> ইন্দিরা গান্ধী
-->

ইন্দিরা গান্ধী




গত শতাব্দীর শেষ প্রান্তে ১৯৯৯ সালে বিবিসি এক জরিপ পরিচালনা করে ‘শতাব্দীর সেরা নারী কে’? জরিপের ফলাফল এলো ইন্দিরা গান্ধী। আমরা সকলেই তার নাম জানি। ভারতের প্রাক্তণ এই প্রধানমন্ত্রীকে আমি সম্মান করি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য। তার রাজনৈতিক জীবনে ছিলো বহু ঘটনা-দূর্ঘটনা। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে, ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর নিজেরই দু’জন শিখ দেহরক্ষী তাকে খুব কাছে থেকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করেছিলো। আজ তার মৃত্যুদিবস।
তার জন্ম হয় ১৯১৭ সালে। তার বাবা ছিলেন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু। নেহেরু দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিলেন ইন্দিরা। যদিও তার এক ভাই ছিলো কিন্তু শৈশবেই ভাইটি মারা যায়। একমাত্র সন্তান হলেও ইন্দিরার শৈশব খুব সুন্দর ছিলোনা। তার বাবা বৃটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ব্যস্ত থাকতেন। প্রায়ই তাকে কারাগারে আটক থাকতে হতো, নয়তো আন্দোলনকে বেগবান করতে পুরো ভারতবর্ষ চষে বেড়াতে হতো। ইন্দিরার মা খুব অসুস্থ থাকতেন। ডাক্তারের পরামর্শে প্রায় সকল সময়ই তাকে বেড রেস্টে থাকতে হতো। বাবার সাথে ঐ সময়ে ইন্দিরার দেখা হতো খুবই কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের যোগাযোগ হতো চিঠির মাধ্যমে। সম্পদের কোনো অভাব ছিলোনা নেহেরু পরিবারের, তাই চাকর-বাকরেরও কমতি ছিলোনা। কিন্তু ইন্দিরা বেড়ে উঠেন অনেকটা একাকীত্বের মাঝে। এমনকি তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় মেট্রিক পরীক্ষার সময়, যখন তাকে অত্যন্ত দামী ও অভিজাত স্কুলে ভর্তি করা হয়। এর আগ পর্যন্ত তার বিদ্যা শিক্ষার দায়িত্ব ছিলো একাধিক গৃহশিক্ষকের হাতে। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, শৈশবের সেই একাকীত্বের যন্ত্রণা তার হৃদয়কে কঠোর করে ফেলে, যা ভবিষ্যতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকে বিভিন্ন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করে থাকতে পারে।
একসময় তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হোন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নাম রাখেন ‘প্রিয়দর্শিনী’। বিশ্বভারতীতে বিদ্যা অর্জনের পর ইন্দরা পাড়ি জমান বিলেতে। ভর্তি হোন বিখ্যাত অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে তিনি পড়েন ইতিহাস, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে। বিলেতে থাকা অবস্থায় তার পরিচয় হয় ফিরোজ গান্ধী নামের এক পার্সি যুবকের সাথে। পরিচয় থেকে প্রণয় এবং পরে তাদের বিয়ে হয় ১৯৪২ সালে। বিয়ের পর ইন্দিরা নেহেরু নাম পাল্টে হয়ে যান ইন্দিরা গান্ধী। নামের মিল থাকলেও ইন্দিরা কিংবা ফিরোজ কেউই মাহাত্মা গান্ধীর আত্মীয় ছিলেননা। ফিরোজ গান্ধী ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিক। তবে মাত্র ৪৭ বছর বয়সেই মারা যান তিনি, ১৯৬০ সালে। ইন্দিরা-ফিরোজ দম্পতির দুই ছেলে- রাজীব গান্ধী ও সঞ্জয় গান্ধী।
অক্সফোর্ডে পড়া শেষ করে ইন্দিরা দেশে ফিরে আসেন। ১৯৪৭ সালে বৃটিশদের কাছ থেকে ভারত স্বাধীনতা লাভ করলে ইন্দিরা গান্ধীর বাবা জওহরলাল নেহেরু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হোন। বাবা যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন তার ব্যক্তিগত সহকারী। বাবার সাথে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সফরেও তিনি ছিলেন সফরসঙ্গী। এই সময়ে নিজেকে দেশ পরিচালনার জন্য যোগ্য করে গড়তে থাকেন ইন্দিরা। ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রীত্ব করার পর প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় মৃত্যু হয় জওহরলাল নেহেরুর। পরবর্তীতে লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হলে ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রীসভার সদস্য নির্বাচিত হোন। তবে ১৯৬৬ সালে যখন শাস্ত্রী মারা যান, তখন ১৯৬৬ সালের জানুয়ারীতে ইন্দিরা গান্ধী প্রথমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার শাসনামল ছিলো দীর্ঘ। প্রথমবার ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭ এবং পরবর্তীতে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪, মোট ১৫ বছরেরও বেশী সময় ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সরকার প্রধান ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনের পুরোটা সময়ই তিনি ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করেন।
তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর ছিলো ১৯৭১। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যখন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করে নতুন এক দেশ ‘বাংলাদেশ’ গঠন করে তখন ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এর পাশাপাশি প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশী, যারা পাকিস্তানী বাহিনীর ভয়ে ভারতে আশ্রয় নেয় তাদের খাবার ও চিকিৎসারও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে। ১৯৭১ সালের শেষভাগে ভারতীয় সেনা ও বিমানবাহিনী সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যৌথবাহিনী গঠিত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯০ হাজার সৈন্য যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে ১৬ ডিসেম্বর। এই বিজয় ইন্দিরা গান্ধীকে তার নিজ দেশ ভারতে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এমনকি তার তৎকালীন প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অটল বিহারী বাজপেয়ী তাকে ‘মা দূর্গা’ বলে আখ্যায়িত করেন।
তবে ১৯৭৫ সালে ভারতের হাইকোর্টে এক রায়ে ইন্দিরা গান্ধীর সংসদ সদস্য পদ খারিজ করার রায় দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো যে বিগত নির্বাচনে তিনি তার প্রধানমন্ত্রী পদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন। এতে ইন্দিরা গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী পদ হারাতে হতো। তিনি ও তার দল সুপ্রীম কোর্টে আপিলের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু রায়ের সাথে সাথেই পুরো ভারতজুড়ে সরকারী ও বিরোধী দলগুলোর মাঝে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয় এবং ইন্দিরা গান্ধী পুরো দেশে ‘ইমার্জেন্সী’ ঘোষণা করেন। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এই ইমার্জেন্সী বলবৎ ছিলো এবং অভিযোগ আছে- এই সময়ে অন্যায়ভাবে লক্ষ লক্ষ বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার, নির্যাতন এমনকি হত্যা করা হয়। ১৯৭৭ সালে ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী হোন মোরারজি দেশাই।
১৯৮০ সালের নির্বাচনে আবারও ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হোন এবং দক্ষ হাতে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। ১৯৮৪ সালে গোয়েন্দা সংস্থা থেকে খবর আসে যে শিখ কিছু সন্ত্রাসী ব্যাপক গোলা-বারুদসহ স্বর্ণমন্দিরে আত্মগোপন করে আছে। স্বর্ণমন্দিরটি ছিলো শিখ সম্প্রদায়ের ধর্মীয়ভাবে সবচেয়ে পবিত্র স্থান। সন্ত্রাসীরা আত্মসমর্পণে রাজী না হলে ইন্দিরা গান্ধী সেই স্বর্ণমন্দিরে অভিযানের নির্দেশ দেন সেনাবাহিনীকে। ৩ দিন ধরে যুদ্ধ চলে এবং সন্ত্রাসীরা নিহত হয়। তবে পুরো ভারতের শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম হয় পবিত্র স্থানে হামলার কারনে। দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়, একপর্যায়ে ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নেয় এই বিক্ষোভ। ইন্দিরা গান্ধী শক্ত হাতে মোকাবেলা করেন দাঙ্গা। অনেক শিখ ধর্মীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকে। এই স্বর্নমন্দিরে হামলার মাত্র কয়েকমাস পরই ইন্দিরা গান্ধী নিহত হোন নিজ দেহরক্ষীদের গুলিতে। এই দুই দেহরক্ষীই ছিলেন শিখ এবং তারা প্রধানমন্ত্রীকে খুব কাছে থেকে গুলি করেন। দিনটা ছিলো ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর।
ইন্দিরা গান্ধীর দুই ছেলের কেউই স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেননি। রাজীব গান্ধী পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনী প্রচারনার এক পর্যায়ে তামিল বিদ্রোহীদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হোন তিনি। এর বহু আগে সঞ্জয় গান্ধী নিহত হোন বিমান দূর্ঘটনায়। তার ফ্লাইং লাইসেন্স ছিলো। প্রায়ই তিনি ফ্লাইং ক্লাবে গিয়ে বিমান চালাতেন। দূর্ঘটনার সময় সঞ্জয় নিজেই বিমানটি চালাচ্ছিলেন এবং অন্য কোনো যাত্রী তার সাথে ছিলেন না। দুই ছেলে মারা গেলেও ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর এতো বছর পর তার পরিবারের প্রভাব ভারতীয় রাজনীতিতে কমেনি। তার ছেলে রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। রাজীব গান্ধীর স্ত্রী, ইটালিয়ান নারী সোনিয়া গান্ধী দীর্ঘদিন কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। রাজীব-সোনিয়া দম্পতির ছেলে রাহুল গান্ধী এবং মেয়ে প্রিয়াংকা গান্ধীও ভারতের রাজনীতিতে সক্রিয় এবং জনপ্রিয়।
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর জীবনী নিয়ে, তার শাসনামল নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, অনেক বই-প্রবন্ধ লিখা হয়েছে। তাকে বলা হতো লৌহমানবী। তার বিখ্যাত একটি উক্তি আছে ‘পৃথিবীতে মানুষ দুই দলের, প্রথম দল কাজ করে যায় আর দ্বিতীয় দল শুধু কৃতিত্ব নেওয়ার সুযোগ খোঁজে। প্রথম দলের হওয়ার চেষ্টা করো কারণ এই দলে মানুষ কম- তাই প্রতিযোগীতাও কম’। আমার এই লিখার একমাত্র কারণ আমাদের মুক্তি সংগ্রামে তার সহায়তার জন্য সম্মান প্রদর্শন। তিনি ছিলেন এক ক্যারিশমেটিক নেতা। তার সাহস, বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান ও ব্যক্তিত্ব তাকে অমর করে রেখেছে। আজ তাই মৃত্যু দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এই মহিয়সী নারীকে...

Writer:- 
Rumel M S Pir
 

Delivered by FeedBurner

a