তখন বাইরে কেবল আজান দিতে শুরু করেছে। আজানের শব্দেই ঘুমটা ভেঙ্গেছে তৃতির। তৃতির সকালে উঠে নামাজ পড়ার অভ্যাস খুব ছোট থেকেই। আজানের সাথে সাথেই তার ঘুম ভাঙ্গে যায়। কাল হয়তো নতুন জায়গা বলে একটু অনিয়ম হয়েছিল কিন্তু আজ আবার সব ঠিক হয়ে গেছে। তৃতি তাড়াতাড়ি করে উঠে ওযু করতে গেল যেন নামাজ পড়তে দেরী না হয়।
সে ওযু করে বের হওয়ার সময় ভাবছিল আরহামকে বলবে কি নামাজের কথা। আজ বলবে নাকি কটা দিন দেখবে। কিন্তু ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে সে অবাক হয়ে গেল। আরহাম আগেই উঠে বসে রয়েছে বিছানার উপরে। তৃতি বের হতেই আরহাম গেল ওযু করতে। তৃতি একটা সস্তির নিশ্বাস ফেলে তার সাথে আনা জায়নামাজটা পেতে নামাজ শুরু করল।
আরহাম একটা সাদা পাঞ্জাবী পড়ে নামাজ পড়তে গিয়েছিল। তখন তৃতি নামাজে থাকার জন্য দেখতে পায় নি। কিন্তু ফিরে এসে যখন ঘরে ঢুকল তখন আরহামকে দেখে তৃতি জাস্ট হা হয়ে গেল। সাদা পাঞ্জাবীতে আরহামকে বেশ শুভ্র লাগবে, একটা সুন্নাতী ভাব এসেছে। এ রুপ যেন ছড়িয়ে পড়ছে সারা ঘরে, তৃতি চোখ ফেরাতে পারছে না।
অনেক কষ্টে তৃতি চোখটা ফিরিয়ে নিল। নাহলে আবার উনি লুচ্চা মেয়ে বলতে পারে। আরহাম তৃতির দৃষ্টি বুঝতে পারল কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপ করল না। সে আলমারী থেকে জগিং এর ট্রাউজারটা নিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেল। আরহাম চলে যেতেই তৃতি বিছানাটা চট করে গুছাতে লাগল। আরহামের বের হতে বেশী সময় লাগলো না। আরহাম বের হতে তৃতি আরও একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আরহামের দিকে।
এবার আরহাম একটু হেসে তৃতির দিকে তাকিয়ে বলল, আমার সাথে জগিং এ যাবে? তৃতি চোখ মুখ কুচকে ফেলল। এবার আরহাম শব্দ করে হেসে উঠল। তারপর হাসি থামিয়ে তৃতিকে জগিং করার উপকারীতা নিয়ে একটা বিশাল লেকচার দেওয়া শুরু করল। তৃতির সকাল সকাল এসব লেকচার মোটেও ভাল লাগছে না। ক্লাসেও সে কখনও টিচারদের লেকচার ভালভাবে শোনে না। আর বাড়িতে এতো সকালে সে শুনবে লেকচার । আবারও চোখ মুখ কুচকে আরহামের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কি এখন চা খাবেন?
কথার মাঝে বাধা পেয়ে আরহাম বেশ আশাহত হল। ওর লেকচার দিতে বেশ ভাল লাগে। একটা সময় ওর লেকচারার হওয়ার বেশ ইচ্ছা ছিল। এখনও ইচ্ছাটা মরে যায় নি কিন্তু সময় আর সুযোগ হয়ে উঠে নি। তবে ওর ইচ্ছা আছে। কিছু দিনের জন্য হলেও সে কোন কলেজ কিংবা ভার্সিটির লেকচারার হবে। সেটা অল্প সময় হলেও সমস্যা নেই।
তৃতির কথায় বাধা পেয়ে আরহামও চোখ মুখ কুচকে ফেলল। তৃতির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, নাহ্, তবে এসে জুস খাব। বলেই হন হন করে বেড়িয়ে গেল। আজ ওর বেশ দেরী হয়ে গেছে। অন্য দিন এতোক্ষনে সে অনেকটা চলে যায় কিন্তু আজ তৃতির সাথে কথা বলতে বলতে দেরী হয়ে গেছে। তৃতিও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্না ঘরের দিকে এগুলো।
তৃতি রান্না ঘরে এসে দেখলো আজ মনেয়ারা বেগম আসেন নি। হয়তো দুইটা বউ আছে তাই আর নিচে নামেন নি। নহুরা একা চায়ের পানি বসিয়েছে সবার জন্য। তৃতি গিয়ে নহুরাকে সাহায্য করতে লাগল। বাসার সব কাজ কাজের লোক করলেও রান্নার কাজটা বাড়ির বউদেরই করতে না হলে বাসার সাহেবদের সে খাবার মুখে রোচে না।
তৃতি গিয়ে আরহামের জন্য জুস বানিয়ে ফ্রিজে রেখে দিল। আরহাম জগিং থেকে ফিরেই এই ঠান্ডা জুসটা খায়। কাল নহুরা ওকে আরহামের সব রুটিন সম্পর্কে বলেছে। সব মনে না থাকলেও কিছুটা আছে। বাকিটা সে ধীরে ধীরে শিখে ফেলবে। নাহলে মাথার উপর এই ভাবীর মতো মা টা তো আছে। তৃতিরও নহুরাকে বেশ ভালো লেগেছে। এতোটা কম সময়ে এতোটা আপন করে নিয়েছে তৃতিকে যেন নিজের দুই বোন ওরা। নহুরার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল ছোট জায়ের সাথে ও এমন বোনের মতো থাকবে কিন্তু তার জন্য অপর পাশের মানুষটাকেও ভাল হতে হবে। একজন ভাল হলে হয় না কিছুই, কথায় আছে না একহাতে তালি বাজে না তেমনটা। আর তৃতি সেদিক দিয়ে একশো তে একশো।
আজও আরহামের কয়েকটা ইন্টারভিউ আছে। আজও সে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়ল, কখন ফিরবে তৃতি জানে। সকালের সব গুছিয়ে লেগে পড়ল দুপুরের জন্য রান্না বান্নার কাজে। দু জায়ে মিলে বেশ করছে সব। দুজেনে ভাব হয়েছে প্রচুর যার জন্য বেশ আনন্দের সাথে তারা কাজ করছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন নিজের দুই বোন।
দুর থেকে মনোয়ারা বেগম সেটা দেখে একটা মিষ্টি হাসি দিলেন। তার দুই বউকে নিয়ে বেশ গর্ব হচ্ছে, তারা কি সুন্দর গুছিয়ে সব কাজ করছে। তিনি আগে থেকে এটা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন যে তার দুই বউ কেমন হবে। অন্যদের বাড়িতে দুই জায়ের মধ্যে সংঘর্ষ দেখে তার বেশ ভয় করত। তার তো দুটো ছেলে, শেষে কি তারা বউয়ের জন্য আলাদা হয়ে যাবে। আজ এই দৃশ্য দেখে তিনি একটা সস্তির নিশ্বাস ফেললেন। আসলে সবকিছু নিজের উপর ডিপেন্ড করে। আপনি নিজে নিজের দ্বায়িত্বটুকু করে যান ফলের আসা করবেন না। দেখবেন অপর পাশের মানুষটাও ঠিক এগিয়ে আসবে। কিন্তু আপনি নিজের দ্বায়িত্বটুকু পালন না করা সামনের মানুষটার কাছে কিছু আশা করাটা বোকামী। কথায় আছে না একহাতে তালি বাজে না। তালি বাজানোর জন্য আগে দিন না নিজের হাতটা বাড়িয়ে, অপর পাশের মানুষটাও ঠিক বাড়াবে হোক সেটা দেরীতে।
এভাবেই কেটে গেল কয়েক দিন। সবার সাথে বেশ ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠলেও তৃতি যার হাত ধরে এই বাড়িতে এসেছিল তার সাথে সম্পর্কের কোন উন্নতি হয় নি। আরহাম যে কোন কথায় বেশ সুন্দরভাবে তৃতিকে এড়িয়ে যায়। তৃতি কিছুটা বোঝে কিন্তু একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে এই আশায় বুক বেধে চলেছে প্রতিনিয়ত।
আজ নহুরা সকাল থেকে প্লান করেছে তারা আজ শপিং এ যাবে। নিজের জন্য না। তৃতির জন্য কিছু কেনা হয় নি তাই। শহরে আসার পরও বাসার কাজ গুছিয়ে এ কয়দিন সময় করে উঠতে পারে নি। মেয়েটার বিয়ে হয়েছে অথচ পুরোনো কয়েকটা শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়িতে। বিষয়টা নহুরার মোটেও ভাল লাগছে না, তার শাশুড়িও অবশ্য কিছু কিনে দেওয়ার কথা বলেছিল, তাই এই উদ্যোগ।ইবনীহাও যাবে ওদের সাথে। দুপুরে তাড়াতাড়ি কাজ করে তারা রেডী হতে শুরু করে দিল, মেয়েদের কথা তো বলা যায় না। তারা শপিং এ এতো সময় ব্যয় করে। আবার ওরা প্লান করেছে তৃতিকে নিয়ে সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখবে। আরহামকেও আসার কথা বলেছিল। কিন্তু ও কাজের কথা বলে আসবে না বলেছে।
গাড়িতে যাবার সময় নাহুরা আর তৃতি পাশাপাশি বসেছে। ইবনীহা বসেছে ড্রাইভারের পাশে। নাহুরা তৃতিকে গাড়িতে বসে শহুরে কিছুু কালচার বোঝানোর চেষ্টা করছে যেন শপিং মলে গিয়ে কোন ওকওয়ার্ড সিচুয়েসানে পড়তে না হয়। তৃতি সেগুলো বুঝছে কি না কে জানে শুধু হা করে তাকিয়ে আছে নাহুরার মুখের দিকে। নহুরার কথা বলা শেষে তৃতিকে সব বুঝেছে কিনা জিজ্ঞেস করতে সে কিছু বলল না তবে মুখে একটা হাসি দিল। এই হাসিটা কেমন যেন, এই হাসির অর্থ নাহুরা বুঝলো না। সে তৃতির দিকে তাকিয়ে ঠাই বসে রইলো।
শপিং এ গিয়ে তাদের আর সিনেমা দেখা হলো না। ভেবেছিল রাতে ডিনার করে আসবে রেস্টুরেন্ট থেকে, সেটাও হলো না তৃতির জন্য। নাহুরা এই ভয়টাই পাচ্ছিল। বাচ্চা একটা গ্রামের মেয়ে শহুরে কালচার বুঝবে না। তবুও সে যথা সম্ভব তৃতিকে শিখানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তৃতি তার ধার না ধেরে শপিং মলে গিয়ে একটার পর একটা ব্লান্ডার করে গেছে। হাওয়ারই কথা, ও তো ছোট থেকে গ্রামের বড় এই সব কিছুই তার কাছে নতুন লাগবে। ওদেরই উচিত ছিল আগে ওকে সব শিখিয়ে তরপর বাইরে আনা। শেষে ওদের মুখ দেখানোর মতো অবস্থা ছিল না।
শপিং মলের রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েও বাধল আরেক ঝামেলা । তৃতি সব খাবার ফেলে দিয়েছে গায়ের উপর। ছুড়ি ধরতে গিয়ে সেটা ছুটে গিয়ে কার যেন গায়ে পড়েছে এটা নিয়ে সেই লোকটা এসে বাধিয়েছে ঝামেলা। ওরা কোন রকমে সিচুয়েসান হ্যান্ডেল করে বেড়িয়ে আসল সেখান থেকে । আশেপাশের মানুষজন নানা কথা বলা শুরু করেছে। কেউ কেউ তো বলছে, এসব গাইয়া ভুতকে বাসাতে রাখলেই পারে বাইরে আনে কেন? যতোসব ম্যানারলেস মানুষজন। চালচলের ঠিক নাই এই এতো বড় শপিং মলে এসেছে, এমনটা তো হবে।
যতই তৃতি অশিক্ষিত হোক তবুও নাহুরার বাইরের মানুষের বলা কথাগুলো ভালো লাগে নি। ওরা যখন বাসায় আসল তখন বাসায় সবাই উপস্থিত ছিল। ওদের এতো তাড়াতাড়ি আসার কথা না থাকায় সবাই জিজ্ঞাসা করল কি হয়েছে? এতো তাড়াতাড়ি এলো কেন?
ইবনীহা বাসায় এসে সবাইকে আজ বাইরে যা কিছু ঘটছে বলে চলেছে। আরহামও ছিল সেখানে। সে সব কিছু শুনে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। তার চোখ ক্রমশ লাল হচ্ছে। কিন্তু কোন কথা বলল না। ইবনীহার বলা শেষ হলে আরহাম উঠে তৃতির হাতটা ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেল। নাহুরা বাধা দিলেও শুনলো না। আরহামের চোখের দিকে তাকিয়ে নাহুরা বেশ ভয় পেল কারন তা পুরো লাল হয়ে গেছে। এতো রাগে মেয়েটার সাথে কি না কি করে বসে কে জানে।
আরহাম তৃতিকে ঘরে নিয়ে এসে দড়াম করে দড়জাটা লাগিয়ে দিল। এবার ভয়ে কেপে উঠল তৃতি। ভয়ে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে রইলো এক জায়গায়। আরহাম কিছু সময় দাড়িয়ে রইলো চুপচাপ। জোরে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস ফেলে ঘুরে দাড়ালো তৃতির দিকে। তৃতি তখনও ভয়ে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে। আরহাম তৃতির দিকে তাকিয়ে বেশ শান্তভাবে বলল,
- বাইরে গিয়ে ওসব কেন করেছো?
- আমি বুঝতে পারি নি?
- কি বুঝতে পারো নি। তুমি গাইয়া এটা নাকি এটা তোমার গ্রাম না এটা। তোমাকে বাইরে যেতে কে বলেছে। ঘরে বসে মন টিকে না। বাইরে কি দেখতে গেছিলা। বেশ জোরে চিৎকার করে কথাগুলো বলল আরহাম।
- ভাবী বলেছিল তাই। কোনরকমে বলল তৃতি। সে আরহামের চিৎকারে বেশ ভয় পেয়েছে।
- ভাবী বললেই যেতে হবে। তুমি যানো না তুমি কেমন? তুমি যে একটা গাইয়া এটা তোমার মাথায় থাকে না নাকি শহরে এসে নিজেকেও এদের মতো ভাবতে শুরু করেছে। কাককে ময়ূরের পালক লাগালেই ময়ূর হতে পারে না, তুমিও পারবে না। এসব কালচার তোমার জন্য না। বাইরে গিয়ে চুপচাপ থাকা যায় নি। এটা কি তোমার গ্রাম পেয়েছ যে যা খুশি করবা। তোমাকে বিয়ে করা আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল হয়েছিল। কেনো যে গ্রামে যেতে গেলাম আমি। আমারই ভুল হয়েছে তোকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখতে হতো তাহলে কোথাও যেতে পারতি না।
তারপর তৃতির দিকে এগিয়ে এসে তৃতির মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল, তুমি জানো আমি কে? আমার তোমার সাথে কোনো দিক দিয়ে যায় না। তোমরা দুই বাবা মেয়ে মিলে আমার বাবার মাথাটা নষ্ট করে দিয়ে আমাকে বিয়ে করেছ। ভেবেছ রাজপুত্র আর রাজ্য একসাখে হাসিল করে ফেলবে। কিন্তু সেটা করার জন্য যে যোগ্যতা থাকা লাগে। এই যোগ্যতা নিয়ে তুই আমাকে হাসিল করতে এসেছিলি। বলেই একটা নিশ্বাস ফেলল।
তৃতির এবার বেশ কষ্ট হচ্ছে। ও সব সহ্য করতে পারলেও ওর বাবা সম্পর্কে কোন কটু কথা ও সহ্য করতে পারে না। সে বেশ রেগেও গেছে ওর বাবা সম্পর্কে এমন কথা শুনে। ও রাগে কাপতে কাপতে বলল, মোটেও মিথ্যা কথা বলবেন না। আমার বাবা না আপনার বাবা গিয়েছিল আমার বাবার কাছে, আপানার বাবা আমার বাবার থেকে আমাকে চেয়েছিল আপনার জন্য। তাই বাবা রাজি হয়েছিল। এমন বাজে কথা আপনি আমার বাবার নামে বলতে পারেন না।
তৃতি কথাগুলো স্বাভাবিক ভাবে বললেও রাগের জন্য তা বেশ ঝাঁঝালো শোনালো। এমনিতেই আরহাম রেগে ছিল তার উপর তৃতির এভাবে কথা শুনে তৃতিকে ঠাস করে একটা চড় মেরে দিল। তৃতি বুঝতেই পারল না কি হল। তাপ্পরটা মেরেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল আরহাম। তৃতি থাপ্পড় খেয়ে সেখানেই লুটিয়ে পড়ল।
চলবে,,,,
জাকিয়া সুলতানা