নতুন কলেজে উঠেছি। পরিবার খুব সচ্ছল না হলে পড়াশোনা চালানোর রাস্তা একটাই-টিউশনি। সেই পেশাটাই আপন করে নিয়েছি। আজ প্রথমবার কাউকে পড়াতে যাবো। ছেলেটা ক্লাস সেভেনে পড়ে।আমার এক বন্ধু এই টিউশনিটা পাইয়ে দিয়েছে।
বিকেল চারটায় টিউশনিতে যাওয়ার কথা।দেরি যাতে না হয় সেজন্য আধঘন্টা আগেই বেরিয়ে পড়লাম।মোটামুটি পাঁচ মিনিট আগেই পৌঁছে গেলাম ।আমি আমার খালাতো ভাইয়ের বাসায় যখন যেতাম তখন ওকে একজন এরকম টিউশনি পড়াতে আসতো। আমার খালা ওনাকে দারুণ সমাদর করতেন। আমি ভাবছি,তেমন সমাদর জুটবে কপালে নাকি অন্যকিছু।দোতলায় স্টুডেন্টের বাসা। কলিংবেল চাপলাম। দরজা খুললো না। পাঁচ-ছয়বার কলিংবেল বাজানোর পর এক জনৈক মহিলা দরজা খুললেন। সম্ভবত তিনি এই বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। একটু কর্কশ কণ্ঠেই বললেন,
-"কে আপনি?"
কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম। বললাম,
-"আমি পড়াতে এসেছি।এটা রাব্বিদের বাসা না?
-"হ্যাঁ,রাব্বিদের বাসা। আপনি এসে বসুন। "
একটা রুমে গিয়ে বসলাম।বাসাটা বড্ড অগোছালো।মনে হয় ওনারা নতুন এসেছে এই বাসায় ।কিছুক্ষণ পরে একটা বাচ্চা ছেলে আসলো। ওই বোধহয় রাব্বি।আমি বললাম,
-"তুমি রাব্বি?"
ছেলেটাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছে। বললো,"জ্বি স্যার।"
-"তোমরা নতুন এসেছো এ বাসায় তাই না?"
-"এই গতকালই এলাম।"
-"আচ্ছা। তো এখন পড়বে তো?ভালোভাবে পড়তে হবে কিন্তু। ক্লাস সেভেনে ভালোভাবে পড়লে পরের ক্লাসগুলোর সাথে সমন্বয় করতে সুবিধা হবে।"
ছেলেটা কিছু বললো না।
আমি বললাম,"পড়তে ইচ্ছে করছে না?"
ছেলেটা হুড়মুড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। আমি ভীষণ অপ্রস্তুত হলাম।ওর কান্নার শব্দে ঐ গৃহপরিচারিকা দৌঁড়ে এলেন।
উনি ওকে থামালেন।আর পাশের রুমে নিয়ে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ বসে রইলাম। প্রায় আধঘন্টা পর একজন লোক বাসায় আসলেন। উনি বোধহয় রাব্বির বাবা। আমি সালাম দিলাম। উনি হাস্যোজ্জল চেহারায় সালাম নিলেন। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে নিজের ছেলেকে নিয়ে আমার কাছে আসলেন। ছেলেটা এখনো বিমর্ষ। ওর বাবা যথেষ্ট চেষ্টা করছেন যেন আবার ও না কাঁদে। আমাকে বললেন,
-"তোমাকে তুমি করে বলছি। আমার থেকে তো ছোটোই হবে বয়সে। দেখো,ছেলেটা একদমই পড়ে না। পড়তে বললেই কাঁদে। তাই হঠাৎ কেঁদে ফেলেছিলো। নিশ্চয়ই পড়তে বলেছিলে?"
আমি মৃদু হাসলাম।
নানা কথা বললাম ওনার সাথে ।হঠাৎই ছেলেটা আমাকে বলে উঠলো,"স্যার,আপনার মা আছে?"
আমি আরও একবার অপ্রস্তুত হলাম। বললাম,"হ্যাঁ,আছেন তো। কেন?"
-"আপনার মাকে যদি কেউ মারে আপনি কী করবেন?
-"কেউ মারলে তাকে কসিয়ে একটা থাপ্পড় মারবো প্রথমে। পরেরটা পরে দেখা যাবে। "
এটা শোনার কিছু সময় পর ছেলেটা নিজের বাবাকে কসিয়ে একটা থাপ্পড় মেরে দৌঁড়ে চলে গেলো। ওর বাবা থ হয়ে রইলো। আমি আরও একদফা অপ্রস্তুত হলাম।তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলাম।
যাওয়ার পথে ভাবলাম,বাচ্চা ছেলেটার সামনে তার বাবা তার মাকে মারধর করে,সেজন্য ছেলেটা কাঁদছিলো বারবার।ঘৃণায় ভরে উঠছিলো মনটা।এই দাম্পত্য কলহের জন্যই তো কত বাচ্চা বিপথে চলে যায়।কে জানে বাচ্চাটার ভবিষ্যত কী।লোকটা তো বহুরূপী।উনি নিজের স্ত্রীকে মারেন এটা ওনার সাথে কথা বলে বুঝতেই পারিনি। তবে এর যথাযোগ্য শাস্তিই তিনি পেলেন।নিজের সন্তানকে কী শিক্ষা দিচ্ছেন আর নিজের চরিত্রটাকে কোন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন সে কথা ভাবলে তিনি আর কখনো তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলবেন না-এটা আমার বিশ্বাস।সারা জীবন এই চড়টা ওনারও মনে থাকবে আর আমারও।
Writer:- Mainul Islam Tanim