Leave a message
> জোয়ান অব আর্ক পর্ব ১
-->

জোয়ান অব আর্ক পর্ব ১


সাল ১৪৫৬।
রোম শহর।
ক্যাথলিক চার্চের সামনে জড়ো হয়েছে হাজারো জনতা। সবাই উত্তেজিত। কে কী নিয়ে কথা বলছে ভিড়ের মধ্যে ভালোভাবে শোনা যায় না। কেউ কেউ ঠেলাঠেলি করে সামনে যেতে চাচ্ছে। কয়েকজনকে ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন বৃদ্ধ নিকোলাস। দশ বছর বয়সী নাতির হাত ধরে আছেন তিনি। বেশ কয়েকজনকে ঠেলে সামনের কাতারে গেলেন তিনি নাতিকে নিয়ে। প্রখর রোদ। ঘামছে সবাই। তবুও কেউ যেন ধৈর্য হারালো না। রোদ থেকে বাঁচতে এক হাত কপালের উপর রেখে দাঁড়ালেন নিকোলাস। নিজের ছায়ায় দাঁড় করালেন তাঁর নাতি ইরোনাসকে।
-আমার ছায়ায় দাঁড়াও ইরোনাস। তুমি দেখছি খুব ঘেমে গেছো।' নাতির দিকে তাকিয়ে বললেন নিকোলাস। দাদুর কথা শুনে মৃদু হাসলো ইরোনাস। চোখে তার বিস্ময়। এতো মানুষ কেন জমা হয়েছে তা জানার চেয়ে এই গরম কিছুই না বিস্ময় এই বালকের কাছে।
-না দাদু, আমি ঠিক আছি।' বলেই হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো ইরোনাস। হঠাৎ উত্তেজনায় চিৎকার করে ওঠলো জনতা। ঘোড়ার টগবগ শব্দ শোনা গেল। সামনে তাকালো ওরা দাদু আর নাতি। ঘোড়ার গাড়ি এসে থামলো চার্চের সামনে। মাথায় মুকুট পরিহিত এক লোককে সম্মান জানিয়ে নামানো হলো গাড়ি থেকে। লোকটা কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা ঢুকে গেলেন চার্চের ভেতর।
-কে উনি?' জিজ্ঞেস করলো ইরোনাস।
-উনি আমাদের পোপ তৃতীয় ক্যালিক্সটাস।
-উনি কি আজ বিচার করবেন জোয়ানের?
-বিচার করবেন না। রায় দেবেন।
-কিন্তু, জোয়ান তো বেঁচে নেই। এ রায় কি শুনবে সে?
-শুনবে আমার প্রিয় নাতি। জোয়ানের আত্মা সবসময় এখানে ঘুরে। আজ যদি তার পক্ষে রায় দেয়া হয়, তবে তার আত্মা খুব খুশি হবে।'
মাথা দুলায় ইরোনাস, যেন সবকিছু বুঝে গেছে সে।
চার্চের ভেতর শুরু হলো বিচার কার্য। প্রধান আসনে বসেছেন পোপ তৃতীয় ক্যালিক্সটাস। তাঁর দুপাশে আরও দুজন বিচারক বসেছেন।
-সাক্ষীদের হাজির করা হোক।' গম্ভীর কণ্ঠে বললেন ক্যালিক্সটাস। কিছুক্ষণ পর চার্চের ধর্মীয় যাজকরা প্রবেশ করলো। এরাই সাক্ষী।
-জোয়ানের ব্যাপারে তোমাদের কী বলার আছে বলো...' সাক্ষীদের দিকে তাকিয়ে বললেন ক্যালিক্সটাস।
-জোয়ান নির্দোষ। আমরা সেদিন মিথ্যা সাক্ষী দিয়েছিলাম। জোয়ান আসলে ডাইনি না। আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ ছিল সে।
-তোমরা একটা চার্চের ধর্মীয় গুরু। তোমরা কী করে এমনটা করতে পারলে?' কিছুটা ক্রোধ প্রকাশ পেল পোপের কণ্ঠে।
-আমাদের ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা চাইছি।' বললেন চার্চের পাদরি।
-ক্ষমা? ক্ষমা চায়ছো তোমরা? তোমাদের মিথ্যে সাক্ষীর কারণে এক নিষ্পাপ মেয়ে মারা গেল। এর দায় কি তোমাদের নয়?' বলে ওঠলেন এক বিচারক।
-আমরা সেদিন ইংল্যান্ডের সার্থটাই বড় করে দেখছিলাম। জোয়ানের কারণেই ইংল্যান্ড ফ্রান্সের কাছে হেরে গিয়েছিল, তাই এমনটা করেছি আমরা।'
-চুপ করো।' গর্জে ওঠলেন পোপ। 'কী করে পারলে তোমরা? তোমাদের কাছ থেকে কী শিখবে তোমাদের অনুসারীরা?
