গরম ভাতের বোলটা খাবার টেবিলের উপর রাখতেই মা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। অস্থির কন্ঠে বললেন,"বৌমা, তুমি একটু ফোন করোতো ছেলেটাকে। চিল্লিয়ে নাকি আন্ধার করে ফেলছে সব। হায় আল্লাহ! এই ছেলে রাগলে পরে বড় ছোট মানেনা। তোমার বাবার এমনেই প্রেশার হাই হয়ে আছে সকাল থেকে। এত অশান্তি হলে উনি এখন নিশ্চিত স্ট্রোক করবে।"
ততক্ষনে চিরচেনা কন্ঠের প্রলয়ংকারী হুঙ্কারগুলো আমিও শুনতে পাচ্ছি। আহসান চেঁচাচ্ছেন। চেঁচাচ্ছেন বললে ভুল হবে উনি রীতিমত সিংহের মতো গর্জন করছেন। অথচ সকালে হাঁটে গেলেন ভালো মেজাজে। যাবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,"কি রংয়ের গরু কিনবো বলোতো চৈতি?"
আমি উওর দিলাম," কালো রংয়ের। কুচকুচে কালো। লোমগুলো চিকচিক করেনা? একদম সেরকম।"
উনি পান্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে হেসে বললেন,"আচ্ছা ঠি কাছে।"
সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। আড়াইটা বেজে গেছে উনার আসার নাম নেই। আমি ফোন করে খাবার কথা জিজ্ঞেস করলাম। উনি বললেন,"তোমার কালো গরু পাইনি এখনো। ফিরতে দেরি হবে। দূরে আছি।"
আমি জোরপূর্বক মেজাজ দেখিয়ে বললাম,
---"ধুরো, কালো গরু লাগবেনা। যেটা ভালো পান সেটাই নিয়ে আসেননা। আর বাড়ির কাছে এত্তবড় হাঁট থাকতে আপনি দূরে কেনো গিয়েছেন?"
উনি বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে ব্যস্ত গলায় বললেন,"আচ্ছা রাখি। তুমি খেয়ে নাও। আমি এসে খাবো।"
আমি একটু আপত্তি করবো। উনি সুযোগ না দিয়ে আবার বললেন,"খেয়ে নিও, ঠি কাছে?" আমি হাল ছাড়লাম। ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে উওর দিলাম,"আচ্ছা।"
মা তাড়া দিচ্ছেন,"এই বৌমা, ফোন দাও শিগগির। উপরে আসতে বলো ওকে। আর পারিনা আমি। ইদের আগে এতো চিল্লাচিল্লির মানে আছে? ট্রাক থেকে গরুকে নামাতে যেয়ে একটু ব্যাথা পেয়েছে পায়ে। ব্যস!"
আমি মিনমিন করলাম,
---"আপনি ফোন দিননা মা। আমাকে ধমক দিবে। আপনি বললে কিছু বলবেননা।"
মা উওর দেবার আগেই বড়আপু এলেন নিচ থেকে। উনি গরু দেখতে নেমেছিলেন। নিশ্চিত কিছু হয়েছে। এসেই থমথমে গলায় বললেন,
---" এখন ফোন দিওনা কেও। আহসান ভয়ংকর রেগে আছে। গরুর কিছু হলে যারা নামাচ্ছিলো সবগুলা কে নাকি বেঁধে পিটাবে। অবশ্য ঠি কই আছে। গরুটার বা'পা কেটে গেছে। কোরবানির পশু অনেক যত্ন করে রাখতে হয়।"
মা ঝাড়ি মেরে বললেন,"চুপ থাক তুই। এমনে চিল্লালে মানুষজন কি বলবে? তুমি ফোন করোতো বৌমা।"
আমি কাঁচুমাচু করে তাকাতেই উনি বললেন,"আহা! ভয় পায় কেন মেয়ে? আর যাই হোক অন্তত তোমার সাথে রাগ দেখাবেনা। ভয় পেয়োনা।"
শেষমেষ বাঁচার উপায় না পেয়ে গুটিগুটি পায়ে ঘরে গেলাম আমি। জানালা দিয়ে দেখলাম রাস্তায় মানুষ জড়ো হয়ে আছে। উনার ধমকাধমকি শোনা যাচ্ছে। ফোন করলাম। উনি ধরলেননা। দু'তিনমিনিট বাদে নিজ থেকেই ফোন দিলেন। আমি চোখ খিঁচে রইলাম। নিশ্চিত ঝাড়ি দিবে। কিন্তু না, উনি স্বাভাবিকভাবেই বললেন,"হ্যাঁ, বলো।" কিন্তু একটু আগের গমগমে টানটা চলেই এলো।
আমি গলার স্বর যতটা নরম করা যায় ঠি ক ততটাই নরম করে মিষ্টি আবদার করে বললাম,
---"আপনি আমার মেহেদি কিনেছেন?"
