Leave a message
> ডোরিয়া শফিক
-->

ডোরিয়া শফিক


আমি নিজেকে একজন নারীবাদী মনে করি । তবে আমার নারীবাদের সংজ্ঞা নিতান্ত আমার নিজস্ব । সেই সংজ্ঞায় ন্যুডিটি , পিরিয়ড় , স্যানিটারী প্যাড বা মেনস্ট্রুয়েশন ট্র্যাঁবুর ভাঙ্গার প্রাধান্য নেই বললেই চলে । আমার নারীবাদের সংজ্ঞা আমি যাকে দেখে পড়ে একটু একটু করে গড়ে তুলেছি উনি হলেন 'ডোরিয়া শফিক' (Doria Shafik) । অনেকে হয়তো এই মহীয়সী ঈজিপ্টসিয়ান রমণীর কথা কখনো শুনেননি । শুনলেও গা করেন নি । বাংলাতেও তাঁকে নিয়ে তেমন কোন লিখা নেই বললেই চলে । তাঁকে এরাবিয়ান নারী জাগরণের অগ্রদূত বলা হয় । তিনি আমাদের বেগম রোকেয়ার এরাবিয়ান ভার্সন ।
.
এই মহিয়সী রমনীটি গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । ছোট থেকেই তাঁর ছিলো অসাধারণ মেধা ও শক্তিশালী নেতৃত্বের গুণ । মাত্র ১৬ বছর বয়সে ফ্রেঞ্চ ব্যাচেলারেট ডিগ্রী অর্জন করেন । ১৯ বছর বয়সে ঈজিপ্টশিয়ান শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে স্কলারশীপ পেয়ে পাড়ি জমান প্যারিসে । পি এইচ ডি করেন সাইকোলজিতে । সেখানে বিয়ে করেন আইনের ছাত্র ‘নুর আল দিন রাজাই'কে । এই সুদর্শন প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন পুরুষটি তাঁর মাঝে কি দেখতে পেরেছেন জানি না তবে পরবর্তী জীবনে একজন খ্যাতনামা আইন যোদ্ধা হয়ে ডোরিয়া শফিকের প্রতিরক্ষা শীল্ডে পরিণত হন ।
.
১৯৪০ সালে ডোরিয়া শফিক ফ্রান্স থেকে ইজিপ্টে ফিরে আসেন । তিনি দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদে যোগদানের ইচ্ছা ব্যক্ত করলেও তৎকালীন ডিন তাঁকে 'টু মর্ডান' বলে তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন । পরবর্তীতে তাঁর যোগ্যতা বুঝতে পেরে তৎকালীন কিং ফুয়াদের ১ম স্ত্রী শিবকিয়ার ইব্রাহিম (Shivakiar Ibrahim) তাঁকে দেশের অন্যতম প্রভাবশালী ম্যাগাজিন 'লা ফ্রেমে নুউভ্যালী' (La Femme Nouvelle) এর এডিটর ইন চীফ- এর পদ অফার করেন । যা ডোরিয়ার জীবন আমূল বদলে দেয় । তার উত্থান শুরু হয় এখান থেকে । তিনি ১৯৪৫ সালে বিনতে আল নীল বা নীলনদের কন্যা নামে একটি এরাবিয়ান ম্যাগাজিন চালু করেন । কালক্রমে এই নামটি (নীলনদের কন্যা) তাঁর উপাধিতে পরিণত হয় । এরাবিয়ান নারী জাগরণে এই ম্যাগাজিনটি নারীদের মুখপাত্র হয়ে উঠে । তৈরী হয় 'বিনতে আল নীল' ইউনিয়ন ।
.
১৯৫১ সালে তিনি এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটান যা তৎকালীন কোন মুসলিম রাস্ট্রে কেউ কখনো দেখেনি । তিনি গোপনে বিনতে আল নীল ইউনিয়ন ও ঈজিপ্টশিয়ান ফ্যামিনিস্ট ইউনিয়নের ১৫০০ সদস্যকে একত্র করে হঠাৎ ইজিপ্টশিয়ান পার্লামেন্টের দিকে মার্চ করা শুরু করেন । পুলিশী বাঁধা অতিক্রম করে তারা পার্লামেন্ট ঢুকে ৪ ঘন্টার জন্য অধিবেশন অচল করে রাখেন । ঈজিপ্টশিয়ান নারীদের আর্থ সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রচলিত বহুবিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত পুরানো আইন সংশোধনে পার্লামেন্টকে বাধ্য করেন । পার্লামেন্ট অবমাননার দায়ে তাঁকে আদালতে হাজির হতে বলা হলে তিনি পুরো বিনতে আল নীল ইউনিয়ন কর্মীদের নিয়ে আদালতে হাজির হন । অবস্থা বেগতিক দেখে আদালত মুলতবী ঘোষিত হয় । পরবর্তীতে ঈজিপ্ট সরকার তাঁর দাবী মেনে নেয় ও আরোপিত অভিযোগ তুলে নিলে কায়রোর অচলাবস্থার নিরসন হন ।
.
সেই বছরই তিনি ব্রিটিশদের তাঁদের মাটি থেকে বিতাড়িত করতে দেশের/আরবের প্রথম ফিমেইল মিলিশিয়া ইউনিট গড়ে তুলেন এবং সরকার কর্তৃক তাঁর 'বিনতে আল নীল' পলিটিক্যাল পার্টি হিসেবে অনুমোদন পায় ।
.
তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় ঈজিপ্টশিয়ান মহিলাদের ভোট দেওয়ার যোগ্য বলে বিবেচনা করা হতো না । তাই ১৯৫২ সালের বিপ্লবে রাজতন্ত্রের উৎখাত পরবর্তী সংবিধান প্রনয়ন কমিটিতে কোন নারীর স্থান দেওয়া হয়নি । নীল নদের কন্যা এবার এখানে আঘাত আনলেন । দলবল নিয়ে শুরু করলেন অনশন । যা ব্যাপক মিডিয়া কাভারাপ পায় । পুরো পশ্চিমা মিডিয়া ফালাও করে তা প্রচার করে । জাতিসংঘ থেকে চাপ বাড়তে থাকে ঈজিপ্টের প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাগিবের উপর । অনশন শুরু করার ৮ দিন পর প্রেসিডেন্ট নাগিব লিখিতভাবে তাঁদের দাবী মেনে নেন । ১৯৫৬ সালে সংবিধান রচিত হয় । ইজিপ্টশিয়ান নারীরা ভোটাধিকাল পায় ।
