Leave a message
> জোয়ান অব আর্ক পর্ব ৮
-->

জোয়ান অব আর্ক পর্ব ৮


জুলাই ০১, ১৪২৯।
রাজা সপ্তম চার্লস তার কমান্ডারদের নিয়ে সভায় বসেন রেইমস নগরীতে যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে। ৯ই মে লে তুরেল দুর্গ জয়ের পর তুরেল বুরুজ শহর ইংরেজমুক্ত হলে তাদের পরিকল্পনা ছিল রেইমস নগরীতে আক্রমণ করার। কিন্তু, মাঝখানে তাদের পরকল্পনায় ভিন্ন মোড় নেয়। জুন মাসেই পরপর ওরা তিনটা যুদ্ধে অংশ নেয় ইংরেজদের বিরুদ্ধে। তিনটাতেই জয় লাভ করে ওরা জারগিউ, মেউনগ এবং বারগুনডি দখল করে নেয়। এতগুলো বিজয়ের পর ওরা স্বপ্ন দেখতে থাকে পুরো ফ্রান্স স্বাধীন করার। রেইমস নগরীটা উদ্ধার করতে পারলেই ফ্রান্স তাদের স্বপ্ন পূরণের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। রেইমস নগরীটা যেহেতু ফ্রান্সের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই রাজা চার্লস ভেবেচিন্তে বলেন,
-আমাদের এ যুদ্ধটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জোয়ানের যেহেতু অল্প বয়স, আর সেনার সংখ্যাও বেশি, তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাদের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন ডিউক জন আলেনকন।' বলেই থামলেন চার্লস। তারপর সবার দিকে তাকালেন। কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকলো পুরো সভা। এরপর জোয়ান বলে ওঠলো,
-দৌপিন, আমি ডিউক জন আলেনকনের সাথে সেনাবাহিনীর যৌথ নেতৃত্ব প্রার্থনা করছি।'
জোয়ানের কথাটাও ফেলে দেয়ার মতো না। চার্লস তার বিষয়টা মাথায় নিলেন। কী যেন ভাবতে লাগলেন তিনি। তখন জন আলেনকন বলে ওঠলো,
-জি দৌপিন, জোয়ান ঠিকই বলেছে। আমাদের যৌথ নেতৃত্বে আমরা নিশ্চয়ই রেইমস পুনরুদ্ধার করতে পারবো।'
আলেনকনের কথা শুনে চার্লস তাকালেন ওর দিকে। আলেনকন আবার বলে ওঠলো,
-আমরা যে পরপর এতগুলো যুদ্ধে জয়ী হয়েছি, এতে জোয়ানের অবদানই ছিল সবচেয়ে বেশি। তার সাহস, নেতৃত্ব এবং যুদ্ধ কৌশল আমাদেরকে জয় এনে দিয়েছে।' বলেই জোয়ানের দিকে তাকিয়ে উপর নিচ মাথা দুলালো আলেনকন। জোয়ানের প্রতি সে কৃতজ্ঞ। জারগিউতে যখন যুদ্ধ চলছিল, তখন আলেনকন ইংরেজদের তরবারির নিচে পড়েছিল। সেই মুহূর্তে যদি জোয়ান তরবারি নিয়ে তাকে রক্ষা না করতো তবে আলেনকন জীবিত থাকতো না আর।
-ঠিক আছে, আমাদের সেনাবাহিনীর যৌথ নেতৃত্ব দেবে ডিউক জন আলেনকন এবং জোয়ান অব আর্ক।'
রাজার সিদ্ধান্ত শুনে সবার মুখে হাসি ফুটে ওঠলো।
রেইমস নগরীতে ইংরেজ কমান্ডার আর্ল অব সালিশবুরির কাছে একটা পত্র এসেছে রাজা হেনরির। পত্রতে রাজা জানিয়েছেন, জোয়ান অব আর্ককে যেভাবে হোক যেন বন্দী করে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। পত্রটা পড়ে কমান্ডার সালিশবুরি তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বললো,
-সৈন্যরা শত বছর ধরে এই ফ্রান্সে আমরা রাজত্ব করে এসেছি। কিন্তু পরপর বেশ কয়েকটা যুদ্ধে আমাদের সেনারা হেরে গেছে ফ্রান্সের কাছে। এর সবকিছুর জন্য একজনই দায়ী, আর সে হলো জোয়ান অব আর্ক। আমাদের রাজা হেনরি পত্র দিয়ে জানিয়েছেন, তাকে যেন আমরা বন্দী করে ইংল্যান্ডে নিয়ে যায়।
সেই মুহূর্তে গেইটরক্ষী এসে কথা বলার অনুমতি চাইলো। কমান্ডার সালিশবুরি অনুমতি দিলে গেইটরক্ষী বললো,
-কমান্ডার সালিশবুরি, ফ্রান্সের একজন যোদ্ধা এসেছে। নিজেকে সে 'জোয়ান অব আর্ক' বলে পরিচয় দিয়েছে।
-জোয়ান অব আর্ক!' নামটি বিড়বিড় করে চমকে ওঠলো সালিশবুরি। তারপর কিছুই না ভেবে নিজেই দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল। নামটিতেই কেমন যেন একটা আকর্ষণ আছে। গেইটের দরজা খুলতেই সালিশবুরি দেখলো অল্প বয়সী ফ্রেঞ্চ যোদ্ধাকে। ঘোড়ায় বসে আছে সে নির্ভীকভাবে।
-তুমিই জোয়ান অব আর্ক?' প্রশ্ন করলো সালিশবুরি।
-হুমম।' মাথা দুলালো জোয়ান। তারপর ঘোড়া থেকে নামলো সে। সালিশবুরি কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। যাকে বন্দী করার আদেশ দিছেন স্বয়ং রাজা হেনরি, সে নিজেই এসে উপস্থিত হয়েছে। তাও সম্পূর্ণ একা। এই মুহূর্তে কী করা উচিত সালিশবুরির মাথায় ধরলো না। কী যেন ভেবে সৈন্যদের আদেশ দিলো,
-বন্দী করো ওকে।'
সাথে সাথে কয়েকজন সৈন্য গিয়ে বল্লম ধরলো জোয়ানের চারপাশে। জোয়ান মৃদু হাসলো, ভয় পেলো না একটুও। সালিশবুরির দিকে তাকিয়ে বললো,
-কমান্ডার সালিশবুরি, আমি এখানে নিশ্চয়ই শুধু শুধু নিজেকে বিপদে ফেলতে আসিনি। কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে বলেই এসেছি।'
সালিশবুরি সৈন্যদের ইশারা করলো জোয়ানকে ছেড়ে দিতে। ওরা বল্লম নামিয়ে নিলে জোয়ান বললো,
-চলুন, ভেতরে গিয়ে নির্জনে কথা বলা যাক।'
সালিশবুরি জোয়ানকে নিয়ে ভেতরে এলো। তারপর মুখোমুখি দাঁড়ালো দুজন। জোয়ানের ঠোঁটে মৃদু হাসিটা তখনও লেগে আছে। সালিশবুরির কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো। এ আবার কী বলতে এসেছে, কী এমন বিষয় যা তার জীবনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
-আমি জানি আপনারা আমাকে বন্দী করতে পারলেই বাঁচেন। কিন্তু, আমি যদি আমার বদলে রাজা চার্লসকে আপনাদের হাতে তুলে দেই?' কথাটা বলেই জোয়ান তাকালো সরাসরি সালিশবুরির চোখের দিকে। সালিশবুরিকে চমকাতে দেখা গেল। কপালের ভাজটা আরেকটু প্রসারিত হলো।
-রাজা চার্লসকে আমাদের হাতে তুলে দেবে মানে?' পুনরায় প্রশ্ন করলো সালিশবুরি। জোয়ানের কথাটা যেন তার বোধগম্য হচ্ছে না সহজে।
-মানে রাজা চার্লস, যিনি ফ্রান্সের রাজা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করবেন। আমার চেয়ে নিশ্চয়ই রাজা চার্লস আপনাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভেবে বলুন, কাকে চান? আমাকে চায়লে এখনই বন্দী করুন আমাকে, আর যদি রাজা চার্লসকে চান, তাহলে আমাকে সাহায্য করুন।'
কয়েকমুহূর্ত ভাবতে দেখা গেল কমান্ডার সালিশবুরিকে। তারপর বিড়বিড় করে ওঠলো,
-কী সাহায্য?'
-সাহায্যটা হলো, আমাকে এবং আমার সৈন্যদেরকে এখানে আশ্রয় দিতে হবে। ফ্রেঞ্চদের সাথে এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করার পর নিশ্চয়ই ওরা আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে না।
-তা ঠিক। কিন্তু তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করবে কেন? আমাদের হাতেই কেন রাজা চার্লসকে তুলে দিতে চাইছো?'
-একবার ভাবুন, যে আমি ফ্রান্সকে একের পর এক বিজয় এনে দিয়েছি, সেই আমার মূল্যটা ওদের কাছে কতখানি থাকা দরকার। কিন্তু তা আমি পেলাম কই? ওরা এখন রেইমস নগরী বিজয় করার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু রাজা চার্লস সেনাবাহিনীর নেতৃত্বটা আমাকে না দিয়ে দিয়েছেন ডিউক জন আলেনকনকে। এটা আমার জন্য অপমান নয়, বলুন?
-অবশ্যই অপমান।
-তাহলে আমি কেন ওদের পক্ষে যুদ্ধ করবো? তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি রাজা চার্লসকে আপনাদের কাছে তুলে দিয়ে ইংল্যান্ডের আনুগত্য মেনে নেবো।
-সাব্বাশ! এই না হলে সাহসী যোদ্ধা? এতদিন তোমার নাম শুনেছি শুধু, আজ স্বচক্ষে দেখছি তোমার সাহস এবং বুদ্ধিমত্তা। আমাদের রাজা হেনরির কাছে নিশ্চয়ই এর উপযুক্ত পুরস্কার পাবে তুমি।
-আমাকে এবং আমার সৈন্যদেরকে আশ্রয় দিলেই আমি কৃতজ্ঞ থাকবো রাজা হেনরির কাছে। এতদিন ফ্রান্সের পক্ষে যুদ্ধ করার ফলে বেশকিছু সৈন্য আমার আনুগত্য মেনে নিয়েছে। তারাও আসতে চায় আমার সাথে। আমরা একসাথে তারপর যুদ্ধ করতে পারবো ইংরেজদের পক্ষে।
-তোমার মতো সাহসী আমাদের সাথে থাকলে আমরা হারানো নগরীগুলো আবার ফিরে পাবো।' খুশি হতে দেখা গেল সালিশবুরিকে। জোয়ান বুকে হাত দিয়ে মাথা দুলিয়ে কৃতজ্ঞতা জানালো। তারপর কমান্ডার সালিশবুরি হাসতে হাসতে নিজেই এগিয়ে দিলো জোয়ানকে গেইটের দিকে। তা দেখে ইংরেজ সেনারা হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো।
রেইমস নগরীর প্রবেশদ্বার থেকে একটু দূরে অবস্থান করছে জোয়ান তার সৈন্যদের নিয়ে। সাথে বন্দী অবস্থায় আছে রাজা চার্লস। চার্লস চিৎকার করে ওঠলে জোয়ান একটা ঘুষি চালায় চার্লসের মুখে। থুতনি ফেটে রক্ত বের হয় তার। এর আগেও বেশ কয়েকবার মার খেয়েছে চার্লস। এখন আর মার হজম করার মতো শক্তি তার নেই। সৈন্যরা তাঁকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে, সেও চললো সাথে সাথে। তাকে নিয়ে ওরা রেইমস নগরীতে প্রবেশ করলে ইংরেজ সেনাদের উল্লাসধ্বনি শোনা গেল,
-জয়, জোয়ান অব আর্কের জয়।'
হাসিমুখে ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে এলো কমান্ডার সালিশবুরি। ঘোড়া থেকে নেমে হাসতে হাসতে দাঁড়ালো জোয়ানের সামনে। তারপর জোয়ানের কাঁধ চাপড়ে বললো,
-সাব্বাশ আমার সাহসী বীর, তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছো, রাজা চার্লসকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছো। এবার আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষার পালা। তোমাকে এবং তোমার সেনাদের স্বাগতম আমাদের দলে।'
জোয়ান বুকে হাত রেখে মৃদু হেসে কৃতজ্ঞতা জানালো। বন্দী অবস্থায় রাজা চার্লস জোয়ানের দিকে থুথু ফেলে বললো,
-বিশ্বাসঘাতক। তোমার উপর আমি ভরসা করেছিলাম। আর তুমিই আমাদের বিশ্বাসটা বিক্রি করে দিলে এভাবে?'
জোয়ান ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে আবারও ঘুষি চালালো চার্লসের মুখে। চার্লসের চোখ মুখ দিয়ে জল বের হলো। আবারও জোয়ান ঘুষি চালাতে গেলে কমান্ডার সালিশবুরি তাকে বাঁধা দিয়ে বলে,
-শান্ত হও জোয়ান, শান্ত হও।'
জোয়ান চিৎকার করে বললো,
-বন্দী করো এই ফরাসি পাপিষ্ঠকে।'
জোয়ানের আদেশ পেয়ে কয়েকজন ইংরেজ সেনা কারাগারে নিয়ে চললো রাজা চার্লসকে।
রাত নেমেছে রেইমস নগরীর বুকে। নগরীর ইংরেজ সেনারা ফুর্তিতে ব্যস্ত। রাজা চার্লসকে বন্দী করতে পারায় তারা উল্লাস করছে। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে জোয়ানের ফ্রেঞ্চ সেনারাও। জোয়ানও কিছুক্ষণ মজা করছিল তাদের সাথে। তারপর হেঁটে চলে গেল কারার দিকে। দুজন কারারক্ষী তখন পাহারা দিচ্ছিল রাজা চার্লসকে। জোয়ান এগিয়ে গেল তাদের দিকে। কারারক্ষীদের উদ্দেশ্যে বললো,
-খুলো এটি।'
একজন কারার দরজা খুলে দিলো। জোয়ান কারারক্ষীদের উদ্দেশ্যে আবার বললো,
-ঠিকঠাক পাহারা দেবে, যেন পালাতে না পারে।'
-যথা আজ্ঞা, কমান্ডার জোয়ান।' একসাথে উচ্চারণ করলো কারারক্ষীরা। ভেতরে প্রবেশ করলো জোয়ান। তাকে দেখে মুখ তুলে তাকালো রাজা চার্লস। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জোয়ান বিড়বিড় করে বললো,
-ক্ষমা চাচ্ছি দৌপিন, আঘাতটা একটু বেশি হয়ে গেছে।'
রাজা চার্লস নিজেকে সামলিয়ে বললেন,
-আমি ঠিক আছি, তোমাদের খবর বলো।'
জোয়ান মৃদু হেসে ভরসা দিলো রাজা চার্লসকে,
-আমরা ঠিকঠাক অবস্থান নিয়েছি দৌপিন। ওদের আস্থা অর্জন করেছি আমরা। এবার সুযোগ বুঝে আক্রমণ করবো ডিউক জন আলেনকন সৈন্য নিয়ে এলেই।'
রাজা চার্লসও মৃদু হাসলেন। সব আঘাত যেন ভুলে গেলেন হঠাৎ জোয়ানের কথা শুনে।



চলবে...



লেখা: ShoheL Rana 
 

Delivered by FeedBurner

a