> হ্যাশট্যাগ গ্রামের খালাতো/ফুপাতো/মামাতো/চাচাতো ভাই
-->

হ্যাশট্যাগ গ্রামের খালাতো/ফুপাতো/মামাতো/চাচাতো ভাই



ব্র্যান্ডের টি শার্টের ওপরে ব্র্যান্ডের শার্ট আর হাঁটুতে ছেঁড়াফাটা, উরুতে বিড়ালের খামচির মতো দাগের জিন্স পরনে ছেলেটা রোদ চশমার আড়ালে চোখদুটো ঢেকে রেখেছে রাতের অন্ধকারেও । কথায় কথায় Cool আর OMG বলা ছেলেটার নাম শাহরিয়ার । জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছে আসাদ এভিনিউ'র নয়তলা এক বাসার সাত তলায় । দাদা, নানা উভয়েই ঢাকার বাসিন্দা ছিলেন তাই ছুটিতেও কখনো ঢাকার বাইরে যাওয়া হয়নি ছেলেটার । এই প্রথমবারের মতো সে ঢাকার বাইরে এসেছে ফুপুর বাসায় ।

সকালবেলা খেয়ে, নিজের ক্যামেরাটা গলায় ঝুলিয়ে ফুপাতো ভাইকে নিয়ে বের হয় গ্রাম ঘুরে দেখার জন্য । বর্ষার মৌসুমে চারদিকে শুধু পানি আর পানি । তার সমবয়সী গ্রামের ছেলেদের সামনে দিয়ে ভাব নিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সে ভাবে গ্রামের ছেলেগুলা কত্ত ক্ষ্যাত আর আনস্মার্ট হয় ! ডিএসএলআর কাঁধে ঝুলিয়ে সে মনে মনে ভাবে আমি কি হনু রে !! এসব গ্রামের পোলাপাইন কি আর আমার লেভেলের ?

পুরোটা সকাল ঘোরাঘুরি করে দুপুরে বাসায় গিয়ে তার চক্ষু ছানাবড়া । ওঠোনে শাপলার মেলা বসেছে যেন ! এতো শাপলা ফুল কখনো একসাথে দেখা হয়নি তার । ক্যামেরা বের করে ক্যাচ ক্যাচ করে কয়েকটা ছবি তুলে নেয় । ছেলেটা আরো বেশি অবাক হয়ে যায়, যখন তার ফুপাতো ভাই শাপলা ছিঁড়ে ভেতরের হলুদ অংশ খেতে থাকে । ছেলেটার চোখ আটকে যায় সেদিকে ! ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফুপাতো ভাই রিমন বলে, "ভাইয়া, তুমি কখনো ঢ্যাপ খাওনি ?"

শাহরিয়ার তাকিয়ে থাকে, প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না । ফুলও যে খাওয়া যেতে পারে, তা তো তার কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে ! প্রথমবারের মতো তার মনে হয়, সে হয়তো অনেক কিছুই জানে না ।

খুব ভোরে তার ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রস্রাবের চাপে । ঢাকায় তো তার রুমের সাথেই অ্যাটাচড বাথরুম ছিল কিন্তু গ্রামে এসে ছেলেটা চরম বিপাকে পড়ে যায় । উঠোন পেরিয়ে অনেকটা দূরে টয়লেট, এই আধো আলো-অন্ধকার ভোরবেলায় পুকুরের পাড়ের টয়লেটে যাওয়ার কথা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে তার । একদিকে প্রস্রাবের চাপ ক্রমবর্ধমান আর, একদিকে ভূতের ভয় তাকে মাঝামাঝি অবস্থায় আটকে ফেলেছে । অগত্যা, ফুপাতো ভাইকে ডেকে তোলে সাথে যাওয়ার জন্য । অথচ সেই ফুপাতো ভাই তার থেকে চার বছরের ছোট ।

সকালবেলা খাওয়ার সময় সবার সামনে এ কথা বলতেই সবাই হেসে ওঠে । লজ্জায় তার মাথা নিচু হয়ে আসে । কলেজে ওঠেছে এইবছর কিন্তু এখনো ভূতের ভয়ে কিনা টয়লেটে যেতে পারেনি । আসলে ছেলেটারও তো কোন দোষ নেই, আগে কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি সে । গ্রামে থাকার অভিজ্ঞতা একেবারেই শূণ্যের কোটায় ! গ্রামের টয়লেট এতো দূরে হলে তার কি করার আছে সে ভেবে পায় না !

