Leave a message
> জোয়ান অব আর্ক পর্ব ৪
-->

জোয়ান অব আর্ক পর্ব ৪


সাল ১৪২৮।
প্রায় তিনটি বছর কেটে গেল। জোয়ানের প্রতীক্ষা তবু শেষ হয়নি। কমান্ডার রবার্ট বড্রিকটের খোঁজ করে চলেছে সে এখনও। এই তিন বছরে সে আরও সাহসী হয়েছে। ইংরেজদের প্রতি ক্ষোভ আরও বেড়েছে তার।
বাজার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল জোয়ান। প্রায় সে বাজারে আসে বিভিন্ন কাজে। বাজারের শেষ মাথায় এক দর্জির কাছে সে একটা যুদ্ধ পোশাক সেলাই করতে দিয়েছে। ওটা আনতে যাচ্ছে। আশেপাশে অনেক লোক নিজেদের মতো বেচাকেনা করছে রোদ মাথায় নিয়ে। আচমকা মানুষজন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগলো। বেশকিছু ঘোড়ার হ্রেষা রব শোনা গেল। ওদিকে তাকালো জোয়ান। দেখলো ইংরেজ সৈন্যরা বাজারে হামলা করেছে। মাঝেমাঝেই ওরা বাজারে হামলা করে লোকজনের মালামাল আর স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে যায়। আজও হয়তো তাই করবে। জোয়ান নিজের মতো হেঁটে চলে গেল নিজের পোশাকটি নিতে।
নিজের জান বাঁচাতে বাজারের অনেক লোক পালিয়ে গেছে বেচতে আসা মালামাল ফেলে রেখে। ইংরেজ সৈন্যরা মালগুলো নিজেদের ঘোড়ার গাড়িতে তুলতে লাগলো। যারা মাল দিতে চায়লো না, তাদেরকে তরবারির আঘাতে শুয়ে দিলো ওরা মাটিতে। তা দেখে কেউ কেউ ভয়ে নিজেদের মাল তুলে দিলো ওদের গাড়িতে। সব সম্পদ লুট করা হলে, ওদের দলপতি বিভৎস হেসে ওঠে চিৎকার করে বলে,
-এই ভূখণ্ড ইংল্যান্ডের দখলে। তাই সব সম্পদ যাবে ইংল্যান্ডে।'
দলপতির কথার জবাবে কেউ কিছু বলতে পারলো না সাধারণ জনগণ। তারপর সব সম্পদ নিয়ে চলে যেতে লাগলো ইংরেজরা। যেতে যেতে অনেকটা পথ চলে এলো ওরা। হঠাৎ দেখলো একটা কিশোরী মেয়ে তাদের পথ আটকে আছে কিছুটা দূরে। মেয়েটার গায়ে যুদ্ধ পোশাক। আর হাতে একটা ধনুক। ধনুকের তীর তাক করে আছে সে ওদের দিকে। তীরের ডগায় মশালের মতো আগুন জ্বলছে। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেয়েটা তীর ছুড়লো। ওরা ভাবতেও পারেনি মেয়েটা তাদের লুট করা সম্পদের উপরেই তীর ছুড়বে। তীরটা এসে লাগতেই তাদের লুট করা সম্পদে আগুন ধরে গেল। আগুনটা ছড়িয়ে পড়লো পুরো গাড়িতে। ঘোড়াগুলো চিৎকার করে লাফাতে লাগলো। ইংরেজ সৈন্যদের দলপতি অবাক হয়ে গেল মেয়েটার সাহস দেখে। ক্রোধান্বিত হয়ে সে প্রশ্ন করে,
-কে তুমি? তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।'
মেয়েটাও গলার তেজ বাড়িয়ে জবাব দিলো,
-জোয়ান... জোয়ান অব আর্ক। আমি বেঁচে থাকতে ফ্রান্সের সম্পদগুলো এভাবে লুট করে তোমাদের ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে দেবো না আর।'
দলপতি নিজ সৈন্যদের আদেশ দিলো,
-মেয়েটাকে ধরে নিয়ে এসো।'
দলপতির আদেশ পেয়ে কয়েকজন সৈন্য ঘোড়া থেকে নেমে জোয়ানের দিকে ছুটে গেল। জোয়ান আগেই প্রস্তুত ছিল। আরেকটা তীর তাক করলো সে ওদের দিকে। ওরা থেমে গেল। জোয়ান তীরের নিশানা আরেকটু ঘুরিয়ে ছেড়ে দিলো। মুহূর্তেই ছুটে গিয়ে তীরটা গেঁথে গেল দলপতির বুকে। দলপতি আর্তনাদ করে ওঠে পড়ে গেল ঘোড়া থেকে। তার এ অবস্থা দেখে সৈন্যরা ঘাবড়ে গেল। কী করবে বুঝে ওঠতে পারলো না। জোয়ান গলা উঁচু করে বললো,
-শিকার করলে দলের মাথাটাই আগে শিকার করবো।' বলেই এক লাফে ওঠে গেল সে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের ঘোড়ার উপর। তারপর ঘোড়া ছুটাতে লাগলো। ঘোড়া ছুটাতে ছুটাতে পেছনে ঘুরে আরও কয়েকটা তীর ছুড়লো। অব্যর্থ লক্ষ। ইংরেজের আরও কয়েকটা কুকুর লুটিয়ে পড়লো দলপতির মতো। জোয়ান নিজের ঘোড়া ছুটিয়ে আরও দূরে চলে যেতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর আরেকটা দল এলো ওখানে। ঘোড়া থেকে নেমে মৃত সৈন্যদের পর্যবেক্ষণ করলো ওরা। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে মৃতদের। তা দেখে দ্বিতীয় দলের দলপতি জিজ্ঞেস করলো,
-কী করে হলো এসব?
-একটা মেয়ে করেছে।' প্রথম দলের একজন জবাব দিলো।
-একটা মেয়ে করেছে, আর তোমরা মেয়েটার কিছুই করতে পারলে না?
-কোথা থেকে যেন মেয়েটা এসে হঠাৎ আক্রমণ করে বসে। আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাদের দলপতিকে তীর নিক্ষেপ করে। তারপর ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যেতে যেতে আরও কয়েকটা তীর ছুড়ে আমাদের সৈন্যদের উপর।
-মুখ থেকে এভাবে ফেনা বের হচ্ছে কেন?' মৃতদের ইশারা করলো দ্বিতীয় দলের দলপতি।
-মেয়েটা তীরে বিষ ব্যবহার করেছিল। তীর লাগার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিষক্রিয়া হয়ে মারা যায় এরা।
-কোনো সাধারণ মেয়ে না ও।' বিড়বিড় করলো দলপতি। তারপর সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বললো,
-মেয়েটাকে যেখানে পাও, জীবন্ত ধরে নিয়ে এসো আমার কাছে।
-যথা আজ্ঞা কমান্ডার কার্ডিনোস।'
তারপর দু দলের কয়েকজন সৈন্য এক হয়ে খুঁজতে চলে গেল জোয়ানকে।
সরাইখানায় তদারকি করছিলেন থমাস। তখন ইংরেজ সৈন্যের একটা দলকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে তাঁর চোখেমুখে ভয় ফুটে ওঠলো। দলটা এসে থমাসের সামনে দাঁড়ালো। একজন থমাসের মুখোমুখি হয়ে, কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
-জোয়ান তোমার বাসায় থাকে? তুমি তাকে আশ্রয় দিয়েছো?
-হ্যাঁ।' গলা কিছুটা কেঁপে ওঠলো থমাসের। জোয়ান নিশ্চয়ই এদের কোনো ক্ষতি করেছে। নয়তো এভাবে ওরা জোয়ানের খোঁজ করতে আসতো না।
-জোয়ান এখন কোথায়? তার সন্ধান দাও...' কড়া শুনালো ইংরেজ সৈন্যের কথা।
-আমি জানি না কোথায় সে। তাছাড়া সে কখন কোথায় যায় তার খোঁজ আমাদের জানা থাকে না। মাঝেমধ্যে কয়েকদিন হারিয়ে যায় কোথায় যেন।
-তুমি তাকে আশ্রয় দিয়েছো। তোমার বিপদে নিশ্চয়ই সে লুকিয়ে থাকতে পারবে না। তোমাকে নিশ্চয়ই বাঁচাতে আসবে।
-মানে?' ভীতি বাড়লো থমাসের চেহারায়।
-মানে তোমাকে এখন আমরা নিয়ে যাবো। তোমাকে যদি সে ভালোবাসে, তবে নিজেকে সে ধরা দেবে আমাদের কাছে।'
বলেই ওরা থমাসকে ধরে নিয়ে এলো বাইরে। তারপর ঘোড়ার সাথে বেঁধে নিয়ে চললো। বেশিদূর যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। ওদের সামনে কোথা থেকে যেন এসে দাঁড়ালো জোয়ান। জোয়ানকে দেখে ইংরেজ সৈন্যদের মুখে হাসি ফুটে ওঠলো। জোয়ান চিৎকার করে বললো,
-উনাকে ছেড়ে দাও। তোমাদের আমাকেই প্রয়োজন। এই যে আমি এসেছি।'
হাসতে হাসতে এক ইংরেজ সৈন্য বললো,
-ফাঁদ তাহলে কাজে লেগেছে। তোমার তীর আর তরবারি আমাদের দিকে ছুড়ে ফেলো। নিজেকে নিরস্ত্র করো। তারপর আমরা থমাসকে ছেড়ে দেবো।
-ঠিক আছে।' বলেই নিজের তরবারি আর তীর ছুড়ে ফেললো জোয়ান। তারপর ঘোড়া থেকে নামলো। ইংরেজ সৈন্যরা থামাসকে বাঁধনমুক্ত করলো। মুক্তি পেয়ে থামাস জোয়ানের সামনে এসে দাঁড়ালেন। জোয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, জোয়ানের চেহারায় কোনো ভয় নেই, নির্ভীক দাঁড়িয়ে আছে সে। থমাস জিজ্ঞেস করলেন,
-তুমি আমার জন্য নিজেকে ধরা দিলে কেন?'
-কারণ, আমি নিজের জন্য আপনাকে বিপদে ফেলতে পারি না।
-ওরা তোমার ক্ষতি করতে পারে।
-অদৃষ্টে যা আছে, তাই ঘটবে। আমার ঘোড়াটি নিয়ে চলে যান আপনি।'
তবুও থমাস দাঁড়িয়ে থাকেন স্তব্ধ হয়ে। কী জবাব দেবেন বুঝতে পারেন না তিনি। ইংরেজ সৈন্যরা এসে জোয়ানের গলায় তরবারি ধরে। তারপর জোয়ানকে বন্দী করে নিয়ে যেতে থাকে। জোয়ান চিৎকার করে বলে,
-অদৃষ্টে থাকলে আমাদের আবার দেখা হবে থমাস।'
থমাস বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন অনেকক্ষণ।
ছুটে চলেছে ইংরেজ সৈন্যেদের ঘোড়া। জোয়ান নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। মাঝেমাঝে চিৎকার করে ওঠছে সে বাঁধন ছাড়াতে না পেরে। তা দেখে ইংরেজ সৈন্যদের মুখে হাসি ফুটে ওঠছে। ওদের হাসি দেখে জোয়ান চিৎকার করে বলে,
-হাসছো কেন শয়তানের দল? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?'
-তোমাকে আমাদের কমান্ডার কার্ডিনোসের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।
-আমাকে এখনই মেরে ফেলো। যদি বাঁচিয়ে রাখো, তবে যিশুর কসম, ফ্রান্সের স্বাধীনতা দেখে যাবো।'
'হা হা হা' করে হেসে উঠে সৈন্যরা জোয়ানের কথা শুনে। হাসি থামিয়ে এক সৈন্য বললো,
-তোমার আত্মবিশ্বাস আছে। কিন্তু কখনও সেটা সম্ভব হবে না। ফ্রান্স আজীবন ইংল্যান্ডের দখলেই থাকবে।'
ক্রোধ বেড়ে গেল জোয়ানের। চিৎকার করে ওঠে আবার নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে সে। আচমকা কোথা থেকে তীর ছুটে এসে লাগলো কয়েকজন ইংরেজ সৈন্যের বুকে। ছিটকে পড়লো ওরা ঘোড়া থেকে। ঘোড়ার গতি থামালো বাকিরা। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো তখন আরেকটা সৈন্যদল। সংখ্যায় ওরা বিশাল। গায়ের পোশাকই বলে দিচ্ছে ফ্রান্সের সৈনিক এরা। ইংরেজ সৈন্যেদের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ চলতে লাগলো ওদের। ফ্রান্সের এক সৈন্য গিয়ে জোয়ানের বাঁধন খুলতে চায়লো। তাকে তরবারি দিয়ে আঘাত করতে গেল ইংরেজ এক সৈন্য। দুজনের মাঝে তরবারি লড়াই চলার এক ফাঁকে হঠাৎ ইংরেজ সৈন্যের তরবারি গিয়ে লাগলো জোয়ানের পেটে। আর্তনাদ করে ওঠলো জোয়ান। মুহূর্তেই ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো পেট থেকে। দুহাত দিয়ে পেট চেপে ধরলো জোয়ান। সেই মুহূর্তে ইংরেজ সৈন্যটার গলায় তরবারির কোপ বসালো ফ্রান্সের সৈন্যটা। গলা কেটে গেল তার। লুটিয়ে পড়লো সে নিচে। বাকিরাও ধীরে ধীরে পরাজিত হয়ে প্রাণ দিতে লাগলো ফ্রান্সের সৈন্যদের হাতে। ইংরেজ সৈন্যদের শেষ করার পর ফ্রান্সের সৈন্যরা নজর দিলো আহত জোয়ানের দিকে। একজন জোয়ানের দু'বাহু ধরে জোয়ানকে প্রশ্ন করলো,
-তুমি ঠিক আছো?'
জোয়ান জোরে নিশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করলো। মুখটা হা হয়ে গেল তার। বাতাস যেন ভারি হয়ে আসছে। সবকিছু যেন অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশে। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। চিৎকার করে ওঠলো এবার ফরাসি সৈনিক,
-ওকে এখনই নিয়ে চলো। জখমটা খুব বেশি। দেরি হলে বাঁচানো যাবে না।'
উনার কথা শেষ হতেই জোয়ান তার এক হাত ধরে কী যেন বলতে চায়লো।
-হ্যাঁ, বলো...' জোয়ানের হাত আঁকড়ে ধরে ভরসা দিলো সৈনিক। জোয়ান আবার বলতে চায়লো, কিন্তু মুখ দিয়ে কিছুই যেন বের হচ্ছে না তার। অনেক কষ্টে সে সৈনিকের চেহারার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
-আপনি কে?'
সৈনিক জবাব দিলো,
-আমি কমান্ডার রবার্ট বড্রিকট।'
কথাটা শুনতে পেল কি না জোয়ান, বুঝা গেল না। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল তার চোখ। কমান্ডার রবার্ট বড্রিকটকে চিন্তিত দেখালো। জোয়ানের ক্ষতস্থানটা কাপড় দিয়ে বাঁধলো সে। তারপর তাকে নিয়ে চললো নিজেদের সাথে।



চলবে...



লেখা: ShoheL Rana
 

Delivered by FeedBurner

a