> প্রণয়িনী পর্ব ৩ - ভালোবাসার গল্প - Love Story Bangla - প্রেমের গল্প - Bangla Love Story - দুষ্টি মিষ্টি প্রেমের গল্প
-->

প্রণয়িনী পর্ব ৩ - ভালোবাসার গল্প - Love Story Bangla - প্রেমের গল্প - Bangla Love Story - দুষ্টি মিষ্টি প্রেমের গল্প

|৩|

লাবণ্যকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো কৌশিক। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলল,

' কী ব্যাপার বলুন তো? নাটক দেখলেন অথচ মন্তব্য না দিয়েই পালালেন। আমাদের উপর এ বড় অন্যায়।' 

লাবণ্য হেসে বলল,

' আপনাদের নাটকে মন্তব্য করার মতো বুকের পাটা আছে নাকি আমার? আমি এতো জ্ঞানী নই। তবে আপনাদের অভিনয় দক্ষতা চমৎকার। এতো জীবন্ত!' 

' প্রসংশা করছেন তবে?' 

' না করে উপায় আছে?' 

কৌশিক হেসে ফেলল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,

' চা না কফি? চলুন, আজ আমি খাওয়াব।' 

' কোন উপলক্ষে? প্রসংশা করলাম বলে?'

' উঁহু। বদনাম না করে মান বাঁচিয়েছেন বলে।' 

লাবণ্য হেসে ফেলল। একটা চেয়ার টেনে বসবার উদযোগ করে বলল,

' তাহলে তো আমারও আপনাকে খাওয়াতে হয়৷ কাল ওমন ফাঁকা প্রসংশা করলেন যে!' 

লাবণ্যর মুখোমুখি চেয়ারে ঠেস দিয়ে আহত কন্ঠে বলল কৌশিক, 

' আপনি খুব নিষ্ঠুর লাবণ্য। অযথা দোষারোপ করছেন। গান আর সুর দুটো ভিন্ন ব্যাপার। গানের ভাষা না বুঝলে যে সুরও ভালো লাগা যাবে না, এমন তো নয়। আমি চিত্রকর্মের ভাষা বুঝি না বলে সুরের প্রসংশা করেছি। সুব্রত ভাষা বুঝে বলে ভাষার সমালোচনা করেছে। দু'জনের মন্তব্য দুদিক থেকে যথার্থ। কাউকেই মিথ্যাচারের দায় দেওয়া যায় না।' 

' আচ্ছা! আপনি জিতলেন। এবার চা খাওয়া যাক?' 

কৌশিক হাসল। পেছন ফিরে নিজেদের টেবিলটি দেখিয়ে বলল,

' আমাদের টেবিলে এসে বসুন না। আমরা চিত্রের ভাষা না বুঝলেও আড্ডার ভাষায় খুব একটা খারাপ না। একটা সন্ধ্যা কাটানোর জন্য যথেষ্ট।'  

লাবণ্য তাদের টেবিলের দিকে তাকাল। সুব্রতসহ সকলেই গল্পরসে মশগুল। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে না। লাবণ্যর অস্বস্তি হচ্ছে। হৃদয় কাঁপানো মানুষটির কাছে বসার ইচ্ছে যেমন হচ্ছে, তেমনই হচ্ছে ঘোর অনিচ্ছা। অস্বস্তি। সেখানে বসে কতটুকু স্বাভাবিক থাকতে পারবে লাবণ্য? কী কথা বলবে? তাদের পরিচিত আড্ডায় নিজেকে উটকো, অযথা মনে হবে না? কৌশিকের প্রস্তাব এড়িয়ে মৃদু হাসল লাবণ্য,

' আজ নয়। প্রচন্ড মাথা ধরেছে। অন্য কোনোদিন নাহয়?' 

' আচ্ছা। জোর করছি না। কিন্তু, মাথা ধরা যে আড্ডায় যোগ দেবার কঠোর নিমন্ত্রণ, জানেন তো? সব রোগ যাপনের বিচিত্র কিছু পদ্ধতি আছে। মাথা ধরা রোগ সারে আড্ডায়। জ্বর সারে অবসরে।' 

' বাজে কথা।' 

' আরে, সত্যি বলছি।' 

' তো, আড্ডায় যোগ দিতে হবেই বলছেন?' 

কৌশিক লাবণ্যর মুখের দিকে চেয়ে হাসল। লাবণ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ' চলুন, মাথা ধরা সারানো যাক।' 

সুব্রতদের টেবিলে তখন  বুদ্ধদেব বসু আর জীবনানন্দকে নিয়ে তর্ক চলছে। বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদিত জীবনানন্দের 'ঝরা পালক' নিয়ে চলছে তীব্র বাক-বতিন্ডা। 

' শুধু সজনীকান্ত দাসের কথা কেন বলছ? রবিবাবু স্বয়ং জীবনানন্দের সমালোচনা করতেন। ১৩২২ বঙ্গাব্দের ২২ অগ্রহায়ণ রবিবাবু যে চিঠিটা লিখেছিলেন, পড়োনি?' 

