এভাবে দশ দিনে দশজনের বাড়িতে ভ্রমণ শেষে তিনি তিনটি বাড়িকে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় ঘোষণা করবেন। বিজয়ীদের দেওয়া হবে অকল্পনীয় পুরষ্কার। বিজয়ী নির্ধারিত হবে তাদের বাড়ির পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, লোকজনের আন্তরিকতা, কথাবার্তায় দেশের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, পরিবারের লোকজনদের নিজের প্রতি ভালোবাসা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে। কেউ যদি প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য দেয়ালে প্রধানমন্ত্রীর কিংবা প্রধানমন্ত্রীর পূর্বপুরুষদের ছবি টাঙিয়ে রাখে তাহলে সে সাথে সাথে ডিসকোয়ালিফাইড।
দেশের সমস্ত মানুষকে প্রস্তুতির জন্য প্রধানমন্ত্রী এক সপ্তাহ সময় দিলেন। তিনি বলে দিলেন, একদম নিম্নবিত্ত যেমন ডিমবিক্রেতা কিংবা মুচি-নাপিত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত এমনকি সচ্ছল , যে কারো বাড়িতে তিনি যেতে পারেন।
এমন ঘোষণা শোনার পর জনগণে মধ্যে নানা প্রভাব এবং নানা মত দেখা গেলো। বিরোধী দলের লোকজন বললেন, প্রধানমন্ত্রীর যখন খেয়ে দেয়ে কাজ থাকে না তখন তিনি এমন উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। আমরা অতি দ্রুত এই সরকারের পতন চাই। জনগণ আমাদের সাথে আছে।
মার্ক্সবাদ-লেলিনবাদ মুখস্থ করা মানুষরা প্রধানমন্ত্রীর এই ঘটনাকে ‘সোস্যাল ডিজাস্টার’ হিশেবে আখ্যা দিয়েছে। তারা বলছে- দেশের কত মানুষ না খেয়ে আছে! কত কৃষক নিজের শ্রমের মূল্য পাচ্ছে না। গরুর দুধের ন্যায্য দাম না পেয়ে রাজপথে দুধ ঢেলে দিয়ে প্রতিবাদ করছে গোয়ালীরা! দেশে এমন কতো সমস্যা। নিশ্চয়ই দেশের মানুষ এসব ভুলে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আষাঢ়ে গালগল্প বিশ্বাস করবেন না। দশ দিন এই অহেতুক কাজ না করে প্রধানমন্ত্রীর উচিৎ আগে দেশে দিকে মনোযোগ দেওয়া। নিশ্চয়ই জনগণ আমাদের সাথে আছে।
জনগণ আসলে কারোর সাথে নেই, তারা প্রধানমন্ত্রীর কথা বিশ্বাস করে কাজ নেমে পড়েছে। সবার বাড়িঘর পরিষ্কার করতে শুরু করেছে, আবর্জনা বের করে দিচ্ছে, বাড়ির পাশের ড্রেন পরিষ্কার করেছে, প্রধানমন্ত্রী বলছেন, দুপুরে ঘুম থেকে উঠে তিনি বাড়ির চারপাশে হাঁটতে বের হবেন, তখন যদি নোংরা ড্রেন চোখে পড়ে তাহলে তো সমস্যা। যে ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র সিগারেট খেয়ে ফিল্টারগুলো টেবিলের পাশেই রেখে দিতো, সে সেগুলো কুড়িয়ে পলিথিনে ভরেছে, নিজের এলোমেলো জামা কাপড় হ্যাঙ্গারে সাজিয়েছে। শখ করে বারান্দায় ফুলের টব রাখা মেয়েটা সবগুলো টব পরিষ্কার করেছে, নিজের চিরুনিতে আটকে থাকা চুল সরিয়েছে। কোম্পানিতে চাকরি করা মধ্যবিত্ত পুরুষ, যে কখনো নিজের বাড়িতে তেমন সময় দিয়ে পারতো না, সেও সময় করে দেয়ালে আটকে থাকা মাকড়শার জাল পরিষ্কার করেছে। গ্রামের মানুষজন বাড়ির পাশের সমস্ত ঝোপঝাড় কেটে ফেলেছে।
এসব দেখে বিরোধী দলে মানুষজনও সন্দেহ করতে শুরু করলো, প্রধানমন্ত্রী তাহলে সত্যিই আসতে পারেন। ওরাও সবার দেখাদেখি নিজের বাড়ির কাজে লেগে পড়লো।
কলা খাওয়ার পরেও এখন কেউ খোসা যত্রতত্র ফেলছে না। বাড়ির পাশের ড্রেন পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখা গেলো, ড্রেনের ভেতর প্রচুর পলিথিনজাত দ্রব্য, চিপসের প্যাকেট, বিস্কুটের প্যাকেট, সেভেনাপের বোতল, এবং এসব ড্রেনে ফেলেছে বাড়ির লোকজনরাই। তারা সবাই ঠিক করলো প্রধানমন্ত্রী আসা অবধি এসব দ্রব্যাদি আর ড্রেনে ফেলা যাবে না।
দেখতে দেখতে সাতদিন শেষ। আগামীকাল থেকে প্রধানমন্ত্রী এই অদ্ভুত ভ্রমণে বের হবেন। দেশের সমস্ত মানুষ উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছে। প্রধানমন্ত্রী কার বাড়িতে যাবেন? কে সৌভাগ্যবান?
প্রধানমন্ত্রী নিজবাসভবনে রাতের খাবার শেষ করে পিএসকে ডেকে বললেন, গাড়ি বের করুন। আমি একটু ঘুরতে বের হবো। কোনো সিকিউরিটি গার্ড লাগবে না। শুধু আপনি যাবেন আমার সাথে।
কালো কাঁচে ঢাকা কারে চড়ে প্রধানমন্ত্রী বের হলেন। রাস্তা-ঘাট ফাঁকা, সমস্ত মানুষ নিজের ঘরে চলে গেছে, কারণ তাদের আশা প্রধানমন্ত্রী তাদের কারোর বাড়িতে সারাদিন কাটাবেন। সবাই সাগ্রহে অপেক্ষা করছে।
প্রধানমন্ত্রী তার পাশে বসা পিএসকে বললেন, শহরটা কি সুন্দর লাগছে না?
পিএস মাথা নেড়ে বলল, জ্বি। ছিমছাম লাগছে।
প্রধানমন্ত্রী তার পাশে বসা পিএসকে বললেন, শহরটা কি সুন্দর লাগছে না?
পিএস মাথা নেড়ে বলল, জ্বি। ছিমছাম লাগছে।
প্রত্যেকটা বাড়ি দেখেছেন, কত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। গাছে কোনো ময়লা নেই। রাস্তায় একটা পলিথিনও দেখলাম না। আচ্ছা আমি শহরের ডাস্টবিনগুলো সরানোর কথা বলেছিলাম সিটি মেয়রদের। তারা কি কাজটা করেছেন?
পিএস বলল, জ্বি করেছে। সমস্ত দেশেই করা হয়েছে। আবর্জনাগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আপনার কথা মতো সিঙ্গাপুর থেকে ফিল্টার আনা হয়েছে যেনো আবর্জনা পোড়ানোর ধোঁয়ায় পরিবেশের ক্ষতি না হয়।
বাহ্। এই সাতদিনে মানুষের মধ্য কি কিছুটা পরিবর্তন এসেছে? আপনার কি মনে হয় পিএস সাহেব?
হ্যাঁ এসেছে কিছুটা।
এই পরিবর্তন কি দীর্ঘস্থায়ী হবে।
না হবে না। আমরা কেউই নিয়ম মেনে অভ্যস্ত নই।
তা ঠিক।
পিএস বলল, আপনি তো শুধু বাড়িতে যাবেন বলেছিলেন, সবাই নিজের ঘর পরিপাটি করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে শুরু করে সরকারি হাসপাতাল, সমস্ত কিছুই নোংরা। সরকারি হাসপাতালগুলোর কোনো পায়খানা ব্যবহার যোগ্য বলে আমার মনে হয় না। সেসবের কি হবে?
প্রধানমন্ত্রী বললেন, ছোটোবেলায় পড়েন নি- চ্যারিটি বিগেইনস এট হোম। নিজের বাড়ি থেকে আগে শুরু হোক, বাকিটা দেখা যাবে।
সন্ধ্যা থেকে আকাশ মেঘে মেঘে গুমোট ধরে ছিলো, এখন ঝিরিঝির বৃষ্টি শুরু হলো। প্রধানমন্ত্রী গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দিলেন। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন, আস্তে আস্তে তার হাত ভিজে গেলো।
পিএস বলল, আচ্ছা, আপনি কি আসলেই কাল থেকে কারো বাড়িতে যাবেন? নাকি এটা একটা ট্রিক ছিলো?
প্রধানমন্ত্রী উত্তর দিলেন না। ল্যাম্পপোস্টের সোনালি আলোতে বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে গলিত স্বর্ণের মতো লাগছে। তিনি মুগ্ধ চোখে এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছেন।
প্রধানমন্ত্রী উত্তর দিলেন না। ল্যাম্পপোস্টের সোনালি আলোতে বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে গলিত স্বর্ণের মতো লাগছে। তিনি মুগ্ধ চোখে এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছেন।
Writer:- ওয়ালিদ প্রত্যয়