দুপুরবেলা সুইচগেট ব্রিজে গোসল করতে যায় লাইফ জ্যাকেট নিয়ে । সেখানে গিয়ে তার আরও অবাক হওয়ার পালা ! ছোট ছোট ছেলেরা ব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়ছে পানির মধ্যে কিন্তু কারো সাথে লাইফ জ্যাকেট নেই । তার মানে ওরা সবাই সাঁতার কাটতে পারে আর সে এতো বড় হয়েও লাইফ জ্যাকেট নিয়ে এসেছে গোসল করার জন্য ? তার ইচ্ছা জাগে লাইফ জ্যাকেট ছাড়াই পানিতে নামবে এবং সবার কথা অমান্য করেও নামেও ! স্রোতের টানে আটকে থাকতে না পেরে অনেক দূরে চলে যায় শাহিরয়ার, কিন্তু সে ভেসে থাকতে তো পারে না ! শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে তাকে বাঁচায় এক ছেলে !

বাসায় হইচই অবস্থা, আরেকটু হলেই প্রাণটা চলে যেতো তার । কেন সে লাইফ জ্যাকেট রেখে পানিতে নামলো ? সে কি সাঁতার জানে ?
এমন হাজার প্রশ্নে তার মাথা আরো নিচু হয়ে আসে । সাঁতার না পারার লজ্জায় তার মরে যেতে ইচ্ছা করে । বিশেষ করে ওই ছেলেটার কথা মনে হলে, যে ওকে পানি থেকে টেনে তুলে এনেছিল । কতই বা বয়স হবে তার, সর্বোচ্চ এগারো কি বারো !! অথচ কি দক্ষতা তার, কি ভালো সাঁতার কাটতে পারে ! হাত পা নাড়ানো ছাড়াই ভেসে থাকতে পারে ! চুপ করে ওল্টো হয়ে শুয়ে থাকতে পারে পানির ওপর ! সে কি কখনো পারবে এমনটা ?

পানির ঘটনার পর থেকে তাকে চোখে চোখে রাখে বাসার সবাই । যদি আবার দূর্ঘটনার সম্মুখীন হয় ছেলেটা ! একদিন বিকালে বাসার সবাই নৌকায় করে ঘুরতে যাবে । নৌকা নিয়ে বের হয় ছেলেটাকে সবার মাঝখানে বসিয়ে রেখে । ছেলেটা অবাক হয়ে দেখে তার ছোট ফুপাতো ভাই বাশের লগি দিয়ে কি নিপুণভাবে নৌকা ঠেলে নিচ্ছে ! তাকে দিয়ে কি এই কাজটা হবে কখনো ? অথৈ পানিতে গিয়ে আবার বৈঠা হাতে বসে যায় রিমন । এক বার ডানে, একবার বায়ে বৈঠা মেরে নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে যায় । শাহরিয়ার ক্যামেরায় ধারণ করে রাখে সেই দৃশ্য !

বর্ষায় দিনে তিনদিন হয়ে গেলো সে গ্রামে এসেছে, অথচ এখনো বৃষ্টির দেখা মেলে নাই । চতুর্থদিন হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি নামে ! ফুপাতো ভাই তাকে নিয়ে ফুটবল খেলতে বের হয় তার বন্ধুদের সাথে । নদীর বালু এনে ক্ষেতের জমি উঁচু করা হয়েছে মার্কেট বানানোর জন্য । সেই বালুচরে দল ভাগ ফুটবল খেলা শুরু হয় । বালুর মধ্যে ফুটবল খেলা যে ঘাস ওয়ালা মাঠে বুট পরে খেলার চেয়ে কতোটা কঠিন তা হারে হারে টের পেতে থাকে ছেলেটা । দুই ঘন্টা দৌড়াদৌড়ি বৃষ্টিতে দৌড়াদৌড়ি করে পায়ের ব্যাথায় আর ঠান্ডায় জ্বর এসে যায় ।

তার পরের দুই দিন বাসা থেকে বের হওয়া তো দূরে থাক, বিছানা থেকে ওঠাই মুশকিল হয়ে গিয়েছিলো শাহরিয়ারের । তিনদিনের দিন জ্বর নেমে গেলে সে রিমনের সাথে বরশি নিয়ে বের হয় মাছ ধরার জন্য । কিন্তু না পারে বরশিতে খাবার গাঁথতে, না পারে ছিপের ব্যালেন্স রাখতে । মাছ কখন খাবার খেয়ে চলে যায় তাও বুঝতে পারে না সে ! আর তার ছোট রিমন পটাপট কয়েকটা বড় আকারের পুঁটি খলুইতে ভরে ফেলেছে । এখানেও তার ব্যর্থতা মেনে নিতে হয় । মাথাটা আরো নিচু হয়ে আসে । তখন দ্বিতীয় বারের মতো তার বোধ হয়, সে আসলে অনেক কিছুই পারে না !

