ভার্সিটির হলে থাকতে একবার এক অন্ধকার রুমে ঘুমিয়েছিলাম। রুমটা অনেকদিন থেকে তালা দেয়া ছিল। কেন ছিল, কেউ বলতে পারে না।
আমাদের ভার্সিটির হলগুলোতে তখন রুমের সংকট। এক রুমে পাঁচজন-ছয়জন করে থাকছে, তবুও সব ছাত্রকে সিট দেয়া যাচ্ছে না। বাইরে মেস করে থাকে অনেকে। অনেকেই হলে সিট পেতে এর ওর কাছে ধরনা দিয়ে বেড়ায়। তবুও সিট পাওয়া যায় না। এরকম হাহাকার অবস্থাতেও একটা রুম পুরো খালি পড়ে আছে তালাবদ্ধ অবস্থায়, ব্যাপারটা সবার কাছেই অবাক লাগে। তবুও এই রুম এমন বন্ধ থাকার কারণটি কারো জানা নেই। স্যারদের বা হলের মামাদের জিজ্ঞেস করলেও কেউ ঠিকভাবে কিছু বলেন না।
তবে, কিছু কান কথা শোনা যায়। এই রুমটায় নাকি পরপর দুবছরে দুজন ছাত্র সুইসাইড করেছিলো, এরপর থেকেই রুমটা তালাবদ্ধ। তবে তালাবদ্ধ করবার আগেও সেখানে ছাত্র রাখবার চেষ্টা করা হয়েছিলো। কেউ দুতিনদিনের বেশি টিকতে পারেনি। কেন পারেনি, সেটা জানা নেই কারো। ঘটনা আরো বিশ বছর আগের। সেসময় যারা ছাত্র ছিলেন, তারা এখন বড় বড় অফিসের বড় বড় পদে কর্মরত।
আমার এ রুমে থাকবার কোনো কথাই ছিলো না। থাকতে হলো। আমার রুমমেট সজিব হঠাৎ পালিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। বউকে লুকিয়ে নিয়ে এসেছে হলে। প্রভোস্ট জানতে পারলে ওকে হল তো হল, ভার্সিটি থেকেই বের করে দিবেন। তবুও সজিবকে একদমই চিন্তিত মনে হলো না। আমাকে বললো, 'প্লিজ, আজকে রাতে অন্য কোথাও থাক। কাল সকালেই আমরা চলে যাবো।'
আমাদের অন্য রুমমেটরা তখন ছুটিতে, রুমে কেবল আমি আর সজিবই ছিলাম। সে রাতে কোথায় থাকবো, বুঝতে পারছিলাম না। এক বন্ধু থাকতো বাইরের মেসে, তার জন্ডিস হওয়ায় বাসায় চলে গেছে কিছুদিন আগে। হলের অন্য কারো রুমে থাকাও বিপদ, ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেতে পারে। শেষে হঠাৎই মনে হল, ঐ বন্ধ রুমটায় তো থাকা যায়।
রুমটা কেবল তালা দিয়ে বন্ধ করা। সেই তালাও খুব সাধারণ, যেকোন মাস্টার কী দিয়েই খোলা যায়। আমার কাছে একটা মাস্টার কী ছিলো, সেটা দিয়েই মাঝরাতের পর আস্তে আস্তে তালা খুলে রুমটায় ঢুকলাম। রুমটাতে বিছানা, টেবিল সব আছে, কেবল একটু ধুলো জমা। একটা বিছানার ধুলো হালকা পরিষ্কার করে, আমার রুম থেকে নিয়ে আসা তোষক বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। শোয়ার আগে, সজিবকে বেশ কিছুক্ষণ গালাগালও করে ফেললাম মনে মনে। একটু অস্বস্তিও লাগছিলো, মনে হচ্ছিলো এই রুমে দুজন সুইসাইড করেছিলো। তখন তারা তো রুমে একা ছিলেন, আমার মতো। তাদের মনের অবস্থা তখন কি ছিলো? একটুও কি ভয় লাগেনি এই অন্ধকারে এভাবে ঝুলে পড়তে? যারা তাদের লাশ প্রথম দেখেছিলো, তাদের মনের অবস্থা তখন কি ছিলো?
এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙলো কেমন এক শব্দে। চোখ মেলে দেখলাম, ভীষণ অন্ধকার। কিছুক্ষণ পর সে অন্ধকারটুকু সয়ে আসলো চোখে। দেখলাম রুমটা খালি। কিসে যে শব্দ হচ্ছিলো, বুঝতে পারলাম না।
তখনই একটা মানুষ আমার বিছানার সামনে রুমের একপাশের দেয়াল দিয়ে দৌড়ে বের হয়ে রুমের অন্যপাশের দেয়ালের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল।
এতো দ্রুত হলো ব্যাপারটা, কি যে হলো প্রথমে বুঝতেই পারলাম না। ব্যাপারটা মাথায় ঢুকতেই ভয়ে জমে গেলাম। আমার কি হ্যালুশিনেসন হলো? কখনো তো এমন হয়নি।
আমি বিছানার চারপাশ হাতাতে লাগলাম আমার মোবাইলের জন্য। মোবাইলটা হাতে পেয়ে অন বাটন টিপলাম। মোবাইল অন হলো না। চার্জ নেই মোবাইলে।
আমি রইলাম অন্ধকারে। আমার ভয় বাড়তে লাগলো।
হঠাৎই রুমে ফিসফিস আওয়াজ পেলাম। কারা যেন চুপিচুপি কথা বলছে। রুমে আমি একা। আশপাশের রুমের শব্দ এখানে আসার কথা নয়। তাহলে, কথা বলছে কে?
ফিসফিস আওয়াজ বাড়ছে। দুএকবার হাসির শব্দও পাচ্ছি। অন্ধকার ঘরটায় আমার সাহস তলানির নিচে নেমে গেছে। বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে যে পালাবো, সে সাহসটুকু পাচ্ছি না। এমন সময়, কেমন এক শব্দে উপরে তাকালাম। আমার বিছানার ওপরে, ছাদ থেকে একটা লাশ ঝুলছে। লাশের মুখটা আমার দিকে ফেরানো। অন্ধকারে তার খোলা চোখটা জ্বলজ্বল করছে।
আমি আর পারলাম না। সবটুকু সাহস এক করে বিছানা থেকে নেমে দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। দরজা খুললো না। বাইরে থেকে আটকানো দরজা।
আমি পেছনে তাকালাম। লাশটা তখনও ঝুলছে। জানালা দিয়ে বাইরে থেকে আসা হালকা আলোয় তার মুখ দেখতে পারছি। কি বিভৎস সে মুখ!
মুখটা আমার।
আমি তখন ঘোরের মধ্যে চলে গেছি। সময় কিভাবে কাটলো, জানি না। আমি কি অবস্থায় ছিলাম তখন, মনে নেই। সকাল হতেই আমার সম্বিত ফিরে এসেছিলো। দেখলাম, আমি দরজার সামনে পড়ে রয়েছি। হাত দিয়ে হালকা ঠেলা দিতেই খুলে গেল দরজা।
আমি দরজায় তালা লাগিয়ে হলের বাইরে বেরিয়ে আসলাম। হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পাসের বাইরে চলে এলাম, এরপর একটা বাসে চড়ে বাড়িতে। বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার টানা তিনদিন জ্বর ছিলো। জ্বর ভালো হলে আবার ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই হলে আর উঠিনি কখনো।
এতোদিন এসব কথা আমি কাউকে বলিনি, নিজের স্ত্রীকেও না। আজ বললাম। কারণ, আজ সকালে পেপারে পড়লাম আমার ভার্সিটির এক ছেলে নাকি সুইসাইড করেছে। সেই হলে, সেই রুমটাতে। কর্তৃপক্ষ রুমটা পরিষ্কার করে ছাত্রদের জন্য বরাদ্দ দিয়েছিলেন। সেই ছেলেটা মাত্র গত পরশুই উঠেছিলো রুমটায়।
আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না জানি। তবুও বললাম কাহিনীটা, যে যা ভাবে ভাবুক। আমি চাই না সেই রুমটাতে আর কেউ উঠুক, ভয়ানক কোনো পরিস্থিতিতে পড়ে আর কারো প্রাণ যাক।
( সমাপ্ত )
লেখা: সোয়েব বাশার