.
এই ঘটনা তাকে ক্ষমতার শীর্ষে তোলার পাশাপাশি সারা বিশ্বে পরিচিতি এনে দেয় । তাঁকে তৎকালীন নারীদের আইকন মানা হচ্ছিল । ইজিপ্টশিয়ান নারীদের বিষয়ে লেকচার দিতে বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রণে তিনি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ট্যুরে যান । তিনি পাকিস্তানেও আসেন । ফাতেমা জিন্নাহ’র সাথে দেখা করেন । তবে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে এসেছিলেন কিনা জানা যায় না ।
.
এর মধ্যে প্রেসিডন্ট মুহাম্মদ নাগিবকে গৃহবন্দী করে ক্ষমতায় আসেন ইজিপ্টশিয়ান লৌহমানব জামাল আবদেল নাসের । ডোরিয়া শফিকের হাতে পড়ে নাগিব কিভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছিল তা লৌহমানব জামাল আবদেল নাসেরের জানা ছিল । তিনি ডোরিয়া শফিকের টুটি চেপে ধরার সুযোগে ছিলেন । ডোরিয়া শফিকও তাকে নাগিব মনে করে ভুল করলেন । ১৯৫৭ সালে ডোরিয়া তার ডিক্টেটরশীপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর এক পর্যায়ে অনশন শুরু করেন । আর্মি এসে তাঁকে গ্রেফতার করে । পরবর্তীতে তাঁকে গৃহবন্দী করা হয় । প্রেসে তাঁর সর্ম্পকে কোন তথ্য প্রকাশ কিংবা তার নাম পর্যন্ত প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় । ‘বিনতে আল নীল’ পার্টি যেটি কিনা সামান্য ম্যাগাজিন থেকে ইউনিয়ন, ইউনিয়ন থেকে রাষ্ট্রীয় পার্টিতে পরিণত হয়েছিল, সেই পার্টিকে নাসের ধুঁলোয় মিশিয়ে দেন । যেখানে ডোরিয়া শফিকের নাম পাওয়া গেল মুছে দেওয়া হল । তার সমর্থকরা গুম হলো । এইভাবে প্যান এরাবিজমের প্রবক্তা জামাল আবদেল নাসের নারী অধিকারের কন্ঠরুদ্ধ করে দিয়েছিলেন ।
.
১৯৭৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ডোরিয়া শফিক গৃহবন্দী ছিলেন । দীর্ঘ ১৮ বছরের গৃহবন্দীর সময় ডোরিয়া শফিক কবিতা উপন্যাস সাহিত্য নিয়ে প্রচুর লিখালিখি করেন । যা তাঁর মৃত্যূর পর মুক্তি পায় ।১৯৭০ এ নাসেরের মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট হন নাসেরের শিষ্য তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল সাদাত । ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নাগিবকে গৃহবন্দী হতে মুক্তি দিলেও ডোরিয়া শফিককে মুক্তি দেওয়ার সাহস করেননি ।
বলা হয় দীর্ঘ ১৮ বছরের গৃহবন্দী জীবনে তাঁকে চরম একাকিত্বের মধ্যে যেতে হয়েছে । তাঁর স্বামী ও দুই কন্যাকে ঠিকমত দেখতে দেওয়া হয়নি । নাসের সরকার তার মনোবল ভাঙ্গতে তার স্বামী নূর আল দীন রাগাইকে তাঁর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদে বাধ্য করেন । তখন থেকেই মূলত তিনি ক্রমে ভেঙ্গে পড়তে থাকেন । ১৯৭৫ সালে আর্ন্তজাতিক মহল আনোয়ার সাদাতের উপর ডোরিয়া শফিককে ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে ঠিক তখনই ডোরিয়া শফিক বারান্দা থেকে পড়ে যান ! অনেকে বলে আত্মহত্যা করেন ! আসলেই কি হয়েছিল তা কেউ জানে না ।
.
এই হলো একজন প্রকৃত নারীবাদীর জীবনী । নারী জাতির প্রতি সম্মান রেখেই বলছি- যে নারী আর্থ সামাজিক ব্যবস্থায় নারীর প্রতি বৈষম্যতা , দারিদ্রতা , জাস্টিস সিষ্টেমে নারীর যোগদান , সাক্ষী সংক্রান্ত জটিলতা , যৌন হয়রানী , নারী দেহকে পণ্য বানানোর মত বহু মহত্ত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে শুধু স্বল্প বাসনার রাইটস নিয়ে পড়ে থাকে সে আর যাইহোক আমার সংজ্ঞায় নারীবাদী নয় ।
.
২০১৬ সালে গুগল ডোরিয়া শফিকের ১০৪ তম জন্মবাষির্কী নিয়ে একটি 'ডুডল' (DOODLE) করে । তখনই তাঁর সর্ম্পকে প্রথম জানতে পারি । আকুন্ঠ শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এই মহিয়সী নারীর প্রতি ।


.
Writer:- শান্তনু চৌধুরী শান্তু
 

Delivered by FeedBurner

a