সুব্রত বলল,

' তবে সজনীকান্ত দাসের সমালোচনা যেমন নির্দয় ছিল ততটা নির্দয় ছিল না সেই চিঠি।' 

লাবণ্যর উপস্থিতিতে উত্তেজনায় ভাটা পড়ল। সুব্রত কথা থামিয়ে লাবণ্যর দিকে তাকাল। নিতান্তই পরিচিতের মতো বলল,  

' আপনি তো লাবণ্য। দুপুরে ব্যস্ত ছিলাম বলে আলাপ হয়ে উঠেনি। এক্সিবিশন কেমন যাচ্ছে?' 

সুব্রতর এমন আন্তরিক সূচনা লাবণ্যকে দলের ভেতর চুষে নিল এক লহমায়৷ চোখের পলকে হয়ে উঠল তাদেরই একজন। টেবিলে চায়ের কাপ খালি হলো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আঠারশো ফুট উঁচুতে ধোঁয়া উঠা গরম চায়ে চুমুকের পর চুমুক পড়ল। এবার তর্ক উঠল পিকাসো নিয়ে। তারপর এলো জয়নুল। রঙিন বাতির তলায় ধোঁয়ার মতো ভাসতে লাগল ছন্নছাড়া মেঘ। লাবণ্য মুগ্ধ হলো। অপরিচিতকে এক লহমায় প্রাণের কাছে টেনে নেওয়ার ওই ঐশ্বরিক শক্তিতে তুলতুলে এক মায়া এলো। মায়া নাকি আসক্তি? লাবণ্য নীরব শ্রোতা হয়ে শুনে গেল একের পর এক কথামালা। ঘন্টাখানেক বাদে নামাজের নামে উঠে গেল সুব্রত। লাবণ্য এতোক্ষণ চুপই ছিল। এবার বেশ অবাক হলো। সুব্রতর সাথে আলাদাভাবে গল্প জমে উঠেনি তার। তবুও সুব্রতর অনুপস্থিতি নরম মেঘের মতোই ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেল মন। মাঝি বিহীন নৌকো যেমন চলে। ঠিক তেমনই উদ্দেশ্যহীনভাবে এগিয়ে চলল আড্ডা। কেমন বিষাদ, নিরামিষ, প্রাণহীন। তারপর আচমকা থেমে গেল। ভেঙে গেল আসর। কৌশিক যখন লাবণ্যকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলো তখন আর কৌতূহল ধরে রাখতে পারল না লাবণ্য। অতিরিক্ত কৌতূহলটুকু ডেকে খুব সাধারণ গলায় প্রশ্ন করার চেষ্টা করল,

' সুব্রতবাবু যে ধর্মপ্রাণ মুসলিম দেখে বুঝার উপায় নেই। চাল-চলনে বেশ আধুনিক।' 

কৌশিক লাবণ্যর প্রশ্নটাকে স্বাভাবিকভাবেই নিল। কৌতুক করে বলল,

' কেন? আধুনিকদের কী ধর্মপ্রাণ হতে নেই? আপনি তো মশাই আধুনিকদের বেশ বেকায়দায় ফেলে দিচ্ছেন।'

লাবণ্য বিব্রত হয়ে বলল,

' না, না। আমি তেমনটা বলছি না।'

' তাহলে কেমনটা বলছেন?' 

কৌশিকের ঠাট্টা বুঝতে পেরে হাসল লাবণ্য। কৌশিক সিঁড়ির গোড়ায় এসে উত্তর দিল,

' সুব্রত যে খুব ধর্মপ্রাণ তেমনটা নয়। তবে, ওয়াক্ত হিসেবে নামাজ পড়া তার অভ্যেস। জঙ্গল, পাহাড়, সমুদ্র, সমতল যেখানেই থাকুক এই কাজটা সে ঠিকঠাক করে।' 

লাবণ্য প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। মুখ নিচু করে অস্থির চোখে এদিক-ওদিক তাকাল। বারবার মনে হতে লাগল, এই বুঝি ধরা পড়া গেল অনুভূতি। কৌশিক বুঝে গেল সব।  

