ভেড়ার পাল মাঠে ছেড়ে দিয়ে একটা গাছের গোড়ায় এসে বসে জোয়ান। ভেড়াগুলো মাঠে চরে বেড়াচ্ছে। জোয়ানের মতো আরও অনেক ছেলে মেয়ে নিজেদের ভেড়ার পাল নিয়ে এসেছে চরাতে। প্রতিদিন ছেলেমেয়েগুলো যখন একসাথে হয় মাঠে, তারা নানারকম খেলায় ব্যস্ত থাকে। জোয়ানও যোগ দিতো তাদের সাথে। কিন্তু মন খারাপ বলে সেদিন ও খেলায় যোগ দেয়নি। গালে হাত দিয়ে সবার খেলা দেখতে থাকে সে। কয়েকজন ঘুড়ি উড়াচ্ছিল আকাশে। হঠাৎ ঘুড়ি উড়াতে উড়াতে দুইটা ছেলেমেয়ের ঝগড়া বাঁধে। ছেলেটা ধাক্কা দেয় মেয়েটাকে। মেয়েটা পড়ে যায় নিচে, আর তার হাত থেকে ঘুড়ির সুতোটা ছুটে যায়। ঘুড়িটা তখন উড়তে উড়তে দূরে হারিয়ে যেতে থাকে। মেয়েটা কাঁদতে থাকে ঘুড়ির জন্য। জোয়ান সব দেখছিল এতক্ষণ। এবার সে উঠে এসে মেয়েটার পাশে দাঁড়ায়। হাত ধরে তুলে মেয়েটাকে। ঐ ছেলেটা পুনরায় নিজের ঘুড়ি উড়াতে ব্যস্ত ছিল। জোয়ান তার মুখে একটা ঘুষি চালিয়ে ঘুড়ির সুতোয় টান দিলো। তারপর তার ঘুড়িটাও ছেড়ে দিলো আকাশে। ছেলেটা হা করে চেয়ে থাকলো নিজের ঘুড়িটার দিকে। জোয়ানকে জিজ্ঞেস করলো,
-এটা তুমি কী করলে?'
জোয়ান মেয়েটাকে দেখিয়ে জবাব দিলো,
-তুমি ওকে ধাক্কা দিয়েছো, ওর ঘুড়িটা ছুটে গেছে। তাই তোমার ঘুড়িটাও থাকবে কেন?'
-কিন্তু ও আমার ঘুড়ির সাথে ওর ঘুড়ি আটকে দিয়েছিল।
-আমি দেখেছি কে প্রথম দোষ করেছে। তুমিই ইচ্ছে করে ওর ঘুড়ির সাথে নিজের ঘুড়ি লাগিয়েছিলে।'
জোয়ানের কথা শুনে ছেলেটার ক্রোধ বেড়ে যায়। ক্রোধান্বিত হয়ে সে মারতে আসে জোয়ানকে। তখন জোয়ান দু'হাতে ধাক্কা দেয় তার পেটে। ছেলেটা পড়ে যায়। আবার যখন উঠে মারতে আসে সে, তখন বাকি ছেলেমেয়েরা তাকে আটকে রাখে। ছেলেটা ফুঁসতে থাকে রাগে। সেই মুহূর্তে একটা ছেলে ঘোড়া নিয়ে সেই জায়গায় এলে, সবার দৃষ্টি যায় ছেলেটার দিকে। ছেলেটা ঘোড়া থেকে না নেমেই হাঁপাতে হাঁপাতে জোয়ানের উদ্দেশ্যে বললো,
-জোয়ান খবর আছে...'
-কী খবর দানোস?' প্রশ্ন করে জোয়ান।
-আমি বারগুনডি গ্রাম থেকে খবর নিয়ে এসেছি, ওখানে যে রাজনৈতিক দলটা থাকে, ওরা তোমাদের গ্রামের দিকে যাবে আজ।'
দানোসের কথা শুনে সবাই ঝগড়ার কথা ভুলে যায়। সামনে বিপদের আশঙ্কা আছে। কারণ, দানোস যে রাজনৈতিক দলটার কথা বলছে, ওরা খুব খারাপ। ইংরেজদের পা চাটা গোলাম। মাঝেমাঝে ওরা আশেপাশের গ্রামগুলোতে হানা দিয়ে ধ্বংসলীলা চালায়। জোয়ান ওখানকার ছেলেমেয়েগুলোর উদ্দেশ্যে বললো,
-তোমরা আমার ভেড়ার পালটা দেখে রেখো। আমি দানোসের সাথে গ্রামে যাচ্ছি খবরটা দিতে।
-ঠিক আছে, যাও...' একসাথে গলা মিলালো সবাই। তখন জোয়ানের মার খাওয়া ছেলেটাও আর শত্রু ভাবে না জোয়ানকে। জোয়ান ঘোড়ায় উঠে বসলো দানোসের পেছনে। দানোস ঘোড়া ছুটাতে লাগলো। হ্রেষা ধ্বনি করে ছুটে চললো ঘোড়াটা।
-এটা তুমি কী করলে?'
জোয়ান মেয়েটাকে দেখিয়ে জবাব দিলো,
-তুমি ওকে ধাক্কা দিয়েছো, ওর ঘুড়িটা ছুটে গেছে। তাই তোমার ঘুড়িটাও থাকবে কেন?'
-কিন্তু ও আমার ঘুড়ির সাথে ওর ঘুড়ি আটকে দিয়েছিল।
-আমি দেখেছি কে প্রথম দোষ করেছে। তুমিই ইচ্ছে করে ওর ঘুড়ির সাথে নিজের ঘুড়ি লাগিয়েছিলে।'
জোয়ানের কথা শুনে ছেলেটার ক্রোধ বেড়ে যায়। ক্রোধান্বিত হয়ে সে মারতে আসে জোয়ানকে। তখন জোয়ান দু'হাতে ধাক্কা দেয় তার পেটে। ছেলেটা পড়ে যায়। আবার যখন উঠে মারতে আসে সে, তখন বাকি ছেলেমেয়েরা তাকে আটকে রাখে। ছেলেটা ফুঁসতে থাকে রাগে। সেই মুহূর্তে একটা ছেলে ঘোড়া নিয়ে সেই জায়গায় এলে, সবার দৃষ্টি যায় ছেলেটার দিকে। ছেলেটা ঘোড়া থেকে না নেমেই হাঁপাতে হাঁপাতে জোয়ানের উদ্দেশ্যে বললো,
-জোয়ান খবর আছে...'
-কী খবর দানোস?' প্রশ্ন করে জোয়ান।
-আমি বারগুনডি গ্রাম থেকে খবর নিয়ে এসেছি, ওখানে যে রাজনৈতিক দলটা থাকে, ওরা তোমাদের গ্রামের দিকে যাবে আজ।'
দানোসের কথা শুনে সবাই ঝগড়ার কথা ভুলে যায়। সামনে বিপদের আশঙ্কা আছে। কারণ, দানোস যে রাজনৈতিক দলটার কথা বলছে, ওরা খুব খারাপ। ইংরেজদের পা চাটা গোলাম। মাঝেমাঝে ওরা আশেপাশের গ্রামগুলোতে হানা দিয়ে ধ্বংসলীলা চালায়। জোয়ান ওখানকার ছেলেমেয়েগুলোর উদ্দেশ্যে বললো,
-তোমরা আমার ভেড়ার পালটা দেখে রেখো। আমি দানোসের সাথে গ্রামে যাচ্ছি খবরটা দিতে।
-ঠিক আছে, যাও...' একসাথে গলা মিলালো সবাই। তখন জোয়ানের মার খাওয়া ছেলেটাও আর শত্রু ভাবে না জোয়ানকে। জোয়ান ঘোড়ায় উঠে বসলো দানোসের পেছনে। দানোস ঘোড়া ছুটাতে লাগলো। হ্রেষা ধ্বনি করে ছুটে চললো ঘোড়াটা।
বাড়ির বাইরে একটা কাঠের চেয়ারে বসে আছেন জ্যাক ডি আর্ক। সামনে একটা ছোট টেবিল। টেবিলের উপর তার হিসাবের প্যাপারাস। কৃষকরা একজন একজন করে জমির খাজনা দিয়ে যাচ্ছেন তাঁকে। আর তিনি প্যাপারাসে হিসাবটা লিখে রাখছেন। হঠাৎ তিনি তাঁর মেয়ের কণ্ঠ শুনে সামনে তাকান। দেখেন, জোয়ান ঘোড়া থেকে নেমে তাঁর দিকে ছুটে আসছে।
-কী হয়েছে জোয়ান? ভেড়ার পাল রেখে এখানে কী করছিস?'
-ভেড়ার পাল ঠিক আছে বাবা। আমি একটা খবর নিয়ে এসেছি। বারগুনডি গ্রামের শকুনগুলো আমাদের গ্রামে হামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদেরও প্রস্তুত থাকা উচিত ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।'
-তুই কার কাছে শুনেছিস।
-দানোসের কাছে শুনেছি বাবা।' দানোসকে দেখিয়ে দিলো জোয়ান। মেয়ের কথা শুনে চিন্তিত দেখালো জ্যাককে। তখন খাজনা দিতে আসা কৃষকগুলো বলে ওঠলো,
-আমরা কিছুতেই হামলা হতে দেবো না আমাদের গ্রামে।'
সেই মুহূর্তে বেশকিছু সৈন্যের ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল। গ্রামবাসীদের আর রুখে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নেয়া হলো না। হ্রেষা রব করে কাছে এসে থামলো ঘোড়াগুলো। সবাই তখন ওদের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো। ওদের দলপতি ঘোড়া থেকে নেমে জ্যাকের সামনে এসে দাঁড়ালো। জ্যাক তার দিকে বোবার মতো তাকিয়ে রইলেন। দলপতি তখন বললো,
-খাজনাগুলো দিয়ে দাও জ্যাক। ওগুলো এখন থেকে ইংরেজের কোষাগারে যাবে।
-না বাবা, তুমি দিও না...' চিৎকার করে ওঠে জোয়ান।
জোয়ানের চিৎকার শুনে দলপতি তার দিকে তাকায়। কষে এক চড় বসায় ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে জোয়ানের ডান গালে। জোয়ান মাটিতে পড়ে যায়। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দলপতি আবার জ্যাককে বললো,
-দিয়ে দাও খাজনাগুলো জ্যাক।'
-কিন্তু এগুলো ফ্রান্সের অধিকার।' প্রতিবাদ করেন জ্যাক। তখন হেসে ওঠে দলপতি। তার সাথে হাসিতে যোগ দেয় তার সৈন্যরা। যেন হাসির মাধ্যমে বিদ্রূপ করছে ওরা। হঠাৎ হাসি থামিয়ে দলপতি বলে ওঠে,
-ফ্রান্সের অধিকার, তাই না?' বলতে বলতে জ্যাকের গালেও একইভাবে চড় বসায় দলপতি।
-বাবা...' চিৎকার করে ওঠে জোয়ান। বাবাকে ধরতে যায় সে। তখন দলপতি তাকে বাধা দেয়। একহাতে সে জোয়ানের হাত ধরে থাকে। জোয়ান নিজের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। জ্যাক তখন খাজনাগুলো দলপতির হাতে তুলে দিয়ে বললো,
-এই নাও, সব দিয়ে দিলাম। আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও।'
খাজনা পেয়েও দলপতি ছাড়লো না জোয়ানকে। আবারও বিদ্রূপ করে হেসে ওঠে ওরা। ধীরে ধীরে গ্রামবাসীরা ওখানে এসে হাজির হয়। কিন্তু কারও প্রতিবাদ করার সাহস হলো না। জানে ওরা, প্রতিবাদ করলেই নির্ঘাত মৃত্যু হবে ওদের। তাই কেবল চেয়ে চেয়ে দেখলো ওরা। দলপতি তার সৈন্যদের আদেশ দিলো,
-সারা গ্রামে আগুন লাগিয়ে দাও। জ্বালিয়ে দাও পুরো গ্রাম।'
-না...আ...আ...' একসাথে চিৎকার করে ওঠে এবার পুরো গ্রামবাসী।
-খাজনা তো দিয়ে দিলাম। তাহলে গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার কথা বলছেন কেন?' আকুতি করলেন জ্যাক। তাঁর আকুতি দেখে বিশ্রীভাবে হেসে ওঠলো দলপতি। তাঁর কথার জবাব দিলো না কোনো। সৈন্যদের উদ্দেশ্যে দলপতি বললো,
