.
অফিসে বসে কাজের ফাঁকে সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস তুহানের। আজকে খবরের কাগজে চোখ বুলাতে গিয়ে খবরের কাগজের মাঝের পাতার এককোণে এ শিরোনামে চোখ আটকে গেলো তার। পুরো আর্টিকেল টা মনোযোগ সহকারে পড়লো সে। আর্টিকেলে লিখা ডাঃ নায়লা গতকাল রাত সাড়ে নয়টায় বাড়ি ফিরে যান এবং তার মৃত্যু হয় রাত আড়াইটা নাগাদ।
.
নিকিতার আটসপ্তাহ চলছে। তুহান নিকিতার চেকআপের জন্য তাকে নিয়ে গতকাল ডাঃ নায়লার চেম্বারে যায় রাত সাড়ে আটটায়। তার মানে নিকিতার পর আর কোনো পেশেন্ট দেখেননি ডাঃ নায়লা। কিন্তু তুহান নিজে দেখেছে নিকিতার পরেও প্রায় সাত-আটজন পেসেন্ট ওয়েটিং রুমে ছিলেন। ডাঃ নায়লা নিকিতাকে দেখে সব ঠিকঠাক আছে বলেছিলেন। মাত্র দু'মাসে পেটের আকারের তেমন পরিবর্তন বোঝা যায়না। নিকিতার পেট স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটা ফোলা মনে হচ্ছে। ডাঃ নায়লা কিছুটা সন্দিহান হয়ে আরেকবার ইউএসজি করে নিতে বললেন। তুহান নিকিতাকে নিয়ে তখনোই ইউএসজি রুম থেকে আলট্রাসনো করিয়ে আনলো। ডাঃ নায়লা রিপোর্ট হাতে নিয়ে আতঙ্কিত চাহনিতে তাকিয়ে রইলেন।
"এটা কিভাবে সম্ভব? এত তাড়াতাড়ি ভ্রূণের হাত পায়ের প্রতিটা আঙ্গুল স্পষ্ট বোঝা যাওয়ার কথা না। তারচেয়ে বড় কথা..."
এতটুকু বলেই চুপ হয়ে গেলেন তিনি।
তুহানের প্রশ্নে চমকে তাকিয়ে বললেন, "ভ্রূণের হাত পায়ের প্রতিটিতে ছয়টা করে আঙ্গুল দেখা যাচ্ছে। আর... ভ্রূণের চতুর্দিকজুড়ে নীলচে আভা! এর অর্থ কি আমি জানিনা। আমার বারো বছরের চিকিৎসাজীবনে এমন অদ্ভুত ইউএসজি রিপোর্ট আমি দেখিনি।"
তুহান স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, "কি বলছেন ডাঃ নায়লা?"
"আমি ঠিক বলছি মিস্টার তুহান। আমি বুঝতে পারছিনা কি করা উচিত! আপনারা বরং আজ আসুন। আমি অন্যান্য ডাক্তারদের সাথে কথা বলে আপনাকে জানাবো!"
.
তুহানের গতকাল রাতে ডাঃ নায়লার কথোপকথনের কথা মনে পড়তেই সে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে তার বন্ধু, ধানমন্ডির ওসি নাজমুস সাকিবের সাথে দেখা করতে থানায় গেলেন। ডাঃ নায়লার মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্য তার কাছে পাওয়া যেতে পারে। নাজমুস সাকিবই প্রথম ডাঃ নায়লার মৃত্যুর খবর পেয়ে তৎক্ষনাৎ তার বাড়িতে গিয়েছিলেন। সকল আলামতে স্পষ্ট যে তিনি সুইসাইডই করেছেন, কিন্তু এর কারণ জানা যায়নি।
.