---"কিহ্?"
---"আমার মেহেদি..."
উনি বোধহয় রাস্তার পাশ থেকে সরে একটু ভেতরে ঢুকলেন। কোলাহলটা একটু আবছা হলো। আমি মনে মনে স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। উনি সন্দিহান কন্ঠে বললেন,
---"মেহেদি? কিনতে বলেছিলে?....কখন বললে?"
---" বলিনি। আপনি নিজ থেকে কিনেননি?"
উওর এলোনা। উনি ফোনটা কান থেকে সরিয়ে কাকে যেনো কি বললেন। তারপর ফের কানে লাগিয়ে বললেন,
---"মনে ছিলোনা চৈতি। এখনই পরবে? আচ্ছা, দিয়ে যাচ্ছি। কয়টা লাগবে?"
আমি মৃদু কন্ঠে বললাম,
---"এখন লাগবেনা। কিন্তু আপনি আসেন। খেয়ে যান। দুপুরে খাননি।"
উনি ছোট্ট করে উওর দিলেন,
---"আচ্ছা, আসি। তুমি খাওনি তাইনা?"
---"হু।"
তারপর আর চিল্লাচিল্লি শোনা গেলোনা। পরিবেশ শান্ত। মা, বড়আপু শান্তির শ্বাস ফেলে বললেন," যাই গরুটা দেখে আসি।"
আমি যাইনি। ভয় লাগে। আহসান জোরাজোরি করে নিয়ে গেলেন। উনার ইয়া বিশাল হাতি সাইজের কালো গরু দেখে আমার জান যায় যায় অবস্থা। উনি আদর করতে বললেন। আমি 'না' 'না' করে উঠলাম। উনি নাছোরবান্দা। হাত ধরে কাছে নিয়ে গেলেন। গরু আমার দিকে দু'কদম এগোতেই ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছি বাবার সামনে। বাবাই শেষমেষ আহসানের থেকে ছাড়িয়ে উপরে নিয়ে এলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,"আর নিয়ে যাবেনা মা। কাঁদেনা।"
রাত হলো। আহসান সন্ধ্যার দিকেই মেহেদি কিনে দিয়ে গেছেন। কাজ শেষে দেরি করে মেহেদি নিয়ে বসলাম।
উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন ততক্ষণে। আমি মেহেদি পরতে পরতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম টেরই পেলামনা।
ঘুম ভাঙলো আহসানের চিৎকারে। ঘরের আলো জ্বলছে। আধবোজা চোখে পিটপিট করলাম কিছুক্ষণ। মাত্র উঠেই আলোটা সহ্য হচ্ছেনা। ঘুমানোর আগে বাতি নিভাইনি? মনে পড়ছেনা। আহসান অস্থির গলায় চেঁচাচ্ছেন,"কি করেছো তুমি! উঠো। এই মেয়ে। আহহা।"
আমি মুখ কুঁচকালাম। অভ্যাসবশত চোখ ডলবো একটু। উনি দ্রুত কব্জি ধরে থামালেন। পরমূহুর্তেই আমার হাত ছেড়ে নিজের হাত দিয়ে চোখের কাছটায় কিছু একটা মুছে দিতে দিতে মৃদু ধমকে বললেন,"পাগল হয়েছো? আমাকে তো মাখিয়েছোই। এখন নিজেও মাখবে নাকি? পাগল মেয়ে। উঠো।"
তন্দ্রাঘোর কেটে গেলো। 'মাখিয়েছোই' মানে? কি মাখিয়েছি? ঘুমের সাথে তোড়জোড় কুস্তি করে চোখ মেললাম। উনি আস্তে করে মাথার নিচ থেকে বাহু সরিয়ে উঠে বসলেন। খালি গা। কাঁধের কাছে কি যেনো লেগে আছে। আৎকে উঠলাম। হাতের দিকে তাকানোর আগেই বুঝে গেলাম সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেলেছি। আহসান ঘাড় ফিরালেন। হায় আল্লাহ! উনার গাল গলা সব মেখে মেহেদি মেখে একাকার। শুকিয়েও গেছে। ঘড়ির দিকে তাকালাম। ছ'টা ত্রিশ। এতক্ষণে তো রংও হয়ে গেছে বোধহয়। আমি আমতা আমতা করে উঠে বসলাম।
উনি বালিশের পাশ থেকে খুলে রাখা গেন্জি ডলে ডলে মোছার বৃথা চেষ্টা করছেন। আমাকে উঠতে দেখে অনুভূতিহীন স্বরে বললেন,
---"এমন করে কেও?"
আমি একপলক হাতের দিকে তাকালাম। এতো রাত জেগে লাগালাম, সব ভেস্তে গেছে। আগে কোনোদিন এমন হয়নি। না চাইতেও চোখে পানি চলে এলো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললাম,
---" আমি ঘুমের মধ্যে বুঝেছি নাকি? আপনি আমাকে বুকে টেনেছেন কেনো?"
উনি হাঁফ ছাড়লেন। বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললেন,
---"ওটাতো আমার অভ্যাস, জানোই। তুমি মেহেদি তুলে শুবানা?"
আমি হাতের দিকে তাকিয়ে আচমকাই কেঁদে ফেললাম। উনি ভেবাচেকা খেয়ে গেলেন। ঝুঁকে এসে তড়িঘড়ি চোখ মুছিয়ে বললেন,
---"আচ্ছা ঠি কাছে, কাঁদেনা। ইদের দিন কাঁদতে হয়না। চুপ।"
আমি হেঁচকি তুলে বললাম,
---"আমি..আমি...কতক্ষণ ধরে লাগালাম।"
---"এমনেও সুন্দর লাগছে তো।"
---"নাহ।"
---"তুমি 'না' বললে হবে? আমি বলছি সুন্দর লাগছে, মানে লাগছে।... গোসল করতে হবে চৈতি। নামাজে যাবোনা একটু পর? কান্না থামাও রে বাবা।"
আমি থামলাম। কখন ঘুমালাম কে জানে! উনি বললেন," হাত ধুয়ে আসো। গোসলে যাবো আমি।"
হাত ধুয়ে এলাম। উনি গোসলে ঢুকলেন তড়িঘড়ি করে। লোকটার মেহেদির গন্ধ সহ্য হয়না একদম। কালো পান্জাবিটা আয়রন করে রাখলাম। ঘর গোছাতে গোছাতে সাতটা বেজে গেলো। উনি বের হননি এখনো। সাবান ডলে বোধহয় গাল- গলার চামড়া তুলে ফেলছেন। রান্নাঘরে গেলাম। সেমাই রাঁধছি। দশমিনিট বাদে মা আসলেন। বাবা ঘর থেকে বের হয়েই ডাক দিলেন,"চৈতি, ইরিনা এদিকে আসো।"
বড়আপু হাই তুলতে তুলতে এগিয়ে আসলেন। মা হাত থেকে খুন্তি নিয়ে বললেন,"যাও যাও, রাগ করবে আবার। আমি দেখছি এটা।"
আমি গেলাম। বাবা সালামি দিলেন। আমার বাবাও এমন করতো। নামাজে যাবার আগে আমাকে আর বড়আপুকে সালামি দিয়ে যেতো।
সেমাই হয়ে গেছে। সাড়ে সাতটার বেশি বাজে। আহসান বেরোলেন। আমি রান্নাঘর থেকেই হা করে চেয়ে রইলাম। হায় আল্লাহ! মানুষটা এতো সুন্দর কেনো! এতো সুন্দর? কালো পান্জাবিটাই পরতে হলো? এভাবে আবার বাইরেও যাবেন? ধ্যাত! ভাল্লাগেনা।
উনি ফোনে কথা বলতে বলতে একবার তাকালেন। আমাকে হাভাতের মতো চেয়ে থাকতে দেখে হাল্কা ঠোঁট নাড়িয়ে বললেন,"মা পাশে।"
আমি চোখ নামালাম। আপু হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠলেন,"তোর গালে কি হয়েছে? রং লাগলো কি করে? মেহেদি নাকি? দেখি।" উনি তখন বাবার সাথে বসা। কিসব কাগজপত্রের হিসাব মিলাচ্ছেন যেনো। আপুর কথায় বাবা সচেতন চোখে তাকালেন। মেহেদির রং হয়ে গেছে। অতো গাঢ় না হলেও বোঝা যাচ্ছে। বাবা কেঁশে উঠলেন। উনি গলা ঝেড়ে মৃদু স্বরে বললেন,"লেগেছে আরকি।
আপু সময় না নিয়েই জিজ্ঞেস করলেন,
---"কিভাবে?"
উনি উওর দিলেননা। ঈষৎ লজ্জিত ভঙ্গিতে কাগজ দেখতে দেখতে কপাল ঘষলেন। বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন,
---"ইরিনা, ঘরে যাও।"
আপু মুখ গোমড়া করে ঘরে ঢুকলেন। উনাদের কথোপকোথন আর আমার হাতের যাচ্ছেতাই অবস্থা দেখে মা হেসে বললেন," মেহেদী নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলে বৌমা? ও বকেছে তোমাকে?"
আমি তাকালাম না। মাথা নিচু করেই লাজুক স্বরে মিনমিন করলাম,"বকেননি মা।"
কোরবানি শেষ হলো দেরি করে। কসাই আসতে দেরি করেছে। আহসান সেই নিয়েও একচোট চিল্লাচিল্লি করেছেন। দামামার মতো রাগ শেষে ক্ষ্যান্ত হয়েছেন। উনার মাঝেমাঝে এতো রাগ উঠে যায়। কাউকে মানেননা।
জবাইটা নিজ হাতেই দিয়েছেন। হাতে রক্ত যখন নিয়ে উপরে আসলেন, আমি তখন তুমুল ব্যস্ত। রান্নাঘরে সব সামলাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। নিচে যাইনি রক্ত ভয় পাই বলে। আহসান একবার ডেকেছিলেন, ভয় পাই শুনে আর কিছু বলেননি। গোসল করতে পারিনি এখনো। উনি দরজা দিয়ে ঢুকেই হাঁক ছাড়লেন," চৈতি, এদিক আসো।"
বাসায় তখন কেও নেই। সবাই নিচে। যেয়ে বেসিনের কল ছেড়ে দিলাম। উনি হাত ধুলেন। মুখে পানি ছিঁটালেন। ঘরের ফ্যান ছেড়ে দিলাম। উনি একটানে পান্জাবি ছাড়িয়ে ধপ করে বিছানায় বসলেন, কোমড় থেকে আচঁল খুলে হাত মুছলেন। গলার ঘাম মুছলেন। তারপর আচমকাই কোমড় টেনে কোলের উপর বসিয়ে একাধারে মুখের দিকে চেয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। বাইরে আপুরা এসে পড়েছে। কয়েকজন প্রতিবেশি আন্টির হাসাহাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে কতক্ষণ আগে থেকেই। আমি কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বললাম,"বাইরে যাই। সবাই কি বলবে।"
---"কি বলবে?"
আমি উওর দিলামনা। উনি দূর্বোধ্য হাসলেন। কানের কাছের চুলগুলো এলোমেলো উড়ছে। সেগুলোই জায়গামতো গুঁজে দিতে দিতে বললেন," মার সাথে কথা হয়েছে না?"
