Bangla Love Story |
বিয়ের দেড় বছরের মাথায় নাবিলার মানসিক সমস্যাটা প্রথম ধরতে পারি।
মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে বিড়বিড় করতো, কখনো বাথরুমের শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতো, কখনো রেলিংহীন ছাদের কিনার ঘেঁষে ভয়াবহ ভঙ্গিতে হাঁটতো। ভোররাত অবধি এগুলো চলতো। তারপর নিজেই বিছানায় এসে ঘুমিয়ে পড়তো।
দিনে ওর মধ্যে অস্বাভাবিকতার লেশমাত্র থাকতো না। তখন ওকে দেখে বোঝার উপায় নেই, সে যে রাতে অমন অদ্ভুত এবং ভয়ংকর কাজ করতো। তবে তারচেয়ে অদ্ভুত এবং ভয়াবহ হলো, এই কাণ্ডগুলোর সাথে ও আমাকে ব্যাখ্যাহীন ভাবে যুক্ত করে নিতো।
যেমন, ওকে যদি বলতাম,"এই মাঝরাতে না-ঘুমিয়ে বারান্দায় বসে কী বিড়বিড় করছো?"
সে পাশের চেয়ারটা ইঙ্গিত করে বলতো,"বোসো। বলছি।"
ওর কথায় এমন কিছু থাকতো, আমি আচ্ছন্নের মতো বসে পড়তাম, এবং তার কথা শুনে যেতাম, যদিও ওর কথা কিছুই বুঝতাম না।
শাওয়ারের নিচে ভিজতে দেখলে যদি বলতাম,"এই মাঝরাত কি গোসল করার সময়? ঘুমাতে এসো।"
সে আমার দিকে স্থির তাকিয়ে বলতো,"মাঝরাত হলো গোসলের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।"
এই বলে সে সরে গিয়ে আমাকে শাওয়ারের নিচে দাঁড়াতে বলতো। আমি বিনা প্রশ্নে অভিভূতের মতো দাঁড়িয়ে পড়তাম শাওয়ারের নিচে।
ছাদের ব্যাপারটা ছিলো বিপদজনক। রেলিংহীন ছাদের কিনার ঘেঁষে ও হাঁটতো। যদি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বলতাম,"সরে এসো ওখান থেকে।"
সে অপলক আমার দিকে তাকিয়ে বলতো,"এসো তুমিও হাঁটো। দেখবে এরচেয়ে সুখ আর নেই।"
তারপর সম্মোহিতের মতো আমিও ছাদের কিনার ঘেঁষে হাঁটতে থাকতাম।
ভোররাতে ওরই নির্দেশে দু'জনে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়তাম। যেনো কিছুই হয় নি।
ওর সমস্যাটার কথা কাউকে বলতে পারতাম না। কারণ ওর রহস্যময় প্রভাব দিনের বেলাতেও আমার ওপর কাজ করতো। এদিকে রাতে ঘুম না-হওয়ায় আমার শরীর ভেঙে পড়তে লাগলো। অফিসে কাজের ক্ষতি হতে লাগলো। আমি বুঝতে পারলাম, বাঁচতে হলে ওর বলয় থেকে আমাকে মুক্ত হতে হবে। ওকে আমি তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এই সময়ই নাবিলা একদিন বললো,"আমার এক আত্মীয় বড়ো মানসিক ডাক্তার। চলো কাল সেখানে যাই।"
মনে মনে বললাম, বাহ এতোদিনে নিজের সমস্যাটা ধরতে পেরেছো! আমি বললে হয়তো বিশ্বাসই করতো না। যাই হোক, নিজ থেকে যখন যেতে চাইছে তখন একবার দেখা যাক। যদি ভালো হওয়ার সম্ভবনা থাকে তাহলে চিকিৎসা চলবে, নইলে তালাক।
ডাক্তারখানায় আমার জন্য চরম বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো।
সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম সমস্যাটা নাবিলার নয়, সমস্যাটা আমার! রাতে ঘুম থেকে উঠে আমিই ওসব কাণ্ড করতাম। বারান্দায় বসে একা একা কথা বলতাম, বাথরুমে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতাম, রেলিংহীন ছাদের কিনার ঘেঁষে হাঁটতাম। আর নাবিলা সারারাত না-ঘুমিয়ে আমার সঙ্গে থাকতো, যাতে বড়ো কোনো বিপদ ঘটিয়ে না-ফেলি। এক মুহূর্তের জন্যও সে আমাকে বুঝতে দেয় নি আমি যে পাগল। আর এই মেয়েকেই কিনা আমি তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম!
আমি জানলাম পাগলও কাঁদে।
আমার চিকিৎসা শুরু হয়েছে। একটা নার্সিং হোমে থাকি। ছায়ার মতো সঙ্গে থাকে নাবিলা।
মাঝে মাঝে চোখ দিয়ে পানি পড়তে দেখলে সে বলে,"তুমি তো দ্রুত সেরে উঠছো। তাহলে চোখে পানি কেনো?"
কেনো আমার চোখে পানি তা নাবিলাকে কোনোদিন বলতে পারবো না। কোনোদিন না।
""
( সমাপ্ত )
লেখা: রুদ্র আজাদ