নাজমুস সাকিবের সাথে কথা বলে তুহান এবিষয়ে যা জানতে পারলো তা তার মনে বেশকিছু প্রশ্নের জাল তৈরি করলো।
ডাঃ নায়লা গতকাল রাতে নিজগৃহে ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুইসাইড করেছেন৷ বিয়ের তিনবছরের মাথায় তার ডিভোর্স হওয়ার পর তিনি আর বিয়ে করেননি। ধানমন্ডিতে তাঁর নিজস্ব দোতলা বাড়িতে তিনি একাই থাকতেন। সাথে একটা পনেরো-ষোলো বছরের মেয়ে থাকতো। গতকাল রাতে তিনি চেম্বার থেকে সাড়ে নয়টায় বাড়িতে ফিরে যান। রাতে কিছু খাবেন না বলে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েন। সকালে মেয়েটা নাস্তা নিয়ে গিয়ে দরজা ধাক্কিয়ে কোনো সারা পাননা। প্রায় একঘন্টা ডাকার পর বাড়ির কেয়ারটেকার কে ডেকে আনে মেয়েটা। দরজা ভাঙ্গা হয়। ডাঃ নাহার লায়লা বিছানার ওপর পড়ে ছিলেন। তার হাতের কাছেই ওষুধের কৌটা পাওয়া যায়৷ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী তিনি আনুমানিক রাত আড়াইটা নাগাদ মারা যান। তার বিছানার পাশের ছোট টেবিলের ওপর তার ব্যক্তিগত ডায়েরি পাওয়া যায়। ডায়েরির সর্বশেষ লেখার পূর্বের লেখাটা ছিলো ছয়মাস পূর্বের। অর্থাৎ তিনি নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন না কিংবা লিখার সময় পেতেন না। তার সর্বশেষ লিখাটা ছিলো সুইসাইডের রাতেই লেখা। তিনি সাদা পাতায় তারিখের নিচে শুধু দুটো শব্দ লিখেছেন....
"ওরডগ" "ভ্লোকোশ্লাক"
তুহান ডায়েরির লিখাটা দেখলো। এদুটো শব্দ সে আগেও কোথাও শুনেছে বলে মনে হলো। কিন্তু এশব্দ দুটোর অর্থ কি! ইন্টারনেট ঘেঁটে শব্দদুটোর অর্থ বের করলো সে৷ ওরডগ অর্থ শয়তান, আর ভ্লকোশ্লাক অর্থ রক্তশোষক পিশাচ বাদুর। তুহানের মনে পড়লো সেদিন রাতে নিকিতাও এমন কিছু শব্দই জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে বলছিলো। তুহানের কেমন ভয়ভয় করতে লাগলো। ডাঃ নায়লার সুইসাইডের সাথে নিকিতার কোনো সম্পর্ক নেই তো!
.
ডাঃ নায়লার মৃত্যুর ঠিক চারদিন পর তুহানের নম্বরে একটা ফোন এলো। ডাঃ নাহার নায়লার কলিগ, গাইনোকোলজিস্ট, ডাঃ অতুল সরকার তুহানের সাথে দেখা করতে চাইলেন৷ সেদিন রাতেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে তুহান তার সাথে দেখা করলো। তিনি জানান, ডাঃ নাহার নায়লা সেদিন রাতে অর্থাৎ সুইসাইডের রাতে নয়টায় চেম্বারেই ডাঃ সরকারের সাথে দেখা করেন। তিনি নিকিতার কথা তাকে জানান। আল্টাসনো রিপোর্টটাও তিনি তাকে দেখিয়েছিলেন। ডাঃ সরকার একয়দিনে রিপোর্ট নিয়ে অনেক ভেবেছেন। কিন্তু এমন অদ্ভুত ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা তার জানা নেই। মেডিকেলের হিস্টোরিতে এমন ঘটনা কখনো দেখা যায়নি।
ডাঃ সরকার তুহানকে নিকিতার অপারেশনের কথা বললেন। হয়তো অপারেশন করলে অস্বাভাবিকতাটা ধরা পড়বে।
তুহান বাড়ি ফিরে নিকিতাকে অপারেশনের কথা জানাতেই নিকিতা উন্মাদের মতো আচরণ করতে শুরু করলো। বারবার একই কথা বলতে লাগলো, "না তুহান। ওরা চায়না আমি মা হই। অপারেশন করে আমার মেয়েকে মেরে ফেলতে চায় ওরা। তুমি ওদের কথা শুনিওনা!"
নিকিতার পাগলামি ক্রমশ বেড়ে চললো। গর্ভাবস্থায় তার এমন উদ্বিগ্নতা দেখে কেউ আর তাকে জোর করার সাহস করলোনা।
.
.
নিকিতা এখন পাঁচমাসের গর্ভবতী। তার শরীরের কোনোরকম সমস্যা হয়নি, বরং আগের চেয়ে বেশি হাসিখুশি থাকে সে সবসময়। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো, তার পেট দেখলে মনে হবে সে আট-নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ডাঃ সরকার নিকিতার মানসিক অবস্থা বিবেচনায় অপারেশনের কথা এরপরে আর বলেননি। তবে তৃতীয়বারের মতো তিনি নিকিতার আল্ট্রাসনোগ্রাফি করেছিলেন। এবার ভ্রূণের কোনো অস্বাভাবিকতা আর ধরা পড়েনি। তাই পূর্বের রিপোর্ট তিনি ভুল হিসেবেই ধরে নিয়েছেন।
.
.
সাতমাসেই নিকিতার পেইন উঠে যায়। তাই ডাক্তাররা তাড়াতাড়ি ডেলিভারি করতে বাধ্য হয়। ডাঃ সরকার নিজে অপারেশন থিয়েটারে পুরোসময় থাকেন।
নিকিতার মেয়ে হয়। মেয়ের গায়ের রং নিকিতার মতোই টকটকে ফরসা। তুহানের কোলে যখন প্রথমবারের মতো বাচ্চাটাকে দেয়া হয়, সে মেয়েকে আলতো করে আগলে নিয়ে আদর করতে করতে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠছে একেকবার, তারপরই আবার পাগলের মতো বসে কাঁদছে।
.
নিকিতা-তুহান মেয়ের নাম রাখলো, "নাতাশা"। ভালোই কাটছিলো সময়গুলো। নিকিতা বিয়ের পর যেমন উচ্ছলতা নিয়ে থাকতো, মেয়ে হওয়ার পর মপয়েকে নিয়ে তেমনই মেতে উঠলো। তুহানও অফিসে ছুটি নিয়ে প্রায়ই বাড়িতে সারাদিন কাটিয়ে দিতো৷ কয়দিন যাওয়ার পর একদিন রাতে নিকিতা আচমকা তুহানকে বললো, " আমি না থাকলে তুমি আমার মেয়ের যত্ন নিবে তো?"
"না থাকার প্রশ্ন আসছে কেনো নিকিতা?"
"না এমনিই বললাম। কিছুক্ষণ পর নিকিতা আবার বললো, "তুহান কখনো যদি আমার উপর খুব রাগ হয়, আমাকে ক্ষমা করে দিও।"
"এসব কথা বলছো কেনো তুমি? কি হয়েছে বলোতো?" বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলো তুহান!
"আমার হাতে বেশি সময় নেই। ওরা আমাকে বেশি সময় দেয়নি!"
"কারা? কিসের সময়? আমি কিছু বুঝতিছিনা?"
নিকিতা এই প্রশ্নের আর কোনো উত্তর দিলোনা। অন্যমনস্ত হয়ে ঘরের দরজার দিকে একমনে তাকিয়ে রইলো।
.
কয়দিন পরেই বড় ধরণের এক অস্বাভাবিক ঘটনা কালো ছায়া হয়ে নেমে এলো তুহানের জীবনে। নাতাশার জন্মের দশদিনের দিন রাতে নিকিতা ঘরের ফ্যানে ওড়না ঝুলিয়ে আত্নহত্যা করলো। তুহান পুরোপুরি ভেঙে পড়লো নিকিতার মৃত্যুতে। নিজেকে সামলিয়ে তুলতে বাধ্য হলো নাতাশার কথা ভেবে। তার এখন অনেক দায়িত্ব। নাতাশা কে নিয়ে শুরু হলো তার নতুন যুদ্ধ। কিন্তু এরপর নাতাশাকে নিয়েই শুরু হলো তার জীবনের আরেক কলঙ্কময় অধ্যায়........
.
.
চলবে...........
.
.
Writer:- নবণীতা ফেরদৌস