আমি নতজানু মাথাটাই আরো একটু নুইয়ে বললাম,
---"উহু। আমার ফোনে টাকা নাই।"
উনি চোখ বড় বড় করে তাকালেন। ব্যসত ভঙ্গিতে পকেট থেকে ফোন বের করে মার নাম্বারে ডায়াল করতে করতে বললেন,
---"তো টাকা নেই আমাকে বলবা না? ইদের দিন। একটু ফোন করোনি। কি ভাববেন উনারা।"
---"আপনি ব্যস্ত ছিলেন। তাছাড়া একটু পরতো যাবেনই।"
---"সে তো আমি যাবো মাংস নিয়ে। তুমি তো আর যাবেনা। নাও, কথা বলো।"
মার সাথে কথা হলো। বাবা বাসায় নাই। আমি কথা শেষে ফোন নামিয়ে বললাম," এবারতো ছাড়ুন। কি না কি ভাবছেন উনারা। পরে আমাকে লজ্জায় পরতে হবে।"
উনি একপলক তাকিয়ে গলার কাছে চটপট একান্ত একটা কাজ সেড়ে বললেন,
---"আর তুমি যে আমাকে এতোবড় লজ্জায় ফেললা। গালে মেহেদি নিয়ে উনাদের সামনে দিয়ে কি করে বেরোবো আমি? আন্টিরা তো তুমুল ঠোঁটকাটা।"
---"বেশ করেছি। আপনার লজ্জা লাগা উচিত। নির্লজ্জ একটা। ছাড়ুন।"
সন্ধ্যা হলো। মেহমানরা চলে গেছে। উনার কোন একটা ফুপু এসেছিলেন। পরিবার নিয়ে। আপন না। দূর সম্পর্কের। গেলেন একটু আগে। আহসান ফিরেননি এখনো। দুপুরে আমাদের বাসায় গিয়েছেন। ওখান থেকে আর কোথায় কোথায় জানি যাবেন। একমাত্র ছেলে। সব উনারই সামলাতে হয়।
ফোন বাজছে। আপু ফোন করেছে। ধরলাম। আপু ঝলমলে স্বরে বললো,"কিরে ফোন ধরিস না কেন? কতক্ষণ ধরে করছি।"
---"গোসলে ছিলাম আপু, বলো।"
আশেপাশে খুব হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। চাচিরা কিছু একটা নিয়ে হেসেই যাচ্ছেন তো হেসেই যাচ্ছেন। আপু ধমক দিলেন,"এই তোমরা একটু চুপ করোতো। আব্বুর মেয়ের সাথে কথা বলছিনা।" উনারা দ্বিগুন জোরে হেসে উঠলেন। আমি শূন্য মস্তিষ্কে আন্দাজ করার চেষ্টা করছি আসলে হয়েছে কি।
আমাকে ভাবতে হলোনা। আপু নিজেই বললো,"আহসান ভাই তো আজ পুরো বেকুব বনে গেছে রে। তুই উনার গালে- গলায় মেহেদি লাগিয়েছিস না?" আমি চোখ বুজলাম। উফফ! আবার। আমার জামাইকে আমি মেহেদি লাগিয়েছি তো কি হয়েছে? লোকজনের খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই। মানুষটা একটু সুন্দর দেখতে। ব্যস! সবার এখন মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।
ওদিকে আপু বলেই যাচ্ছে,"তো ওটা দেখে আব্বু পুরা ঘরভর্তি মানুষের সামনে উনাকে বলে,"বাবা, তোমার কি এলার্জির সমস্যা? গাল- গলা এমন হয়ে আছে কেনো? আল্লাহ! ডাক্তার দেখিয়েছো? আমার এক চেনা পরিচিত ডাক্তার আছে।" মেজো চাচা, ছোট চাচা সবাই বসে আছে সামনে।
উনি তো লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতেই পারছিলেন না। তোকে যদি ভিডিও করে দিতে পারতাম রে। ইশশ! এতো বড় মানুষটার কি লজ্জা! প্রথমবার দেখলাম। আর আব্বুও কিছু না বুঝে, ভালো করে না দেখেই ওই ডাক্তার কোথায় বসে, কবে বসে, শেষমেষ পকেট থেকে ফোন বের করে এগিয়ে দিয়ে বললো,"দেখোতো বাবা, 'এলার্জি আকমল' দিয়ে নাম্বারটা সেভ করা আছে। চৈতিই করেছিলো। উনি তো এসবেরই ডাক্তার। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। চৈতিরও তো এলার্জির সমস্যা অনেক। ওকেও এখানেই দেখিয়েছিলাম। দেখো দেখো। আমার চশমাটা নেই তো কাছে। নয়তো আমিই বের করে দিতাম।"
আহসান ভাই ফোন নিলেননা। আব্বু" নাও, নাও, লজ্জার কি আছে? এলার্জি থাকতেই পারে।" বলতেই তিনি একঝলক তাকিয়ে নিচু কন্ঠে বললেন, "আপনার মেয়ে একটু উল্টোপাল্টা ঘুমায় তো আব্বু। ঘুমের ঘোরে কখন হাতের মেহেদি ভরিয়ে ফেলেছে বুঝতে পারেনি। সেজন্যই আরকি... রং হয়ে গেছে। আমার এলার্জি নেই।"
তারপর আব্বুও বেকুব। চাচারা হাসি থামাতে পারলেন না। আমরাও হেসে ফেলেছি। আর আহসান ভাই ঝটপট উঠে বললেন,"আমার একটু দূরে যেতে হবে। কাজ আছে। আজকে আসি। পরে একদিন বেশিক্ষণ থাকবোনে।" বলে মনেহয় আর একসেকেন্ডও থাকেননি। এতো লজ্জা পায় উনি, আমরাতো ভাবতেই পারিনি।"
ফোন রাখলাম দুরুদুরু মন নিয়ে। নির্ঘাত আজ গালে চড় লাগিয়ে উনার মতো লাল না হলেও তার কাছাকাছি রং ঠি কই বানিয়ে ফেলবেন।
এমন কিছুই হলোনা। আহসান ফিরে একবার আমাদের ঘরে গেলেন। না পেয়ে মা কে বললেন,
---"কই তোমার বৌমা? হাত কেটে কই লুকিয়ে আছে?"
মা আস্তে করে বললেন,
---"আমার ঘরে শুয়ে আছে।"
মার বলতে দেরি, উনার আসতে দেরি হয়না। একটু আগে হাত কেটে ফেলেছি। বটি ধরতে পারিনা তবু আপেল কাটতে গিয়েছিলাম। ছুরিটা পাইনি আশেপাশে। ভেবেছি পারবো কিন্তু বটি কেঁপে আপেলের জায়গায় পুরো তালুটাই ডেবে গেলো। রক্তারক্তি অবস্থা। মা ভয় পেয়ে দ্রুত উনাকে ফোন করে জানালেন। বাবা অবশ্য সাথেসাথেই পাশের একটা ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছেন। ব্যান্ডেজ করিয়ে এনেছেন।
আমি বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ছিলাম। উনার পদচারণ শুনে সাথে সাথে শুতে না পেরে মাথা কাত করে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছি এমন একটা ভাব করলাম। উনি একবিন্দু ধ্যান না দিয়ে কাছে এসে ধমকে উঠলেন,
---"একদম ঘুমের ভান করবানা চৈতি। ভালো হবেনা কিন্তু। উঠো বলছি। দেখি, হাত দেখাও। কতদিন বলেছি বটি ধরোনা, বটি ধরোনা। আমার একটা কথার দাম নেই।"
আমি ফ্যাকাশে মুখে তাকালাম। মা তড়িঘড়ি করে এসে বললেন,
---"আহা! বকিসনা। কতগুলা রক্ত পড়েছে এমনেই। দূর্বল হয়ে গেছে শরীরটা।"
উনি সাদা গজ বাঁধা ডান হাতটা কোলের উপর নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন,
---"তুমিই ওকে মাথায় তুলেছো আম্মা।"
মা মলিন হাসলেন। আহসান ওখান থেকে ঘরে নিয়ে গেলেন। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন," কেনো কাটতে গেছো? কাউকে বললেই হতো। ইদের দিন এমন একটা ব্যাথা না পেলে হতোনা?"
আমি উওর দিলামনা। গালে মেহেদি দিয়ে উনাকে সুন্দর লাগছে খুব। উনাকে কি সবসময়ই সুন্দর লাগে? বলেই ফেললাম,
---"আচ্ছা, আপনাকে একদিন আলকাতরা মাখিয়ে দিবোনে। আমার মনেহয় আপনাকে আলকাতরা মাখলেও এমনই সুন্দর দেখাবে। তাইনা?"
উনি হেসে ফেললেন। হাতের ব্যান্ডেজে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললেন,"আচ্ছা, দিও। তার আগে বলো, 'এ্যালার্জি আকমল' মানে কি?"
হাসলাম আমিও। উনি কপালের চুল সরিয়ে দিতে দিতে বললেন,"তুমি আর কোনোদিন লাগিও মেহেদি।"
---"আপনি আর কোনোদিন বুকে টেনেন আমাকে।"
---"ওটা আমার অভ্যাস।"
---"আমি মেহেদি লাগাবোই।"
উনি বেগতিক হাসলেন। কিছুক্ষণ নিষ্পলক চোখে চোখ রেখে আলতো স্বরে বললেন,"আচ্ছা, লাগিও। রক্ত দেখে বেশি ভয় পেয়েছো? দেখি? হাতের ব্যাথায় আবার জ্বর এলো নাকি। গা টা গরম। নাপা কোথায় রাখো চৈতি? ড্রয়েরে?"
Writer:- মালিহা খান