> মায়েদের ইচ্ছেগুলো
-->

মায়েদের ইচ্ছেগুলো



ঘরের সকলের হাতেই স্মার্টফোন,কেবল মা বাদে।বাবা স্যামসাং A5 ব্যবহার করেন,বড়আপু আইফোন 10,ভাইয়া দুটো ফোন একসাথে ইউজ করেন-একটা স্যামসাং J2pro,অন্যটা HTC। আমি এখন ব্যবহার করছি Mi 5A prime। আমার তারও আগে একটা ফোন ছিল,বাটন ফোন-Symphony D10। কলেজে স্মার্টফোন নেওয়া নিষেধ ছিল বলে রোজই বাটন ফোনটা নিয়ে কলেজ যেতাম। দু/একরবার রাগের বশে আছাড়ও দিয়েছিলাম ফোনটাকে,ব্যাক কভার ভেঙে গেছে প্রায়। পানিতেও ডুবেছিল কয়েকবার। এখন সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি,কলেজের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার সাহস হয়েছে। তাই প্রতিদিন ক্লাসে যাই Mi 5A prime স্মার্টফোনটা নিয়েই। আর পানিতে নাকানিচুবানি খেয়ে সর্দি-জ্বরে ভুগা আমার হাঁটুভাঙা বাটন ফোনটা???ওটাই গায়ে গতরে আঠা-কস্টেপ মেরে নিজের ঠাঁই করে নিয়েছে আম্মার কোলে।
আজ বৃহস্পতিবার।কলেজ শেষে হোস্টেল থেকে বাসায় গিয়েই শুনলাম ভাইয়া আরও একটা ফোন নিচ্ছে। কী যেন নাম বলল,Mi note 7pro, ব্র্যান্ড নিউ। ভাইয়া ফোন নিচ্ছে শুনে আপুরও বায়না,একটা নতুন ফোন নেবে।বাবার এতসবে খেয়াল নেই। যে যা আবদার করে,মোটামুটি 'দেখা যাবে' বলে আস্বস্ত করে আবদারকারীকে।
হোস্টেলে ওয়াইফাই নেই। মোবাইল ডাটাও ব্যবহার করিনা আমি।ক্লাস আর প্রাইভেট নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে থাকি কিনা,তাই। বাসায় এসে পৌঁছেছি রাত দশটায়।কমলাপুর থেকে সোয়া নয়টায় উঠেছিলাম এয়ারপোর্টের ট্রেনে। দুদিন ছুটি,ফেসবুক না চালালে হয়?ঝটফট প্লে স্টোরে ফেসবুক ইন্সটল করতে দিয়ে দিলাম। আর বাবাও অফিস থেকে এসে ঘরে ঢুকলেন।
হাতমুখ ধুয়ে রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করেছি সবাই। ভাইয়া তার রুমে কী করছে কে জানে,বড়আপু পড়ার টেবিলে বসে ফেসবুকিং করছে। ড্রয়িং রুমে অবহেলিত টিভিটা অন করা,বাবার খবরও নেই সেদিকে। সোফায় বসে তিনিও ধ্যান-জ্ঞান দিয়ে ফেসবুক-বন্ধুদের সাথে এটাসেটার গুণকীর্তন করছেন। কলেজ থেকে এসে আমিও ক্লান্ত। মশারি টাঙিয়ে পারমানেন্টলি শুয়েই মোবাইল টেপার প্রস্তুতি নিচ্ছি।কারো কাজে কোন শব্দ নেই। সকলেই মোবাইল ফাংশনে ব্রতী,একেবারে নিরবে,সম্পূর্ণ নিস্তব্ধে।কেবল কোণার ঐ রান্নাঘরটা থেকেই টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছে কানের পর্দায়। হুম,ওটা আম্মাই।ডিনারের পর যেসব বাসনকোসন বেরিয়েছে, সেগুলোকে ঘষামাজা করছেন তিনি।
লাইট অফ করে দিলাম রুমের। ড্রয়িং রুমের জ্বলন্ত এনার্জি বাল্বের চিকন আলোর রেখাটা আমার রুমে এসে কাজ করছে ড্রীম লাইটের মতো। মোবাইল হাতে নিলাম।হোস্টেল থেকে প্ল্যান করেই এসেছিলাম ফোনের রিংটোনটা বাড়িতে আসলে চেঞ্জ করবো। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে দীপান্বিতা গানটা আমার খুব প্রিয়,নাটকটাও। তাই নেট অন করেই ডাউনলোড দিলাম দীপান্বিতা গানের বাঁশিসুরের রিংটোনটা। ডাউনলোড হয়ে গেলেই হাইসাউন্ডে একবার টেস্ট করে নিতে শুরু করলাম। সঙ্গে সঙ্গে রুমে আম্মার প্রবেশ ছোটখাটো একটা দৌড় দিয়েই।রিংটোনটা শুনেই বললেন,"নাটকটা দেখছিস নাকি?" আমি হেসে বললাম,"নাহ!এটা রিংটোন।" আম্মা বললেন,"নাটকটা দে না একটু,দেখি।"

