> হিমু বনাম শুভ
-->

হিমু বনাম শুভ



:-"আম্মুকে দা দিয়ে জবাই করে মেরে আব্বু
জেলে গেছে..."

:-হা হা হা বল কি? তোমার আম্মু এখন কোথায়?

:-আমার আম্মুকে পুকুরের ঘরে বেঁধে রেখেছে...

আঁতকে ওঠার মতো অবস্থা হল,রান্না করছিলাম... ইলিশের বাটিটা হাত থেকে খসে গেল! নতুন বাসায় এসেছি দুমাস হল।
প্রতিবেশীদের সঙ্গে এখনো ঠিক ভাবে পরিচিতি মিলেনি।প্রতিবেশীদের মধ্যকার কারোরই একটা ছোট্ট চার বছরের বাচ্চা আমার বাচ্চাদের সঙ্গে ইদানীং খেলতে আসে।অফিস ব‍্যস্ততার কারণে আমার কখনও তাকে দেখা হয়নি।আজ হলিডে জমে থাকা সাপ্তাহিক কাজে ঘর গিজগিজ করছে। আসন্ন বইমেলায় একটা গল্পের ভাবনা ভাবতে ভাবতে রান্না করছিলাম।ওরা কিচেন রুমের সঙ্গে লাগোয়া আমার বেডরুমে বসে খেলছে।
কিন্তু কান্না মাখা আধোআধো গলাটা এক ঝটকায় সব
কিছু দূরে সরিয়ে দিল।আমার ভাবনার তার ছিঁড়ে গেল।কয়েক সেকেন্ড ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম,
একটা স‍্যান্ডো গেঞ্জি, হাফপ্যান্ট পরা ছোট্ট তিনচার বছরের ছেলে।হাতে একটা চিপসের প‍্যাকেট।
আমার বড় ছেলে হিমু বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

:-শুভ, তোমাকে এই চিপস্ কে কিনে দিয়েছে?

:-আমার আম্মু কিনে দিয়েছে

:-তোমার আম্মু না পুকুরের ঘরে ??

:-আমার... আমার... আটটা আম্মু হি হি।এক নম্বর আম্মু পুকুরের ঘরে।

আমাকে দেখে হিমু কিছুটা ইতস্ততঃ হয়ে থামল। শুভর
দুষ্ট চেহারায়ও কিছুটা ভয়ের আভাস ফুটেছে।আমি জানিনা কেন জানি আমার আশপাশের মানুষ এমন কি ছোট বাচ্চারাও আমাকে দেখে ভয় পায়।অথচ ভয়ের মতো তেমন কোনো কারণই আমার চোখে পড়ে না।
আর শুভকে তো আগে কখনো দেখিইনি।ওর ভয়টা কাটাতে কাঁধে হাত রেখে বললাম--

--নাম কি তোমার?

--আমি..? আমি ফারহান শুভ

--ওও আচ্ছা... কোন বাসায় থাকো?

--ঐ যে মোটা দারোয়ানের ঐ বাসায়।

পিচ্চির সরলতায় আমি হেসে ফেললাম,বললাম

--হা হা তোমার আব্বুর নাম কি?

--জসিম্মা ,,,ইইইইই না না জসিমউদ্দিন।আব্বুটা ভালো না তোহ্ ।আমার আম্মু জেরিন সে অনেক ভালো।

--আব্বু ভালো না কেন?মজা কিনে দেয়নি?

--সে কিভাবে দেবে,জসিম্মা তো জেলে,আমিই তাকে মজা কিনে দিয়েছি।

--জেলে কেন ?

--জসিম্মা আমার এক নম্বর আম্মুকে বটি দিয়ে জবাই
করেছে।কত রক্ত কত্ত কত্ত রক্ত ইস্।আম্মু এখন খুব অসুস্থ।আমার নানাভাই,সবাই মিলে আম্মুকে পুকুরের ঘরে বেঁধে রেখেছে।কাল সুস্থ হলেই বাসায় নিয়ে আসবো।আমার সবচেয়ে ভালো আম্মুটা কে জবাই করে দিয়েছে জসিম্মা।আমার জন‍্য নাকি আম্মুকে জবাই করে দিয়েছে।

--কে বলেছে তোমাকে?

--আমার ছোট আম্মুরা বলে ,,শুনেছি।নানুও বলে।

কি শুনছি এসব?গা গুলিয়ে উঠছে।আমার বাচ্চারাও গোগ্রাসে এসব শুনছে শুভর কাছ থেকে।কি শিখছে এরা পৃথিবী থেকে,পৃথিবীর মানুষের কাছে?চার বছরের একটা বাচ্চা বাবার নাম বিকৃত করছে!মায়ের জন্য প্রতিক্ষায় দিনের পর দিন কাটাচ্ছে। আমাদের সমাজ তথা পরিবেশ, পরিবারের প‍রিচয় কোথায় গিয়ে ঠেকছে?
দেশ কিংবা সমাজের পরিচালক প্রতিনিধিদের সর্বোপরি আমাদের কি করণীয় এসব শিশুদের জন্য?
আমরা তাদের জন্য কি রেখে যাচ্ছি?
সৌজন‍্যবোধ, উপযুক্ত পরিবেশ, সচ্ছল আবাসন,
শিশুসুলভ আচরণ এসব এদেশের ক'টা শিশু পাচ্ছে?
এসব দেখবার সময় কি এদেশের বুদ্ধিজীবী চিন্তাবিদদের আদৌ আছে?আমাদের মিডিয়া সংস্থা,
দেশীয় শিশু আইন শৃঙ্খলা উন্নয়ন কার্যক্রম কতটা জোরদার?শুভ কি পরিবেশে কি পরিচয়ে বড় হচ্ছে?
এই শুভর সঙ্গে আমার নিজের বাচ্চাদের মিশতে দেয়া উচিৎ হবে কী?

নিশ্চয়ই বলবেন "না"।

আমিও তাই করলাম।হিমু,ইয়াসা কে কপট রাগ দেখিয়ে
রুমে পাঠালাম।ফ্রীজ থেকে খুব ঠান্ডা একগ্লাস পানি খেলাম,কয়েকদিন আগে ঝলকের আনা কয়েকটা করমচা পাংসু চেহারায় ফ্রীজের কোণে পড়ে ছিল।সেগুলো তুলে মুখে পুরলাম।শুভ কে খুব ঠাণ্ডা ও কঠিণ কণ্ঠে স্পষ্ট বললাম--

--শুভ তুমি এখন বাসায় যাও।এখানে আর আসবে না।

--কেন আসবোনা কেন?এখানে কি কল্লাকাটা আছে?

--হুম আছে।খুব ভয়ংকর কল্লাকাটা আছে।তুমি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও।আর কখনও আসবে না।

ব‍্যাপারটা কয়েকদিন মনের ভেতর খচখচ করলেও
একসময় ঠিক হয়ে আসছিল।বিবেকের দংশন কমে এসেছিল।যখনই আমার ছেলেদের মুখে ফিসফিসিয়ে শুভর নাম নিতে শুনেছি তখনই শুভ‍র নাম উচ্চারণও
নিষিদ্ধ করলাম।মোটকথা শুভ নামে যে একটা পারসন আছে তা পুরোপুরি মুছে ফেলতে চাইছি।
আমি বাচ্চাদের কাছে শুভ পারসন টাকে একটা দুঃস্বপ্ন
হিসেবে তুলে ধরেছি।যেন এইমাত্র দুঃস্বপ্ন দেখে তোমার ঘুম ভেঙেছে।
শুভর সম্পর্কে খোঁজ নিলাম।জসিমউদ্দিন, শুভর বাবা
জেরিন শুভর মা তাদের লাভ ম‍্যারেজ হয়েছিল।বছর না ঘুরতেই শুভর জন্ম।কোনো এক বিচিত্র কারণে
জসিম স্ত্রীকে রান্না ঘরের বটি দিয়ে জবাই করে।
শুভর সেদিন তৃতীয় জন্মদিন ছিল।রক্তের বন‍্যা দেখে শুভ অজ্ঞান হয়।তার মাকে পোষ্টমর্টেম ছাড়াই তড়িঘড়ি করে যেখানে কবর দেয়া হয় তার পাশেই একটা পুকুর।
লাশ দাফন করতে না দেখলেও কবর খোঁড়ার পর সেটা দেখেছে শুভ।
ছোট বড় সবাই তাকে আস্বস্ত করে তার মাকে কবরের ঐ ঘর থেকে সুস্থ হলেই নিয়ে আসা হবে!

কি বিভৎস অসম সিনেমাটিক জীবন! বাস্তবতা যে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে শুভর মায়াকাড়া চোখে তাকালেই টের পেতে লাগলাম।মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙ্গেও কেন জানি শুভর কথা মনে পড়তে লাগল।
নিজেকে বিভিন্ন কায়দায় ব‍্যাস্ত রাখতে লাগলাম।

বিবেককে ব‍্যাস্ততায় ডুবিয়ে দিতে পেরে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফেলেছি।কিন্তু আমি বুঝতেই পারিনি শিশুর মন কখনো কখনো কিছু কিছু বিষয় খুব যত্ন করে একান্ত নিজের কাছে রেখে দেয়।ভুলে গেছি এমন শৈশব-কৈশোর আমিও পার করেছি।আমার অভিভাবক যখন কারো সঙ্গে মিশতে না করেছেন তখন তার জন্য মিশবার আকুলতা আরও বেড়েছে, এবং গোপনে সেই যোগাযোগ ঠিকই ছিল।এতে করে আমার ও অভিভাবকদের মধ‍্যকার দূরত্বই বেড়েছে।যা মোটেও শোভনীয় নয়।

দুটো সপ্তাহ কেটে গেল।সেদিনও হলিডেতে বিকেলে
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছি।কখন যে ঝলক
এসে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি।ঝলক বর্তমান সময়ের পুরুষ মানুষের মতো নয় বেশ সরল চরিত্রের।
তার এই সারল‍্যই আমার মন কাড়ে।আমার সবকিছুই ঝলক সুন্দর ভাবে নেয়।
কোনো ডিসিশন খারাপ লাগলেও সেটা খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দেবার মতো প্রসংশনীয় কৌশল ও মানসিকতা আছে তার।বাচ্চাদের যেকোনো ব‍্যাপারে আমার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।একজন বাবা হিসেবে এবং একজন স্বামী হিসেবে ঝলক পারফেক্ট।

সাধারণত ছুটির দিনে পড়ন্ত বিকেলে বাচ্চাদের চোখ এড়িয়ে আমার আর ঝলকের একটু খানি প্রেম দেয়ানেয়া হয়ে যায় এই ছোট্ট ব‍্যলকনিতে।কিন্তু
ঝলক অন‍্যদিনের মতো মুগ্ধতা নিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে না,আমার আকাশটাও দেখছে না।তার দৃষ্টি রাস্তায়।চোখ বাঁকিয়ে তাই ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম
কি দেখ এতো রাস্তায়?

ঝলক তর্জনী উঁচিয়ে যাকে দেখালো তাতে ঝুপ করে দোতলা থেকে নিচে পড়ে যাওয়ার মতোই ধাক্কা খেলাম।
বাসার সামনে ব‍্যাস্ত রাস্তার এককোণে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে শুভ!

বুঝলাম বাচ্চারা আমার থেকে দূরে সরে তাদের বাবার কাছ ঘেঁষেছে,শুভর ব‍্যাপারটা ঝলককেও জানিয়েছে।
তাদের মধ্যেও যে যোগাযোগ হচ্ছে, মানে শুভর সঙ্গেও
যে হিমু, ইয়াসার যোগাযোগ হচ্ছে!ঠিক আমার নজর এড়িয়ে, আমার শাসন এড়িয়ে, মায়া ঘাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে!
মিইয়ে যাওয়া খচখচানি অনুভূতিটা আবারও ফিরে এলো।ঝলকের উপর কিছুটা রাগ হল।

কয়েকদিন পর অসুস্থতার কারণে আমার অফিস কামাই দিতে হল।ভর দুপুরে শুয়ে আছি, হিমু স্কুল থেকে এসেই খুব দুষ্টুমিতে মাতে।কিন্তু আজ তাকে কিছুটা বিচলিত মনে হল!বললাম

--হিমু...তোমার কি হয়েছে?

--কিছুনা মম্।মম্ তোমার শরীর এখন ভালো তো?

হিমুর চোখ কেমন ধরাপড়া চোখের মতো মনে হল।
মায়ের চোখ এড়িয়ে সন্তান বোধহয় কখনো নিজেকে লুকোতে পারে না।হিমু ও পারেনি।কিন্তু বিষয়টা কি সেটাই আমাকে ভাবালো।
ভাবতে ভাবতে সামান্য তন্দ্রা লেগেছে,
একটু পর একটা আধোআধো কণ্ঠে আমার তন্দ্রা ছুটে গেল।

--"আম্মু ও আম্মু তুমি নাকি অসুস্থ?"

--কে শুভ!

--তোমাকে দেখতে এসেছি।তুমিও তো আমার আরেকটা আম্মু ঠিক না ? আমার আটটা আম্মু ছিল এখন নয়টা আম্মু।হিমু ভাই আমাকে বাসায় ঢুকতে মানা করেছিল।ভাইকে বলেছি আর কখনো আসবোনা।তুমিও অসুস্থ... তুমিও কি পুকুরের ঘরে ঢুকে যাবে...?

আমি বাকরুদ্ধ হলাম।বাস্তবতা যে কখনো কখনো সিনেমাকেও হারায় শুভর সঙ্গে পরিচয় না হলে কখনো বুঝতে পারতাম না।আমার সচেতন মন,শিক্ষা, পরিবার তথা পরিবেশের উর্ধ্বে এই নিষ্পাপ শিশু, নিষ্পাপ তার ভালোবাসা,নিষ্পাপ তার আধোআধো বুলি। আমার অবচেতন মনে শুভ ঠিকই জায়গা করে নিয়েছিল প্রথম দিন।
আমি জানি এমন অসংখ্য শুভ আছে আমাদের দেশে।
তাদের থেকে আমরা কোনো না কোনো ভাবে দূরে সরে থাকি।তাদের জন্য আমাদের অভিভাবক শ্রেণীর চোখ কানে তালা দিয়ে দেই।ভাবি ওটাই তার নিয়তি।
প্রকৃতি তাকে এভাবে সাজিয়েছে।তাকে এভাবেই থাকতে হবে।তাকে মায়া দেখালে নিজের সন্তানের জন্য অশুভ সংকেত।কিন্তু আমরা কেবলই কি সচেতনতার ছলে নিজেকে সরিয়ে রাখব?

কোনই দায়িত্ব নেই এসকল পথশিশুর প্রতি?


Writer:- বিপুল
 

Delivered by FeedBurner

a