> প্রণয়িনী পর্ব ৪ - ভালোবাসার গল্প - Love Story Bangla - প্রেমের গল্প - Bangla Love Story - দুষ্টি মিষ্টি প্রেমের গল্প
-->

প্রণয়িনী পর্ব ৪ - ভালোবাসার গল্প - Love Story Bangla - প্রেমের গল্প - Bangla Love Story - দুষ্টি মিষ্টি প্রেমের গল্প

|৪| 

সন্ধ্যায় সুব্রতর সাথে দেখা হতেই সে বলল, 

' শুনুন, আপনাকে একটা ছবি আঁকতে হবে।' 

লাবণ্য অবাক চোখে তাকাল। ছবি আঁকতে হবে? কীসের ছবি আঁকবে লাবণ্য? সুব্রতর কোনো ছবি? লাবণ্য তো অনেক আগেই সুব্রতর অগোচরে সুব্রতর পোট্রের্ট এঁকে ভরিয়ে ফেলেছে ক্যানভাস। নতুন করে কী আঁকবে সে? লাবণ্য তার নিজস্বতা ধরে রাখার চেষ্টা করে ভুরু বাঁকাল, 

' ছবি! কী ধরনের ছবি?' 

' একদম সাধারণ ছবি। তবে ছবিটা আঁকতে হবে জ্যোৎস্না রাতে। খোলা আকাশের নিচে।' 

লাবণ্য সরু চোখে চাইল। বিভ্রান্ত হয়ে বলল,

' ছবি আঁকতে জ্যোৎস্না রাত লাগবে? জ্যোৎস্না রাত ছাড়া ছবি আঁকা যাবে না?' 

' না। যাবে না।' 

লাবণ্য সন্দিগ্ধ চোখে চাইল। এহেন অদ্ভুত কথা ইতোপূর্বে শুনেছে বলে মনে পড়ল না। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

' ছবির থেকে ছবি আঁকার পরিবেশকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, সুব্রতবাবু?' 

'সুব্রতবাবু' সম্বোধনটা শুনে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল সুব্রত। পরমুহূর্তেই হেসে মাথা নাড়ল, 

' হ্যাঁ হচ্ছে। আজ যে পূর্ণিমা জানেন তো?'  

' জানতাম না। এখন জানলাম। চাঁদ, সূর্যের হিসেব রাখার অভ্যাস নেই।' 

সুব্রত বলল,

' অভ্যেস না থাকলেও ক্ষতি নেই। সবাইকে চাঁদ-সূর্যের হিসেব রাখতে হবে এমন বাধ্যবাধকতাও নেই। চাঁদ-সূর্য রেখে এবার বরং কাজের কথায় আসা যাক?' 

লাবণ্য একই সাথে দ্বিধা ও আগ্রহ নিয়ে তাকাল। সুব্রত সুন্দর হেসে বলল, 

' পাহাড়ি জ্যোৎস্না ভয়াবহ সুন্দর। আপনাকে আজ এই ভয়াবহ সুন্দর জ্যোৎস্নার লাইভ ফটো আঁকতে হবে। পাহাড়ের গা জ্যোৎস্নায় ভাসবে। জ্যোৎস্নার আলোয় আগুন জ্বেলে রিহার্সালে নামবে প্রাণোচ্ছল যুবক-যুবতীর দল। পাহাড় থাকবে নিস্তব্ধ অথচ প্রেমময়। চারপাশের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম বিষয়গুলোও তুলে আনতে হবে ছবিতে।  তারপর কৃত্রিম জ্যোৎস্না ও প্রকৃতি দুটোকে একই সাথে ফ্রেমবন্দী করব আমি। আপনার চোখে একটা প্রেমময় ব্যাপার আছে। আশেপাশের সবকিছুতেই আপনি খুব কোমল চোখে তাকান। এই দৃষ্টিটা ক্যাপচার করতে পারলে দারুণ হতো। জ্যোৎস্নার প্রেমে ডুবে জ্যোৎস্নারই ছবি আঁকছে এক জ্যোৎস্নাময়ী মানবী। চমৎকার না?' 

লাবণ্য হতভম্ব, 

' মানে!' 

সুব্রত ব্যস্ত হয়ে বলল,

' ব্যস্ত হবেন না। আপনার অনুমতি ছাড়া আপনার কোনো ছবি নেওয়া হবে না। সেক্ষেত্রে শুধু পেইন্টিংটাই থাকবে। এক্সিবিশন টাইমে এমন একটা প্রস্তাব নেহাৎ-ই বিরক্তিকর। তবুও, আই ইনসিস্ট।' 

লাবণ্য ঘাড় ফিরিয়ে কৌশিকের দিকে তাকাল। কৌশিক অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

' আমাদের পরিচালক মশাই প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার কী না? ওর জ্যোৎস্না নিয়ে বেশ কিছু সিকুয়েন্স প্রয়োজন। তবে আপনি না চাইলে সুব্রত আপনাকে জোর করবে না।' 

লাবণ্যর ভেতরটা বিরক্তিতে তিক্ত হয়ে উঠল। সুব্রতর দিকে চেয়ে কঠোর কন্ঠে বলল,

' সহজ কথায়, আপনি আপনার ফটোগ্রাফিতে আমায় মডেল বানাতে চাইছেন, তাই তো?' 

সুব্রত চমকে উঠল। পুরু ভুরু জোড়া কুঁচকে লাবণ্যর মুখের দিকে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

' ব্যাপারটা আপনি যেভাবে দেখছেন তেমন নয় লাবণ্য। আপনি আমাকে খুব খারাপভাবে নিচ্ছেন। পাহাড়ি জ্যোৎস্নাগুলো ভয়াবহ সুন্দর হয়। আমি ভেবেছিলাম, পাহাড়ি জ্যোৎস্নায় আপনিও আঁকার মতো দারুণ কিছু সাবজেক্ট পেয়ে যেতে পারেন। এই নিয়ে হয়তো ছবিও আঁকতেন। দৃশ্যটা যদি ঘরের ভেতর না এঁকে, বাইরে বসে আমার ইন্সট্রাকশন মতো আঁকেন তাহলে আমারও একটু সুবিধা হতো। আমিও একটা সাবজেক্ট পেয়ে যেতাম। আপনি এতোটা বিরক্ত হবেন জানলে কখনওই বলতাম না। বিব্রত করার জন্য দুঃখিত। আচ্ছা, বাদ দিন।' 

লাবণ্যর মন খারাপ হয়ে গেল। সুব্রত যতটা সহজভাবে ব্যখ্যা করল, নিজে ততটা সহজ হতে না পারায় অতিশয় বিরক্ত হলো। কিন্তু কী-ই বা করতে পারতো লাবণ্য? সারাদিন ছটফট করার পর সুব্রত যখন এমন একটা প্রস্তাব করলো পর্বতসম আত্মসম্মানে তীক্ষ্ণ আঘাতটা তখনই লেগে গেল। লাবণ্য সুন্দরী, উচ্চ শিক্ষিতা। নিঃসন্দেহে কামনীয়। অথচ সুর্বতের দৃষ্টি বন্ধুর মতো শীতল। কথাবার্তায় চাওয়া পাওয়া, আবেগের চিন্হটুকু নেই। সুব্রতর শীতল ব্যবহার লাবণ্যর অহংকারে সূক্ষ্ম আঘাত করল বলেই হয়তো তার কথায় ফুটে উঠল স্পষ্ট অহংকারের ছাপ! লাবণ্য নিজের আচরণে নিজেই বিস্মিত হলো। সংকুচিত হয়ে পড়ল। অথচ সুব্রত হাস্যোজ্জল। প্রাণ খুলে হাসছে। আড্ডা চলছে। ভূ-পৃথিবীর কোনো কিছুই যেন তাকে আটকে রাখবার নয়। তাকে অপমানিত, লাঞ্চিত করবার নয়। রাত আটটা বাজতেই আকাশের বুকে বিশাল এক চাঁদ উঠল। লাউঞ্জের জানালা দিয়ে হলদেটে চাঁদের দিকে আনমনা হয়ে চেয়ে রইল লাবণ্য। আকাশটা যেন ধপ করে নেমে এলো মাথার উপর। হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেওয়া যাবে পূর্ণমাসী চাঁদ। আড্ডা শেষে সরাসরিই প্রস্তাব দিয়ে বসল কৌশিক,

