> সমর্পণ
-->

সমর্পণ

.
(১)

বিয়ের পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে অরোতী। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে প্রকান্ড বাড়িটা দেখে। এ বাড়িতে মোটে তিনটে দালান।
বাড়ির উত্তরে তিনতলা দালানটার নিচতলায় বিনয়ের ছোটমা সরলার,দোতলায় বোন মৃণালি ঘর। মৃণালির বিয়ে হওয়ায় সে ঘরটা প্রায় খালিই পড়ে থাকে।তেতলাটা অরতী আর বিনয়ের।পূর্বের দোতলা দালানটা এখন ঝি-চারকদের দখলে। পশ্চিমে দিকে একতলা রান্না ঘর অার কল-তলা।দক্ষিণ পাশে রয়েছে সাঁন বাঁধানো পুকুর ঘাট।এককালে অরতীর শ্বশুরমশাইরা যে খুব বড় জমিদার ছিলেন সেটা এই বিশাল বাড়িটা দেখলেই বোঝা যায়।বিশাল বাড়িটায় নিজেকে কেমন বেমানান মনে হয় অরতীর।একটু ভয় পায় যেন।কিন্তু পুকুরপাড়ে পৌঁছুতেই সব ভয় কেটে যায়।দেবী কি সত্যিই তার প্রার্থনা শুনেছিলো?তা না হলে বাগান ভর্তি এমন শিউলি গাছের সারি কেন!
শিউলি ফুল ভীষণ পছন্দ অরতীর।বিয়ের খবরটা শোনার পর থেকে দেবীর কাছে তার যেন কেবল একটাই চাওয়া ছিলো,"আমার আর কিছুই চাইনে,মা।শুধু উঠোনভর্তি শিউলি ফুল রেখো।শরতের রোজ ভোরে কেউ একজন যেন মুঠোভরা শিউলি এনে আমায় চমকে দিতে পারে।"
এমনিতেই সকালের স্নিগ্ধ প্রকৃতিটা ভালো লাগে অরতীর।শিশিরভেজা শুভ্র শিউলি ফুল সে স্নিগ্ধতাকে যেন শতগুণ বাড়িয়ে দেয়।শরৎ এলেই রোজ ভোরে শিউলিতলায় তার যাওয়া চাই।মুঠো ভরে তাজা ফুলের সৌরভ নেয়,আঁচলেভরে ফুল কুড়িয়ে দেবীর পুজো করে।কতকটা দিয়ে মালা বানিয়ে হাতে,গলায়,পায়ে পরে।
আর কিছুদিন পরেই শরৎ শুরু হবে।অরতী স্বপ্নালু চোখে পুকুরপাড়ের শিউলি গাছের সারির দিকে তাকিয়ে থাকে।যেন অপেক্ষা প্রহর গুনে,এক মুঠো শিউলি ফুলের জন্যে...
.
(২)
সবার কাছে জমিদারবাড়ি বলে পরিচিত হলেও মূলত এ বাড়ির জমিদারীর সমাপ্তি ঘটেছে প্রায় ৪৫-৫০ বছর আগেই।বিনয়ের দাদা রামাদিত্য তখন বেশ যুবক।তিনি স্বাধীনচেতা মানুষ,জমিদারী বোধহয় খুব একটা পছন্দ করতেন না।তাই তা রক্ষার চেষ্টাও করেননি।বিনয়ের বাবা প্রতাপাদিত্য ঠিক তার উল্টো।তিনি হারানো জমিদারী ফিরে পেতে প্রায় গোটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।ব্যর্থ হলেও বাড়িতে জমিদারী চালচলন বজায় রেখেছেন এখনো।বিনয়াদিত্যের স্বভাবে দাদার প্রভাবই বেশি।বরং তার চেয়েও একটু বেশিই একরোখা স্বভাবের।নিজের মতো করে থাকতে পছন্দ করে।
সকালের খাবার নিয়ে তেতলার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল রামাই।অরতী উঠনে ছিল।রামাইকে উপরে যেতে দেখে পেছন থেকে ডাক দিল।তারপর তার কাছ থেকে খাবার গুলো নিয়ে সামনে এগোলো।নিচতলায় আসতেই সরলা ডেকে বললো,
-অরতী,বিনয় প্রায়ই কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।তাই ও ঘরে থাকলে অনুমতি নিয়ে ঢুকবে।
"জ্বি মা,"এই বলে অরতী সিঁড়িতে পা বাড়ালো।খাবার নিয়ে এসে দেখে বিনয় ততক্ষণে স্নান সেরে অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে।কাজ করছেনা বলে অরতী আর অনুমতি নিলনা।ধীরপায়ে খাবারগুলো টেবিলে রাখলো।তারপর খাটের নিচ থেকে বিনয়ের জুতোজোড়া হাতে নিলো।
-আরে আরে,কি করছো?
অরতী চমকে উঠে।ভীত কন্ঠে বললো,
-জুতোজোড়া ময়লা হয়ে গেছে যে!
-তা তো দেখেছি।কিন্তু তুমি কেন পরিষ্কার করছো?
-এইটুক কাজের জন্য ঝি-চাকরদের ডাকাটা ঠিক হবে?
-কাউকে ডাকতে হবে না।আমিই পারবো।তুমি রাখো।
-আমি করে দেই?অল্প একটুই তো!
বিনয় আর প্রতিবাদ না করে টেবিলে গিয়ে বসলো।কিন্তু মনে বুঝলো,আজ হতে তার স্বাধীন চলাফেরায় ব্যাঘাত আরম্ভ হলো।
.
(৩)
রান্নাঘরে সরলা আর অরতি দুপুরের খাবার তৈরি করছে।বাড়ির সকল কাজ দাস-দাসীরা করলেও দুপুরের খাবারটা নিজেদের তৈরিই বেশি পছন্দ করেন বিনয়ের মাতা সরলা।মৃণালির বিয়ের আগে রান্নার কাজটা সেই করত।আর এখন সে দায়িত্ব অরতীর উপর।
-মা,মৃণালি কবে আসবে?
জানালার পাশ থেকে সরে এসে সরলা বললেন,"তাতো জানিনা।বিয়ের পরের দিন কেমন হুট করেই না চলে গেল।সেদিন শ্বাশুড়ি ওমনভাবে অসুস্থ না হলে আরো কিছু দিন থাকার ইচ্ছে ছিল মেয়েটার।"
-তাহলে বিনয়কে বলব মৃণালিকে নিয়ে আসতে।
-না,গেলতো মাএ পনের দিন।পূজোর আগে আর হয়তো আসতে দেবেনা।তারপরও দেখি পূজোর এক সপ্তাহ আগে যদি আনতে পারি।
-ওর শ্বাশুড়ি এখন কেমন আছে?
-শুনলাম এখন নাকি আগের চেয়ে কিছুটা ভালো আছে।
কথা বলতে বলতে দাসীর কাছ থেকে কাটা সবজিগুলো অরতীর দিকে এগিয়ে দিলেন সরলা।তারপর রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আশাকে ঘর পরিষ্কার করতে বললেন।
দুপুরের খাবারটা বিনয় সাধারণত বাইরেই খেয়ে নেয়।কারন আহারের জন্য অফিস যে হালকা ব্রেক দেয়া হয় তাতে বাসায় আসাও সম্ভব নয়,আবার বাসা থেকে খাবার বোঝাই করে নেওয়া,এও তার পছন্দ না।
প্রতিদিনের মতই রান্না শেষে স্লান সেরে সরলাকে নিয়ে অরতী যখন খেতে বসলো,ঠিক তখনই অফিসের ব্যস্ততার মাঝে সময় করে বিনয় তারই মত কতকগুলো ব্যস্ত মানুষের সাথে কোনো হোটেলে দুপুরের আহারে বসলো।
.
(৪)
ছুটির দিনগুলো ছাড়া বিনয়কে বাড়িতে পাওয়া মুশকিল।ভোরে অফিসে যায়,ফিরে আসে রাত আটটা কিংবা ৯টায়।কখনো বা আরো দেরি...
বিনয় কতকগুলো কাগজপত্র নিয়ে কাজ করছিল।অরতী দরজায় টোকা না দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।বিনয়কে বেশ ভয় পায় সে।কেন যেন মনে হয় বিনয় তাকে মোটেও পছন্দ করেনা।তা না হলে বিয়ের আজ প্রায় একমাস হতে চলল,অথচ খুব প্রয়োজন ছাড়া কখনো তার সাথে নিজ থেকে কথা বলে নি।নামটা পর্যন্ত ডাকেনি একবার!সে যা বলে তার উত্তরও দেয় হুঁ/হ্যাঁ বলে।এটা সত্যি যে বিনয় তার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি,বরং ভালো ব্যবহারই করেছে বেশি।কিন্তু ভালো ব্যবহার তো সে ঝি-চাকর,বেয়ারা সবার সাথেই করে।সে কি ওদের চেয়ে বেশি কিছু না?অরতী এসব নিয়ে কারো কাছে কোনো অভিযোগ করেনা ঠিকই,কিন্তু মনে মনে কষ্ট পায়...ভীষণ!একবার ভাবে জিজ্ঞেস করবে,কিন্তু তারও তো একটা অধিকার থাকা চাই!
-দাঁড়িয়ে আছো কেন?আসো।
অরতী ঘরে এসে বিনয়ের সামনে চেয়ারটায় বসে।
-বাবা এসেছিলেন কাল।বললেন,পুজোয় যেন আমরা অবশ্যই যাই।
থেমে থেমে বলে অরতী।
-আচ্ছা।
বিনয় কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে টেবিলে রাখতে রাখতে অরতীর দিকে তাকায়।
-কিছু বলবে?
-মা বললেন,একবার দেখা করতে।
-তাকে বোলো,আমি নবীনদের বাড়িতে যাচ্ছি।ফিরে এসে দেখা করবো।
-আচ্ছা।
দুটো সিঁড়ি পেরিয়ে পেছন ফিরে তাকায় বিনয়,
-আর শোনো....
-এখানে আসতে অনুমতির প্রয়োজন নেই।
-কিন্তু,মা যে বললো....
-সে নিয়ম অন্যদের জন্য।এ ঘর তোমারও।নিজের ঘরে আসতে কখনো অনুমতির প্রয়োজন হয় না।
বিনয় চলে যায়।অরতী বুঝতে পারেনা,তার কি খুশি হওয়া উচিত?নিজের ঘরে ঢোকার সম্পূর্ণ অধিকার পাওয়ায়?জানেনা সে....তবুও খুশি হয়।
.
(৫)
বিকেলের শেষ আলো মিলিয়ে গেছে অনেক আগেই।অরতী ছাদে বসে আছে।নিচ থেকে মা কিছুক্ষণ পর পর অরতী অরতী বলে ডাকছেন।কিন্তু সে কিছুই শুনতে পাচ্ছেনা।তার সমস্ত সত্তা যেন হারিয়ে গেছে মৃণালির ঘর থেকে ভেসে আসা গানটায়....
"আমায় রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে--
তোমার আপন রাগে,তোমার গোপন রাগে,
তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে
অশ্রুজলের করুণ রাগে॥
রঙ যেন মোর মর্মে লাগে,আমার সকল কর্মে লাগে,
সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে,গভীর রাতের জাগায় লাগে॥
যাবার আগে যাও গো আমায় জাগিয়ে
দিয়ে......"
অরতী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়িটার দিকে তাকায়।কত বড় বাড়ি!লোকজনও কম নয়।তবু কেমন প্রাণহীন মনে হয়।এ বাড়ির ধরা-বাঁধা জীবনে দম বন্ধ হয়ে আসে অরতীর।এর চেয়ে ভাঙ্গা মন্দিরে বাবার সাথে বেশ ভালোই থাকতো সে।বাবাকে রোজ দেবীর প্রসাদ সাজাতে সাহায্য করতো।শিউলী,মাধুবীলতা,জবা ফুল দিয়ে চুড়ি,মালা বানাতো,খোঁপায় পরতো.......
-কি হলো,বৌদি?তোমাকে মা সে কখন থেকে ডাকছেন।সন্ধ্যে হয়ে এলো যে!
মৃণালির ডাকে সম্বিত ফিরে পায় অরতী।
-ডেকেছিলেন বুঝি?
-ওমা!তুমি শুনতে পাওনি?
অরতী এ কথার কোনো প্রতুত্তর না করে চুপ করে রইলো।
মৃণালি পাশে এসে বসলো।
-আচ্ছা বৌদি,তোমার কি হয়েছে বলো তো?সবার সাথে তো হাসি-খুশিই থাকো,একা হলে এমন মনমরা হয়ে যাও কেন?বিনয়দাকে পছন্দ হয়নি?
-তেমনটা বলেছি কখনো?
-তা বলোনি।তাহলে কি বিনয়দার সাথে ঝগড়া হয়েছে?বকেছে তোমাকে?
-না,তা কেন!
অন্যদিকে তাকিয়ে কথাটা বললেও অরতীর ম্লান হাসিটুকু মৃণালি চোখ এড়ায় না।
-তবে কি জানো মৃণালি?ঝগড়া হলো বোধকরি একটু শান্তি পেতাম।দিনরাত এমন গম্ভীরতা অসহ্য ঠেকে আমার।
-তুমি শুধু শুধু কষ্ট পেয়োনা বৌদি।দাদার স্বভাবটাই এমন।
কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করে মৃণালি,
-ছোটবেলায় বড়মা মারা যাওয়ার পর থেকে একা থাকার অভ্যেস হয়ে গেছে তো।কারো সাথে খুব একটা কথা বলে না।বাবার উপর বড্ড রাগ ছিলো।দেখোনা,এত চাকর-বেয়ারা থাকতে নিজের কাজগুলো নিজেই করে।কেন জানো?ওরা বাবার চাকর-বেয়ারা।আজ ছয়বছর হলো বাবা মারা গেছেন।কেঁদেছিলও খুব।অভিমান তবু কমে না।
-বাবার সাথে রাগ এতো কেন?
-মাকে বিয়ে করার তিনমাসের মাথায় বড়মা মারা যান।বিনয়দার ধারণা বাবার কারণে কষ্ট পেয়েই এমনটা হয়েছে।তবে অবাক ব্যাপার কি জানো,বৌদি?সৎ বোন হলেও এখন যা একটু সখ্যতা আমার সাথেই।(কিছুক্ষণ থেমে)
-মিছে কিছু ভেবে নিজেকে কষ্ট দিয়োনা তো,বৌদি।সব ঠিক হয়ে যাবে।শুধু একটু সময় লাগবে,এই যা।এখন নিচে চলো তো।শেষে বিনয়দা এসে খুঁজে পাবেনা।
-তুমি যাও।আমি চলে আসবো।
মৃণালি চলে গেছে।দূর থেকে শিউলি গাছগুলো দেখা যাচ্ছে।অরতী ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।দেবী কেবল তাকে শিউলীগাছই দিলেন!এ বাড়িতে শিউলি ফুল দিয়ে শুধু পুজোই হয়।আর কিচ্ছু না।
.
(৬)
শারদীয় দুর্গাপুজার প্রথম দিন আজ।ভোরের আলো ফুটতেই শুরু হয় জমিদারবাড়ির মন্দির সাজানোর কাজ।সরলা ঝি-চাকরদের নাড়ু আর সন্দেশ বানানোর কাজে সাহায্য করছিলেন।বহুদিন পর পুজোর আনন্দে বাড়িটা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।অরতী রান্নাঘরে এসে সরলাকে প্রণাম করে।সরলা মৃদু হেসে কাছে টেনে বলেন,
-আমার ছেলেটা তোকে বড্ড কষ্ট দেয়,না রে?
-না,মা।
-তুই বলতে না চাইলেও আমি তো সবই বুঝিরে মা।বিনয়টা যে কি একরোখা- তা আমার চেয়ে ভালো কে জানে!
কিছুক্ষণ থেমে অরতীর চিবুক স্পর্শ করে বলেন,
-আজ তোকে খুব করে আশির্বাদ করলাম,মা।দেখিস,বিনয় তোকে অনেক ভালোবাসবে।
অরতী সলজ্জ হাসে।
-মা,আজ একবার মন্দিরে বাবার কাছে যাবো।বাবাকে ছাড়া কখনো পুজো করা হয়নি।
-আচ্ছা,বিনয়কে বলে বিকেলে দুজন যাস।এখন মৃণালিকে নিয়ে তাড়াতাড়ি স্নানটা সেরে নে।
-আমার কথা হচ্ছিলো বুঝি?
রান্নাঘরে ঢুকে সরলাকে প্রণাম করে বলে মৃণালি।
-যা,স্নানটা সেরে সাজগোজ করে নে।সবাই একসাথে মন্দিরে যাবো।মন্দির তো সাজানো হয়েই গেলো।
-আজ কিন্তু আমরা শিউলিফুল দিয়ে সাজবো,মা।
অরতীর আবদার শুনে হাসেন সরলা।
-যা ইচ্ছে করিস।আগে স্নান সেরে বিনয়ের খাবারটা দিয়ে আয়।
অরতী মৃণালিকে নিয়ে পুকুরপাড়ে শিউলিতলায় আসে।
-পুকুরে স্নান করবে নাকি,বৌদি!
-আরে ধূর,ভাবলাম,ফুলগুলো কুড়িয়ে নিই আগে।কতদিন পর এভাবে শিউলিতলায় আসলাম!
-শিউলিফুল তোমার পছন্দের,তাইনা বৌদি?
-ভী...ষ...ণ...!
অরতী পুকুরপাড়ে ছড়িয়ে থাকা ফুলগুলো কুড়িয়ে ঝুড়িভর্তি করে। মৃণালি সেগুলো দোতলায় সাজঘরে রেখে আসতে বলে।মৃণালি চলে গেলে আঁচলভরে ফুল কুড়িয়ে নেয় অরতী।শিউলিফুল,ভোর যেন তাদের আপন শুভ্রতায় অরতীকে শুভ্র করে তুলেছে।বারান্দায় দাড়িঁয়ে শিউলিতলার দিকে চেয়ে বিনয় বোধকরি সে শুভ্রতারই পরিমাপ করছে।অরতী বিনয়কে লক্ষ্য করেনি। সে আচল ভর্তি ফুল নিয়ে গাছের পেছন
দিকের বিশাল মন্দিরটায় চলে এলো।তারপর পরম যত্নে দেবীর পায়ে ঢেলে প্রার্থনা করে।কতকগুলো ফুল হাতের মুঠোয় নেয়।ভাবে বিনয়কে চমকে দেবে।কিন্তু কেমন যেন লজ্জা পায়।মুঠোর ফুলগুলোর আবার দেবীর পায়েই ঠাই হয়!
.
(৭)
দুপুর গড়িয়ে পড়েছে,ঘরে ঢুকে বিনয়কে প্রণাম করে অরতী।ক্ষানিকটা বিব্রত হয় বিনয়।এই প্রথম কেউ তাকে প্রণাম করলো।
-আরে,ও কি করছো?
-আজ পুজো যে!
-তা বলে প্রণাম করতে হবে?
-বারে,সবাই-ই তো করে।
বিনয় আর কোন কথা না বলে খাটের নিচ থেকে জুতো জোড়া বের করে নেয়।
-যাওয়া হচ্ছে কোথাও?
-হ্যাঁ।অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবো।
-বিকেলে বাবার ওখানে যাবোনা?
-পুজোর প্রথম দুদিন এখানেই থাকনা।তারপর না হয় যাওয়া যাবে।তাছাড়া,পুজো তো আজকেই শেষ হয়ে যাবেনা।
রাগ কিংবা অভিমানেই হোক,অরতী আর কোন প্রতিবাদ করেনা।নিঃশ্বব্দে আলমারি থেকে কোটটা নিয়ে আসে।
বিনয় কোটটা এগিয়ে নিতে নিতে বলে,-এসব ছোটখাট কাজ তুমি কোরোনা।।আমার অস্বস্তি হয়।আমার কাজগুলো আমি নিজে করতেই বেশি স্বস্তি পাই।
কথাটায় ক্ষানিকটা ধাক্কা খায় অরতী,কিন্তু বিনয়কে বুঝতে দেয়না তা।
-আমার যদি ফিরতে দেরি হয় খাবার নিয়ে বসে থাকার দরকার নেই।
-আচ্ছা।
-শুধু আজ না।একাজটা আর না করলেই পারো।
বের হতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ায় বিনয়,"আর একটা কথা,ময়লা কাপড়গুলো আমি এসে পরিষ্কার করবো,তুমি ধোয়ার দরকার নেই।"কয়েক সিড়ি পেরুতেই কি ভেবে আবার পেছন ফিরে মৃদু হেসে হাত নাড়ে।কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না অরতী।ছলছল চোখজোড়া বিনয়ের পথ থেকে দ্রুত সরিয়ে নেয়।তার কন্ঠ কেবল কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে।অস্বস্তি হয়!অরতী যেন বিশ্বাস করতে পারে না।তার ভালোবাসা প্রকাশে কেবল অস্বস্তি!নিজেকে বড্ড বেহায়া মনে হয় তার।
.
(৮)
আধা ঘন্টার মাঝেই ফিরে আসে বিনয়।সন্ধ্যার পূজো সেরে আবার বেরিয়ে পড়ে।এতটুকু সময়ের মাঝে অরতীর সাথে কথা বলার সুযোগ মেলেনি।সুযোগ দেয়নি অরতী।বিনয় তাই বুঝতেও পারলোনা কতটা কষ্ট পেয়েছে সে।ফিরে এলো রাত বারোটায়।দরজায় বারকয়েক টোকা দিয়েও কোনো সাড়া না পেয়ে আলতো করে দরজায় ধাক্কা দিলো।দরজা খুলতেই চমকে উঠে সে।প্রতিদিন জেগে থাকলেও আজ অরতী ঠিকই ঘুমিয়ে পড়েছে।তবে মাটিতে মাদুর পেতে,লালপেড়ে সাদা শাড়ী আর শিউলিফুলের সাজে।
একই সাজে অরতীকে সারাদিন দেখেছে সে,ভালোও লেগেছে,কিন্তু বুুঝতে পারেনি এরূপের মাধুর্যতা।বিনয় মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।পুবের খোলা জানলা দিয়ে আসা চাঁদের আলো আর শিউলিফুলের সাজে অরতী......পুরো ঘরটাকে কেমন মায়াপুরী বলে মনে হয় তার।আর অরতী,যেন সে মায়াপুরীর কোন মায়াময়ী মানবী!
বিনয় ধীরপায়ে ব্যাগ আর ফাইলগুলো রাখার জন্য টেবিলের সামনে আসলো।টেবিলে খাবারের বাটি দেখে রামাইকে ডাকলো সে।
-ডেকেছেন বড়বাবু?
বিনয় খাবারের বাটিগুলো রামাইয়ের হাতে দিলো।
-খাবারগুলো নিয়ে যা,নষ্ট হয়ে যাবে।আমি বাইরে খেয়ে আসবো জেনেও খাবার পাঠালি কেন?
-খাবারগুলো তো বৌদিদির জন্যে পাঠিয়েছিল।খায় নি বুঝি?
-বৌদিদির জন্য?
প্রায় মনে মনে কথাটা বলে কিছুক্ষণ থেমে আবার বললো,
-আচ্ছা,নিয়ে যা।তোর বৌদিদি বোধহয় খাবেনা।
রামাই চলে যাওয়ার পর বিনয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে।খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে ধীরপায়ে গিয়ে অরতীর পাশে এসে বসলো।তারপর ঘুমন্ত অরতীকে খাটে এনে রাখলো।হঠাৎ-ই অরতীর চোখের কোনে জমে থাকা অশ্রুগুলো চোখে পড়লো।বিনয়ের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে যেন।তবে কি তার উপর অভিমান করেই এ উপোস? সকালের কথাগুলোর জন্যই মাদুর পেতে নিচে ঘুমানো?নিজের মতো করে চলতে গিয়ে অরতীকে এতটা কষ্ট দিচ্ছে সে!পুজোর দিনটায়ও তাকে কাঁদতে হলো!
.
(৯)
অবহেলায় অনুভূতিগুলো হয়তোবা প্রাণহীন হয়ে যায়।একটা সময় ভালবাসার প্রচণ্ড তৃষ্ণা থাকলেও তখন তা বিরক্তিকর মনে হয়।কি আশ্চর্য!যে ব্যাপারটা দু-দিন আগে ঘটলেও সারাটা দিন আনন্দে কাটতো,আজ তাকে বড্ড নিষ্প্রাণ মনে হয় অরতীর।কারণ সে ভালো করেই জানে,তাকে নিচ থেকে উপরে তোলার কাজটা বিনয় ভালোবাসা থেকে করেনি,করেছে দায়িত্ববোধ থেকে।কিংবা কাউকে নিচে ঘুমোতে দেখলে অস্বস্তি হয় বলেই!
অরতীকে জেগে উঠতে দেখে বিনয় বারান্দা থেকে রুমে আসলো।
-আজ বেশ বেলা হয়ে গেলো...
অরতী কোনো কথা না বলে খাট থেকে নামে বিছানা গোছাতে শুরু করলো।
-শিউলিফুল বুঝি তোমার খুব পছন্দের?
-হুঁ।
অস্পষ্টভাবে উত্তর দেয় অরতী।
-রাত্রে কিছু খাওনি যে!
জবাব না পেয়ে আড়চোখে একবার তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করে বিনয়,
-আর নিচেই বা ঘুমালে কেন?
অরতী কোনো প্রতুত্তর না করে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
-অরতী....
বিনয়ের ডাকে থমকে দাঁড়ালো অরতী।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ছলছল চোখজোড়া বিনয়ের চোখে রাখে বললো,
-আমি কারো অস্বস্তির কারণ হতে চাইনা।
-আমি শুধু সত্যিটাই বলেছি,অরতী।তোমাকে ছোট করে কিছু বলিনি।
-আমিও সত্যিটাকেই মেনে নিয়েছি।
বলে আর উত্তরের অপেক্ষা না করেই নিচে চলে যায়।।
.
(১০)
বেশকিছুক্ষণ ধরে নবীনদের বৈঠকখানায় বসে কথা বলছে বিনয়।কিন্তু নবীনের কোন কথায় স্পষ্ট বুঝতে পারছেনা সে।আজ অবধি অরতীর কথা ভেবে কখনো কোনো আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটেনি তার।অথচ আজ সকাল বেলার সে অশ্রুসজল চোখদুটো যেন কিছুতেই অদৃশ্য হয়না।বারবার সে অভিমানী কন্ঠটা কানে বেজে উঠে,"আমি কারো অস্বস্তির কারণ হতে চাইনা.."
বিনয়ের ঘোর কাটে নবীনদের দারোয়ানের ডাকে।
-বিনয়বাবু,আপনাদের বাড়ি থেকে গোবিন্দ নামে একজন দেখা করতে এসেছে।বললো খুব জরুরি।
-আমাদের বাড়ির দারোয়ান।নিয়ে এসো।
গোবিন্দ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে বিনয়ের কাছে।
-বড়বাবু,এক্ষুণি বাসায় যেতে হবে।বৌদিদিমনির বাবা মারা গেছেন।
বিনয় যেন বিশ্বাস করতে পারেনা।
-কখন!কিভাবে?
-সকালেই হয়তো,এইমাত্র মন্দির থেকে একজন এসে বলে গেলো।
-তোর বৌদিদিমনি কোথায়?
বলেই আর উত্তরের অপেক্ষা না করে হাঁটতে শুরু করে।
.
বাড়িতে পৌছৈ উঠোন পেরুতেই মৃৃণালি দৌঁড়ে আসে,
-বিনয়দা,কিভাবে যাবে ওখানে?বৌদির তো জ্ঞান ফেরেনি এখনো।
-কতক্ষণ হলো?
-ঠাকুরদার মৃত্যুর খবরটা শোনার পরেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
-আমি দেখছি।তুই আর ছোটমা গিয়ে বরং গাড়িতে বস।
বিনয় অরতীকে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে এনে মৃণালি আর সরলার কোলে শুইয়ে দেয়।তারপর মন্দিরের উদ্দেশ্যে গাড়ি চালাতে শুরু করে।
.
(১১)
হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গার কারণটা বুঝতে দেরি হলোনা বিনয়ের।পাশে তাকাতেই দেখতে পায় জ্বরের ঘোরে কাতরাতে থাকা অরতীকে।কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠে সে।জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে পুরো শরীর।দ্রুত নিচে গিয়ে জলপটি নিয়ে আসে বিনয়।তারপর ভিজিয়ে অরতীর কপালে দিতে থাকে।একবার চোখ খুলে অরতী।চারদিকে তাকায়,যেন বুঝতে পারেনা কিছু,পরক্ষণেই আবার চোখ বুঝে।
গতকাল মন্দির থেকে ফিরে আসার পরই ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে।দু-চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুগুলোই বলে দেয়,তার এ ঘুম কতটা যন্ত্রণাময় ছিলো!বিনয় সন্তর্পণে মুছে দেয় অরতীর অশ্রুত চোখজোড়া।নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়।তার কারনেই বাবার সাথে অরতীর শেষ দেখাটা হলোনা।তার প্রতি অরতীর অভিমান নিশ্চয় এবার ঘৃণায় পরিণত হবে।যেমনটা হয়েছিলো বিনয়ের বাবার প্রতি তার মায়েরও।বাবার অবহেলায় মাকে হারিয়েছে বিনয়,আর এখন নিজের স্বভাবের কারনে যদি.....না,আর ভাবতে পারেনা বিনয়।বাইরের গাম্ভীর্যতার আড়ালে অরতীর প্রতি যে কতখানি ভালোবাসা ছিলো,আজ তা বেশ অনুভব করতে পারে সে।
হঠাৎ অরতীর খালি সিঁথিটা চোখে পড়ে বিনয়ের।গতকাল জ্ঞান ফেরানোর জন্য পানি ঢালার কারণেই হয়তো সিঁদুরের রংটা ধুয়ে-মুছে গেছে।বিনয় শূন্য সিঁথিটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।সিঁথিটা যেন অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করছে একটুখানি সিঁদুরের জন্য।শূণ্য সিঁথি কেমন শূন্যতার সৃষ্টি করে মনে।রাতের ঘন অন্ধকার যেন সে শূন্যতার অনুভূতিকে আরো তীব্র করে তোলে।
বিনয় কোটা থেকে সিঁদুর নিয়ে অরতীর কপালে আলতো করে হাত বুলিয়ে সিঁদুর পরিয়ে দেয় সিঁথিতে।
.
(১২)
সরলা নিত্যদিনকার অভ্যেস,সকালের খাবার খেয়ে একবার মন্দিরে যান।পুজো সেরে রান্নার কাজে সাহায্য করেন।দুপুরের খাওয়া শেষে আবার ফিরে যান মন্দিরে।ফিরে আসেন সন্ধ্যায়।কখনোবা মন্দিরেই কাটিয়ে দেন পুরো রাত।
প্রায় চৌদ্দ দিন পর বিকেলের দিকে মন্দিরে আসে অরতী।
-আয় মা।কতদিন পর ঠাকুরের ঘরে এলি!
-হ্যাঁ মা।তিনি চেয়েচেন বলেই তো সুস্থ হয়ে প্রথম তার কাছেই এলুম।
সরলা অরতীকে কাছে টেনে আনেন।তারপর তার মুখপানে চেয়ে বলেন,বড্ড শুকিয়ে গেছিস রে।
ম্লান হেসে সরলার আরো কাছে ঘেষে বসে অরতী।
-মা আজ আমি তোমার সাথে মন্দিরে থাকি?
সরলা চমকে উঠেন যেন,
-ছি,মা!সেকি কথা!বিনয়কে একা রেখে...?
মুখের ম্লান হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে যায় অরতীর।সরলা কিছুক্ষণ অরতীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন,"আমার ছেলেটার উপর রাগ করিসনে মা।বাবার কাছ থেকে কষ্ট পেয়েই এমন হয়েছে।ভালোবাসার মুল্য বোঝেনা।কিন্তু আমি জানি আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।আজ তোকে ফিরিয়ে দিচ্ছি বলে রাগ করিসনে।অন্য একদিন বিনয়কে বলে নিজেই ডেকে নেব।"
সন্ধ্যার কিছুু পরে ঘরে ফিরে আসে অরতি।ঘরে ঢুকে দেখে আরো আগেই ফিরেছে বিনয়।
-মন্দিরে গিয়েছিলে বুঝি?
-হ্যাঁ।
সংক্ষেপে উওর দেয় অরতি।তারপর নিচে গিয়ে খাবার দিয়ে যেতে বলে রমাইকে।
রাতের খাবার শেষে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় অরতী।কিছুক্ষণ পর বিনয় এসে পাশে দাঁড়ায়।
-অরতী একটা অনুরোধ করি,রাখবে?
নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকে অরতী।বিনয়
খানিককাল অপেক্ষা করে আবার বলে,
-আজ আর নিচে ঘুমিয়ো না।ডাক্তারবাবু খুব করে বারণ করেছেন ঠান্ডা লাগাতে..
যেন একথার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ
প্রয়োজন,এমনভাবে চলে এসে মাটিতে মাদুর পেতে শুয়ে পড়ে অরতী।বিনয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ।কিন্তু আজ আর অরতীর ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা করেনা সে।বরং নিজেই এসে নিঃশব্দে তার পাশে শুয়ে পড়ে।
-অরতী....
অরতী নিরুত্তর চোখ বুজে থাকে।বিনয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-তোমার এতো অভিমান কেন,অরতী?
জানি,অন্যায় আমার কিছু কম নয়।কিন্তু প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগতো দেবে।
কিছুক্ষণ থেমে আবার বললো,
-ছোটবেলা থেকে নিজের কাজ নিজে করতেই অভ্যস্ত আমি।বিশ্বাস কর এ তোমার প্রতি আমার অবহেলা নয়,এ আমার অভ্যেস।আর অভ্যেস কি এতো সহজে বদলানো যায়?যদি যেত,তবে তুমি চাইলেই বদলে ফেলতাম।
কোনো সাড়া না পেয়ে বিনয় পাশে পড়ে থাকা অরতীর হাতের উপর হাত রাখলো।অরতী কোনো উত্তর করলোনা,হাতও সরিয়ে নিলো না।
-আর পুজোয় তোমাকে বাড়ি না নেওয়াটা যে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভূল হয়েছে,তা আমি বেশ বুঝতে পারি।কিন্তু যদি জানতাম এমন কিছু ঘটবে তবে কি তোমাকে এভাবে ধরে রাখতাম,অরতী?
বেশ কিছু সময় নিঃশব্দ কেটে যাওয়ার পর অরতী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বিনয়কে জড়িয়ে ধরলো।বিনয় অরতীর চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
-কথা দিচ্ছি,আর কখনোই এমনটা হবেনা।
.
(১৩)
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায় বিনয়ের। শীতকাল প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে।চারপাশের প্রকৃতি ঘন কুয়াশার আবরণে ঢেকে রয়েছে।
ভোরের আকাশে উদিত সূর্যটাও তখনো কুয়াশার আড়াল থেকে বের হতে পারে নি।বিনয় জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে যখন দেখলো কুয়াশা কাটেনি তখন আবার চোখ বুঝলো।কিছুক্ষণ ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা করে অরতীর গায়ে কাঁথাটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিচে নেমে এলো।বাড়ির চাকর-বেয়ারাও এখনো জাগেনি।বিনয় একা একা বাড়ির চারপাশটা ঘুরে দেখছিলো।বহুবছর পর এতো ভোরে হাঁটতে বেরুলো সে।একটা সময় বাবার সাথে ভোরের আলোয় হাঁটতে বের হওয়া বিনয়ের নিত্যকার রুটিনের মতোই ছিলো।মা মারা যাওয়ার পর থেকে সেটা বন্ধ হয়ে যায়।বিনয়ের হঠাৎ মনে হলো,বাবার উপর তার অভিমানের আর চিহ্নটুকুও বাকি নেই।তা না আজ বাবার কথা মনে পড়ায় তার ঘৃণা হচ্ছে না কেন?বরং বুকের ভেতরে একটা চাপা কষ্ট অনুভব করলো।কুয়াশা আর চারদিকের নিস্তব্ধতা যেন প্রভাতের রূপের মাধুর্যতার সাথে কষ্টগুলোকেও আরো বাড়িয়ে দেয়।বিনয় হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দক্ষিণদিকের শিউলীতলায় চলে এলো।
.
অরতী জেগে উঠে বিনয়কে দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে যায়।বিনয় তো ৮-৯টার আগে ঘুম থেকে উঠেনা।তবে?অরতী বিছানা থেকে নেমে পুরো ঘর দেখলো।কোথাও না পেয়ে শেষে ব্যস্ত হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালো।ব্যর্থ হয়ে যখন ফিরে যাচ্ছিলো,তখনই চোখ পড়লো শিউলীতলায়।বিনয় নিচে পড়ে থাকা ফুলগুলো তুলে নিচ্ছিলো।অরতী কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিচে নেমে এসে নিঃশব্দে বিনয়ের পেছনে দাঁড়ালো।মৃদুহেসে বললো,
-পুরো শিউলীতলা কুড়িয়েও মুঠোভর্তি হলো না?
চমকে পেছনে ফিরে হেসে ফেলল বিনয়।তারপর এগিয়ে এসে ফুলগুলো অরতীর হাতে সমর্পণ করে তাকে বাহুমাঝে টেনে নিয়ে বললো,
-কি করবো বলো?অভিমানের পালা মেটাতেই যে শিউলিফুলের বেলা ফুরিয়ে গেলো

Writer:- সাবরিনা শাহরিণ
PREVIOUS ARTICLE ত্যাগ
PREVIOUS ARTICLE ত্যাগ
 

Delivered by FeedBurner

a