> আমার কাহাফ ভাবনা ১০ - আরিফ আজাদ - Arif Azad - Boipoka365 - সুরা কাহাফ - Al Kahf
-->

আমার কাহাফ ভাবনা ১০ - আরিফ আজাদ - Arif Azad - Boipoka365 - সুরা কাহাফ - Al Kahf

আপনার জীবনের প্রতিটা ঘটনাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি, আপনার বন্ধুরা, যাদের সাথে আপনি মিশেন প্রতিনিয়ত, যাদের সাথে গল্প-আড্ডায়, খোশ-আলাপে আপনি পার করেন জীবনের মূল্যবান সময়, তাদের ব্যাপারেও আপনাকে হতে হবে সমান মনোযোগি।

সুরা আল কাহাফে গুহা-বাসী যুবকদের ঘটনা বিবৃত করার পর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন যে— নবিজীর কার সাথে মেশা উচিত আর কার সাথে মেশা উচিত নয়।

আয়াতটা পড়তে গিয়ে আমার পূর্বের একটা ব্যাপার মনে পড়ে গেলো। আমাদের ব্যক্তিগত বন্ধু নির্বাচন কেমন হওয়া উচিত সে ব্যাপারে আমি কিছুদিন আগে লিখেছিলাম। সেখানে আমি বলেছিলাম— ব্যক্তিগতভাবে এমন কাউকে আমি ঘনিষ্ঠ বন্ধু, নিকটজন হিশেবে বাছাই করবো না যারা সিনেমা-নাটক দেখে দিন পার করে। যারা অবসরের সঙ্গী হিশেবে গান শোনাকে প্রাধান্য দেয়। যারা সুন্নাহ পালনে তেমন মনোযোগি নয়।

তবে, আমার সেই লেখাটাকে বেশ অনেকে মিস-কোট করেছেন। তারা বললেন— 'যারা সিনেমা-নাটক দেখে, যারা গান শোনে, যারা সুন্নাহ পালনে উদাসীন, তাদের সাথে যদি আপনি না-ই মিশেন, তাহলে ভালোর দাওয়াতটা তাদের কাছে পৌঁছাবে কীভাবে?'

আমার লেখাটায় তারা যেটা মিস করে গেছেন তা হচ্ছে 'দাওয়াত দেওয়া'র জন্যে মেশা আর 'অন্তরঙ্গ বন্ধু' হিশেবে মেশার মধ্যকার পার্থক্য।

ভালোর দাওয়াত নিয়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাইতে সফলভাবে আর কে যেতে পেরেছে? কিন্তু, যে লোক হারামে ডুবে ছিলো, নবিজী তার সাথে সারা দিনমান কাটিয়ে দেন নি। তাকে শুধরানোর জন্যে তার হারামের মুখরোচক গল্পগুলোকে উপভোগ করেন নি। তিনি সতর্ক করেছেন উত্তম উপায়, উত্তম চরিত্র এবং উত্তম ব্যবহারের সাথে। যাদের সাথে তিনি দিনমান কাটাতেন, যারা সর্বক্ষণ নবিজীর সাথে ছায়ার মতো লেগে থাকতো, কেমন মানুষ ছিলেন তারা? আবু বকর সিদ্দিক, ওমর ইবনুল খাত্তাব, উসমান এবং আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুম। নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরঙ্গ বন্ধুদের ব্যাপারে ধারণা পেতে এই নামগুলোই যথেষ্ট।

আমার লেখাটার মূল কথাও ছিলো সেটা— কেউ যদি হারামের মাঝে থাকে, সাধ্য এবং সুযোগ থাকলে আপনার অবশ্যই উচিত তাকে সতর্ক করা, তাকে নাসীহাহ করা। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে মেশার জন্যে আপনার কখনোই উচিত নয় এমন কাউকে বাছাই করা যার কাছ থেকে আপনার আসলে শেখবার কিছুই নেই। যে আপনার বিপদে আপনাকে ধৈর্যের ব্যাপারে নসীহত করতে পারে না, আপনার আনন্দে আপনাকে শুকরিয়া করতে বলতে পারে না।

ধরুন আপনার ভীষণ মন খারাপ। এমন মন খারাপের দিনে আপনি আপনার সিনেমা-পোঁকা কোন বন্ধুকে ফোন করে বললেন, 'দোস্ত, মনটা বেশ খারাপ।'

আপনার মন খারাপ শুনে আপনার ওই বন্ধু আপনাকে সম্ভাব্য কোন কথাটা বলতে পারে? সে হয়তো বলবে, 'ধুর, মাথায় রাখিস না ওসব। নতুন একটা মুভি এসেছে। একদম সুপার-হিট লেভেলের। ওটা দেখে ফেল এক বসায়। দেখবি মনটা কেমন ফুরফুরা লাগে'।

আবার ধরা যাক আপনি এমন এক বন্ধুকে ফোন দিলেন যে সিনেমা-টিনেমা দেখে না। গান-টানও শুনে না। তার দ্বীনদারিত্ব নিয়ে আপনার মধ্যে কোন সংশয় নেই। আপনি তাকে বললেন, 'বন্ধু, মনটা আজকে ভীষণ খারাপ'।

আপনার মন খারাপের কথা শুনে এই বন্ধুটা আপনাকে কী বলতে পারে? খুব সম্ভবত তিনি বলবেন— 'মন খারাপের দিনে আল্লাহর রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিকির-আযকারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। বেশি বেশি দুয়া করতেন আল্লাহর কাছে। তোমার মন খারাপের কারণ জানি না, তবে দুয়া করছি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা যেন তোমার সবকিছু ঠিকঠাক করে দেন। তোমার মন খারাপ দূর করে দেন। আশা করি মন খারাপের এই অবস্থা তোমাকে রবের আরো অধিক নিকটবর্তী করবে, ইন শা আল্লাহ'।

এই দুই বন্ধুর মধ্য থেকে নিজের জীবনের জন্য কাকে আপনি বেছে নিবেন আমি বলতে পারি না, তবে আমাকে যদি বেছে নিতে বলা হয় আমি নির্দ্বিধায় দ্বিতীয় জনকে বেছে নেবো।

বন্ধু নির্বাচনে এটাই ছিলো আমার প্রস্তাবিত ফর্মুলা। তার মানে কিন্তু এটা নয় যে আমার সিনেমা-দেখা বন্ধুটাকে আমি খরচের খাতায় ফেলে রাখবো। তার সাথেও আমার যোগাযোগ থাকবে, তবে নিজের একান্ত সময়ের সঙ্গী হিশেবে তাকে আমি জীবনে স্থান দেবো না। সেটা আমার নিজের নফসের হেফাযতের উদ্দেশ্যেই।

সুরা কাহাফের ২৮ নাম্বার আয়াত পড়তে গিয়ে আমি ঠিক তেমন কিছুরই সন্ধান পেলাম। এই আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা বলছেন,

'আপনি দৃঢ়চিত্ত হয়ে তাদের সাথে অবস্থান করুন যারা সকাল-সন্ধ্যা তাদের প্রতিপালককে আহ্বান করে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে'।

এই আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের সাথেই দৃঢ়চিত্ত হয়ে থাকতে বলছেন যারা সকাল-সন্ধ্যা নিজেদের মহান আল্লাহ তা'য়ালার স্মরণে ব্যাপৃত রাখে।

সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর স্মরণে থাকবার অর্থ হলো— যারা পুরোদিনে নিজেদের সর্বোচ্চ আল্লাহর পথে ধরে রাখে। যারা হালালের পথ ছেড়ে হারামের পথ না মাড়াবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালায়। তারা কারো সাথে মেশে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই। কারো সাথে হেসে কথা বলে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই। কারো সাথে সদাচরণ করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই। কারো বিপদে সাহায্যের হাত বাড়ায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই। কারো জন্যে দুয়া করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই। নিজের জন্য এবং পরের জন্য যা কিছুই তারা করে, সবকিছুর উদ্দেশ্য থাকে একটাই— আল্লাহর সন্তুষ্টি।

যাদের জীবনধারা এমন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলছেন সেসব লোকদের সাথেই যেন তিনি নিজের জীবনটাকে জড়িয়ে রাখেন। নবিজীর মাধ্যমে সেই একই উপদেশ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা আমাদেরকেও দিয়েছেন যেন আমরা তাদেরকেই বন্ধু হিশেবে বাছাই করি যারা নিজেরা আল্লাহর স্মরণে থাকে এবং যাদের সংস্পর্শে এলে আমাদের অন্তরেও আল্লাহর স্মরণ জাগ্রত হবে।

একটা পঁচনধরা ফলের পাশে একটা ভালো ফল যদি রাখা হয়, ভালো ফলটাতেও পঁচন ধরার সম্ভাবনা শতভাগ। কাদেরকে আপনি আপনার জীবনের সাথে জড়াবেন তা এজন্যেই গুরুত্বপূর্ণ যে— এর ওপর আপনার দুনিয়া-আখিরাতের অনেককিছুই নির্ভর করে।


NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner