Leave a message
> মেঘদূত শেষ পর্ব
-->

মেঘদূত শেষ পর্ব


ঐত্রী প্রচন্ড ব্যাথা নিয়েও বরফের মতো শীতল গলায় বলল 'আমি তো মরেই যাচ্ছি! তোমার মেয়েকে বাঁচাবে কি করে?'

আমার মনে হল এই বাক্য আমার সারাজীবনে শোনা সবচেয়ে আনপ্রেডিক্টেবল বাক্য! ওর বলার ধরন অদ্ভুত। প্রত্যেকটা শব্দে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস।আমি দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছি না। ঐত্রী ট্রমাটাইজড, প্যানিকড অথবা মানসিক বিকারগ্রস্ত! এই বাক্য সে সজ্ঞানে বলতে পারে না! কিছুতেই না!

পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনে আমার একমাত্র পাওয়া 'ঐত্রী'! আমার গত চারবছর ভালো খারাপ ইচ্ছা অনিচ্ছা শুধু তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। যেই মেয়েটা আমার কাছে নিয়তির মতো সত্যি তার অনুপস্থিতি আমার কাছে মৃত্যুর সমান! 

ঈশ্বর নিঃসঙ্গ! প্রিয় মানুষের মৃত্যুর কষ্ট যদি তাঁর জানা থাকতো এ জগতে কোন মৃত্যু থাকতো না। ঐত্রী মারা গেলো অপারেশন টেবিলেই। থেকে গেলো মেঘদূত! এরপরের ছ'মাস দিন রাতের হিসাব আমার কাছে ছিলো না। এরপরের ছ'মাস আমি ঘরের জানালা খুলিনি। আমার অর্ধেক ছাদ জুড়ে ঐত্রীর করা আল্পনা অর্ধেকই রয়ে গেলো। ওই সময়টায় মেঘদূতকে সুবোধ বাবু নিজের বাড়িতে নিয়ে রেখেছেন। সেই দীর্ঘ ছয়মাস এই বাচ্চা মেয়েটার মুখ আমি একবারের জন্যও দেখতে পারি নি! 

পাঁচ বছর পর -

আমি ভোর ছ'টায় এসে শিলং এয়ারপোর্টে নামলাম। আমার সাথে পাঁচ বছর বয়সী মেঘদূত। ওর পড়নে মালবেরী সিল্কের লাল হলুদ জামা। মাথায় রূপালী মুকুট। জয়ন্তিয়ার এই ট্র‍্যাডিশনাল পোশাকটা মেঘালয়ে আসার উদ্দেশ্যেই বানানো। মেঘদূতকে এই জামায় সুন্দর লাগছে। ঐত্রীর মতো ছোট্ট মেঘদূতের চোখের নিচেও কালি জমেছে। মসৃন ত্বক শুষ্ক হয়ে গেছে! 

আমরা শিলং থেকে সোজা চলে গেলাম সামান্দা গ্রামে। ঘন্টা দুয়েকের রাস্তা। দশ বছর আগে ট্যুরে এসে টানা ষোল দিন সামান্দা গ্রামের যে ঘরটার আশেপাশে ঘুরেছি ঐত্রীকে এক নজর দেখার আশায় সেই ঘর চিনতে আমার বেগ পেতে হল না। মাটি থেকে দু ফিট উঁচু শনের চালা দেওয়া বেড়ার ছোট একটা ঘর! জীর্নশীর্ন কঠের দরজা খোলা হয় না বহুকাল! এত বছর মানুষের অনুপস্থিতিতেও এই ঘর মাথা উঁচু করে টিকে আছে কি করে এ আমার কাছে এক বিস্ময়! মেঘদূতের উৎসাহে কিছুতেই ভাটা পড়ছে না। সে মেঘালয়ে এসে প্রচন্ড খুশি! এই প্রানোচ্ছ্বলতার বয়সেও এই মেয়ের হাসি আমাকে অবাক করলো।  কারন মনে হল বহুদিন পর আমি তাকে হাসতে দেখলাম! 

ঘরে একটা পুরনো চৌকি আর পাশে একটা জরাজীর্ন ধুলো পড়া মাদুর ছাড়া কিছু নেই। আমি আর মেঘদূত পরিচ্ছন্ন অভিযানে নেমে গেলাম! দেখা গেল মোটামুটি ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমরা ঘরটাকে অন্তত ঘুমানোর উপযোগী করে ফেললাম!

এই বয়সী বাচ্চাদের কাছ থেকে বড়দের অনেক ব্যাপার নিয়ে লুকোচুরি খেলতে হয়! এবেলা আমি নির্ঝঞ্ঝাট। মেঘদূত আর দশটা সমবয়সী বাচ্চা থেকে অনেক এগিয়ে আছে! হয়তো মা না থাকলে মেয়েরা এমনি হয়। নিজেই নিজের মায়ের অভাব পূরন করে নেয়! মেঘদূত জানে শিলং এর অভিজাত হোটেলগুলো রেখে আমি কেন এই সামান্দার ছোট্ট ঘরটাতে উঠলাম!

টানা পাঁচদিন পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে আশেপাশের পুরনো লোকজনকে খুঁজে বের করে করে আমরা শুধু একটা কথাই জানতে চাইলাম 'দশ বছর আগে এই ঘরটাতে যেই মেয়েটা থাকতো সে কে? তার বাবা মা কে? কোথা থেকে এসেছিলো সে?' 

এই গ্রামের সাড়ে তিনশো মানুষের মধ্যে অন্তত একজন তো জানবে! কেউ জানে না ঐত্রী কোত্থেকে এসেছে! তারা জানে একদিন হঠাৎ করেই ছোট একটা মেয়ে ছোট্ট ওই ঘরটাতে গুছিয়ে জীবনযাপন শুরু করেছিলো। বাবা ছাড়া মা ছাড়া আত্মীয় পরিজন ছাড়া এমনকি নিজের পরিচয়টুকু ছাড়া! আর সেই পরিচয়টুকুই আমি গত দশবছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি!

এই পাঁচদিনে আমি একটা ভয়ংকর ব্যাপার আবিষ্কার করলাম! মেঘদূত সারারাত ঘুমায়! মাঝরাতে আর মায়ের মতো লাল টকটকে চোখ নিয়ে জেগে উঠে না। মেঘালয়ের সামান্দা গ্রামের ছোট্ট এই ঘরটাতে আমার মেঘের মতো একটা মেয়ে ঘুমায় আর আমি রাত জেগে তার ঘুমন্ত মুখ দেখি! গালে হাত রাখি। ওর শরীরও ওর মায়ের মতো শীতল। ঠিক মেঘের মতো হালকা শীতল। ছুঁয়ে দিলে মনে হয় এক্ষনি হাত ভিজে যাবে!

কি শান্তি! 

সেই দিনগুলোর কথা ভাবলেও গায়ে কাটা দেয়! মেঘদূতের বয়স দুই! একরাতে আমি প্রথমবারের মতো দেখলাম সে লাল চোখ নিয়ে বসে আছে। কাঁদছে না ছটফট করছে না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছে! সুবোধ বাবু আশ্বাস দিলেন ঠিক হয়ে যাবে। সারাদিন ব্যস্ত রাখলে রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু না! ঠিক হয়ে যাবে আশা নিয়ে আমি আরো তিন বছর পার করে দিলাম। অবশেষে সুবোধ বাবু অনুরোধের স্বরে বললেন 'মেয়েকে একবার মেঘালয়ে নিয়ে যাবেন? কে জানে হয়তো কিছু সমাধান পেয়েও যেতে পারেন! প্রকৃতির রহস্যের কতটুকুই বা আমরা জানি!'

মেঘদূতের সমস্ত অস্তিরতা অস্বাভাবিকতা এখানে এসে দূর হয়ে গেছে এটা আমাকে যতটা না কৌতূহলী করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি স্বস্তি দিয়েছে! 

ষষ্ঠ রাতে ঘটলো সেই বিশেষ ঘটনাটা! 

মেঘদূত ঘুমিয়ে গেছে। আমি সিগারেট ধরানোর উদ্দেশ্যে বাইরে যেতে গিয়ে অন্ধকারে দরজার পাশের বাঁশের সাথে ধাক্কা খেলাম। সাথে সাথে মনে হল কিছু একটা নিচে পড়েছে। তুলে লাইটারের আলোতে দেখলাম একটা ভাঁজ করা কাগজ। লালচে ধরনের। কর্নফুলি পেপার নাকি অনেকদিন থেকে সাদা কাগজের রঙ পাল্টে গেছে আমি ধরতে পারছি না। বুকপকেটে কাগজটা নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। একটা অজানা অপ্রিয় বার্তা যেন আমার বুকের উপর চেপে বসেছে। আমার মনে হচ্ছে কাগজ খুললেই এক ঝটকায় হুড়মুড় করে সব রহস্য আমার সামনে খুলে যাবে। তারপর সেই রহস্যের ধাক্কা আমি নিতে পারব না! পরক্ষনেই মনে হল কি সব ভাবছি! একটা কাগজই তো! খুবই সাধারন সাদামাটা একটা কাগজ! 

আমি ঘরে এসে মেঘদূতের পাশে বসে কাগজটা খুললাম। উত্তেজনায় আমার হাত কাঁপছে! 

গোটা গোটা অক্ষরে একটা লম্বা ইংরেজী চিঠি। চিঠির শুরু হয়েছে 'Dear inheritress' সম্বোধন দিয়ে! খুব সহজেই বুঝা যাচ্ছে এই চিঠি কোন মেয়ের উদ্দেশ্যে লেখা! পঁয়ত্রিশ লাইনের এই বিশাল চিঠির মূল বক্তব্য ছিলো এরকম -

প্রিয় উত্তরাধিকারী 

মেঘালয়ে স্বাগতম। বাকি জীবন তোমাকে এই রাজ্যেই কাটাতে হবে। জেনে রাখো তুমি এই মেঘালয়ের প্রানশক্তি আর একই সাথে এই মেঘলয়ও তোমার প্রানশক্তি। তবে তুমি একা নও। আমি সেভেন সিস্টার্সের সাতটা রাজ্যে একইভাবে সাতজনকে পাঠাই। যারা চক্রাকারে উত্তরাধিকার সূত্রে এখানেই থেকে যায়। তোমার নিজস্ব কোন সত্তা নেই। তুমি তোমার পূর্বপুরুষদের অস্তিত্ব মাত্র। সুতরাং তুমি এই মেঘালয়ে বসবাস করবে একা এবং সম্পূর্ন একা! তোমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব স্বয়ং ঈশ্বরের। ঘটনাক্রমে তুমি যদি স্থানচ্যুত হও মৃত্যু অবধারিত!

চিঠি শেষ করে আমার হাত পা কাঁপছে। এই চিঠি আমার পাঁচ বছর বয়সী ছোট্ট মেয়েটার উদ্দেশ্যে লেখা! কে এই চিঠিদাতা? ঈশ্বর? অথবা অন্য কোন শক্তি? মেঘদূত আমার স্পার্ম থেকে সৃষ্টি প্রান! তার উপর একক আধিপত্য আমার!

এক মুহুর্তের জন্য আমি ভাবতে পারছি না সে ঐত্রীরও মেয়ে। ঐত্রীর শরীরের রক্তে নয়মাস তার অপরিপক্ক হৃদপিন্ড রক্তের যোগান পেয়েছে! সে ঐত্রীর উত্তরাধিকার! 

কিন্তু এই একা নির্জন একটা ঘরে ছোট এই মেয়েটা টিকে থাকতে পারবে? পারবে। ঐত্রীও পেরেছিলো। মেঘালয় থেকে নিয়ে গিয়ে আমি ঐত্রীর মতো ওকেও মেরে ফেলতে পারি না। 

দু সপ্তাহ শেষ। আমার যাবার দিন আজ।আমি মাঝেমাঝে আসবো মেঘদূতকে দেখতে। ওকে বেশ সজীব লাগছে। ঝলমল করছে চোখজোড়া! আমি চলে যাব শুনে কিঞ্চিত মন খারাপও করেছে। ওকে এখানে একা রেখে যাব শুনে তার খুব একটা ভাবান্তর হয়নি। যেন সে জানতো মেঘালয়ই তার নিয়তি!

আমি যাবার সময় একবার পিছনে ফিরে তাকালাম। মেঘদূত তাকিয়ে আছে চোখে জল নিয়ে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললাম 

'তুইও কি কখনো মায়ের মতো প্রেম আর মৃত্যুর মধ্যে মৃত্যু বেছে নিবি?'



 ( সমাপ্ত )




লেখা: শাহরিন শৈলী

 

Delivered by FeedBurner

a