফেলবেন দেখছি।"
সুজাতা কোনো উত্তর দেয় না।একমনে পড়েই যাচ্ছিল।দু মিনিট পর বইয়ের পাতা থেকে চোখটা সরিয়ে সুজাতা জিজ্ঞেস করে,
"কিছু বলবে?"
"কাল বিকেলে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা হয়ে গেছে।বিকেল চারটেয় টাইম দিয়েছে।"
"এত দিন থাকতে কালকেই করতে হল?কাল আমার একাদশীর ব্রত।তুমি জেনে শুনেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলে?"
"তা কেন।ডাক্তার বাবু ক'দিন থাকবেন না।উনি বাইরে যাচ্ছেন।ফিরতে দশ বারো দিন তো টাইম লাইবেই।তাই মনে হয় দেখিয়ে নেওয়াই ভালো।আপনার কোমরের ব্যথাটাও তো কমছেও না।"
"কোমরের আর দোষ কি।সব দোষ আমার কপালের।যা করেছো ভালোই করেছো।আজকাল আমাকে জিজ্ঞেস করে তো কিছুই করো না।"
সুজাতার এমন কথায় খারাপ লাগলেও কিছু বলতে পারে না নন্দিনী।নন্দিনীও বোঝে সুজাতার মানসিক অবস্থার কথা।বিয়ের আগে নন্দিনী কত কি ভেবেছিল।শাশুড়িকে নিজের মা হিসেবেই পাবে।শাশুড়িকে মা হিসেবে সেভাবে পাওয়া হয়নি যেমনটা মা মেয়ের সম্পর্ক হয়।বিয়ের পর থেকে নন্দিনী এ বাড়িতে একটু ভয়ে ভয়েই থাকে।সুজাতা মুখে কিছু না বললেও মাঝে মধ্যে এমন কিছু আচরণ করে নন্দিনী বোঝে সুজাতা হয়তো মন থেকে এখনো মেনে নিতে পারে নি।আবার কখনো এত ভালো ব্যবহার করে তখন নন্দিনী মনে মনে ভাবে এমনটাই তো সে চেয়েছিল।
দরকারি কথা গুলো সেরে নন্দিনী সুজাতার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।আজ একটু চিলি চিকেন বানাবে নন্দিনী।আবির খেতে খুব ভালোবাসে।পরের দিন একাদশী।একাদশীর দিন সব কিছুই নিরামিষ।রাতের দিকে রান্নাটা এখন নন্দিনীই করে।মাস খানেক হল রাতের বেলা রান্না ঘরে ঢোকে না সুজাতা।সকলের রান্নাটার দায়িত্ব সুজাতার।টুকটাক হেল্প করে দেয় নন্দিনী।সেটা নন্দিনী নিজের ইচ্ছেতেই করে।না করলেও সুজাতার কিছু যায় আসে না।সুজাতা কখনো অভিযোগও করে না।
আবিরের পছন্দের চিলি চিকেন বানালেও সুজাতার জন্য পণির বানিয়েছে নন্দিনী।সাত বছর হল সুজাতা চিকেন খাওয়া ছেড়েছে।মলয় সুজাতাকে বলত,
"এই বয়স থেকেই চিকেন খাবে না,মটন খাবে না,তাহলে খাবেটাই বা কি?"
"কেন?খাওয়ার জিনিস বলতে চিকেন আর মটন ছাড়া কিছু নেই নাকি।"
পাশ থেকে আবিরও মলয়ের কথায় সায় দিয়ে বলত,"বাবা তো ঠিকই বলছে।প্রোটিনের দরকার আছে শরীরে।তাই চিকেন খাওয়াটাও দরকার মা।"
চিকেন খেতে ভালো বাসত মলয়।নিজে না খেলেও মলয়ের জন্য চিকেন বানিয়ে দিত সুজাতা।আবিরটাও হয়েছে বাবার মত।চিকেন খেতেই ভালোবাসে বেশি।
রাতে সকলেরই রুটি চাই।সুজাতাকে দু পিস রুটি আর পণিরের তরকারিটা আলাদা করে একটা বাটিতে দিয়ে নন্দিনী বলল,
"পণির কিন্তু অনেকটাই আছে মা।লাগলে বলবেন।"
আজকাল সুজাতাকে ডায়েট মেনেই চলতে হয়।সুগার ধরা পড়েছে।অনেক কিছুই খাওয়া নিষেধ।সুজাতা তরকারির বাটিটা টেনে নিয়ে বলল,"না থাক এতেই হয়ে যাবে।"
আবিরও খেতে খেতে টিভির রিমোটটা নন্দিনীকে দিতে বলে।কোথায় একটা বিস্ফোরণ হয়েছে সে খবরটাই দেখবে।নন্দিনী বলে উঠল,"ও সব পরে দেখো।এখন আমি এই সিরিয়ালটা দেখে নিই।"
আবির আর এই নিয়ে কথা বাড়ায় না।কথা বাড়ালেই সুজাতাও দু কথা শোনাবে।চুপচাপ খেতে থাকে।সুজাতার খাওয়া প্রায় শেষের দিকে।"আজ পণিরটা বেশ রান্না করেছো দেখছি।" কথাটা বলেই খাওয়া শেষ করে সুজাতা উঠতে যাবে,ঠিক সেই সময়েই নন্দিনীও সুযোগটা কাজে লাগিয়ে নিয়ে সুজাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
"একটা কথা আপনাকে বলার ছিল মা।"
"বলার ছিল যখন তখন বলেই ফেলো।"
"বলছিলাম বিয়ের পর থেকে তিনবছর হয়ে গেল।আমাদের অ্যানিভার্সারিতে সেভাবে কিছুই করা হয়ে ওঠেনি।ওই দিন আমরা নিজেদের মধ্যে একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান করতে চাইছি।আপনি কি বলেন?"
"তুমি ভাবলে কি করে?তুমি জানো ওই দিনটা কি?"
"জানি মা।"
"তার পরেও মুখে আসে?তোমার ফূর্তি আনন্দটাই সব।বুঝতে পারছ আমার মনের অবস্থাটা?আবির তোকেও বলি।ও নয় পরের মেয়ে।ও এসবের কিছু বোঝে না।তুইও?ছি!ভাবতে লজ্জা করছে তুই আমার ছেলে।"
আবির তখন খাওয়া শেষ করেছে।সুজাতার কথা শুনে আবির বলে,"মা তুমি এতটা কেন রিয়াক্ট করছ?তুমি চাইলে হবে,না চাইলে না হবে।তার জন্য এতটা চিৎকার করার কোনো মানে হয় না।আমি জানি তোমার চিৎকার করাটাই যুক্তি সঙ্গত।"
রাগে গজগজ করতে সুজাতা চলে যায় নিজের ঘরে।মলয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে এই পৃথিবীতে মানুষ যতদিন থাকে ততদিন তার মূল্য।মৃত্যুর পর কে আর মনে রাখে?
সুজাতা বুঝতে পারছে মলয়ের স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসছে ছেলের কাছে।মনে পড়ছে চার বছর আগের কথা।ছেলের বিয়ের সব দায়িত্ব নিজের হাতেই নিয়েছিল মলয়।একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা।সুজাতা মলয়কে বলেছিল,"এত দিনে তোমার মনের ইচ্ছেটা পূরণ হবে।" মলয় বলত,"বাড়িতে একটা মেয়ে না থাকলে ঘর মানায়।" খুব সখ ছিল একটা মেয়ের।মানুষের পরিকল্পনা করে বটে।কিন্তু সব কিছুই চলে ওপরওয়ালার নিয়মে।তা না'হলে ছেলের বিয়ের দিনেই এমন অঘটন ঘটে?ছেলের বিয়েতে পরবে বলে চিৎপুর থেকে মলয় কিনে এনেছিল তসরের ওপর কাজ করা পাঞ্জাবি।সুজাতা রসিকতা করে বলেছিল,"বুড়ো বয়সে যত ঢঙ।" মলয় হেসে ফেলেছিল সুজাতার কথা শুনে।বলেছিল,"সুজি ওই পাঞ্জাবিটা পরলে বয়স কুড়ি বছর কমে যাবে।"
মলয় সুজাতাকে সুজি বলে ডাকত।সুজাতা বলত,"এত ভালো নামটাকে বিচ্ছিরি করে তুমিই ডাকো।ছেলের বিয়ের পর তুমি আর ওই নামে আর আমাকে ডাকবে না।"
"বেশ বাবা বেশ।ওই নামে আর ডাকব না।"
মলয় যে সত্যিই আর ওই নামে কখনোই ডাকবে না সুজাতা আদৌ বুঝতে পারে নি সেদিন।আবিরের বিয়ের দিন সন্ধ্যেবেলা।সুজাতা আবিরকে বরণ করছিল।আবির বিয়ে করতে যাবে।মলয় সুজাতাকে তাড়া দিচ্ছিল,
"আরে গিন্নী তাড়াতাড়ি বরণ করে ছাড়ো।ওদিকে সাড়ে আটটায় লগ্ন।তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে।"
বরণ পর্ব সেরে মলয় বর আর বর যাত্রী নিয়ে বেরিয়ে গেল।কে জানত জীবিত মানুষটা বাড়ি ফিরবে মৃত মানুষ হয়ে।বিয়ের পর্ব চলছে।কত লোকজন।তারই মাঝখানে শুরু হয় মলয়ের বুকে ব্যথা।মলয় বলেছিল,"ও সামান্য ব্যাপার।প্রায়ই হয়।ওই গ্যাস থেকে।" বেশিক্ষণ টাইমও দেয়নি।বুকে ব্যথাটা বেশি হতেই সঙ্গে সঙ্গে হসপিটালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বলে,ম্যাসিভ অ্যাটাক।সব শেষ হয়ে যায়।সুজাতার জীবনে নেমে আসে এক কালো অন্ধকার।ছেলের বিয়ের দিনেই ঘটে গেল এক অঘটন।পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন সকলের মুখে তখন একটাই কথা,মেয়েটাই অপয়া।তা নাহলে এমন ঘটনা ঘটবে কেন?
সেদিনের বাড়ির পরিবেশটা খুব ভয়ঙ্কর ছিল নন্দিনীর কাছে।অনেকেই যখন দোষ দিচ্ছিল তখন শোক সামলে সুজাতা প্রতিবাদ করেছিল বটে।সুজাতা চিৎকার করে বলছিল,"কারো জন্য কারো কিছু হয় না।নিয়তির হাতে বাঁধা আমরা।নতুন বৌকে কেউ দোষ দিও না।আমার কপালের দোষ।বিধির বিধান কেউ খণ্ডাতে পারে না।"
নন্দিনীকে আত্মীয় স্বজনের রোষের হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিল সুজাতা।সমাজে এখনো যা কিছু খারাপ ঘটে তার দায় এসে পড়ে একটা মেয়ের ওপরেই।তার দোষ থাকুক বা না থাকুক।
নন্দিনীর শ্বশুর বাড়িতে আগমনটা সুখকর হয় নি।নতুন বৌকে বরণ করার জন্য মলয়ের কিনে দেওয়া লাল পাড় গরদের বেনারসিটা পড়া হয়ে ওঠেনি সুজাতার।শাড়িটা হাতে দিয়ে মলয় বলে ছিল,"তোমাকে এই শাড়িটা পরে একদম গিন্নীমা লাগবে।" মলয়ের কথা মিথ্যে হয়ে যায় সুজাতার কাছে।সে সব কথা কত জীবন্ত আজ।অথচ ছেলে বৌ সব কিছু ভুলে ওই দিনেই অ্যানিভার্সারি পালন করবে।ভাবলেই যেন কেমন লাগে সুজাতার।
রাত্রে মলয় এসেছিল সুজাতার ঘরে।সুজাতাকে দেখেই বলতে শুরু করল,"চেহারার কি হাল করেছো?টাইমে খাওয়া দাওয়া করো না,নিয়মিত ওষুধ না খেলে কত দিন চলবে বল তো?আমার প্রতি অভিমান করে থেকো না।আমার জন্যই তো আবির আর বৌমার বৌভাতের অনুষ্ঠানটা হল না।কত সাধ ছিল জানো।কত আনন্দ করব,আমার বন্ধুদের বলে ছিলাম,ছেলের বিয়েতে কবজি ডুবিয়ে খাওয়াব।সব অপূর্ণ রয়ে গেল।সুজি তুমি আমার একটা কথা রাখবে,ওদের বিবাহ বার্ষিকীর অনুষ্ঠানটা তুমি নিজে হাতে দায়িত্ব নিয়ে করাবে?তুমি পারবে তো?কি হল করবে না?বলো করবে তো?
সুজাতা চিৎকার করে বলে ওঠে,"আমি করব।আমি করব।"
সুজাতার চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে আবির ছুটে আসে।সঙ্গে নন্দিনীও।
"কি হয়েছে মা!ভয় পেয়েছো।জল খাবে?"
সুজাতা জলটা খায়।তারপর বলে,"কিছু হয়নি স্বপ্ন দেখছিলাম।"
আবির ও নন্দিনীর চতুর্থ বিবাহ বার্ষিকী।আবির অফিস ছুটি নিয়েছে আজ।ছোটো করেই একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে।নন্দিনীর বাবা মাও এসেছে বাড়িতে।আনন্দীও এসেছে।আনন্দী নন্দিনীর খুব কাছের বন্ধু।অসীম আর অপরেশকে নিমন্ত্রণ করেছে সুজাতা।এই দুজন মলয়ের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু।আবিরের দুজন বন্ধুও আজ আসবে।
"তুমি সেজে রেডি থেকো।" নন্দিনীকে কথাটা বলে আবির স্কুটিটা নিয়ে বেরিয়ে যায় কেকটা আনতে।কেকটা অর্ডার দেওয়া আছে আবিরের অফিসের কাছাকাছি একটা দোকানে।আবির বের হওয়ার আগে সুজাতা অবশ্য বলেছিল,
"বাড়ির কাছাকাছি এত দোকান থাকতে দশ কিলোমিটার দূরে কেকের অর্ডার দিয়েছিস?"
"আরে ওটা অর্ঘ্যর বন্ধুর দোকান।অর্ঘ্যই বলল,ওখান থেকে নিতে।তাছাড়া অর্ঘ্যও তো আসবে আজ।স্ক্রুটিটা নিয়েই তো যাচ্ছি ওই জন্যই।আমি চালিয়ে নিয়ে আসব।অর্ঘ্য কেকটা ধরে নিয়ে স্কুটির পিছনে বসবে।"
অনেক দিন পর সুজাতাও যেন একটু খুশি খুশি।সুজাতাই নিজে হাতে সব রান্না করেছে।পাঁচ বছর আগে পুজোতে মলয়ের দেওয়া পিওর সিল্কটাই পরেছে সুজাতা।কালো রঙের সাউথ ইণ্ডিয়ান সিল্কটা পরেছে নন্দিনী।খোঁপায় জুঁই ফুলের মালা।নন্দিনীকে খুব সুন্দর লাগছেও।নন্দিনীর মা নন্দিনীকে দেখেই বলে উঠল,
"এত শাড়ি থাকতে কালো রঙের শাড়িটা পরা ঠিক হয়নি।কালো রঙটা আমার ঠিক পছন্দ নয়।"
এদিকে মলয়ের দুই বন্ধুও চলে এসেছে বাড়িতে।অনেকদিন পর এক সঙ্গে এতজন লোক বাড়িতে।সুজাতা তাই ভাবছে,কে বলবে মলয় নেই বাড়িতে।দুই বন্ধুর সাথে পাশের ঘরে গল্পের আসর জমিয়েছে যেন।
এদিকে আটটা বাজতে যায়।আবির কেক নিয়ে ফেরেনি।বেরিয়েছে তো সেই সন্ধ্যে ছ'টায়।খুব বেশি দেরি হলে সাড়ে সাতটার মধ্যেই ফিরে আসা উচিত।সেই জায়গায় ঘড়ির কাঁটা আটটা পেরিয়ে গেছে।নন্দিনী চিন্তা করতে করতে আবিরকে কল করে।আবিরের মোবাইল তো ড্রেসিং টেবিলের ওপর পড়ে আছে।তাড়াহুড়োতে মোবাইলটাই ফেলে গেছে আবির।উপায় না দেখে অর্ঘ্যকে কল করতে যাবে নন্দিনী।কারণ কেকটা নিয়ে ওরই আবিরের সাথে আসার কথা।সঙ্গে সঙ্গে অর্ঘ্যর ফোন আবিরের মোবাইলে।অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করে,
"আবির কি বাড়ি থেকে বের হয় নি?আমি তো কেক নিয়ে এক ঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে আছি।"
এমন কথা শুনে নন্দিনী থ।বলে,
"ও তো ছটার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।"
"সে কি?ও তো এখানে আসেনি।তাহলে কোথায় গেল?"
