Leave a message
> জোয়ান অব আর্ক শেষ পর্ব
-->

জোয়ান অব আর্ক শেষ পর্ব


কয়েকমাস কেটে গেছে। এরই মধ্যে ফ্রান্স তাদের প্রায় অনেক অঞ্চল ইংরেজ মুক্ত করেছে। প্যারিসটা ইংরেজ মুক্ত করতে পারলেই ফ্রান্স হবে পুরোপুরি ইংরেজমুক্ত। নিজেদের প্রায় সব অধিকার ফিরিয়ে আনার পর ফ্রান্স এখন অনেকটাই শক্তিশালী। ইতোমধ্যে জোয়ানের মর্যাদাও বেড়ে গেছে ফ্রান্স রাজসভায়। তাকে রাজা চার্লস উঁচু একটা পদ দেন রাজ সভায়। এতে মনে মনে ক্ষুব্ধ হয় অনেকেই। অল্প বয়সী হয়ে সে সবকিছুতে এগিয়ে আছে। যুদ্ধে নেতৃত্ব হোক, সেটার দায়িত্ব দেয়া হয় জোয়ানকে। কোনো কিছুর পরামর্শ হোক, তাতেও রাজা চার্লস জোয়ানের পরামর্শকে এগিয়ে রাখে। তাছাড়া রাজসভার উঁচু পদ দেয়া হয়েছে তাকে। এতকিছুর পর রাজ সভার উঁচু পদের কেউ কেউ গোপনে হিংসে করতে থাকে জোয়ানকে। জোয়ানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নেই। তাদের মতে একটা অশিক্ষিত অল্পবয়সী সেনা কী করে রাজ সভার উঁচু পদ পায়? যারা জোয়ানকে হিংসে করে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো কমান্ডার লাহির। মনে মনে লাহির জোয়ানের প্রতি এতটাই ক্ষিপ্ত, সুযোগ পেলেই সে জোয়ানের অধপতন করে ছাড়বে।
প্যারিসে হামলা করার দায়িত্বটাও দেয়া হয় জোয়ানকে। জোয়ানের নেতৃত্বে সেনারা প্যারিসে ইংরেজদের আক্রমণ করবে। কমান্ডার লাহিরকেও জোয়ানের নেতৃত্ব মেনে নিতে হবে।
দিনটি ছিল ৯ই সেপ্টম্বর। ঐদিন জোয়ান তার বাহিনী নিয়ে সরাসরি আক্রমণ করে প্যারিসে ইংরেজদের উপর। দুপক্ষের অনেকেই হতাহতো হতে লাগলো। জোয়ান দুহাতে তরবারি চালাতে লাগলো। বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ইংরেজ এক সৈন্য ক্রসবোর আঘাত করে জোয়ানের পায়ে। প্রচণ্ড আঘাত পায় জোয়ান। হাঁটুগেড়ে বসে পড়ে সে নিচে। ঐ সৈন্যটা এবার তরবারি নিয়ে আঘাত করতে যায় তাকে। হাঁটুগাড়া অবস্থায় তরবারি তুলে প্রতিরক্ষা করে জোয়ান। তখন আরেকটা সৈন্য এসে তার বাহুতে আঘাত করে তরবারির। কেটে যায় তখন অনেকটা। কিন্তু জোয়ান হার না মানা এক সৈনিক। পায়ের ব্যথা ভুলে গিয়ে উঠে দাঁড়ায়। হাতের ব্যথা ভুলে গিয়ে তরবারি উঁচু করে। তারপর আবারও একই গতিতে তরবারি চালাতে থাকে। হিংস্র গতিতে নিজের চারপাশের শত্রুদের বুকে তরবারি চালায় সে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ছিনিয়ে নেয় বিজয়। ইংরেজদের পতন হলে, জোয়ান হাসতে হাসতে ঢলে পড়ে নিচে। হাত থেকে রক্ত ঝরতে ঝরতে তার সাদা যুদ্ধ পোশাকটি লাল হতে থাকে। মাটিতে শুয়েই জোয়ান তার পেছন থেকে ফ্রান্সের পতাকা বের করে এক হাতে উড়াতে থাকে। তখন কয়েকজন সেনা এসে আহত জোয়ানকে তুলে নেয়। উল্লাসধ্বনি করে ওঠে ওরা। আর আহত জোয়ান তখনও পতাকা উড়াতে থাকে ফ্রান্সের অধিকার ফিরিয়ে আনার খুশিতে।