সেদিন রাতে ভালো ঘুম হলো না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে আচমকায় খুব অভিমান হলো লাবণ্যর। উপলব্ধি করল, প্রথম আলাপেই অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে সর্ব সাধারণের পর্যায়ে নামিয়ে আনাটা সুব্রতর চারিত্রিক  মাহাত্ম্য নয় বরং দায় মুক্তির পদ্ধতি মাত্র। সুব্রত জানে, সাধারণের উপর কোনো দায় থাকে না। অপরিচিত, অর্ধ পরিচিতের মতো অযথা গুরুত্ব দেওয়ার বাহুল্য থাকে না। সুব্রতও কী তাই করল না? ভরা আড্ডায় লাবণ্যকে সাধারণের পর্যায়ে নামিয়ে এনে খুব সূক্ষ্মভাবেই এড়িয়ে গেল না? লাবণ্য অপমানিত বোধ করল। সুব্রতর প্রতি রাগ হলো। সব থেকে রাগ হলো নিজের ওপর। আড্ডার সময়টুকু মনে করে আত্মতুষ্টি এলো না৷ স্মার্ট লাবণ্যর হঠাৎ এমন বোকা আচরণে মেজাজ খারাপ হলো। বারবার মনে হতে লাগল, কেন গেলাম সেখানে? কেন বসলাম আড্ডায়? লাবণ্যর ঘুম উড়ে গেল। সুব্রতর প্রেমে পড়াটাই তার কাছে মারাত্মক হ্যাংলাপনা বলে মনে হলো। আত্মগর্বে আঘাত হানল তীক্ষ্ণ কিছু সুচ। সেই রাতদুপুরে, বিষণ্ন রাগ কমাতে আবারও রঙ-ক্যানভাস নিয়ে বসল লাবণ্য। নিজের ভাগের রাগটুকু নির্দোষ সুব্রতর কাঁধে চেপে আত্মতুষ্টির চেষ্টা চালাল। রঙ মাখামাখি হাতখানি চলতে লাগল দ্রুত। যেন, দগদগে সেই রাগটুকুকেই ক্যানভাসে ঢেলে দিতে চাইছে লাবণ্য। আঁকতে চাইছে রাগেরই কোনো প্রতিমূর্তি। 

আকাশে যখন লালচে আভা ছড়াল। বারান্দায় এসে পড়ল সোনালি আলোর কিরণ। তখন গিয়ে নিজেকে মনে পড়ল লাবণ্যর। সচকিত হয়ে ক্যানভাসের দিকে তাকাল। ক্যানভাস জুড়ে তখন রঙিন রঙের ছড়াছড়ি। আচ্ছন্ন লাবণ্য ভাবল, তবে কী রাগের রঙ ভীষণ রঙিন?ভীষণ কালো? হাত মুখে পানি ঢালতে ঢালতে লাবণ্য  সিদ্ধান্ত নিল, সুব্রতর কথা আর ভাববে না। নিজের মনে অন্যকারো প্রাধান্য স্বাধীনতার খর্ব। এ তো মেনে নেওয়া যায় না। নিজেকে মনঃ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে এক্সিবিশনের জন্য বেরিয়ে আসতেই অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা ঘটে গেল। নাজমুল ভাই ও অন্যান্যদের সাথে লাউঞ্জে পৌঁছাতেই সুব্রতর মুখোমুখি হয়ে গেল সে। সাথে সাথেই মন পাঁজরে তীব্র এক ধাক্কা খেল। চোখ দুটো চুম্বকের মতো সেদিকেই চলতে চাইল বারবার। ধুরু ধুরু বুকে লাবণ্য খেয়াল করল, তার দৃঢ় মনোবল, প্রতিজ্ঞা, বিশ্বাস সবই কেমন ভেসে গেল। সুব্রত পরিচিত হাসি হেসে বন্ধুসুলভ কন্ঠে বলল,

' আরে আপনি! আপনাকেই খুঁজছি। শুনুন, আপনার একটা কাজ আছে।' 

লাবণ্য প্রথমে বিস্মিত পরে স্তম্ভিত চোখে চাইল। ক্ষণিকের জন্য থেমে গেল হৃৎস্পন্দন। নিজের অপ্রস্তুত অবস্থাটা আড়াল করে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, 

' কাজ? আমার কী কাজ?'  

সুব্রত নাজমুলদের দিকে এক নজর চেয়ে বলল,

' এখন তো হাতে সময় নেই। বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। সন্ধ্যায় আড্ডায় আসছেন তো? কাজটা বরং তখনই বলব।' 

এটুকু বলে, লাবণ্যকে মহাশূন্যে ভাসমান রেখেই জায়গাটা থেকে সরে গেল সুব্রত। নাজমুল চোখ ছোট ছোট করে চাইল। লাবণ্যর কানের কাছে ঝুঁকে এসে সন্দিহান কন্ঠে শুধাল,

' কাহিনী কী বল তো? এই নাটকের ছেলেদের সাথে এতো সখ্যতা তোমার কখন হলো? পূর্ব-পরিচিত নাকি ইন্সটেন্ট?' 

লাবণ্য উত্তর দিল না। কপালে গাঢ় ভাঁজ নিয়ে আচ্ছন্নের মতো হেঁটে গেল এক্সিবিশন গ্রাউন্ড পর্যন্ত। গলা শুকিয়ে গেল। বুক ধরফর করতে লাগল। ক্ষণপূর্বের প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গিয়ে ভাবতে বসল সুব্রতর কথা। সুব্রত কীসের কাজের কথা বলল তাকে? লাবণ্যর সাথে তার কীসের কাজ ? আশ্চর্য! সেদিন আর এক্সিবিশনে মন বসল না লাবণ্যর। বারবার ঘুরেফিরে সুব্রতকেই ভাবল সে। তীব্র উত্তেজনায় দুপুরে খাওয়া হলো না। চোখ দুটো ঘুরতে লাগল ঘড়ির কাটায় কাটায়। 




চলবে...




Writer:- নৌশিন আহমেদ রোদেলা 


NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner