পত্রিকার এই ভয়াবহ ভুলটা বিজ্ঞানী আলফ্রেডের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো। আসলে ক’দিন আগে তার আপন ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছিলো। তৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব ভালো না থাকায় এবং দুই ভাইয়ের নামের মিল থাকায় পত্রিকাওয়ালারা ভুল করেছিলো। তারা ভুল করে ভেবেছিলো বিজ্ঞানী আলফ্রেডের মৃত্যু হয়েছে। তার পুরো নাম আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল। আর তার সদ্য প্রয়াত ভাইয়ের নাম ছিলো লাটভিগ ইমান্যুয়েল নোবেল।
পত্রিকার এমন ভুলের কারণে বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল বুঝতে পারলেন, তার মৃত্যুর পর পরবর্তী অনেক প্রজন্ম তাকে ঘৃণা করতে পারে। কারণ তিনি আজীবন গবেষণা করেছেন রসায়নের এমন সব উপাদান নিয়ে যেগুলো দিয়ে ভয়ংকর সব আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরি হয়েছে। এই আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক বিক্রি করে তিনি অঢেল টাকার মালিক হয়েছেন। তার মোট ফ্যাক্টরী ছিলো ৯০ টা। অপরিসীম সেই টাকা। কিন্তু মরণের পর যদি মানুষ ভালো না বাসলো তবে এই টাকার কিছুমাত্র কি মূল্য থাকলো? তিনি তার জীবনে অর্জিত প্রায় সব সম্পদ মানুষের কল্যানে দান করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তৈরি করলেন একটি ট্রাস্ট। যে ট্রাস্টের টাকা দিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মানুষের কল্যানকারীদের পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্ত নিলেন বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল। আমরা আজ সবাই জানি সেই পুরস্কারের নাম, ‘নোবেল পুরস্কার’। একাধারে মহাজ্ঞানী এবং তুখোড় ব্যবসায়ী আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুর ৫ বছর পর ১৯০১ সাল থেকে প্রতিবছর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। বিভিন্ন সময় ক্যাটাগরী পরিবর্তনের পর বর্তমানে রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসা, সাহিত্য, অর্থনীতি ও শান্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই পুরস্কারকে পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। একটি মেডেল এবং সার্টিফিকেটের সাথে এই পুরস্কারের বিজয়ীকে দেওয়া হয় এককালীন প্রায় সাড়ে আট কোটি টাকা। টাকার পরিমাণে যদিও এর সম্মানকে কখনোই তুলনা করা সঠিক নয়।
বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলর মোট আবিষ্কারের সংখ্যা ছিলো ৩৫৫। সবগুলোরই পেটেন্ট আছে তার নামে। তার প্রায় সব আবিষ্কারই ছিলো ভয়াবহ সব বিস্ফোরক নিয়ে। তিনি গান-পাউডার এবং নাইট্রোগ্লিসারিনের মতো ভয়ংকর উপাদান ব্যবহার করে অনেক আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করেছেন। তবে তার সবচেয়ে বেশী অর্থ প্রাপ্তি হয়েছে ‘ডায়নামাইট’ দিয়ে। এটা এমন এক শক্তিশালী বোমা যা দিয়ে পাহাড় পর্যন্ত ধ্বংস করা যায় নিমেষে। দুষ্ট মানুষ বিজ্ঞানী নোবেলের উদ্ভাবিত এসব উপাদান ব্যবহার করতো যুদ্ধক্ষেত্রে- যার ফলে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শেষ বয়সে তাই এই মহান বিজ্ঞানী ভীষণ অনুশোচনায় ভুগতেন।
আলফ্রেড নোবেল শুধু মহাজ্ঞানী এবং অসাধারণ ব্যবসায়ীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বহুভাষায় পন্ডিত। সুইডেনে জন্মগ্রহণ করা এই মহান মানুষ একই সাথে ছয়টি ভাষায় পড়তে, লিখতে ও কথা বলতে পারতেন। সুইডিশ, ইংরেজী, ফরাসি, জার্মান, রাশিয়ান ও ইটালিয়ান। তিনি চমৎকার কবিতাও লিখতেন। আজীবন অবিবাহিত ছিলেন তিনি, তাই তার উত্তরাধীকার বলে তেমন কেউ ছিলোনা। তবে তার জীবনে অন্তত ৩ বার গভীর প্রেম এসেছিলো। প্রথমবার তিনি ভালোবাসেন রাশিয়ার মেয়ে আলেকজান্দ্রাকে। তবে এই সম্পর্ক বেশীদিন টেকেনি। পরে নোবেলের সংস্পর্শে আসেন বার্থা কিনস্কি নামের এক কোমলমতি নারী। অনেকেরই মতে এই বার্থা কিনস্কি’র ঐকান্তিক চেষ্টাতেই নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রবর্তন হয়। আলফ্রেড নোবেলের দীর্ঘ সময়ের সঙ্গী ছিলেন সোফি হ্যাস নামের এক সুইডিশ নারী। যদিও তারা বিয়ে করতে পারেননি। নোবেলের ব্যক্তিজীবনের এই আবেগের সম্পর্কগুলো নিয়ে আমরা হয়তো কিছুই জানতে পারতাম না যদিনা তার মৃত্যুর প্রায় ৬০ বছর পর তার লিখা বিভিন্ন চিঠি স্টকহোমে জনসম্মুখে প্রকাশ করা না হতো।
আজ ২১ অক্টোবর, মহান এই বিজ্ঞানী, আবিষ্কারক ও ব্যবসায়ীর জন্মদিন। ১৮৩৩ সালের এই দিনে সুইডেনের স্টকহোমে অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল। তার কর্মজীবনের একটা বড় অংশই কেটেছে ফ্রান্সে। তবে মৃত্যুর বছর পাঁচেক আগে তিনি পাড়ি জমান স্পেনে। সেখানেই তার মৃত্যু হয় মাত্র ৬৩ বছর বয়সে, ১৮৯৬ সালে। তার শেষ ইচ্ছা কিংবা উইল অনুযায়ী মৃত্যুর সময় ব্যাংকে রেখে যাওয়া তার বিশাল সম্পদের লভ্যাংশ দিয়ে আজও মানবকল্যানে অগ্রনীদের পুরষ্কৃত করা হচ্ছে। ১৯০১ সালে নোবেল পুরষ্কার চালু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০০ মানুষ ‘নোবেল’ প্রাপ্তির স্বাদ পেয়েছেন। তার আবিষ্কারের ভুল ব্যবহারে ব্যথিত হয়েই বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল স্বপ্ন দেখেছিলেন ‘মৃত্যুর ব্যবসায়ী’ হিসেবে তার নাম যেনো আর কেউ স্মরণ না রাখে। তার শেষ স্বপ্ন বৃথা যায়নি। আজ তাই ‘নোবেল’কে বিশ্বজুড়েই স্মরণ করা হয় গভীর শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায়। ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’- শেষটা ভালো করে এই বিজ্ঞানী মহান হয়েছেন পৃথিবীর ইতিহাসে। তার নাম চিরদিন অমর থাকুক...
Writer:-
Rumel M S Pir