ছেলের বিয়ের আগে আমার নিজের দিদিই বলল,গোপা,চাকরি করা মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে একদম দিস না।চাকরি করা মেয়ে গুলো একদম ভালো হয় না।তুই কি ভাবছিস ওই মেয়ে সংসার করবে?উঁহু।ওই সাজ গোজ করে বেড়াবে,কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে অফিস যাবে,বর থাকতেও অফিসে বসে অন্য ছেলের সাথে প্রেম করবে।
ভাবলাম হতেও পারে।আমার দিদি তো,তাই মুখের ওপর কিছু বললাম না।কথাটা শুনে নিজের মধ্যেই রেখে দিলাম।ছেলের বিয়ে কিন্তু চাকরি করা মেয়ের সাথেই দিলাম।আমার বিশ্বাস হয় না চাকরি করা মেয়েরা খারাপ হয়।যদি হয় তাহলে নিজের চোখেই না হয় দেখব।ছেলের বিয়েতে এসে আমার দিদি বলল,
তুই চাকরি করা মেয়ের সাথেই ছেলের বিয়ে দিলি?দেখিস তোর অবস্থা কি হয়।
আমি বলেছিলাম,দেখিই না কি হয়।
বিয়ের দু মাস কেটেছে।আমার ছেলে আর বৌমা দুজনেই চাকরি করে।ওরা অফিস বেরিয়ে গেলে আমি দুপুরটা ফ্রি। কোনো কাজ থাকে না।তাই গল্পের বই পড়ি।আমাদের প্রতিবেশিনী মালিনীদি দুপুর বেলা একদিন বাড়িতে এল।আমি গল্পের বই পড়ছি দেখে মালিনীদি বলল,
গোপা দি তুমি সিরিয়াল দেখো না?
না গো।সিরিয়াল দেখি না।আমার বৌমা গল্পের বই এনে দিয়েছে,তাই ওই গুলোই পড়ি।রোজ নতুন নতুন গল্প।নতুন নতুন স্বাদের।ওই এক ঘেয়ে সিরিয়ালের কি আর দেখব।সিরিয়াল মানে তো একজন মানুষের তিনটে করে বিয়ে।
মালিনী দি হেসে বলল,
আমি ঠিকই ধরেছি।তোমার ছেলের বৌ ভীষণ চালাক মেয়ে।একেই বলে টাকা বাঁচানো।তুমি সিরিয়াল দেখা মানেই প্রতি মাসে টিভির পিছনে খরচ,ইলেকট্রিক বিল বাড়ানো,এসব বাজে খরচ হবে তো,তাই।ওই জন্যই একশো টাকার একটা বই কিনে দিলে মাসে কিছুটা হলেও তো টাকা বাঁচবে।
মালিনীদির কথা গুলো জাস্ট শুনেছিলাম।তারপর মালিনীদি চলে যেতেই আমি ভাবলাম সত্যি কি তাই?বুঝে দেখলাম ঠিক তো বলে গেল না।টিভি থাকার জন্য মাসে যে খরচটা হয় সেটা তো বন্ধ করে দেয়নি।একটা বই পড়া শেষ হলে,বরং আর একটা বই কিনে নিয়ে এসে দেয় আমার বৌমা।
বুঝলাম,মনের শান্তি উড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই কথা গুলোই যথেষ্ট।
বিয়ের পর প্রথম বৌমার জন্মদিন।আমার ছেলে বলল রিয়ার জন্মদিন পালন করব।রিয়া মানে আমার বৌমা।আমার ছোটো ননদ শুনে বলল,আমাদের বাড়িতে মেয়েদের জন্মদিন পালন হয় না।অমঙ্গল হয়।কথাটা শুনে আমি বুঝতে পারছিলাম না কি বলব।তারপর ভাবলাম,দেখিই না কি হয়।আমি নিজেই পায়েস রান্না করলাম।দিব্যি হৈ হুল্লোড় করে কেটে গেল।বরং মনটা আনন্দের নতুন স্বাদ পেল।কোনো অমঙ্গল হয়নি।তার কিছু দিন পরেই ছেলে আর বৌমা আমার জন্মদিন পালন করে বাড়িতে চাঁদের হাট বসালো।আত্মীয় স্বজনদের নিমন্ত্রণ করল।অনেকেই এসেছিল।কেউ আবার কানাকানি করে বলেও গেল,টাকা থাকলে যা হয় আর কি।এসব না করে গরীব লোকেদের কিছু দান করতেও তো পারে।
বুঝলাম,মানুষ সব কিছুতেই বাঁকা চোখে দেখে।
একদিন আমার ছোটো বোন ওর ছেলের বৌকে নিয়ে আমাদের বাড়ি বেড়াতে এল।আমার ছেলের বিয়ের এক বছর কেটে গেছে বলতে গেলে।সকাল বেলার রান্নাটা আমিই করি।ছেলে বৌমা দুজনেই অফিস বেরোয়।সকালে অফিস যাবার তাড়া থাকে।আমি রান্না করছি দেখে আমার বোন বলল,
তুই রান্না করছিস,আর ছেলের বৌ পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।একটা রান্নার লোক রাখতে পারে তো।এই বয়সে তোকে দিয়ে কাজ করায়?এখনকার মেয়েরা খুব চালাক।আমার বৌমা সব নিজে করে।আমি পায়ের ওপর পা তুলে বসে থ1কি।
তারপর থেকে আমিও মুখ খুলতে শুরু করলাম।আমার বোনকে বললাম,ওই বদ অভ্যাসটা আমার ও ছিল।আমি ছেড়ে দিয়েছি।নিজেকে ভালো রাখতে গেলে নিজেকে আগে দিতে হবে।আমি যদি কিছু না দিই তাহলে কিছুই পাব না।দেখ, কত দিন পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকতে পারিস?
আমার বোন তখন আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল।আমার থেকে ওই রকম একটা উত্তর পেয়ে আর কিছু বলেনি।
আমিও এক সময় স্বার্থপরের মত মেন্টালিটি নিয়ে চলতাম।বিয়ের পর যখন শ্বশুর বাড়িতে এলাম,তখন বাড়িতে আমি,আমার বর,শাশুড়ি আর একমাত্র দেওর।ননদদের তখন বিয়ে হয়ে গেছে।আমার বিয়ের একবছর পর দেওড়ের বিয়ে হল।দেওর বিয়ে করে বৌ নিয়ে চলে গেল কর্ম স্থলে।সেখানে জায়গা কিনে বাড়ি করেও ফেলল কিছু দিনের মধ্যেই।শাশুড়ি থেকে গেল আমাদের কাছেই।আমার ছেলে হওয়ার কিছু দিন পরেই শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়ল।সেভাবে আর কিছু করতে পারত না।শাশুড়ির সেবা শুশ্রূষা আমাকেই করতে হবে দেখে আমি আমার হ্যাজব্যাণ্ডকে বললাম,আমি কোনো কিছুই করতে পারব না। আমার হ্যাজব্যাণ্ড বলল,তোমার ইচ্ছে হলে করো,না হলে না করো।আমি তোমাকে জোর করতে পারি না।আমার মা তাই আমাকেই করতে হবে।আমি দেখতাম আমার হ্যাজব্যাণ্ড মায়ের জন্য সব কিছু করত।এতে আমার আরো খারাপ লাগতো।আমি ওকে বলতাম,তুমি কি একাই ছেলে?ছোটো ছেলেও তো আছে।সেও তো মাকে নিয়ে গিয়ে রাখতে পারে?সম্পত্তির ভাগ তো সেও নেবে।তাহলে মায়ের জন্য কিছু করবে না কেন?
আমার কথা শুনে আমাকে বলল,কে করল না সেই বিষয়ে আমি কাউকে অভিযোগ করতে চাই না।আমি আমার কর্তব্য করছি কিনা সেটাই হল কথা।
বললাম,সব কর্তব্য কি তোমার?
আমার এমন কথা শুনে আমাকে কাছে বসিয়ে আমার হ্যাজব্যাণ্ড বলল,
গোপা,একটা কথা মন দিয়ে শোনো।আমি যে আমার মায়ের জন্য যা করছি তা তোমার ভালোর জন্য।এক সময় মায়ের জায়গায় তুমি আমি দুজনেই আসব।আমাদের ছেলে আমাদের থেকে কি শিখবে বল তো?ও এটা দেখে বড় হোক ওর বাবা তার মায়ের জন্য কি করছে।ভবিষ্যতে ছেলেও কিন্তু সেভাবেই করবে আমাদের জন্য।ছেলেকে ডাক্তার বানাবে,শিল্পী বানাবে,কিন্তু তার আগে তো মানুষ বানাতে হবে।মানুষ হওয়ার শিক্ষা যদি আমরা দিতে না পারি,তাহলে অনেক খারাপ দিন দেখতে হবে আমাদের।
কেন জানি না এই কথাটা আমার মনের মধ্যে দারুণ ভাবে গেঁথে গেল।সত্যিই তো আমি যদি কিছুই না করি আগামী দিনে আমি তো কিছুই পাব না।পরিবারের শিক্ষাতেই ছেলে মেয়ে বড় হয়।নিজেকে শুধরে নিলাম।না দিলে কিছুই পাওয়া যায় না।শেষ কয়েকটা বছর যদিও বেশি দিন করতে পারিনি তবুও শাশুড়ির সেবা করেছি।যে দিন গুলো করতে পারিনি সে দিন গুলো না করতে পারার আক্ষেপ ছিল।এখন সেটা করি আমার বৌমার জন্য। তাই এখন ভাবি,আমি যদি পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকি,তাহলে সেটা ভালো দেখায় না।বৌমার থেকে আশা করার আগে আমাকে ভাবতে হবে আমি বৌমাকে কি দিয়েছি।বৌমা আমার থেকে অনেক ছোটো।ওর থেকে অনেক আগে আমি পৃথিবীতে এসেছি।অভিজ্ঞতা অনেক বেশি আমার।বড় গাছের ছায়ায় ছোটো গাছটা একদিন বড় হয়ে যাবে।সেদিন সে ফুল ফল ঠিক দেবে।তাই তার আগে মাথার ওপর বড় ছাতা হয়ে আমাকেই থাকতে হবে।
ছেলের বিয়ে হয়েছে তিন বছর।ছেলে বৌকে নিয়ে বেশ ভালো আছি।বৌমাও চাকরি করছে।সুন্দর করে সব কিছু বজায় রেখেছে।
একদম সুখের সংসার।আমার হ্যাজব্যাণ্ডের ওই কথাটা যে কত বড় সত্যি সেটা এখন বুঝি।আমার ছেলে যেভাবে আমার প্রতি দায়িত্ব পালন করে,আমি তো তাই ভাবি এই পৃথিবী হল বড়ো আয়না।যে যেমন দেখাবে তেমনি দেখতেও হবে।জীবনে ভালো করে চলতে গেলে, নিজেরা ভালো করে থাকতে গেলে বাইরের লোকের কথায় কান দিলে চলবে না।আমরা ভালো থাকলে আমাদের কাছের লোক গুলোই ভালো থাকে না।পজেটিভ কোনো বার্তা না দিয়ে সবেতেই নেগেটিভ কিছু খুঁজতে চেষ্টা করে।বাইরের লোকের কথায় যদি কান দিতাম তাহলে আজ যে এতটা ভালো আছি, এই ভালো থাকাটাও থাকতে পারতাম না।সংসার আমাদের।সংসার গড়ার দায়িত্বও আমাদের।কিন্তু সংসার ভাঙে বাইরের লোকের কথাতেই।এই সত্য আমি বুঝেছি।তাই ভালোবাসতে হলে নিজের ছেলের সাথে ছেলের বৌকেও বাসতে হবে বেশি।কারণ তার হৃদয়ে ভালোবাসা না জমালে সে আদৌ বাসবে তো?ভালোবাসা এমনি এমনি পাওয়া যায় না,ভালোবাসা দিলেই তবে ভালোবাসা মেলে।
Writer:- সরজিৎ ঘোষ