-তোমরা আগুন জ্বালাও। আমি এই মেয়েটাকে নিয়ে যাচ্ছি। কয়েকজন আমাকে অনুসরণ করো।' বলতে বলতে দলপতি জোয়ানকে ধরে নিজের ঘোড়ার দিকে টানতে লাগলো। জোয়ান চিৎকার করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। তার মা ইসাবেলা ছুটে এসে স্বামীকে বললো,
-তুমি কিছু করো, ওরা আমার মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছে, তুমি কিছু করো।' বলতে বলতে স্বামীর উত্তরের আশা না করে সে ছুটে যেতে চায়লো মেয়েকে বাঁচাতে। জ্যাক তাকে আটকিয়ে নিজে গেল দলপতির কাছে। দলপতি ততক্ষণে জোয়ানকে নিজের ঘোড়ার উপর তুলে নিয়েছে। নিজেও ওঠেছে ঘোড়ায়। জ্যাক গিয়ে তার পা ছুঁয়ে বললো,
-দয়া করে ছেড়ে দেন আমার মেয়েকে।'
দলপতি জোয়ানকে একহাতে জড়িয়ে ধরে, পা দিয়ে লাথি মারলো জ্যাকের বুকে। চিৎ হয়ে পড়ে গেলেন জ্যাক। তাঁর দিকে তাকিয়ে দলপতি বললো,
-তোমার মেয়েটা দেখতে বেশ হয়েছে। ওকে আজ রাতে আমার বিছানার সঙ্গী করবো। তারপর ছেড়ে দিলে দিতে পারি। আর নয়তো উপরে পাঠিয়ে দেবো।' বিশ্রী হাসি দিয়ে ঘোড়া ছুটালো দলপতি। তাকে অনুসরণ করলো তার কয়েকজন সৈন্য। বাকি সৈন্যরা থেকে গেছে গ্রাম পুড়িয়ে দিতে। জ্যাক কাঁদতে লাগলেন মেয়ের জন্য। তার পাশে ইসাবেলা এসে কান্নায় ভেঙে পড়লো।
-কী হয়েছে জোয়ান? ভেড়ার পাল রেখে এখানে কী করছিস?'
-ভেড়ার পাল ঠিক আছে বাবা। আমি একটা খবর নিয়ে এসেছি। বারগুনডি গ্রামের শকুনগুলো আমাদের গ্রামে হামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদেরও প্রস্তুত থাকা উচিত ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।'
-তুই কার কাছে শুনেছিস।
-দানোসের কাছে শুনেছি বাবা।' দানোসকে দেখিয়ে দিলো জোয়ান। মেয়ের কথা শুনে চিন্তিত দেখালো জ্যাককে। তখন খাজনা দিতে আসা কৃষকগুলো বলে ওঠলো,
-আমরা কিছুতেই হামলা হতে দেবো না আমাদের গ্রামে।'
সেই মুহূর্তে বেশকিছু সৈন্যের ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল। গ্রামবাসীদের আর রুখে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নেয়া হলো না। হ্রেষা রব করে কাছে এসে থামলো ঘোড়াগুলো। সবাই তখন ওদের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো। ওদের দলপতি ঘোড়া থেকে নেমে জ্যাকের সামনে এসে দাঁড়ালো। জ্যাক তার দিকে বোবার মতো তাকিয়ে রইলেন। দলপতি তখন বললো,
-খাজনাগুলো দিয়ে দাও জ্যাক। ওগুলো এখন থেকে ইংরেজের কোষাগারে যাবে।
-না বাবা, তুমি দিও না...' চিৎকার করে ওঠে জোয়ান।
জোয়ানের চিৎকার শুনে দলপতি তার দিকে তাকায়। কষে এক চড় বসায় ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে জোয়ানের ডান গালে। জোয়ান মাটিতে পড়ে যায়। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দলপতি আবার জ্যাককে বললো,
-দিয়ে দাও খাজনাগুলো জ্যাক।'