এরপর অনেকদিন লাগে জোয়ানের সুস্থ হতে। অনেকদিন ও কষ্ট পায় পায়ের ব্যথায়। হাতের ক্ষতটা শুকাতেও লেগে যায় অনেকদিন।
সাল ১৪৩০, ২৩ মে।
সেদিন জোয়ান তার জীবনের শেষ যুদ্ধে অংশ নেয়। কম্প্যেন যুদ্ধ। জোয়ান তখনও জানতো না তার নিজের মানুষরাই তার সাথে বেইমানি করবে। জোয়ানকে জানানো হয় বারগুন্ডি সীমান্তে ইংরেজদের হামলা হয়েছে। তখন কমান্ডার লাহির জোয়ানকেসহ কিছু সৈন্য নিয়ে যায় ইংরেজদের আক্রমণ করতে। কিন্তু এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জীবনে। কমান্ডার লাহির আগে থেকেই বারগুন্ডিয়ান্স এবং ইংরেজদের সাথে চুক্তি করে জোয়ানকে ধরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে। জোয়ান নিজের মতোই যুদ্ধ করছিল সেদিন। কিন্তু, নিজের সৈন্যরা তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো না। তবুও জোয়ান নিজেকে ধরা দিলো না সহজে। কতক্ষণ একা ওদের সাথে পেরে ওঠবে? একসময় বারগুন্ডিয়ান্সরা জোয়ানকে আটক করে হাত পা বেঁধে ফেলে। লাহির তার সৈন্য নিয়ে চলে যায়, আর জোয়ান পড়ে থাকে বারগুন্ডিয়ানসদের হাতে বন্দী হয়ে।
বন্দী অবস্থায় জোয়ান বেশ কয়েকবার পালাতে চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। প্রতিবারই সে ধরা পড়ে। এরপর উপায় না দেখে ওরা একটা টাওয়ারে তাকে বন্দী করে রাখে। ওখান থেকে পালানোটা মোটেও সহজ ছিল না। পালাতে গেলেই কারও না কারও নজরে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার উপর জোয়ানকে মোটেও ওরা সহজ চোখে দেখছে না। তার জন্য করা হয়েছে কড়া নিরাপত্তা। সেই মুহূর্তে যদি জোয়ানকে পালাতেই হয়, তবে টাওয়ার থেকেই লাফ দিতে হবে। যে উচ্চতায় তাকে রাখা হয়েছে, সেটাও নেহাৎ কম না। প্রায় ষাট থেকে সত্তর ফুট হবে। ঐ উচ্চতা থেকে লাফ দিলে তার জীবনের ঝুঁকি থাকতে পারে। তবুও জোয়ান ঝুঁকিটা নিতে প্রস্তুত হলো। তার মতো যোদ্ধা মৃত্যুর ভয় পায় না। দ্বিতীয়বার না ভেবেই জোয়ান লাফ দেয় টাওয়ার থেকে। নিচে একটা পানিপূর্ণ পরিখা ছিল। ওখানেই পড়ে জোয়ান। কিন্তু জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। আবারও ব্যর্থ হয় সে পালাতে।
কিছুদিন পর ইংরেজ একটা দল আসে বারগুন্ডিয়ানসদের কাছে। ওরা কিনতে চায় জোয়ানকে। যে জোয়ান তাদেরকে অধপতন করে ছেড়েছে, সেই জোয়ানকে তারা কিনে নিয়ে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে চায়। বারগুন্ডিয়ানসদের ডিউক তৃতীয় ফিলিপও রাজি হয় জোয়ানকে বিক্রি করে দিতে। এই সুযোগে একটা চড়া দাম পাওয়া যাবে। ইংরেজ কমান্ডার সাফুলক জোয়ানের বিনিময়ে চার হাজার পাউন্ড দিতে চাইলে, ফিলিপ বলে,
-না কমান্ডার সাফুলক, এতো কম মূল্যে আমরা জোয়ানকে আপনাদের হাতে তুলে দিতে পারি না।
-তবে আপনিই বলুন, কতো দাম চান জোয়ানের? আপনি যতো দাম চান, আপনাকে সেই পরিমাণ দামই দেয়া হবে। তবুও জোয়ানকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে চাই।
-দশ হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে আমরা জোয়ানকে আপনাদের হাতে তুলে দিবো।
-বেশ! আমরা রাজি। দশ হাজার পাউন্ডই দেবো।'
হাসলো দুজনই। তারপর চুক্তি পত্রে স্বাক্ষরিত হলো। বিক্রি হয়ে গেল জোয়ান দশহাজার পাউন্ডের বিনিময়ে।
সাল ১৪৩১।
ইংল্যান্ডে বন্দী হয়ে আছে জোয়ান অনেকদিন। এতদিনেও ফ্রান্স থেকে তার খুঁজে কেউ এলো না। স্বয়ং ফ্রান্সের রাজা চার্লসও তার খোঁজ নিলো না। বন্দী জীবনে সে ভাবতে থাকে, কাদের জন্য সে যুদ্ধ করেছে? কাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য লড়াই করে গেছে সে? কার জন্য সে ফ্রান্সের সিংহাসন নিশ্চিত করেছে? ভাবতেই একরাশ অভিমান গ্রাস করে ফেলে তাকে।
ইংল্যান্ডে জোয়ানের উপর পুনরায় ডাইনি অপবাদ আনা হয়। কোনো সাধারণ যোদ্ধা এভাবে প্রতিবার যুদ্ধে জয়ী হতে পারে না। যে ফ্রান্স প্রতিবার যুদ্ধে কোণঠাসা হয়ে পড়তো, সেই ফ্রান্স পরবর্তীতে বারবার যুদ্ধে জিতেছে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। এটা কেবলই সম্ভব হয়েছে জোয়ানের ডাইনি শক্তির কারণে।
৯ই জানুয়ারি ইংল্যান্ডের উইনচেস্টার শহরে জোয়ানের বিচারকার্য শুরু হয়। ক্যাথলিক চার্চে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বিচার কার্য পরিচালনা করেন চার্চের কার্ডিনাল হেনরি বিফোর্ট। সেই সময় বিচার কার্যগুলো পরিচালনা করতো খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় গুরুরা। ধর্মীয় গুরুরা বিচারে যে রায় দেয়, সকল খ্রিষ্টানকেই সেই রায় মানতে হতো। সেটা ফ্রান্সের খ্রিষ্টান হোক, বা ইংল্যান্ডের। কার্ডিনাল বিফোর্ট প্রথমেই জোয়ানের মতামত জানতে চান,
-তোমার উপর আনিত অভিযোগের ভিত্তিতে কিছু বলার আছে?'
জোয়ান নির্ভয়ে বলেন,
-মাননীয় কার্ডিনাল, আমি ডাইনি নয়। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা অপবাদ আমার উপর।
-তবে তুমি কীভাবে প্রতিবার জয়ী হলে যুদ্ধে? আর এতো অল্প বয়সে কেন যুদ্ধ করতে এলে?
-আমাকে ঈশ্বরই আদেশ দিয়েছেন যুদ্ধ করতে। আমি স্বপ্নে দেখি এবং দৈববাণী শুনি যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে। তারপর আমি যুদ্ধ করতে বেরিয়ে পড়ি।
-স্বপ্ন বা দৈববাণীর কথা বলে তো তুমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারো না। তোমার উপর অভিযোগ আছে, তুমি কালো জাদু করে যুদ্ধে জয়ী হও। আর তুমি মেয়ে হয়ে পুরুষের ছদ্মবেশ নিয়েছো। এটাও তোমার উপর একটা অভিযোগ। এটা ধর্মের বিরোধী রীতি। তুমি কি জানো না ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়ার শাস্তি সবচেয়ে বড় শাস্তি?
-আমি ধর্মের বিরুদ্ধে যাইনি।'
কার্ডিনাল বিফোর্ট তখন বলে ওঠলেন,
-জোয়ানের উপর আনিত অভিযোগগুলো এখনও অপ্রমাণিত। তাকে চার্চের ধর্ম যাজকদের কাছে সোপর্দ করার আদেশ দেয়া গেল। যদি তাকে পরীক্ষা করে জানা যায় যে সে ডাইনি এবং সে মেয়ে। তাহলে তাকে দোষী ভেবে শাস্তি দেয়া যাবে, অন্যথায় তাকে মুক্তি দেয়া হবে।'
এরপর জোয়ানকে চার্চের ধর্ম যাজকদের কাছে সোপর্দ করা হলো। ধর্ম এবং ধর্মযাজকদের প্রতি জোয়ানের ছিল অগাধ বিশ্বাস। তার ধারণা, ধর্মযাজকরা নিশ্চয়ই কার্ডিনালের সামনে প্রমাণ দেবে যে, সে কোনো ডাইনি না। একজন ধর্মযাজক জোয়ানকে মেয়েদের পোশাক পরতে বলে। জোয়ান ঐ পোশাক পরতে রাজি না হলে ধর্মযাজক বলে,
-দেখো, তুমি মেয়ে হয়ে যুদ্ধ করেছো। আমাদের ক্যাথলিক ধর্মে মেয়েদের যুদ্ধ করার নিয়ম নেই। মেয়েরা যদি যুদ্ধ করে, তবে ধর্মের বিরুদ্ধে যায় এটি। তুমি তাই তোমার এই যুদ্ধ পোশাক খুলে মেয়েদের পোশাক পরা শুরু করো।'
ধর্মযাজকদের প্রতি বিশ্বাসের জেরেই জোয়ান সেদিন মেয়েদের পোশাক পরে।
রাতে জোয়ান ঐ পোশাক পরে ঘুমালে ধর্ষণের শিকার হয় সে। কাঁদতে কাঁদতে জোয়ান সে কথা চার্চের অন্যান্য ধর্মযাজকদের বললে, তারা বলে,
-তুমি যে মেয়ে, সেটার প্রমাণ নেয়া হলো। মেয়ে হয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছো, ধর্মের বিরুদ্ধে গিয়েছো তুমি, তোমাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।'
জোয়ান আর কিছু বলে না। ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয় নিজেকে। পুনরায় মেয়েদের পোশাক ছেড়ে যুদ্ধ পোশাক পরতে শুরু করে সে।
যেদিন জোয়ানের রায় দেয়ার পালা, সেদিন আবারও কার্ডিনাল হেনরি বিফোর্টের মুখোমুখি হয় জোয়ান। চার্চের ধর্ম যাজকরাও উপস্থিত। কার্ডিনাল তাদেরকে জিজ্ঞেস করে,
-জোয়ানের ব্যাপারে তোমাদের কী বলার আছে? সে কি ডাইনি?'
ধর্মযাজকদের পক্ষ থেকে জবাব আসে,
-জি মহামান্য কার্ডিনাল, আমাদের সাথে জোয়ান অনেকদিন থেকেছে। আমরা বুঝতে পেরেছি তার কোনো ঐশ্বরিক শক্তি নেই। ঈশ্বর তাকে সাহায্য করেন না। বরং সে কালু জাদু করেই যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। আর সে মেয়ে হয়ে পুরুষ সেজে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। আমরা তাকে মেয়েদের পোশাক পরিয়েছিলাম কয়েকদিন, পরে আবার সে নিজের পোশাকটা পরে নেয়।'
কার্ডিনাল এবার জোয়ানের দিকে তাকান। প্রশ্ন করেন তিনি জোয়ানকে,
-জোয়ান, তুমি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো?'
জোয়ান জবাব দেয়,
-মহামান্য কার্ডিনাল, আমি যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করি, তবে তিনি যেন আমাকে এখানেই রেখে দেন, আর যদি বিশ্বাস করি, তবে তিনি যেন আমাকে রক্ষা করেন।'
-মেয়েদের যুদ্ধে যাওয়াটা অন্যায়, ধর্মবিরোধী জানার পরও তুমি যুদ্ধ করেছো পুরুষ সেজে। এটা তুমি বড় ধরনের অপরাধ করেছো। আর তুমি ডাইনি কি না পরীক্ষা করার জন্য যেসব ধর্মযাজকদের কাছে সোপর্দ করা হয়েছিল, তারা প্রমাণ পেয়েছে তুমি ডাইনি। তুমি কালো জাদু করে যুদ্ধে জয়ী হয়েছো। এ ব্যাপারে তোমার কী বলার আছে?'
জোয়ান ধর্মযাজকদের দিকে তাকায় ছলছল দৃষ্টিতে। এই ধর্ম যাজকদের প্রতি তার এবং তার মতো সব খ্রিষ্টানদের একটা অগাধ বিশ্বাস আছে। এরা খ্রিষ্ট সমাজের উঁচু শ্রেণির লোক। কিছু বদ লোকের জন্য সে পুরো খ্রিষ্ট সমাজের ধর্ম যাজকদের বদনাম হতে দিতে পারে না। তাই সে ওর প্রতি আনিত অভিযোগ মেনে নিয়ে বলে,
-জি মহামান্য কার্ডিনাল, ওনারা ঠিকই বলেছেন। ধর্মযাজকরা কখনও মিথ্যা বলতে পারে না। আমার উপর আনিত অভিযোগ সত্যি। আমি স্বীকার করছি।'
জোয়ান নিজের প্রতি আনিত অভিযোগ মেনে নেয়ায় কার্ডিনাল তাঁর রায় শুনালেন,
-জোয়ান তার উপর আনিত অভিযোগ মেনে নেয়াই এটা প্রমাণিত হয় যে, সে ডাইনি এবং ধর্মের বিরুদ্ধে গেছে। তাই আর্টিকেল ১২ অনুযায়ী জোয়ানকে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো।'
জোয়ানের চোখ বেয়ে টোপ করে এক ফোঁটা জল পড়লো। এই জল কষ্টের নয়, অভিমানের।
জোয়ান তা শাস্তি শোনার পরও সে জানতো না যে তাকে আগুনে পুড়িয়েই মারা হবে। সে সময় কেউ ডাইনি প্রমাণিত হলে তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হতো। জোয়ানকেও নিয়ে যাওয়া হয় আগুনে পুড়াতে। উইনচেস্টার থেকে রোয়েন শহরে আনা হয় তাকে। সেখানে রোয়াঁর বাজারের পাশে ব্যস্ত লোকালয়। তার পাশেই সিন নদী। ঐ জায়গায় আনা হয় জোয়ানকে। একটা পিলারের উঁচুতে বাঁধা হয় তাকে। নিচে আগুন জ্বালানো হয়। তখনই জোয়ান বুঝতে পারে তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে। ধীরে ধীরে আগুনের স্তুপ বড় হতে থাকে। জোয়ানের শরীরে আগুনের উত্তাপ লাগতে শুরু করে। জোয়ান সামনে দৃষ্টি দেয়। দেখে, তার মৃত্যু দেখার জন্য অনেকেই এসেছে। ইংরেজ এবং ফরাসিরা এক হয়ে তার মৃত্যু দৃশ্য দেখছে। সেই সময় ধর্মের চেয়ে বড় কিছু ছিল না। জোয়ান ধর্মের বিরুদ্ধে গেছে, শাস্তিটা তার প্রাপ্য।
ভিড়ের মাঝে জোয়ানের চোখ দুটো খুঁজতে থাকে তার আপনজনকে। তার বাবা মা নিশ্চয়ই মেয়ের এভাবে মৃত্যু দেখতে আসবে না। তারা কি আদৌ তার কোনো খবর জানে? তাদের মেয়ের যে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, সেই খবর কি আদৌ পৌঁছেছে ওদের কাছে। একজনকে জোয়ান কথা দিয়েছিল ফিরে যাবে বলে, দানোস। দানোস কি আজও পথ চেয়ে আছে তার? খুব ভালোবাসতো দানোস তাকে। আর সে ভালোবাসতো দেশকে। মনেমনে দানোসের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো জোয়ান,
-দুঃখিত দানোস। আমার কথা রক্ষা করতে পারলাম না। তোমার কাছে ফিরবো বলেছিলাম, আর ফেরা হলো না।'
সামনে জড়ো হওয়া লোকগুলোর উদ্দেশ্যে জোয়ান বলে ওঠলো,
-হে ফ্রান্সবাসী এবং ইংল্যান্ডের অধিবাসী, তোমরা শুনে রাখো, আমার প্রতি ষড়যন্ত্রকারীদেরকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। শুধু তোমরা আমার জন্য দোয়া করো ঈশ্বরের কাছে।'
আগুনের উত্তাপ বাড়তে শুরু করেছে, আগুন জোয়ানের গা ছুঁইছুঁই করছে। আগুনের উত্তাপে জোয়ানের সারা শরীর কেমন যেন করতে থাকে। সহ্য করতে পারছে না সে। সারা শরীর পিলারের সাথে বেঁধে রাখায়, সে নড়াচড়াও করতে পারছে না। জানটা যেন বের হয়ে আসছে তার। শেষবারের মতো সে চোখ খুলে তার প্রিয় ফ্রান্সকে দেখে নিলো। মৃত্যুটা যে তার ইংল্যান্ডে হচ্ছে না, এটাই অনেক। প্রিয় ফ্রান্সেই সে তার শেষ নিশ্বাসটুকু ছাড়তে পারছে।
পাশেই সিন নদীর জল ছলছল করে বয়ে যাচ্ছে। তার উপারে ইংল্যান্ডের সীমান্ত। জোয়ান শেষ নিশ্বাসটা ছাড়লো সিন নদীর জল দেখতে দেখতে। তারপর বন্ধ হয়ে গেল তার চোখ চিরতরে।
আগুন নিভে গেল। জোয়ানের মৃত শরীরটা নামানো হলো পিলার থেকে। তারপর মৃত শরীরেই আবারও জ্বালানো হলো আগুন। জ্বলতে জ্বলতে জোয়ানের শরীরটা কয়লার মতো হয়ে যায়। আবারও নিভে যায় আগুন। তখন শুকনো কাঠ যোগাড় করে তৃতীয়বারের মতো তার কয়লা হয়ে যাওয়া শরীরে আগুন জ্বালানো হয়। যাতে কেউ আর দাবি করতে না পারে, জোয়ান পালিয়ে বেঁচে গেছে।
সাল ১৪৫৭।
বৃদ্ধ নিকোলাস ঘরে ফিরে দেখে তার নাতি ইরোনাসকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রিয় নাতিকে খুঁজে না পেয়ে নিকোলাস ঘোড়া নিয়ে বের হলেন খুঁজতে। আশেপাশের লোকজনকে প্রশ্ন করে,
-হেই তোমরা আমার নাতি ইরোনাসকে দেখেছো?'
সবাই জবাব দেয়,
-নাহ্, দেখিনি।'
উত্তেজিত হয়ে বৃদ্ধ নিকোলাস ঘোড়া ছুটায় এদিক ওদিক। অনেকক্ষণ খোঁজার পর তিনি ইরোনাসকে দেখতে পান শহরের শেষ মাথায়। ওখানে জোয়ান অব আর্কের একটা ভাস্কর্য বানানো হয়েছিল কিছুদিন আগে। ওটার সামনে দাঁড়িয়ে এক ধ্যানে কী যেন ভাবছে ইরোনাস। বৃদ্ধ নিকোলাস নাতির প্রতি আর রাগ দেখালেন না। জোয়ানের প্রতি ইরোনাসের বুকে অসীম ভালোবাসা জন্মেছে, এই ভালোবাসাটা তিনি শেষ করতে চান না। আজীবন অটুট থাকুক। ঘোড়া থেকে নেমে নিকোলাস নাতির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। দাদুর অস্তিত্ব টের পেয়ে ইরোনাস বলে,
-দাদু, জোয়ান মরেনি। আমি এখনও তার অস্তিত্ব টের পাই ফ্রান্সের মাটিতে।'
নিকোলাস মৃদু হাসে নাতির কথা শুনে। নাতির কথায় সম্মতি দিয়ে বলে,
-হ্যাঁ ইরোনাস, জোয়ান মরেনি। সেদিন ওরা তাকে মারতে পারেনি। ফ্রান্সকে বাঁচিয়ে সে নিজের অমরত্ব নিশ্চিত করে গেছে...'




[[সমাপ্ত]]...



লেখা: ShoheL Rana 
 

Delivered by FeedBurner

a