' আজ আমাদের সাথে ডিনার করুন লাবণ্য। আজ পূর্ণিমা। রিহার্সেলের পর সবাই মিলে গান, আড্ডা চলবে। আপনার খারাপ লাগবে না।' 

সুব্রতও সপ্রতিভ কন্ঠে বলল,

' হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমাদের দলে মেয়েরাও আছে। আপনার অস্বস্তি হওয়ার কথা নয়। রাতে বার্বিকিউ করা হবে। ইউ ক্যান জয়েন আস। চলুন সবাই মিলে আজ পাহাড়ি পূর্ণিমা যাপন করি।' 

ওমন একটা ঘটনার পর। লাবণ্যর ওমন রূঢ় ব্যবহারের পর। সুব্রতর এমন আত্মভোলা আন্তরিক ব্যবহারে অবাক হলো লাবণ্য। সেই সাথে চেপে ধরল অনুশোচনার পাহাড়।অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে এভাবেই বুঝি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় অন্যের রূঢ়তা? অপমানের জবাব দেওয়ার এ কেমন নিষ্ঠুর পদ্ধতি সুব্রতর! 

শরীর খারাপের দোহায় দিয়ে সুব্রতদের ছেড়ে আসতেই লাউঞ্জের মুখে নাজমুলের সাথে দেখা হয়ে গেল লাবণ্যর। নাজমুল লাবণ্যর পেছন দিকে উঁকি দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে ধূর্ত দৃষ্টিতে তাকাল। ভুরু নাচিয়ে বলল,

' কাহিনী কী বল তো? প্রণয় ট্রয়ণ ঘটে গিয়েছে নাকি?' 

লাবণ্য দুর্বল হাসল। দু'তলার পথে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

' খেতে যাচ্ছিলেন নাকি নাজমুল ভাই?' 

' উহু। ইনভেস্টিগেশন করতে যাচ্ছিলাম। তুমি হঠাৎ এই নাটকের ছেলেদের সাথে ভীড়ে গেল কেন জানতে হবে না?' 

' আচ্ছা! তো কী রকম জানলেন?' 

নাজমুল গম্ভীর কন্ঠে বলল,

' ইনভেস্টিগেশন খুব এগুইনি। যতটুকু এগিয়েছে তাতে এতটুকু স্পষ্ট তুমি প্রেমে পড়েছ। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না৷ এই নাটকের ছেলেদের মাঝে প্রেমে পড়ার মতো আছেটা কী?' 

লাবণ্য আবারও হাসল,

' কেন? তারা কী প্রেমিক হিসেবে খুব নিম্ন ক্যাটাগরিতে আছে? আন্ডাররেটেড?'

' তা নয়। তবে এদের মাঝে বিশদ এক গন্ডগোল আছে। উপরে আলাভোলা ভেতরে চিকনা শালা টাইপ অবস্থা। উপর উপর সিঙ্গেল থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে বিয়ে থা করে বউ বাচ্চায় ঘর ভরিয়ে ফেলবে অথচ তুমি বুঝতেও পারবে না। অভিনয় শিল্পীদের এই একটা কাজ। এরা সবসময় ভালো মানুষ ধরনের ক্যারাক্টারে ঢুকে থাকে। দে হেভ দোস স্কিলস্।' 

লাবণ্য দাঁড়াল। দরজার নবে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল,

' শরীরটা ভালো নেই নাজমুল ভাই। আপনার সাথে কাল কথা বলি?' 

নাজমুলের তীক্ষ্ণ নজর লাবণ্যর ভেতরটা যেন ছেঁকে এলো একবার। জেনে ফেলল সকল না'বলা কাব্যের আগাগোড়া পঙক্তিমালা। 

' শরীর খারাপ নাকি মন?' 

লাবণ্য উত্তর দিল না। ফ্যাকাশে হেসে রুমের ভেতরে ঢুকেই সে ভাবল, বান্দরবান আসাটা তার উচিত হয়নি। এখানে আসার পর থেকেই বেঁধে যাচ্ছে যত গন্ডগোল। লাবণ্য স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি পেরিয়ে এখন চাকরিজীবী। এই দীর্ঘজীবনে অসংখ্য পুরুষ তার প্রেমে পড়েছে। সেও যে পড়েনি তেমন নয়। দুই একটা প্রেম তার জীবনেও ছিল।  কিন্তু ব্যক্তিত্বের তেজে এতোটা উত্তাপ কেউ ছড়ায়নি। এতোটা নাস্তানাবুদ? না, কক্ষনও না। তারা প্রত্যেকে ছিল রূপে, গুণে অন্যন্য। তবু লাবণ্যর রুচি হয়নি। সুব্রত রূপে,গুণে তাদের ধারে কাছে নেই। কত কমতি তার চেহারায়। অথচ লাবণ্যর সকল অনুভূতি সুব্রততেই বাঁধহীন সমুদ্র। সুব্রতর তীব্র ব্যক্তিত্বই যেন লাবণ্যর বাঁধহীন আসক্তি। লাবণ্য বাইরের জামা গায়েই বিছানায় হাত-পা ছড়াল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, সুব্রতর সাথে কথা বলবে। আজকের এই বিব্রতকর আচরণে তিল তিল দ্বগ্ধ হওয়ার চেয়ে কথা বলে ফেলাই শ্রেয়। পরমুহূর্তেই সেই সুদর্শন কৃষ্ণমানবের শীতল আচরণ মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল লাবণ্য। কেউ রেগে গেলে তার রাগ ভাঙানোর ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি লাবণ্যর জানা। কিন্তু কেউ রাগের কথা বেমালুম ভুলে গেলে তার রাগ কী করে ভাঙাতে হয় কে জানে? 

পরদিন খুব ভোরে রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে গেল লাবণ্য। তখনও সূর্য উঠেনি। মাত্রই শুরু হয়েছে প্রভাত পাখির গুঞ্জন। চারপাশে উড়ছে ঘন কুয়াশার মতো মেঘ। ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে লাবণ্যর শরীর, জামা, চুল। লাবণ্য হেঁটে হেঁটে সুব্রতদের তাঁবু থেকে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়াল। লাবণ্য জানে, সুব্রত খুব ভোরে জাগে। সেদিন তো খুব ভোরেই দেখা হয়েছিল তাদের। আজও নিশ্চয় হাঁটতে বেরুবে সুব্রত? প্রায় মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে থাকার পর তাঁবুর জিপার খুলে বেরিয়ে এলো সুব্রত। পরনে কালো হুডি আর শীত টুপি। গলায় ঝুলানো দামী ক্যামেরা। পায়ে কালো স্পোর্টস শো। কালো মানবকে কালোতে বুঝি এতো সুন্দর মানায়? তাঁবু থেকে বেরিয়ে সোজা রিসোর্টের ঢালুর দিকে হেঁটে গেল সুব্রত। লাবণ্য কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে পেছন থেকে ডাকল,

' সুব্রতবাবু?' 

নিস্তব্ধ পরিবেশে লাবণ্যর কন্ঠস্বর চারদিকে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে ফিরে এলো। সুব্রত তার সুডৌল শরীর বাঁকিয়ে পেছনে তাকাল। চোখদুটোতে তার স্পষ্ট বিস্ময়। লাবণ্য দ্রুত পায়ে তার কাছাকাছি এসে বলল,

' হাঁটতে বেরিয়েছেন বুঝি?' 

সুব্রত অদ্ভুত রকম হাসল, 

' নাহ! বেড়াতে বেরিয়েছি। তবে হাঁটবও নিশ্চয়। হেঁটে হেঁটে বেড়াব।'  

' আমি সঙ্গ দিলে রাগ করবেন?' 

সুব্রত অবাক হলো। তার মূর্তির মতো মুখটিতে অল্প কিছুক্ষণের জন্য ফুটল স্পষ্ট বিস্ময়। অতঃপর হেসে বলল,

' নারীসঙ্গ সব সময়ই উপভোগ্য। কোমলমতী রমণীদের উপর রাগ করা অন্যায়। পুরুষদের একমাত্র কর্তব্য হলো নারীর প্রেমে পড়ে যাওয়া। যেহেতু প্রেমে পড়া যাবে না। সেহেতু বেড়াতে যাওয়া যেতে পারে। চলুন।' 

লাবণ্য হাসল। হাঁটতে হাঁটতে আচমকা প্রশ্ন করল, 

' প্রেমে পড়া যাবে না কেন?' 

সুব্রত হেসে ফেলল। মনখোলা, প্রাণবন্ত হাসি। হাসতে হাসতেই বলল,

' আপনি চাচ্ছেন আমি আপনার প্রেমে পড়ে যাই?' 

লাবণ্য লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ব্যস্ত হয়ে বলল,

' না না। তা বলিনি।' 

সুব্রত ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল,

' সমস্যা নেই। মেয়েদের সাইকোলজিই এমন। তারা চায় পৃথিবীর সকল পুরুষ তাদের প্রেমে পড়ে যাক।' 

লাবণ্য মৃদু প্রতিবাদ করল, 

' একদম নয়।' 

সুব্রত তখনও হাসছে। চারপাশে বাজছে তার উচ্ছল হাসির প্রতিশব্দ। যেন, বিধাতা তাঁর হাসির হাঁড়ির সবটায় উপুড় করে দিয়েছে তার ঠোঁটে। রিসোর্টের এড়িয়া পেরিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় এসে সুব্রত বলল,

' আমি অনেকদূর হাঁটব। হাঁটতে পারবেন অতোটা?' 

লাবণ্য বলল,

' বিলক্ষণ।' 

তারপর কিছুক্ষণ নিশ্চুপ। দুই পাশে বিশাল উঁচু পাহাড়। গাছ,জঙ্গল আর প্রভাত পাখির কান ঝালাপালা করা গান। একদম শূন্য প্রসারিত রাস্তায়, একঝাঁক মেঘের রাজ্যে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সুব্রত বলল,

' সাইরু হিল রিসোর্ট নিয়ে যে একটা উপকথা আছে জানেন?' 

লাবণ্য আগ্রহ নিয়ে তাকাল, 

' কী রকম উপকথা?' 

' দীর্ঘদিন আগে বান্দরবান জেলার এক পাহাড়ি অঞ্চলে পাহাড়ি বংশের এক রাজকন্যার নাম ছিল সাইরু। রাজকন্যা সাইরু যৌবনে অন্য গোত্রের এক রাজপুত্রের প্রেমে মগ্ন হলো। পাহাড়িদের মাঝে ভিন্ন গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রেম তো বাঁধা মানে না। হুট করে এসে লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায় চরাচর। সাইরুর ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটল। তাদের গভীর প্রণয়ের কথা জানাজানি হওয়ার পর রাজ্যের প্রবীণরা ভীষণ ক্ষেপে গেল। দুই গোত্রের আসন্ন শত্রুতা দূর করতে,  উপয়ান্তর না পেয়ে রাজপুত্র তারই গোত্রের এক মেয়েকে বিয়ে করে ফেলল।' 

লাবণ্য মগ্ন হয়ে শুনছিল। এবারে চমকে উঠে বলল,

' সে কী! তারপর?' 

' তারপর! তারপর ট্রাজেডি। রাজপুত্র অন্যত্র বিয়ে করাতে ভীষণ ধাক্কা খেলো সাইরু। নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল। মানসিকভাবেও ভেঙে পড়ল খুব। তারপর হঠাৎ একদিন জঙ্গলের পথে একা একা বেরিয়ে পড়ল। অনেকটা স্বেচ্ছা নির্বাসনের মতো। বলা হয়ে থাকে, রাজকন্যা সেই অজ্ঞাত যাত্রা থেকে কখনও ফিরে আসেননি। সেই রাজকন্যার নাম থেকেই সাইরু রিসোর্টের নামকরণ।' 

লাবণ্যর ভয়ংকর মন খারাপ হলো। গায়ের চাদরটা দুই হাতে আগলে নিয়ে উদাস কন্ঠে বলল,

' ছেলেটা তো খুব স্বার্থপর। নিজের প্রণয়িনীকে কীভাবে একা ছাড়তে পারল? ভালোবেসে কষ্ট আসলে মেয়েরাই পায়। ছেলেরা এমনই হয়, স্বার্থপর।' 

' তাহলে মায়েরা খুনি?' 

লাবণ্য হঠাৎ এমন কথায় অবাক চোখে তাকাল,

' মানে? মায়েরা খুনি হবে কেন?' 

' সেদিনও পত্রিকায় বেরুলো একজন মা তার শিশু সন্তানকে হত্যা করেছেন। একজন মা তার সন্তানকে হত্যা করেছেন বলে পৃথিবীর সকল মায়ের উপর সন্তান হত্যার অপবাদ দেওয়া যায় না৷ একজন মা সন্তান হত্যা করলেও, মায়েরা পৃথিবীর সবচেয়ে মমতাময়ী। সে হিসেবে, একটি ছেলে তার প্রেমিকার হাত ছেড়ে দিল বলে সকল ছেলেকেই স্বার্থপর বলা যায় না।' 

লাবণ্য পরাস্ত হয়ে বলল,

' আপনারা সকলেই যুক্তিতে এতো পাকা কী করে বলুন তো, সুব্রতবাবু?' 

সুব্রত কৌতুক করে বলল,

' সুব্রতবাবু! ওরে ব্যাস! এভাবে সম্বোধন করলে যে নিজেকে কোনো মধ্যযুগীয় উপন্যাসের নায়ক ভেবে ভুল করে বসব!' 

' ভুল করলেই বা সমস্যা কোথায়?' 

' নেই বলছেন? আচ্ছা বেশ।' 

তারপর আবারও কিছু নীরবতা৷ আকাশে তখন সূর্যোদয়ের তোরজোর। পূবাকাশে লাল গালিচা বিছিয়ে প্রভাতের অভ্যর্থনায়  নব্য সজ্জিত রূপ। উঁচু নিচু প্রসারিত রাস্তা। স্নিগ্ধ, নির্মল বাতাস চারিধারে। সুব্রত দুয়েক জায়গায় থেমে গাঢ় বেগুনি রঙের বনফুল দেখল। বিভিন্ন ঢংয়ে ছবি তুলে নিয়ে বলল,

' আপনার চাই?' 

' কী?' 

' ফুল?' 

লাবণ্যর হঠাৎ খুব লজ্জা লাগল। সুব্রত আঙুলের ডগা দিয়ে এক গুচ্ছ ফুল তুলে এনে লাবণ্যর হাতে দিয়ে পাহাড়ি ফুলের নানান রূপের গল্প বলতে লাগল। লাবণ্যর কানে সবই শোনাল রূপকথার গল্পের মতো কাল্পনিক, মধুর। সুব্রত হঠাৎ বলল,

' এখানে মুকুট পাহাড় বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে পাশাপাশি দুটো গাছ আছে। যাদের এখনও সেই রাজকন্যা ও রাজপুত্রের রহস্যময় প্রেমের স্মৃতি হিসেবে মানা হয়। আমি সেখানটাতেই যাচ্ছি। আপনি যেতে চান?' 

' বেড়াতেই তো এলাম।' 

সুব্রত মাথা নেড়ে পথ চলায় মন দিল। এই মেঘরাজ্যের দেশে, পাহাড়ি সুর আর পাখিদের গানে লাবণ্যর মনটা সুখের সাগরে ভাসতে লাগল। এই প্রশস্ত সুন্দর রাস্তায়, প্রকৃতির এতো কাছে, তার প্রেম! প্রেমে পড়া সেই মানুষটির পাশাপাশি হেঁটে চলা, টুকটাক কথা বলা আর দৃষ্টি বিনিময় যেন এক স্বপ্নাতীত অনুভব। মেঘেদের মতোন তুলতুলে, খুব কোমল। 




চলবে...




Writer:- নৌশিন আহমেদ রোদেলা 


NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner