Leave a message
> বন্দী যে মন - Logical Discussion - Boipoka365
-->

বন্দী যে মন - Logical Discussion - Boipoka365


Logical Discussion


আমি আমার ছেলের সব গল্পের বইগুলা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিলাম। ছেলেটা আমার হঠাৎ কান্না থামিয়ে বোকা বোকা চোখে বই গুলার দিকে চেয়ে রইল। আমি তৃপ্তির হাসি হেসে ছাদ থেকে নেমে রান্না ঘরের দিকে এগুলাম  বেলা বেড়ে চলছে ওদিকে রান্নাটা বসানোর ফুসরত পাইনি এখনো।

হাজারটা দিন বারন করেছি এসব ছাইপাঁশ পড়িস না, কি হবে ওসব পড়ে? রাত দিন এক করে মাথা খুঁটে পড়াশোনা করেও যেখানে একটা গতি হয়না সেখানে এত সময় অপচয় করার মত সময় কই? বিকেলের খেলাটা অনেক কষ্টে বন্ধ করেছি,ওর বাবা  একদিন সারা বিকাল ওকে দরজা বন্ধ করে রেখেছিল ওর ঘরে। প্রথমে কয়েকবার দরজা ধাক্কাধাক্কি করল,কান্না কাটি করল তার কিছু সময় পর সব নিরব। আসলে জগৎ টাই এমন শক্তের ভক্ত, নরমের যম। শাসন না করলে ছেলেপুলে মানুষ হয়না। শাসন করত আমার বাবা মা, মায়ের হাতে লাঠি দেখলেই ভয়ে দৌড়ে পালাতাম,বাবার গলার আওয়াজ পেলেই দোয়া ইউনুস পড়তাম। তাইতো আজ মানুষ হতে পেরেছি। আমার ছেলেমেয়ে গুলা হয়েছে ভীষন ঘাড় তেড়া। মাঝে মাঝে মন চায় ঘাড়টা মটকে দেই। কার মত হয়েছে কি জানি।

সৌম্যর কথা মনে  পড়তেই ওর রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম, এখনো কি ছাদেই ঘাপটি মেরে বসে আছে? 

নাহ্ চুপচাপ বই খুলে পড়ার টেবিলে বসে আছে। 

মনটা খুশী হতে গিয়েও ঠিক হতে পারলনা।

কিরে গলায় জোর নাই? কোন আওয়াজ পাচ্ছিনা কেন? ঘড়ি ধরে একটানা দু ঘন্টা পড়বি, না হলে আজ ফিরুক তোর বাবা.....

বাহ্ কথা শেষ হতে না হতেই বেশ সুর করে পড়া শুরু করেছে। আমার ছেলেটার মাথা ভাল, একটু যত্ন পেলেই ভাল করবে। তাইতো আমাকে একটু কঠিন হতে হয়,কে না চায় যে তার সন্তান বড় হোক। 

সাম্মিটাকে তিন বার করে বলে এসেছি ফোনটা রাখতে,এখনও ওর হাসির আওয়াজ পাচ্ছি। 

কিরে তোকে না হাজারবার বলেছি ফোনে এত ফাও আলাপ করবিনা। এইচ. এস. সি র রেজাল্ট টা যদি ভাল না হয়না তাহলে তোর পেছনে খরচ করা প্রত্যেকটা পয়সার হিসেব দিতে হবে এই বলে দিলাম..... 

ঠাস্ করে ফোনটা রেখে উঠে ঘরে গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিল৷ আচ্ছা বেয়াদব হয়েছে মেয়েটা। গালে দুটো কষে চড় দিলে এসব মেজাজ বের হয়ে যাবে। নিছক গায়ে পায়ে বড় হয়েছে তাই আজকাল হাত টা চুলকালও চালাইনা।

মাত্র দুপুরে খেয়ে ভাত ঘুম দিয়েছি। ছোট মেয়েটা কই থেকে দৌড়ে এসে গায়ের উপর পড়ল।  দু'দন্ড শুয়েও শান্তি নেই। সাম্মিকে পাঁচবার ডেকে পেলাম,

কিরে তোকেনা বললাম বোনকে দেখে রাখ। সারাদিন গাধার মত খেঁটে মরব আমি আর ওদিকে উনি না পড়াশোনা করবেন না বোনটাকে সামলাবেন। আমার হয়েছে যত জ্বালা। ছেলে মেয়ে পেটে ধরাও যে কি যন্ত্রণা...... 

সাম্মি আলতো করে সম্পাকে কোলে করে মুখ ভার করে ঘর হতে বেরিয়ে গেল।

রাতে খাবার টেবিলে বসে ওর বাবা সাম্মিকে উদ্দেশ্য করে বলল,পড়াশোনা করতে ভাল না লাগলে বল। হাতে ভাল ভাল পাত্র আছে আমরা আগ্রহ দেখালেই তারা এগুবে।  অযথা পয়সা খরচ করোনা পড়াশোনা ভাল না লাগলে ছেড়ে দাও।

সাম্মি মাথা নিচু করে ডাল দিয়ে ভাত মেখেই যাচ্ছে। একটু পর পর গ্লাস হাতে করে এক এক ঢোক করে পানি খাচ্ছে।

আমি যে এত এত চিল্লাই কানে যায়না,উল্টা মেজাজ দেখায় বাপে বললে ঠান্ডা এখনতো মাথাটাও তোলার সাহস হবেনা। পারে শুধু আমার সাথে। 

ওর বাবা এবার সৌম্যর দিকে ফিরল,

সৌম্য আর যেন তোমার হাতে গল্পের বই না দেখি। যদি দেখিতো তোমার পড়াশোনাও বন্ধ গ্রামে গিয়ে মামাতো ভাই বোন দের সাথে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াবে। বাঁদর ছেলে কোথাকার!

আমি মাছের মাথাটা ওদের বাপের প্লেটে তুলে দিলাম। সে আহা করে উঠল,সৌম্য কে দাও।  সামনে পি. এস. সি ওর এখন ভাল ভাল খাওয়া দাওয়া করা দরকার। 

আমি জানি সৌম্য মাছের মাথা খায়না। কিন্তু বাপের মুখের ওপর না করার সাহস হবেনা তার। আমাদের খাওয়া শেষ হওয়ারও প্রায় চল্লিশ মিনিট পর ও খাবারটা শেষ করে উঠল। ছেলে আমার খুবই বাধ্য মুখ দিয়ে টু শব্দটি করেনা কখনো।

পরদিন বিকেলে পাশের বাড়ীর রিপনের মা যখন বলল সম্পা নাকি তার  ছেলেকে খামচি দিয়েছে আমার মাথা টাই গরম হয়ে গেল। সম্পাকে কান টেনে ধরে নিয়ে এসে বললাম,কিরে রিপন কে খামচি দিয়েছিস? সমানে মাথা নেড়ে না বলতে লাগল। গালে দুটো কষে চড় দিয়ে বললাম,ভাবি মেয়েটা আমার আস্ত বদ,কিছু মনে করবেননা ভাবি,আমিই বোধয় ঠিক মত শাসন করতে পারছিনা।

রিপনের মা রিপনের হাতটা ধরে,"হ ভাবি ছেলে মেয়ের দিকে একটু খেয়াল রাইখেন সন্তান মানুষ করা চাট্টিখানি কথানা" বলে নির্লিপ্ত মুখে বিদায় নিল। 

আমার ভীষন হতাশ লাগতে শুরু করল। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম। একটা ছেলে মেয়েকেও মানুষ করতে পারছিনা। পেটের সন্তান চাইলেও ফেলতে পারিনা,আবার সইতেও পারিনা। 

সন্ধ্যায় ওদের বাবা বাসায় ফিরে আমার মুখ ভার দেখে দু চার বার জানতে চাইল কি হয়েছে। আমার উত্তর করবার ইচ্ছে হলনা৷ হঠাৎ সাম্মি রুমে ঢুকে কোন ভণিতা না করেই বলল,বাবা আমার জন্য ছেলে দেখ,আমি আর লেখা পড়া করব না। আমি অবিশ্বাসের চোখে তাকালাম। ওর বাবা কটমট করে তাকিয়ে বলল, তা পরের বাড়িতে গিয়ে থালা বাসন মাজার ইচ্ছে হয়েছে বুঝি? 

সাম্মি কোন উত্তর না করে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

আমি ওর স্পর্ধা দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। অনেক দিন কিছু না বলতে বলতে মাথায় চড়ে বসেছে মেয়েটা। নির্ঘাত এমন বেয়াদবির জন্য মাইর খাবে এখন।

ওর বাবা কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় সৌম্য পর্দার পেছন থেকে বেরিয়ে এল। বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল,ওকে কিছু বল না বাবা। ও না প্রায়ই রাতে কাঁদে। আমারো কান্না পায়, তোমরা আমার সব খেলনা স্টোরে দিয়েছ বলে,  আমাকে খেলা করতে যেতে দিবেনা বলে,ঘর বন্দি করে রেখেছ বলে, আমার প্রিয় বইগুলা জ্বালিয়ে দিয়েছ বলে যতটা না তার চাইতেও বেশী ওকে দেখে কান্না পায়, বোনকে মারতে দেখে কান্না পায়। আমরাতো ছোট বাবা তাই আমরা না রাগ হলে তোমাদের মত করে বকা দিতে পারিনা, চাইলেও সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে অথবা জ্বালিয়ে দিতে পারিনা, খেতে ভাল লাগছেনা বলে খাবার ফেলে দিতে পারিনা, আমাদের তো টাকা নেই বাবা তাই তো আমাদের পেছনে তোমাদের খরচ হওয়া পয়সাও ফিরিয়ে দিতে পারিনা। 

সাম্মি ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলে,চুপ কর ভাই।

সৌম্য বলে,আমি পড়াশোনা করব আপু। যেদিন আমিও মা বাবার মত বড় হব দেখবি সেদিন আর আমি কাউকে আমাদেরকে বকা দিতে দিব না,মাইর দিতে দিব না, কাউকে কষ্ট দিতে দিবনা তুই দেখে নিস। তোকে অনেক টাকা দিব যেন তোর পড়াশোনা বন্ধ করে কাউকে বিয়ে করে চলে যেতে না হয়। সত্যি বলছিরে আপু এই দেখ তোর গা ছুঁয়ে বলছি। জানিস বনি বলেছে কারো গা ছুঁয়ে কথা দিলে সেটা না রাখলে নাকি সে মারা যায়,তুই বল আমি কি চাই যে তোর কিছু হোক?

সাম্মি ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল ফেলে।

ওর বাবা চোয়াল শক্ত করে ফ্লোরে পায়ের বুড়া আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুকি করে। আমার বুকের ভেতর রাগ,ক্ষোভ, ভয় মিশ্রিত এক অদ্ভুত কষ্টের অনুভুতি হয় ঠিক যেমন কষ্ট বুকে চেপে আমাদের সন্তানেরা হাজারটা অন্যায় অত্যাচারকে প্রতিনিয়ত  নিরবে লালন করে বেড়ে ওঠে। 

এজগতে সব চাইতে অসহায় মনে হয় শিশুরা হয়,আমাদের সন্তানেরাই হয়, যাদের চারপাশে আপনি আমি ছাড়া হাসি খুশি রাখার মত আর কেউ নাই। এটা বুঝেও স্বীকার করবার মত সৎ সাহস আমাদের ক'জনেরই বা হয়!



( সমাপ্ত )




লেখা: তারানা তাবাসসুম

 

Delivered by FeedBurner

a