ব্যাপারটা হচ্ছে নাটকটা আম্মার খুব প্রিয়,নাটকের গানটাও।বছরখানেক আগে নাটকটা আম্মাকে আমিই দেখিয়েছিলাম। আম্মা একটু বেশিই সোজা কিনা,তাই বুঝিয়েও দিয়েছিলাম নাটকের কাহিনীটা।গানটাও পজ করে করে লাইন টু লাইন শাব্দিক অর্থ আর ভাবার্থ বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। সেই থেকে 'সরি দীপান্বিতা' নাটকটা আর তার গানটা আম্মার খুব প্রিয়। আমি যখন বাসায় থাকতাম,তখনও আম্মা প্রায় বায়না করতেন দীপান্বিতা গানটা শোনার জন্য। মাঝেমাঝে বিরক্ত হয়ে যেতাম,"একগান দশবার শোনা লাগে?" আম্মা হেসে বলতেন,"একবার দে।শেষবার।"
এখনও ঠিক তেমনটাই হয়েছে।রিংটোনটা শুনেই আম্মা দৌড়ে এসে আবদার করে বসেছেন নাটকটা দেখার জন্য।আমার তখন একদমই মোড নেই। এক সপ্তাহ পর নেট-জগতে এসেছি।ফেসবুক,ইন্সটাগ্রাম,হোয়াটসঅ্যাপ সবখানেই শতশত পোস্ট-ম্যাসেজ জমা হয়ে আছে।সাতদিনে বের হওয়া নতুন নাটকগুলোও দেখার বাকি এখনো, আর আম্মা এখন এসে বলছেন দীপান্বিতা নাটক দেখবেন!কী অদ্ভুত!আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,"এই নাটক আর কয়বার দেখবেন?পরে দেখিয়েন।চার্জ নাই ফোনে।" আম্মা হেসে বললেন,এমন করিস ক্যান?একবারই তো দেখেছিলাম।তাও অনেক আগে।" বললাম,"একবার না,দুবার।আমি সহ দেখেছিলাম।" আম্মা মন খারাপ করে বললেন,"এখন একবার দেস না।" আমি রেগে বললাম,"আম্মা,বোঝেননা কেন?ফোনের চার্জ নেই।কাল দেখিয়েন।" আম্মা রান্নাঘরে চলে গেলেন আবার।ওধারে সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত।একটুপরে শুনলাম আম্মা বড়আপুর রুমে গিয়ে বলছে,"দীপান্বিতা নাটকটা একটু দিবি ঋতু?এমন করিস ক্যান!" অন-নেটে মগ্ন বড়আপু উল্টো আম্মাকে ধমক দিল। আমাকে ডেকে বলল,"শাতিল,আম্মাকে নাটকটা দেস না একটু।" আম্মা আবার আমার কাছে এসে বললেন,"দিবি নাকি?" আমি বললাম,"আচ্ছা আম্মা!বলি না চার্জ নেই!কাল দেব। এখন না। আম্মা ডাইনিং-এ ফিরে গিয়ে টেবিল গোছাচ্ছেন। খুব সম্ভবত ভাইয়া এসেছেন পানি খেতে।ভাইয়াকে দেখেই আম্মা বললেন,"কী করছিস?দীপান্বিতা নাটকটা একটু দেখাবি তোর ফোনে?" ভাইয়া মুখ ঘুরিয়ে বললেন,"ভার্সিটি থেকে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছে। মোবাইল থেকে সেগুলো তুলছি।তুমি না এই নাটকটা আগেও দেখেছিলে মা?"
ভাইয়া ফিরে গেছেন রুমে।আম্মা আপন কাজে ব্যস্ত।আমিও একটা নতুন গল্প পোস্ট করে কমেন্ট পড়ায় মেতে উঠলাম সহসা। শুনছি আম্মা এও বলছে,"শাতিল,তোর পুরোনো বড় আরেকটা মোবাইল কোথায়?ওটা আমাকে ঠিক করে দিলেও তো হয়,আমি একটু গান শুনতে পারি। আমার কী জীবন নাই?তোরা সবাই-ই ফেসবুকের জন্য এখন আমার সাথে কথাও বলতে পারিসনা।" আমি শুনে বললাম,"দেব,দেব!দেখি।"
আব্বা ড্রয়িং রুম থেকে উঠে ওয়াসরুমে যাচ্ছিলেন বোধহয়।আম্মা বললেন,"এই,তোমার ফোনে আছে নাকি দীপান্বিতা নাটকটা?" আমি বিছানা থেকে বললাম,"আরে আম্মা,সব ফোনেই আছে। নেট থাকলেই হয়।  আব্বাকে বলেন। ওনার ফোনে দেখেন।" আব্বা ব্যস্ততা দেখিয়ে বললেন,"একটা গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট দিয়েছি। এখন ঝামেলা করো না তো শিল্পী। আমার ফোনে কিছু নেই।"
দু/একটা অগোছালো কাপড় ভাঁজ করে আম্মাও গিয়ে বিছানায় বসলেন আপুর রুমে।শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ভেবেছিলাম নাটক দেখার ইচ্ছে আম্মার মরে গেছে।কিন্তু না!ও রুমে গিয়েও আম্মা ভীত কণ্ঠে বড় আপুকে দু/একবার আবদার করতে লাগলেন,"নাটকটা দিবি না? এতই ব্যস্ত সবাই!" আপু আবারো আমাকে ডেকে বললেন,"এই শাতিল!শাতিল,আম্মাকে নাটকটা দিচ্ছিস না কেন? সেই সকাল থেকেই দীপান্বিতা-দীপান্বিতা করছে আম্মা।" আম্মা শ্বাস নিয়ে বললেন,"থাক!থাক!লাগবে না।তোরা তোদের কাজ কর।"
শেষ কথাগুলে শুনে মনের ভেতর আমার কিসে যেন একটু ধাক্কা দিল।আম্মা সকাল থেকেই নাটকটা দেখতে চাচ্ছেন? ডাক দিয়ে বললাম,"এতরাতে যে কীভাবে ইচ্ছা করে নাটক দেখতে!কই,আসবেন নাকি।" আম্মা একছুটে রুমে এসে বললেন,"দেখাবি নাকি?তুই না কাজ করছিস ফোনে।" বললাম,"চার্জও নেই।কী দেখবেন?" আম্মা মশারির ভেতর ঢুকে বললেন,"যতটুকু পারি দেখি না।অর্ধেক হলে অর্ধেক।" পোস্ট করা গল্পে কমেন্ট আসছে একের পর এক। সপ্তাহের শেষে গ্রুপে গ্রুপে বন্ধু-বান্ধবীরা আড্ডায় মাতোয়ারা।দীপান্বিতা নাটক চালু করার কোন ইচ্ছেই আমার নেই।তবুও আম্মার আগ্রহের কমতি নেই।আমারও মনটা কেমন জানি করছে।তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইউটিউবে ঢুকে দীপান্বিতা নাটক চালু করে আম্মাকে বললাম,"আসেন। এপাশে আসেন।"
নাটক চলছে।আম্মা-আমি শুয়ে আছি পাশাপাশি।দু/তিন মিনিট পরপর আমি নাটক থামিয়ে ফেসবুকে ঢুকেঢুকে পোস্ট করা গল্পের নিউ কমেন্টসগুলো পড়ে আসছি। আব্বা,ভাইয়া,আপু সবাই-ই মগ্ন নেটজগতে। আম্মাকে বললাম,"আপনি সকাল থেকে এই নাটকটা দেখতে চাচ্ছিলেন? আমি ভাবলাম আমার রিংটোন শুনেই আপনার মনে উঠেছে নাটক দেখার কথা।" আম্মা নাটক দেখতে দেখতে বললেন,"না......! কাল থেকেই ঋতুকে বলছি নাটকটার কথা। তার খবরই নাই,ফেসবুকে মগ্ন।তোর ভাইয়াকে বলেছিলাম,সেও ধমকায়!তোর আব্বা তো এখন এতই মশগুল নেটে,মাঝেমধ্যে ডিনার করতেও ভুলে যায়।"
মুখ ফুটিয়ে একটু কাঁদতে ইচ্ছে করছে হঠাৎ!বুকটা ভারী হয়ে উঠেছে আচমকা। আচ্ছা,মায়েরা বুঝি এরকমই হয়?লোকালয়ের সমস্ত মানুষের রঙিনসব চাওয়া-পাওয়ার ভীড়ে এভাবেই কি রুদ্ধ-শ্বাসে চাপা পড়ে থাকে সমস্ত মায়েদের ইচ্ছেগুলো?
মোবাইলস্ক্রিনে নাটকের ওপর গল্প-কমেন্টসের নোটিফিকেশনগুলো ভেসে আসছে একের পর এক,সেই সাথে হঠাৎ আলিশার ম্যাসেজটাও। থাক!কমেন্টসগুলো আজ আর না-ই বা পড়ি,ম্যাসেজটাও আজ পড়ে থাকুক সামান্য অবহেলায়। আম্মা একটু শান্তিতে দেখে যাক নাটকটা।

-----সমাপ্ত--------

লেখা:- এলমুন নূর খান - নটরডেম কলেজ।
 

Delivered by FeedBurner

a