চুপ করে রইলেন চার্চের ধর্মীয় গুরুরা। তখন আরেক বিচারক বলে ওঠলেন,
-তোমাদের মিথ্যা সাক্ষীর কারণে মেয়েটা মরার পরেও মিথ্যা অপবাদ বহন করছে। তোমাদের লজ্জা হওয়া উচিত।
-আমরা আমাদের কাজের জন্য খুব লজ্জা প্রকাশ করছি।'
ক্যালিক্সটাস ধর্মীয় যাজকদের দিকে তাকালেন। এই মুহূর্তে তিনি তাদেরকে অপরাধীর চোখে দেখছেন। দু'পাশের বিচারকদের সাথে তিনি কী যেন আলোচনা করলেন ফিসফিস করে। তারপর গম্ভীরকণ্ঠে বলে ওঠলেন,
-চার্চের ধর্মীয় যাজকদের মিথ্যা সাক্ষীর কারণে ডাইনি অপবাদ দিয়ে জোয়ান অব আর্ককে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল আজ থেকে ২৫ বছর আগে। আমি আজ থেকে তার সব অপবাদ মুছে দিয়ে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করছি। আর যারা তার বিরুদ্ধে মিথ্যে সাক্ষী দিয়েছিল তাদেরকে বন্দী করার নির্দেশ দিচ্ছি। বিচারের মাধ্যমে তারাও তাদের শাস্তি পাবে।'
পোপের রায় শুনে কয়েকজন সৈন্য চার্চের ধর্মীয় যাজকদের বন্দী করলো। আর একজন সৈন্য পোপের লিখিত রায় জনতাকে শোনাতে গেল বাইরে। সৈন্যটা যখন রায়টি শুনালো তখন জনতা উল্লাসে ফেটে পড়লো। হাসি ফুটে ওঠলো নিকোলাসের মুখেও। ইরোনাস তার দাদুর হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নিকোলাস নাতিকে বললো,
-মরার পর আরও একবার বিজয়ী হলো জোয়ান অব আর্ক। চল দাদু, এবার ফিরে যাই।' বলেই নাতির হাত ধরে ভিড়ের ভেতর মিশে গেল ওরা। ভিড় ঠেলে বের হতে অনেকক্ষণ লাগলো তাদের। তারপর হেঁটে এগিয়ে গেল ওরা খুঁটির সাথে বাঁধা তাদের ঘোড়া দু'টোর দিকে। ঘোড়ায় উঠতে উঠতে ইরোনাস প্রশ্ন করলো,
-দাদু, জোয়ান কি খুব সাহসী ছিল?'