পাশেই ছিল সুজাতা।নন্দিনীর চোখে মুখে ভয়ের ছায়া তখন।সুজাতা জিজ্ঞেস করলে নন্দিনী বলে,
"ওর বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে।ও এখনো পৌঁছায় নি ওখানে।"
"পৌঁছায় নি?এ কেমন কথা!"
ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে আটটার ঘর পেরিয়ে নটার ঘরে ঢুকবে।এদিকে নন্দিনীর মনে অস্থিরতার ছাপ।কোনো ভাবেই আবিরের সাথে যোগাযোগ করার উপায় নেই। বাড়িতে যে কয়জন গেস্ট আছে তারাও বাড়ি যাবার জন্য উদগ্রীব।নন্দিনীর মা বলে,আমি ওদিকটা দেখে নিচ্ছি।ওনাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।তুই এদিকটা দেখ।
আবিরের কোনো হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না।নন্দিনী আর সুজাতা দুজনেই একে ওকে কল করতে থাকে।ওদিকে অর্ঘ্য বলল,"আমি খোঁজ নিয়ে।দেখছি।" ঘড়ির কাঁটা থেমে থাকছে না আর।দশটার পর সাড়ে দশটা হয়।কেউ বলতে পারছে না আবির কোথায়।নন্দিনীর সুন্দর করে সেজে ওঠা মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।তাহলে কি কোনো অঘটন ঘটল?সন্ধ্যের পর থেকে মনটা বড় কু গাইছিল নন্দিনীর।সিঁদুর কৌটোটা হাত থেকে মেঝেয় পড়ে যেতে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল নন্দিনীর।নন্দিনী ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছে না।নন্দিনী ভাবতে থাকে, মা হয়তো ঠিক কথাই বলেছিল।কালো রঙের শাড়িটাই কি.....
সে সব ভাবতে গিয়ে নন্দিনী যেন সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে যেন।সুজাতাকে বলে,"আমার ভীষণ ভয় করছে মা।" সুজাতাও বলে,"মনকে শক্ত করো।ঈশ্বরকে ডাকো।"
ঘড়িতে তখন এগারোটা।অর্ঘ্যর ফোন আসে আবিরের ফোনে।মোবাইল রিং হতেই নন্দিনী ছুটে যায়।নন্দিনীর বাবা ততক্ষণে রিসিভ করে বলে,
-আমি নন্দিনীর বাবা।
ওপাশ থেকে অর্ঘ্য ফোনে বলে,
"বাগুইআটির কাছে আবিরের স্কুটিটা পাওয়া গেছে।সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে গুরুতর।শুনছি তো একটা সাতাশ আটাশ বছরের ছেলে।আশঙ্কাজনক অবস্থায় পিজি হসপিটালে নিয়ে গেছে।পুলিশের থেকে এই খবরটা জাস্ট পেয়েছি।স্কুটিটা এখনো একটা চায়ের স্টলের পাশে রাখা আছে।পারলে আপনিও চলে আসুন পিজি হসপিটালে।আমিও ওখানে যাচ্ছি।"
এমন খবর শুনে নন্দিনীর বাবা সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যায়।নন্দিনী হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।নন্দিনী কাঁদতে কাঁদতে বলে,"এমন দিন তো দেখতে চাইনি আমি।চাই না এমন অ্যানিভার্সারি।আবিরকে এখনই নিয়ে এসে দাও।"
সুজাতাও যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছে।কি বা বলবে ভেবে পায় না।মনে মনে নিজেকে দোষ দিতে থাকে।দোষ দিতে থাকে মলয়কেও।মলয়কি এমনটাই চেয়েছিল?এই নাকি সে বৌমাকে মেয়ের মত ভালোবাসে?মেয়েটার জীবন থেকে আলোটা কেড়ে নিতে পারল মলয়?মলয় কি এতটাই খারাপ?
সুজাতা নন্দিনীর কাছে গিয়ে বসে।পাশে আছে নন্দিনীর মা।নন্দিনীকে কাছে টেনে নেয় সুজাতা।বুকে জড়িয়ে ধরে সুজাতা বলে,
"আমিই ভুল ছিলাম।হয়তো তোকে সেভাবে ভালোবাসতে পারি নি।কিন্তু বিশ্বাস কর মা তোকে যে ভালোবাসি খুব,সেটা প্রকাশ করতেই পারিনি কখনো।পৃথিবীতে এত অঘটন ঘটে কেউ কারো জন্য দায়ী নয়।কপাল ছাড়া পথ নেই রে।
তারপর মলয়ের ছবিটার দিকে চোখ চলে যায় সুজাতার।রজনী গন্ধার টাটকা মালাটা গলায় পরে মলয় যেন হাসছে আর বলছে,
"সুজাতা দুঃখের রাত বেশিক্ষণ থাকে না।তবে জীবনে কষ্ট আসে।ভেঙে পড়ো না।সব কিছু বিধির বিধান।বড়ো গাছটা ভেঙে পড়লে সেটা গাছটার ওপর এসেই পড়ে।তোমাকে শক্ত হতে হবে।কত কাজ অপূর্ণ অবস্থায় ফেলে এসেছি।তোমাকে শক্ত হাতে ধরতে হবে।নন্দিনী তো অনেক ছোটো।ওর জীবনে ভালোবাসার প্রয়োজন আছে।আজ এমন পরিস্থিতি তৈরি না হলে তুমিও বুঝতে পারতে না মেয়েটাকে তুমি কত ভালোবাসো।এই পৃথিবীর আপন জন যারা তারা কেউ হারায় না।সবাই আছে।তোমাদের সবার সাথেই আমিও আছি।"
রাত দুটো।একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে।আবিরের মোবাইলে রিং হচ্ছে।এত রাতে কার ফোন?নন্দিনী ফোন রিসিভ করে।ওপাশ থেকে ভেসে আসে একটা চেনা কণ্ঠ,
"আমি আবির বলছি।আই অ্যাম সো সরি নন্দিনী।আমাকে ক্ষমা করো।ফোনটা করতে অনেক লেট হয়ে গেল।ঠিক সময়ে ওকে নিয়ে হসপিটালে পৌঁছতে না পারলে ওকে হয়তো বাঁচাতে পারতাম না।অ্যানিভার্সারির কথা মনে ছিল।কিন্তু নিজের কর্তব্য থেকে সরে আসতেও পারেনি।তোমার মতই আর একজন,ধরে নাও ও তোমারই বোন।এই সাত মাস হল ওদের বিয়ে হয়েছে।রিকোয়েস্ট করছিল,"দাদা তাড়াতাড়ি একটু হসপিটালে নিয়ে চলো।আমার স্বামীকে বাঁচাও।" হয়তো না করলেও পারতাম।একটা অ্যানিভার্সারির আনন্দে আমরা হয়তো মশগুল থাকতাম,অন্যদিকে তখন বিসর্জনের বাজনা বাজত।মেয়েটা জীবনের রঙটাই হারিয়ে ফেলত।আমাদের আনন্দের কিছুটা মুহূর্ত হয়তো হারালাম ঠিকই,জীবনের অনেকটা আনন্দ সঞ্চয় করেও তো নিলাম।অনেকটা আনন্দ করব আগামী বছরে। কথা দিলাম নন্দিনী।চিন্তা করো না আমি ঠিক আছি।সকালেই ফিরছি।
সমাপ্ত...
Writer:- সরজিৎ ঘোষ