এসএসসি শেষ করে পনের দিনের জন্য গ্রামে ঘুরতে এসে শাহরিয়ার বুঝতে পারে, তার ওই পিজ্জা/বার্গারের ফাস্টফুড, হাতিরঝিল, ফার্মগেট, বসুন্ধরা, নীলক্ষেত আর মিরপুরে ফ্রেন্ড সার্কেল বাদেও অনেক বড় দুনিয়া আছে । আর সে ওই দুনিয়ার নবজাতক একটা শিশুর মতো যে মাছ ধরতে জানে না, নৌকা বাইতে জানেনা, শাপলার ঢ্যাপ চিনেনা, যার বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর হয়, ঠান্ডা লাগে । সে সাঁতার কাটতে জানে না, ঘুড়ি আর চঙ এর মধ্যে পার্থক্য জানে না, জানে না কিভাবে কোচ দিয়ে মাছ গেঁথে ফেলতে হয় । শাহরিয়ার জানে না কিভাবে মাটি খুঁড়ে কেঁচো বের করে বরশিতে গাঁথতে হয় অথবা কিভাবে হাঁস মুরগির ডিম খোঁয়াড় থেকে বের করতে হয় ।

জীবনে তার অনেক কিছুই অজানা, অদেখা । সে তার ফুপাতো ভাইয়ের মতো শামুকের খোলস ভেঙে হাঁসকে খাওয়াতে পারে না, গাছে ওঠে ডাল কাটতে পারেনা, গরুকে গোসল করাতে পারে না, আমের আইট দিয়ে বাঁশিও বানাতে পারে না । সে পারে শুধু ক্যামেরার লেন্স দিয়ে দেখতে, ফোকাস করে দুই চারটা ছবি তুলতে ! সে তো হাটে গিয়ে বাজারটাও করতে পারে না, মাছ দরদাম করতে পারে না, জিলাপি অথবা নিমকির জন্যে বাজারের টাকায় গোঁজামিল দিতেও পারে না ।

পনের দিন পরে শাহরিয়ার কাঁধে ব্যাগ আর হাতে স্যুটকেস নিয়ে বের হয়, পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে এই পনের দিনে তার সব স্মৃতি ! সে কতোকিছুই জানতো না, কতো কিছু অদেখা ছিল তার ! কিন্তু এখন সে অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরছে, মাথা ভর্তি করে স্মৃতি নিয়ে ফিরছে । বন্ধুদের অনেক গল্প বলার আছে, অনেক স্মৃতি শেয়ার করার আছে ।

আবার হঠাৎই মনে হয়, কি দরকার এসব বলার ! ওরা কি এসব বুঝবে ? রেস্টুরেন্টের লাল নীল বাতির নিচে অনভ্যস্ত হাতে কাওকে চিকেন উইংস খেতে দেখলে কিংবা পিজ্জা খেতে গিয়ে সস কাপড়ে লেগে গেলে কিংবা মেনু দেখে খাবারের নাম না বলে নাম্বার বলে অর্ডার করলে, প্রথমবার রেস্টুরেন্টে খেতে আসা গ্রামের ছেলেটাকে দেখে যারা হাসাহাসি করে ওরা গ্রাম না দেখে গ্রামের ছেলেদের সম্পর্কে কি বলবে ?

ছবি তুলে ফেসবুকে "When your গ্রামের খালাতো ভাই doesn't know how to eat chicken wings" লিখে কয়েকটা হাসির ইমো দিয়ে পোস্ট করা পাবলিকরা গ্রামে না গেলে কিভাবে বুঝবে শহরের জ্যাম আর চার দেয়ালে আটকে থাকা তারা গ্রামের ওই জীবনে কতোটা অনভিজ্ঞ ! যেদিন তারা এসব বুঝবে সেদিন "গ্রামের খালাতো/মামাতো/ চাচাতো ভাই" ট্যাগ দেওয়া বাদ দিবে ।



(বিঃদ্রঃ আমার এই লেখার উদ্দেশ্য কাওকে ছোট করা নয় বরং নিচু মন মানসিকতার কিছু ছেলে মেয়েদের বুঝানোর জন্য । শহরের/বড় নগরীর মানুষের প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোন ক্ষোভ নেই । আর শহরের সবাই যে এমন তাও না, আবার গ্রামের হলেই যে সে ভালো তাও কিন্তু না । লেখাটার উদ্দেশ্য কারো দূর্বলতা/অজ্ঞতা নিয়ে কটুক্তি করা মানুষদের বুঝানো । তারপরও যদি কারো কোন অংশ নিয়ে আপত্তি থাকে তাহলে কমেন্ট বক্স তো খোলাই আছে ।)
 

Delivered by FeedBurner

a