-হ্যাঁ আমার প্রিয় নাতি। খুব সাহসী ছিল ও। ঘরে গিয়ে তোমাকে ওর বীরত্বের কাহিনি সব বলবো।' বলতে বলতে ঘোড়া ছুটালো নিকোলাস। ইরোনাসও নিজের ঘোড়া নিয়ে অনুসরণ করলো দাদুকে।
সাল ১৪২৫।
ফ্রান্সের উত্তরাধিকারী সপ্তম চার্লস রাজ পোশাক পরিহিত অবস্থায় নিজ কক্ষে পায়চারি করছেন। তিন বছর আগেই তিনি ফ্রান্সের রাজা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনও সিংহাসনে বসতে পারেননি। ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম হেনরির আধিপত্য চলে ফ্রান্সে। প্রায় শতবছর ধরে ইংল্যান্ডের রাজারা ফ্রান্সের সিংহাসন দাবি করে আসছে। ফ্রান্সও ইংল্যান্ডের শক্তির কাছে কোণঠাসা হয়ে আসছে। চার্লস নিজেকে ফ্রান্সের রাজা হিসেবে ঘোষণা করলেও, ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম হেনরির শাসন চলতে থাকে ফ্রান্সে। চার্লস নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে চায়লে, হেনরির সৈন্যরা হামলা চালায়। সিংহাসন ছেড়ে পালিয়ে আসে তখন চার্লস। তবে ফ্রান্সের অধিবাসীরা আশা করে একদিন নিশ্চয়ই এ অত্যাচারের অবসান হবে, চার্লস রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসবে। তাই চার্লসকে ভবিষ্যতের রাজা হিসেবে ফ্রান্সের অধিবাসীরা 'দৌপিন' বলে ডাকে। যার অর্থ 'ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী।'
-দৌপিন, ভেতরে আসার অনুমতি দিন।'
ভেতরে আসার অনুমতি চায়লো কামান্ডার রবার্ট বড্রিকট। কামান্ডারকে দেখে চার্লস জিজ্ঞেস করলেন,
-বলো রবার্ট, কী খবর নিয়ে এসেছো।
-দৌপিন, একজন ধর্মযাজক এসেছেন।'
-নিয়ে এসো তাকে।'
একটু পর একজন ধর্মযাজক প্রবেশ করলেন কামান্ডার রবার্টের সাথে। চার্লস ধর্মযাজকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
-বলুন, আমরা কীভাবে এ অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবো? কীভাবে আমরা আমাদের হারানো ভূখণ্ড ফিরে পাবো?'
-দৌপিন, আমি গণনা করে পেয়েছি, আমাদের ফ্রান্সের ভবিষ্যত একটা কিশোরী মেয়ের হাতে। একটা সাহসী কিশোরী, যার হাত ধরে আমরা স্বাধীনতা পাবো।
-যেখানে আমরা হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্য যুদ্ধ করে ইংল্যান্ডের কাছে পেরে উঠছি না। সেখানে একটা কিশোরী মেয়ের হাত ধরেই স্বাধীনতা পাবো? আপনি পাগল হয়ে যাননি তো?
-দৌপিন, আমার গণনা তাই বলছে। একদিন একটা কিশোরী মেয়ে আসবে, সাহসের সাথে যুদ্ধ করবে সে। আর আমাদের প্রিয় ভূখণ্ডকে রক্ষা করবে।
-ঠিক আছে। আপনি এখন যান।'
কুর্নিশ করে বের হয়ে গেলেন ধর্মযাজক। তিনি বের হয়ে যেতেই রবার্ট চার্লসের উদ্দেশ্য বললো,
-দৌপিন, আপনি কি ধর্মযাজকের কথা বিশ্বাস করলেন?'
-আমাদের ধর্মযাজক মনে হয় পাগল হয়ে গেছে। তুমি আমাদের সৈন্যকে প্রস্তুত করে সীমান্তে নিয়ে যাও। সাহসের সাথে যুদ্ধ করো। আমাদের অধিকার আমরা ফিরে পেতে চাই।'
-যথা আজ্ঞা দৌপিন।' বের হয়ে গেল কামান্ডার। চার্লস আবার পায়চারি করতে লাগলেন কক্ষে।
দমরেমি গ্রাম। ফ্রান্সের মিউজ নদীর কোলঘেঁষে ছোট্ট একটা গ্রাম। গ্রামের অধিকাংশ লোক কৃষি কাজ করে। তেমনি এক কৃষক হচ্ছেন জ্যাক ডি আর্ক। নিজের পঞ্চাশ একর জমিতে তিনি কৃষি কাজ করেন। পাশাপাশি তিনি ফ্রান্সের সরকারের পক্ষে কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করেন। তাছাড়া নিজের সম্পদ বলতে রয়েছে তার এক পাল ভেড়া। ভেড়াগুলো তার কিশোরী মেয়ে জোয়ান দেখাশোনা করে। প্রতিদিন ভেড়াগুলো সে মাঠে নিয়ে যায় চরাতে। সন্ধ্যার আগে আগে আবার নিয়ে আসে।
ভোরের আলো ফুটেছে। পাখিরা ডাকাডাকি করছে গাছের ডালে। জোয়ান তখনও ঘুমিয়ে আছে। তার মা ইসাবেলা এসে তার ঘুম ভেঙে দিলে, সে গুঙিয়ে ওঠে বলে,
-উফ মা, এতো তাড়াতাড়ি ডেকে দাও কেন?
-ভোর হয়েছে মা। নদী থেকে জল আনতে হবে তো।'
বিছানায় উঠে বসে কিছুক্ষণ ঝিমাতে থাকে জোয়ান। মা ইসাবেলা বের হয়ে গেল তার ঘর থেকে। জোয়ান চোখ মুছে হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙলো। তারপর বিছানা থেকে নেমে বাইরে এলো। বাইরের আলো চোখে লাগায় চোখ মিটমিট করতে লাগলো তার। ছাইয়ের স্তুপ থেকে কিছু ছাই তুলে নিয়ে দাঁত মাজতে লাগলো সে। তারপর মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
-মা কলসটা এনে দাও...'
ভেতর থেকে মা একটা খালি কলস এনে দিলো। জোয়ান কলসটা নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে হাঁটতে লাগলো মিউজ নদীর দিকে।
জোয়ানের মতো আরও অনেক কিশোরী এসেছে নদী থেকে জল নিতে। প্রতিদিন ভোরে সব কিশোরী যখন এক হয়, তখন নিজেদের মধ্যে মেতে ওঠে ওরা বেশ কিছুক্ষণ। নদীর তীরে রয়েছে বড় বড় পাথর। সেই পাথরে বসে আড্ডা দেয় কিশোরীর দল। আড্ডা দিতে দিতে নদীর জলে পা ভিজিয়ে ওরা হেসে ওঠে। নদীর কুলকুল ধ্বনির সাথে ওদের হাসি মিশে পরিবেশটা যেন মুখরিত হয়ে ওঠে তখন।
কলসটা পাশে রেখে একটা পাথরে বসে জোয়ান। নদী থেকে জল নিয়ে কুলি করে সে। তার আগেই চলে এসেছে কিশোরীর দল। আড্ডায় মেতে ওঠেছে ওরা। জোয়ান কয়েকবার কুলি করে ওদের সাথে আড্ডায় যোগ দেয়। তারপর যখন পুবাকাশে সূর্য উঁকি দিয়ে ওঠে, তখন জোয়ান কলস ভর্তি জল নিয়ে ফিরে যায় ঘরে।
যখন সে ফিরে আসে, তখন মায়ের বকা শুনে। মা একটু রাগ দেখিয়ে বলে,
-সেই কখন গিয়েছিস, এখন আসার সময় হলো? খাবি কখন? ভেড়ার পালগুলো মাঠে নিয়ে যাবি কখন?'
-উফ মা, প্রতিদিন একই কাজ করতে ভালো লাগে না।' বিরক্ত হয়ে বলে জোয়ান।
-তো ভেড়াগুলো কে মাঠে নিয়ে যাবে? আর কে আছে তুই ছাড়া?'
-ঠিক আছে, খাবার দাও...'
ইসাবেলা মেয়ের দিকে রুটির টুকরো এগিয়ে দিলো। কয়েক টুকরো রুটি খেয়ে জোয়ান বের হলো ঘর থেকে। তার বাবা জ্যাক ততোক্ষণে ভেড়ার পালের বাঁধনগুলো খুলে দিয়েছেন। মেয়েকে দেখে বলে ওঠলেন,
-সাবধানে যাস মা।'
-ঠিক আছে বাবা।'
মৃদু হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন জ্যাক। তারপর তিনি নিজের জমিগুলো দেখতে চলে গেলেন। জোয়ান ভেড়ার পাল নিয়ে ধীরে ধীরে যেতে লাগলো মাঠের দিকে। প্রতিদিন এই একই কাজ তার আর ভালো লাগছে না। অসহ্য হয়ে ওঠেছে সে। এই জীবন যেন তার জন্য না। তার জীবনটা অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল। অন্যরকম এক জীবন যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে প্রতিনিয়ত। কিন্তু সে দেখে না। ধোঁয়াশা লাগে তার কাছে। একদিন হয়তো সত্যি সত্যি সে ঐ জীবনের দেখা পাবে।



চলবে...



লেখা: ShoheL Rana শামী
 

Delivered by FeedBurner

a