-কিন্তু এগুলো ফ্রান্সের অধিকার।' প্রতিবাদ করেন জ্যাক। তখন হেসে ওঠে দলপতি। তার সাথে হাসিতে যোগ দেয় তার সৈন্যরা। যেন হাসির মাধ্যমে বিদ্রূপ করছে ওরা। হঠাৎ হাসি থামিয়ে দলপতি বলে ওঠে,
-ফ্রান্সের অধিকার, তাই না?' বলতে বলতে জ্যাকের গালেও একইভাবে চড় বসায় দলপতি।
-বাবা...' চিৎকার করে ওঠে জোয়ান। বাবাকে ধরতে যায় সে। তখন দলপতি তাকে বাধা দেয়। একহাতে সে জোয়ানের হাত ধরে থাকে। জোয়ান নিজের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। জ্যাক তখন খাজনাগুলো দলপতির হাতে তুলে দিয়ে বললো,
-এই নাও, সব দিয়ে দিলাম। আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও।'
খাজনা পেয়েও দলপতি ছাড়লো না জোয়ানকে। আবারও বিদ্রূপ করে হেসে ওঠে ওরা। ধীরে ধীরে গ্রামবাসীরা ওখানে এসে হাজির হয়। কিন্তু কারও প্রতিবাদ করার সাহস হলো না। জানে ওরা, প্রতিবাদ করলেই নির্ঘাত মৃত্যু হবে ওদের। তাই কেবল চেয়ে চেয়ে দেখলো ওরা। দলপতি তার সৈন্যদের আদেশ দিলো,
-সারা গ্রামে আগুন লাগিয়ে দাও। জ্বালিয়ে দাও পুরো গ্রাম।'
-না...আ...আ...' একসাথে চিৎকার করে ওঠে এবার পুরো গ্রামবাসী।
-খাজনা তো দিয়ে দিলাম। তাহলে গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার কথা বলছেন কেন?' আকুতি করলেন জ্যাক। তাঁর আকুতি দেখে বিশ্রীভাবে হেসে ওঠলো দলপতি। তাঁর কথার জবাব দিলো না কোনো। সৈন্যদের উদ্দেশ্যে দলপতি বললো,
-তোমরা আগুন জ্বালাও। আমি এই মেয়েটাকে নিয়ে যাচ্ছি। কয়েকজন আমাকে অনুসরণ করো।' বলতে বলতে দলপতি জোয়ানকে ধরে নিজের ঘোড়ার দিকে টানতে লাগলো। জোয়ান চিৎকার করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। তার মা ইসাবেলা ছুটে এসে স্বামীকে বললো,
-তুমি কিছু করো, ওরা আমার মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছে, তুমি কিছু করো।' বলতে বলতে স্বামীর উত্তরের আশা না করে সে ছুটে যেতে চায়লো মেয়েকে বাঁচাতে। জ্যাক তাকে আটকিয়ে নিজে গেল দলপতির কাছে। দলপতি ততক্ষণে জোয়ানকে নিজের ঘোড়ার উপর তুলে নিয়েছে। নিজেও ওঠেছে ঘোড়ায়। জ্যাক গিয়ে তার পা ছুঁয়ে বললো,
-দয়া করে ছেড়ে দেন আমার মেয়েকে।'
দলপতি জোয়ানকে একহাতে জড়িয়ে ধরে, পা দিয়ে লাথি মারলো জ্যাকের বুকে। চিৎ হয়ে পড়ে গেলেন জ্যাক। তাঁর দিকে তাকিয়ে দলপতি বললো,
-তোমার মেয়েটা দেখতে বেশ হয়েছে। ওকে আজ রাতে আমার বিছানার সঙ্গী করবো। তারপর ছেড়ে দিলে দিতে পারি। আর নয়তো উপরে পাঠিয়ে দেবো।' বিশ্রী হাসি দিয়ে ঘোড়া ছুটালো দলপতি। তাকে অনুসরণ করলো তার কয়েকজন সৈন্য। বাকি সৈন্যরা থেকে গেছে গ্রাম পুড়িয়ে দিতে। জ্যাক কাঁদতে লাগলেন মেয়ের জন্য। তার পাশে ইসাবেলা এসে কান্নায় ভেঙে পড়লো।
উল্লাস করতে করতে ছুটে চলেছে ওরা। দলপতি একহাতে জোয়ানের কোমর জড়িয়ে ধরে আছে। জোয়ানকে আর উত্তেজিত দেখাচ্ছে না। সে বুঝেছে, উত্তেজিত হলে সহজে মুক্ত হতে পারবে না সে। তাই শান্ত হয়ে সে ভাবছে কীভাবে মুক্ত হওয়া যায়। দলপতির কোমরে গুঁজানো ছোরার দিকে তাকিয়ে আছে সে কয়েকমুহূর্ত ধরে। সুযোগ পেলেই ওটাকে কাজে লাগাবে সে। আর কিছুদূর গেলেই জঙ্গল পয়েন্ট আসবে। তখনই সুযোগটা কাজে লাগাবে সে। অপেক্ষা করছে জোয়ান। যখনই জঙ্গল পয়েন্টটা এলো, প্রস্তুত হয়ে নিলো সে। আচমকা চিৎকার করে ওঠে, দলপতির ছোরাটা নিয়ে, ওর কাঁধে ভর দিয়ে শূন্যে একটা ঘুরপাক খেলো জোয়ান। ছোরাটা দলপতির গলায় গভীরভাবে চালিয়ে সে লাফ দিলো। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই সে মিশে গেল জঙ্গলে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হলো দলপতির গলা দিয়ে। পড়ে গেল সে ঘোড়া থেকে। তার সৈন্যরা ঘোড়া থামিয়ে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। দুজন ছুটে গেল জঙ্গলে জোয়ানকে খুঁজতে। এতো ঝোপঝাড়ের ভেতর ওরা খুঁজে পেল না জোয়ানকে। হঠাৎ একটা ছোরা এসে বিঁধলো একজনের গায়ে। বুকে হাত দিয়ে সে পড়ে গেল নিচে। অন্যজন দেখলো, আড়াল থেকে ছোরা নিক্ষেপ করে পালিয়ে যাচ্ছে জোয়ান। সঙ্গীর দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সে জোয়ানের পিছু নিলো। কিন্তু জোয়ান মিশে গেল আরেকটা ঝোপঝাড়ের সাথে। সৈন্যটা অনেকক্ষণ খুঁজলো জোয়ানকে, কিন্তু খুঁজে পেল না তাকে। ব্যর্থ হয়ে শেষে ফিরে আসতে লাগলো। ততক্ষণে ছোরাবিদ্ধ সৈন্যটার নিশ্বাস থেমে গেছে। মৃত সঙ্গীর দু'হাত ধরে টানতে টানতে জঙ্গল থেকে বের করে নিয়ে গেল অন্যজন। বের হয়ে দেখে তাদের দলপতিও মারা গেছে। খুব গভীরভাবে কেটেছে তার গলা। শ্বাসনালী কেটে দুভাগ হয়ে গেছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। ছটফট করতে করতেই মারা গেছে সে। মেয়েটাকে দেখে যেরকম সাধারণ ভেবেছিল ওরা, মেয়েটা আসলে তা না। যেভাবে ক্ষিপ্রগতিতে সে তাদের দলপতিকে মেরেছে, তাদের আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল।
সন্ধ্যা পর্যন্ত জোয়ান জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে। চারপাশে যখন অন্ধকার নেমে আসে ধীরে ধীরে, জোয়ান তখন চুপি চুপি বের হয় জঙ্গল থেকে। যেখানে সে ওদের দলপতিকে মেরেছিল, সেই জায়গায় এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে লাশ দুইটা নিয়ে চলে গেছে ওরা। আবছা আলোতে জোয়ান কেবল মাটিতে মেশা দলপতির রক্ত দেখতে পায়। সেই রক্তে একদলা থুথু ফেলে নিজ গ্রামের দিকে হাঁটতে থাকে সে। কিন্তু গ্রামে এসে সে তার আগের গ্রামকে দেখতে পায় না। সবকিছু পুড়িয়ে ভস্ম করে দিয়েছে ওরা। ভস্ম হওয়া বাড়ির সামনে গালে হাত দিয়ে বসেছিল জেয়ানের বাবা মা। কেউ কারও সাথে কথা বলছে না। আশেপাশেও কোনো শব্দ নেই। পুরো গ্রামটা যেন হঠাৎ নীরব হয়ে গেছে। জোয়ান আলতো কণ্ঠে ডাক দিলো,
-বাবা...'
জোয়ানের কণ্ঠ শুনে চমকে ওঠে ওর বাবা মা। মেয়েকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসে ইসাবেলা। তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। বাবা জ্যাকও এসে জড়িয়ে ধরেন মেয়েকে। কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
-কেন এসেছিস তুই জোয়ান? ওরা তোকে পেলে মেরে ফেলবে। তুই নাকি ওদের দলপতিকে গলা কেটে মেরে ফেলেছিস? কয়েকবার তোর খোঁজে এসেছিল ওরা।'
বাবার কথার জবাব না দিয়ে জোয়ান ঘরের পুড়ে যাওয়া ছাইয়ের স্তুপে ধপ বসে পড়লো। দুহাতে ছাই আঁকড়ে ধরে 'হু হু' করে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
-ওরা আমাদের সবকিছু শেষ করে দিয়েছে বাবা, সবকিছু শেষ করে দিয়েছে।'
-হ্যাঁ মা, শকুনগুলোর হাত থেকে আমরা বাঁচাতে পারিনি আমাদের গ্রামকে।' মেয়ের চোখের জল মুছার চেষ্টা করলো বাবা। জোয়ান কান্না থামিয়ে বললো,
-সকাল থেকে কিছুই খাইনি। কিছু খাবার পাওয়া যাবে? নাকি তাও পুড়িয়ে শেষ করে দিছে বাবা?'
মেয়ের কথার কী জবাব দেবে ভেবে পেলেন না জ্যাক। সত্যি সত্যি খাওয়ার মতো খাবার অবশিষ্ট নেই। সব পুড়ে গেছে। মেয়ের কথার জবাব না দিয়ে ঝরঝর করে চোখের জল ফেলতে থাকেন বাবা। বুঝতে পেরে জোয়ান বললো,
-বুঝেছি বাবা, তাও কপালে জুটবে না।'
মেয়েকে আবার জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন জ্যাক। তখন ঘোড়ার হ্রেষা রব শোনা গেল। নিজেকে সামলিয়ে জ্যাক বলে ওঠলেন,
-জোয়ান, তুই চলে যা। ওরা হয়তো আবার এসেছে তোর খোঁজে। তোকে পেলে বাঁচিয়ে রাখবে না মা। চলে যা তুই। আর আসিস না এদিকে।'
জোয়ান দৌড়ে মিশে গেল অন্ধকারে। হু হু করে কাঁদতে থাকে ইসাবেলা মেয়ের জন্য। একটু পর সেখানে আসে সেই রাজনৈতিক দলের সৈন্যরা। ঘোড়া থেকে না নেমেই একজন জিজ্ঞেস করলো,
-তোদের মেয়ে এসেছে?
-নাহ্, আসেনি।' জবাব দিলেন জ্যাক।
-মেয়ের খোঁজ পেলেই আমাদের জানাবে। নয়তো তোদেরকে বাঁচিয়ে রাখবো না।' বলেই ওরা যে পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ দিয়ে চলে গেল। ওরা চলে যেতেই জ্যাক একটা মশাল নিয়ে মেয়ের খোঁজ করতে লাগলেন। যেদিকে জোয়ান ছুটে গিয়েছিল, সেদিকে কিছুদূর গিয়ে জোয়ানের নাম ধরে ডাকতে লাগলেন,
-জোয়ান... জোয়ান...'
কিন্তু জোয়ানের কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। মেয়ের খোঁজ না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে আসে বাবা।
-বাবা...'
জোয়ানের কণ্ঠ শুনে চমকে ওঠে ওর বাবা মা। মেয়েকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসে ইসাবেলা। তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। বাবা জ্যাকও এসে জড়িয়ে ধরেন মেয়েকে। কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
-কেন এসেছিস তুই জোয়ান? ওরা তোকে পেলে মেরে ফেলবে। তুই নাকি ওদের দলপতিকে গলা কেটে মেরে ফেলেছিস? কয়েকবার তোর খোঁজে এসেছিল ওরা।'
বাবার কথার জবাব না দিয়ে জোয়ান ঘরের পুড়ে যাওয়া ছাইয়ের স্তুপে ধপ বসে পড়লো। দুহাতে ছাই আঁকড়ে ধরে 'হু হু' করে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
-ওরা আমাদের সবকিছু শেষ করে দিয়েছে বাবা, সবকিছু শেষ করে দিয়েছে।'
-হ্যাঁ মা, শকুনগুলোর হাত থেকে আমরা বাঁচাতে পারিনি আমাদের গ্রামকে।' মেয়ের চোখের জল মুছার চেষ্টা করলো বাবা। জোয়ান কান্না থামিয়ে বললো,
-সকাল থেকে কিছুই খাইনি। কিছু খাবার পাওয়া যাবে? নাকি তাও পুড়িয়ে শেষ করে দিছে বাবা?'
মেয়ের কথার কী জবাব দেবে ভেবে পেলেন না জ্যাক। সত্যি সত্যি খাওয়ার মতো খাবার অবশিষ্ট নেই। সব পুড়ে গেছে। মেয়ের কথার জবাব না দিয়ে ঝরঝর করে চোখের জল ফেলতে থাকেন বাবা। বুঝতে পেরে জোয়ান বললো,
-বুঝেছি বাবা, তাও কপালে জুটবে না।'
মেয়েকে আবার জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন জ্যাক। তখন ঘোড়ার হ্রেষা রব শোনা গেল। নিজেকে সামলিয়ে জ্যাক বলে ওঠলেন,
-জোয়ান, তুই চলে যা। ওরা হয়তো আবার এসেছে তোর খোঁজে। তোকে পেলে বাঁচিয়ে রাখবে না মা। চলে যা তুই। আর আসিস না এদিকে।'
জোয়ান দৌড়ে মিশে গেল অন্ধকারে। হু হু করে কাঁদতে থাকে ইসাবেলা মেয়ের জন্য। একটু পর সেখানে আসে সেই রাজনৈতিক দলের সৈন্যরা। ঘোড়া থেকে না নেমেই একজন জিজ্ঞেস করলো,
-তোদের মেয়ে এসেছে?
-নাহ্, আসেনি।' জবাব দিলেন জ্যাক।
-মেয়ের খোঁজ পেলেই আমাদের জানাবে। নয়তো তোদেরকে বাঁচিয়ে রাখবো না।' বলেই ওরা যে পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ দিয়ে চলে গেল। ওরা চলে যেতেই জ্যাক একটা মশাল নিয়ে মেয়ের খোঁজ করতে লাগলেন। যেদিকে জোয়ান ছুটে গিয়েছিল, সেদিকে কিছুদূর গিয়ে জোয়ানের নাম ধরে ডাকতে লাগলেন,
-জোয়ান... জোয়ান...'
কিন্তু জোয়ানের কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। মেয়ের খোঁজ না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে আসে বাবা।
চলবে...
লেখা: ShoheL Rana শামী