Leave a message
> কনে দেখা আলোয় পর্ব ৬
-->

কনে দেখা আলোয় পর্ব ৬


ভোর সকালে কারো ক্রমাগত ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেলো কিনঞ্জলের।আধো খোলা চোখদুটো হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কচলিয়ে হাই তুলতে তুলতে উঠে বসে দেখল সাক্ষর ভেজা হাত-মুখ নিয়ে ওর দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে।কিনঞ্জল কিছু বলার আগেই সাক্ষর ব্যাঙ্গ করে বলে উঠল,
"ভোর হলো দোর খোলো,খুকুমণি উঠো রে।না না খুকুমণি না বুড়ীমনি উঠো রে।"
সাক্ষরের কান্ড দেখেছে কিনঞ্জল ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সাক্ষর ধমকে বলে উঠল,
"কখন থেকে ডাকছি তোকে?এমন গন্ডারের মতো ফোসফোস করে ঘুমাস যে বাড়িতে ডাকাত পরলেও টের পাবি না।"
কিনঞ্জল মনে মনে সাক্ষরকে একটা ভয়াবহ গালি দিয়ে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
"বাড়িতে তো আর ডাকাত পরে নি।তাহলে আপনি আমাকে এই সাত সকালে ডাক দিলেন কেনো?"
"চুমু খাবো বলে।"
কিনঞ্জল চমকে উঠে বলল,
"কি বললেন?"
"বলেছি চুমু খাবো।কালা নাকি তুই?শুনতে পাসনি?"
কিনঞ্জল এবার যেনো খানিকটা মিইয়ে গেলো।গতকাল রাতেও সাক্ষর ভাই বলেছে বিয়ে যেহেতু করেছে সে সংসারও করবে।তো ওনি কি এখন থেকেই নিজের অধিকার ফলাতে চাইছে নাকি?এই ভেবে সকালের এই ঠান্ডা আবহাওয়াতেও ঘামতে শুরু করল কিনঞ্জল।এই দেখে সাক্ষর আবার বলে উঠল,
"কিরে দে চুমু দে।এতদিন তো অন্য মানুষের কাছে চুমু খাওয়ার জন্য দৌড়েছিস এখন দিতে সমস্যা কই?"
"দে..দেখেন সাক্ষর ভাই।"
"তোর দেখাদেখি পরে হবে আগে জিনিসটা দে।"
এবার খানিকটা তেজ দেখিয়েই কিনঞ্জল বলল,
"কি দিবো?আমি কাউকে ওসব বাজে জিনিস দিতে পারবো না।"
"আহা!তোমার চুমু খাওয়ার জন্য তো আমি মরে যাচ্ছি।যেই না তোমার শিরিষ কাগজের মতো খসখসে ঠোঁট।ওই ঠোঁট আমার গালে ছোঁয়া লাগলেও আমার গাল ছিলে রক্তাক্ত হয়ে যাবে।তোর কাছে আমি তোয়ালেটা চাইছি।কি কি করছিস বলে চুমুর কথা বলেছি।তুই তো আবার চুমু নিয়ে পিএইচডি শেষ করে ফেলেছিস না।গতকাল রাতে মাথা মুছে কই রেখেছিস?জলদি খুঁজে দে।আধঘন্টা যাবত ভেজা হাত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।পানিতো হাতে-মুখেই শুকিয়ে যাচ্ছে।"
কিনঞ্জল মাথা নিচু করে মিনমিনিয়ে বলল,
"দেখেন সাক্ষর ভাই।একদম খোটা দিবেন না।আমি কি যেচে আপনাকে বিয়ে করেছি নাকি নুহাশের কথা বলেছি?আপনিই তো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আমার পেট থেকে কথা বের করেছেন।"
সাক্ষর চোখ পাঁকিয়ে ধমকে বলে উঠল,
"তোর কপাল ভালো আমি তোর পেট থেকে নাড়িভুঁড়ি টেনে বের করিনি।পড়ার নামে স্কুল-কলেজে গিয়ে ছ্যাচড়ামি করে আবার বড় গলায় কথা বলিস।মার যদি খেতে না চাস জলদি আমাকে তোয়ালে খুজে দে।"
"এজন্যই বড়রা বলে,দুষ্টু লোকের মিষ্টি কথায় ভুলতে নেই।আপনার মিষ্টি কথার ভুলে পেটের সব উগরে গিয়ে এখন আমি পড়েছি মহাজ্বালায়।পিশাচ একটা!কবে যেনো আমার হাড়গুলোও এই পিশাচটা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে।"
কথাটা বিড়বিড় করে বলতে বলতে কিনঞ্জল বিছানা থেকে নেমে তোয়ালে খুজতে শুরু করে দিলো।
ডাইনিং টেবিলে কিনঞ্জল,সাক্ষর,প্রাঞ্জল আর ইফতেখার মাহমুদ(কিনঞ্জলের বাবা) একসাথে বসে আছে।আর কিনঞ্জলের মা(ফুলঝুরি মাহমুদ)কিচেনে নাশতা রেডি করছে।সাক্ষরের পাশে বসেই কিনঞ্জল ঝিমাচ্ছে।সাক্ষর কিনঞ্জলকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে বলল,
"ওই কিনঞ্জল চা খাবি?"
কিনঞ্জল ঝিমিয়ে ঝিমিয়েই বলল,
"হুম,কড়া লিকার দিয়ে দুধ চা খাই আমি।"
এই শুনেই সাক্ষর কিনঞ্জলকে ধপাস করে চেয়ার থেকে দাড় করিয়ে বলল,
"তাহলে যা দু'কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আয়।না না চার কাপ।চাচা আর প্রাঞ্জলও তো খাবে।"
এই বলেই ঠেলে কিনঞ্জলকে কিচেনে পাঠিয়ে দিলো।কিনঞ্জলের মেজাজ এখন সপ্তম আসমানে।সাক্ষরকে মনে মনে গালি দিতে দুতে কিনঞ্জল চলে যেতেই সাক্ষর বেশ সিরিয়াস মুখ করে প্রাঞ্জল আর কিনঞ্জলের বাবার সামনে বসে বলল,
"চাচা,তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিলো।"
ইফতেখার মাহমুদ একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
"আমি জানি তুই কি বলবি সাক্ষর।নিশ্চয়ই তুই এতক্ষনে নুহাশের ব্যাপারে সবটা জেনে গেছিস।"
"হ্যাঁ,চাচা।কিন্তু এই এত লুকোচুরির কি কোন প্রয়োজন ছিলো চাচা?তুমি খুব ভালো করেই জানো কিনঞ্জলে একটা রিলেশন কেনো ওর যদি বিয়েও হয়ে যেতো আর তোমরা যদি আমাকে একটাবার বলতে আমি কোন প্রশ্ন ছাড়াই কিনঞ্জলকে নিজের করে নিতাম।"
"জানিরে বাবা।এজন্যই তো নিজের কলিজার টুকরোটাকে আমি তোর হাতে তুলে দিয়েছি।আমার মেয়ের সুখের জন্য আমি সব করতে পারি।সেখানে একটা কথা লুকিয়ে রাখা তো তুচ্ছ ব্যাপার।"
"তাহলে নুহাশের সঙ্গে বিয়েটা দিলে না কেনো?"
ইফতেখার মাহমুদ হতাশ সুরে বলল,
"চেষ্টা করেছি।তবে সম্ভব হয়নি।"
সাক্ষর অবাক হয়ে বলল,
"মানে?"
"তুই আর প্রাঞ্জল যেদিন ওই ছেলেটাকে মেরেছিলি ওইদিন বাসায় ফিরেই কিনঞ্জল নুহাশের ব্যাপারে আমাদের সবটা জানিয়েছিলো।আমরা তখন কিনঞ্জলকে কিছুই বলিনি।জাস্ট ওর বাড়ির বাইরে বেরোনো আর ফোনটা নিয়ে নিয়েছিলাম।ওর মুখে নুহাশের কথা শুনেই আমি ছেলেটার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়েছিলাম।ছেলেটাকে আমারো বেশ পছন্দ হয়েছিলো।নম্র,ভদ্র,শিক্ষিত,বড়দের সম্মান করে।জব খুজছিলো।তো আমি ভেবেছিলাম ওদের বিয়ের কথা পাকাপাকি হলে আমাদের ব্যবসাতেই কোন একটা কাজে লাগিয়ে দিবো।তো কিনঞ্জল আর নুহাশের অগোচরেই আমি,তোর চাচি আর প্রাঞ্জল মিলে নুহাশদের গ্রামের বাসায় গিয়েছিলাম।নুহাশ যেহেতু ঢাকায় মেসে থাকে ও ব্যাপারটা জানতে পারেনি।"
সাক্ষর কৌতূহলী গলায় বলল,
"তারপর।"
"তারপরেই তো যত গোলমাল বাধলো রে বাপ।শুনতে খারাপ লাগলেও নুহাশের বাবা-মা প্রচন্ড লোভী প্রকৃতির মানুষ।আমরা ওদেরকে নুহাশ কিনঞ্জলের ব্যাপারটা জানাতেই তাদের আগ্রহের শেষ ছিলো না।তবে তাদের আগ্রহটা আমার মেয়ের চেয়ে আমার মেয়ের ভাগের সম্পত্তির প্রতি বেশি ছিলো।আমরা যতবার ওদের সম্পর্ক নিয়ে কথাটা আগাতে চেয়েছিলাম ঠিক ততবারই তারা ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন করে গেছে বিয়েতে ছেলেকে আমরা কি কি দিবো?মেয়েকে বিয়েতে কত ভরি সোনা দিয়ে সাজাবো তাদের ঘর সাজিয়ে দিবো কিনা?তুই বল এমন একটা পরিবারে নিজের মেয়েকে কিভাবে বিয়ে দিতাম?আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি আমি সময় থাকতে সরে এসেছি।নইলে ওই পরিবারে মেয়ে দিলে কবে জানি খবরের কাগজের হেডলাইনে আমার কিনঞ্জলের ছবি দিয়ে গোটা অক্ষরে লিখা থাকতো যৌতুকের দিতে না পারায় গৃহবধূকে হত্যা।যৌতুক নেওয়া আর ভিক্ষা নেওয়া একই কথা।আর আমি জেনেশুনে একটা ভিখারি পরিবারে মেয়ে কিভাবে দিতাম বলতো সাক্ষর।এসবের কিছুই আমি কিনঞ্জলকে জানাইনি কারন কিনঞ্জল জানলে নুহাশও কোনো না কোনভাবে ঠিকই জেনে যেতো।আর আমি চাইনি নুহাশ ওর বাবা-মার এই নোংরা দিকটা জানুক।তাই আমি কিনঞ্জলকে অনেক ভরষা নিয়ে তোর হাতে তুলে দিয়েছি বাপ।কারন আমি জানি তুই ঠিক আমার মত করেই কিনঞ্জলকে আগলে রাখবি আর তোর পরিবার তো আমাদেরই আরেক পরিবার।ও বাড়িতে আমার মেয়ে সুখেই থাকবে।"
সাক্ষর মাথা নাড়িয়ে বলল,
"সবই তো বুঝলাম চাচা।কিন্তু কিনঞ্জল তো ছেলেটাকে ভালোবাসতো।"
ইফতেখার মাহমুদ চেয়ারে গা টা এলিয়ে দিয়ে হালকা হেসে বলল,
"এখন কি তুইও আমাকে শিখাবি আমার মেয়ে কি ভালোবাসে আর কি বাসেনা।এই বয়সে এমন তিন চারটা ভালোবাসা সবার জিবনেই উড়তে উড়তে এসে উড়তে উড়তেই চলে যায়।বুঝলি সাক্ষর!আমার জিবনেও এসেছিলো আবার চলেও গিয়েছে।এখন তোর চাচিকেই বিয়ে করে পার্মানেন্ট করে নিয়েছি।তেমনি কিনঞ্জলের জিবনেও তুই পার্মানেন্ট।যদিও মেয়েটাকে একটু জলদিই বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।তবে আমি নিরুপায় ছিলাম।নয়ত কিনঞ্জল নুহাশ ছেলেটার সাথে আরও জড়িয়ে যেতো।তোর চাচিকে আবার ওসব বলিস না তাহলে গরম খুন্তি দিয়ে পিটাবে আমাকে।এখন তুই আর প্রাঞ্জল নাস্তা করে বাজারে যা।নিয়মনুযায়ী আজকে তুই এ বাড়ির জন্য বাজার করবি।বড় বড় রুই মাছ কিনবি আমার জন্য বুঝলি।আর তোর বউয়ের জন্য গলদা চিংড়ি।আমার কিনঞ্জল মা আবার চিংড়ির কোন প্রিপারেশন হলে পেটপুরে ভাত খায়।পকেটে টাকা আছে তো?"
সাক্ষর চোখ টিপ মেরে বলল,
"এখনতো তুমি আমার থেকে যৌতুক নিচ্ছো।এমনিতেই তোমার মেয়ের দেনমোহরের টাকা দিতে গিয়েই ফকির হয়ে গেছি।কে বলেছিলো পাঁচ লাখ টাকার কাবিন করতে?পঞ্চাশ হাজার করতে পারলে না?"
"তোর দাদিকে বল গিয়ে।আমরা এসবের কিচ্ছু জানিনা।ফুপুই তো বলেছিলো তার বংশের প্রথম নাতবউকে নগত টাকা হাতে দিয়েই ঘরে তুলবে।"
"ও বুড়ি তো আমাকে ফকির করার ধান্দায় আছে।"
এই বলেই জামাই-শ্বশুর এক সঙ্গে হেসে দিলো।এর মধ্যেই কিনঞ্জল চা নিয়ে চলে আসলো।টেবিলে চা রেখে চলে যেতেই সাক্ষর ধমকে বলে উঠল,
"তুই কি কোনদিন মানুষ হবি না কিনঞ্জল?এরকম ভ্যাবলিই থেকে যাবি।চা এনে সবার হাতে হাতে তুলে দিতে হয়।টেবিলে রেখে দিয়ে তুই কোন রাজকার্য করতে যাচ্ছিস?"
কিনঞ্জল ওর বাবা আর ভাইয়ের দিকে কটমট করে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
"পরোটা আর তরকারি আনতে যাচ্ছি।এক কাপ চা তুলে নিয়ে খেলে এখানে কারো হাত পা খুলে পরবে না।"
এই বলেই হনহনিয়ে ট্রে হাতে কিচেনে চলে গেলো কিনঞ্জল।
সাক্ষর চেচিয়ে বলল,
"এত চোপা করা কার থেকে শিখছিস তুই?ভ্যাবলি একটা!"
এদিকে সাক্ষরের কার্যকলাপ দেখে ইফতেখার মাহমুদ আর প্রাঞ্জল মিটমিট করে হেসেই যাচ্ছে।

(চলবে)

Writer:- নাজমুন নাহার তৃপ্তি

 

Delivered by FeedBurner

a