Leave a message
> সহযাত্রী ১ম পর্ব - Bangla Ghost Story - Boipoka365
-->

সহযাত্রী ১ম পর্ব - Bangla Ghost Story - Boipoka365


Ghost Story

"সদ্য মাটি হওয়া একখান মৃত দেহ কবর খুঁইড়া চুরি কইরা বিক্রি করবার পারলেই কড়কড়া পনেরো হাজার টাকা।"

রমিজ চাচার এমন কথাতে ভ্রু কুচকে গেলো আমার।যেখানে দৈনিক নয়-দশ ঘন্টা গাঁধার মত খেটেও মাস শেষে দশ হাজার টাকা জুটে না।সেখানে কয়েকঘন্টার কাজের বিনিময়ে পনেরো হাজার টাকা!

কথাটা শুনে অনেকটা আলাদিনের প্রদিপ পাওয়ার মত অবস্থা হলো আমার।বর্তমান বাজারে টিকে থাকতে গেলে টাকার কদর ঢের বেশি।তাই রমিজ চাচাকে বলে কইয়ে কোনমতে তার পার্টনার বানানোর জন্য রাজি করালাম।

কিন্তু তারপর রমিজ চাচা যা বললো,তা শুনে কিছুটা ভয়ও লাগলো।

শোন হে ছোকড়া,এই কামে যেমন টাকা আছে,তেমনি রিক্সিও আছে।রাত্রি বেলাতে কবরস্থানে ঢুকাটা চারটেখানি কথা নয়।কলিজ্বা লাগে বুঝলি,অনেক সাহসের দরকার।ভূত-প্রেতে একদমই ভয় পাওয়া চলবো না,জন্তু জানোয়ারের মোকাবেলা করতে হইবো,আর মাঝেমধ্যে কবরস্থানের দারোয়ান তো আছেই।সবমিলিয়ে সবকিছুকে তোয়াক্কা কইরা তারপরই লাশ চুরি করতে হয় বুঝলি।

রমিজ চাচা পারলে আমি কেন পারবো না,আমারো সাহস আছে।হয়তো প্রথম প্রথম একটু গা ছমছম করবে,একটু ভয় করবে,ধিরে ধিরে আমিও একদিন রমিজ চাচার মত পাক্কা লাশ চোর হয়ে যাবো।আর টাকা ইনকামের এমন সহজ পন্থা একবারেই হাত ছাড়া করা যাবে না।তাই রমিজ চাচার সব কথাতে রাজি হয়ে বললাম,"আমি পারবো।একটাবার চান্স তো দিয়েই দেখো।

শেষমেশ রমিজ চাচা আমাকে তার লাশ চুরির পার্টনার হিসেবে গ্রহণ করলো।

আর সেই সাথে এটাও বললো,"আইজকাই তোর প্রথম অপারেশন।ঠিক রাত বারোটার সময় মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়ায়ে থাকবি।আমি সঙ্গে কইরা নিয়া যাবো।আমি মাথা নাড়িয়ে, "হ্যাঁ", বলে বাড়ি চলে আসলাম।

রাত বারোটার সময় রমিজ চাচার কথামত মোড়ের মাথাতে এসে দাঁড়িয়ে রয়লাম।চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধ্যকার,আর জমাট বাঁধা কুয়াশা।এই শীতের কাছে হার মেনে রাতের নিশাচর প্রাণী,কুকুর গুলাও হয়তো রাজপথ ছেড়ে গরম জায়গা খুঁজে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।একটু পর কালো চাদর মুড়ি দিয়ে রমিজ চাচা এসে ডাক দিলো," কিরে আইছিস?

আমি চাপা গলায় জবাব দিলাম,"হ চাচা।

"আয় আমার লগে।

আর কোনো কথা না বলে তার পিছু নিলাম।

হাড় হীম করা শীতের সাথে কুয়াশায় মোড়ানো অন্ধ্যকারাচ্ছন্ন রাত।জোরালো বাতাস না বয়লেও শীতের জন্য হাত-পা জমে যাওয়ার মত অবস্থা।আমি আর রমিজ চাচা ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটছি।উদ্দ্যেশ্য উত্তরপাড়ার কবরস্থানে সদ্য কবর দেওয়া লাশ টাকে মাটি খুঁড়ে তুলে নিকটস্থ একটা মেডিকেল কলেজে বিক্রি করে দেওয়া।এর আগে রমিজ চাচা আর সুলেমান মিঞা দু'জনে এইসব করতো।কয়েকমাস আগে সুলেমান মিঞার যক্ষায় মৃত্যু হওয়াতে আমি তার সাথে যোগ দিয়েছি।

রমিজ চাচা জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস ছেড়ে বললো,"একটু পা চালিয়ে হাঁটবার পারিস না?এখনো অনেকটা পথ বাকি,তাড়াতাড়ি পৌঁছানো লাগবে।

রমিজ চাচার কথার উত্তরে শুধু বললাম,"চাচা আর কতজোরে হাঁটবো?

রমিজ চাচা অন্ধ্যকারের মাঝে দাত কড়মড় করে জবাব দিলো,"তোগো বয়সে আমি দিনে চারবার নদী সাতরিয়ে এপার-ওপার করছি।আর তোরা তো এখন নদীর পানি দেখলেই ডরাইবি।চল তাড়াতাড়ি রাত ফুরানোর আগেই কামডা সারতে হইবো।

আমি তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে জোরদার হাঁটা শুরু করলাম।

মাঝরাতে আমার দুইজনই কেবল বেঁচে আছি এই পথের বুকে।

কুয়াশা মাড়িয়ে দ্রুত বেগে এগিয়ে যাচ্ছি সামনে।মিনিট বিশেক হাটার পর রমিজ চাচা থমকে দাঁড়ালো,সেই সাথে আমিও দাড়ালাম।

রমিজ চাচা তার চাদরের নিচ থেকে কিছু একটা বার করে বললো," খাড়া একটু গলাটা ভিজায়ে লই।তারপর অন্ধ্যকারের মাঝ থেকে ঢকঢক শব্দ ভেসে আসলো কানে।

"তুই খাবি?

" কি?

"নে ধর,খাইলে দেখবি শরীরটা একদম টানটান হয়ে গিছে।সব শীত দৌড়ে পলাইছে।

অন্ধ্যকারের ভিতরে রমিজ চাচার দেওয়া কাচের শিশির মত বোকলের ন্যায় ভারি কিছু একটা মুখে ঢালতেই গলাটা পঁচা গন্ধ্যের তীব্রতাতে ঝাঁঝে ধরে আসলো।

বুঝতে বাকি রয়লো না,বোতলে তারি ছিলো।

শুনেছি এইসব খেলে নাকি,শরীরের ভিতরের সমস্ত ভয় আর শীতের উষ্ণতা নিমিষেই দুর হয়ে যায়।তাই নাক চেপে ধরে কয়েকঢোক মেরে দিলাম।

" খাওয়া শেষ হলে এবার চল,ভিতরে ঢুকতে হইবো।

রমিজ চাচার কথা শুনে মাথা উচিয়ে দেখলাম,সামনে মস্ত বড় একটা সাদা চুন দেওয়া গেইটে কালো রংয়ে কবরস্থান লিখা আছে।

বুঝলাম,আজকে এইখানেই আমার প্রথম কাজ শুরু হবে।শুরুর দিকে যে একটু আধটু ভয় কাজ করছিলো,পেটে তারি পড়ার পর সেই ভয়টুকুও পালিয়েছে।

রমিজ চাচা কথাটা বলার সাথে সাথে আমি গেইটের দিকে যেতে চায়লে চাচা আমাকে আটকিয়ে বললো,"আরে মর্কট,সামনে দিয়া যাওন যাইবো না।তাহলে দারোয়ার বুইঝা ফেলবো।

চল আমার লগে।

কথাটা বলে রমিজ চাচা সোজা রাস্তার পাশে থাকা মস্ত বড় খাঁদে নেমে পড়লো।

তার দেখা দেখি আমিও নেমে হাটতে লাগলাম।

কিছুদূর যাওয়ার পর রমিজ চাচা বললো,"এইখান দিয়া প্রাচীর টপকাতে হইবো বুঝলি।

তারপর দু'জনে প্রাচীর টপকিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম।

মাথার উপর থাকা বড় বড় গাছের পাতাতে জমে থাকা কুয়াশাগুলো ফোঁটায় ফোঁটায় মাথার উপরে পড়ছে।

রমিজ চাচা দিনের আলোতে এই কবরস্থানের সবকিছু ভালোমত আয়ত্ত করে যাওয়াতে অন্ধ্যকারের মাঝেও কবরটাকে খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট হলো না।

সদ্য বাঁশের রেলিং দিয়ে ঘেরা কবরের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,"এইখানে খাড়া,এই হলো কবর।এর ভিতরে পড়ে আছে নগদ পনেরো হাজার টাকা।

চল জলদি হাত লাগিয়ে রেলিং গুলো সরিয়ে ফেল।

তার কথামতো রেলিং গুলো সরিয়ে একপাশে রাখতেই রমিজ চাচা তার পিছন থেকে ছোট্ট একটা বেলচা বার করে মাটি সরাতে লাগলো।এই কয়েকঘন্টার ভিতরে ঝুরঝুরে মাটিগুলোও কেমন যানি শক্ত হয়ে জমাট বেঁধে গিয়েছে।

রমিজ চাচা তার গায়ের চাদরটা আমার হাতে দিয়ে বললো,"ওখানে রেখে জলদি আয়,বাঁশের চাপাটি সরাতে হবে।

দু'জনে ধরাধরি করে বাঁশ সরাতেই চোখ পড়লো,ভিতরে সঠান পড়ে থাকা সাদা কাপড়ে মোড়ানো মৃতদেহটার উপর।

অন্ধ্যকারের মাঝেও কাফনের সাদা কাপড়টা চকচক করছে।

"নে ধর দেখি।

চাচার কথামত লাশটাকে উপরে তুলে একপাশে রেখে দিয়ে আবার পূর্বের মত সবকিছু ঠিকঠাক করতে করতে আরো মিনিট বিশেক সময় লাগলো।

তারপর দু'জনে লাশটাকে কাঁধে তুলে নিয়ে আবার হাঁটতে লাগলাম,পিছনের রাস্তা ধরে।

রমিজ চাচা সামনে,আর আমি পিছনে।

লাশের শারীরিক গঠনের চায়তে ওজনটা দ্বিগুণ লাগছে আমার কাছে।

মনে হচ্ছে আস্তো একটা পাথর কাঁধের উপর তুলে নিয়েছি।

অন্ধ্যকারের ভিতরে কুয়াশা মাড়িয়ে ধির গতিতে এগিয়ে যাচ্ছি।সামনে থাকা রমিজ চাচার নিঃস্বাসের গাড় শব্দটা স্পষ্ট কানে ভেসে আসছে।কেন যানি এই প্রবল শীতের মাঝেও শরীর বেয়ে শার্টের নিচ দিয়ে তরতরিয়ে ঘাম বার হচ্ছে।

কবরস্থান থেকে বার হয়ে রমিজ চাচা আমাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো," তুই লাশটা এইহানে নিয়া দাঁড়ায়ে থাক,আমি ভ্যান লইয়া আইতাছি।

চাচার কথামত লাশটা সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।কেন যানি নিজেকে আজ বড্ড সাহসী লাগছে।যেই আমার অগণিত মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে মৃত মানুষের সামনে যেতেই হাঁটু কাপতো সেই আমি কি না আজকে একা একটা অজ্ঞাত লাশ সাথে করে দাঁড়িয়ে আছি,তাও আবার মাঝরাতে! আসলে টাকার জ্বালা যে মানুষকে কতটা বদলাতে পারে,তা হয়তো আমিই তার চাক্ষুশ নজির।

একটু পর ক্যাচকুচ শব্দ করে রমিজ চাচা একটা ভ্যান নিয়ে এসে থামলো,তারপর বললো,"ল তাত্তাড়ি লাশটাকে এইডার উপরে তুল দেহি।ভোর হওনের আগেই প্রস্থান করতে হইবো।

আমি মুখ বুজে অবিলম্বে সামনে থাকা লাশটাকে দু হাতে শক্ত করে ধরে ভ্যানে তুলে দিয়ে বললাম,"চাচা তুমি পাশে বসো,আমি ভ্যান চালাচ্ছি।

ল হ্যান্ডেল ধরে,তাত্তাড়ি চল।

ভ্যানের সিটে চেপে বসে প্যাডেল ঘুরাতে শুরু করলাম।

সকাল হওনের লগে লগে লাশটা আমাগো শংকর দাদার কাছে দিয়া দিতে হইবো বুঝলি?

শংকর বলতে মেডিক্যাল কলেজের প্রপেসর!

হ,তাঁর কাছেই লাশ বিক্রি করি আমি।বেশ ভালো লোক বুঝলি।

তা লাশ নিয়ে সে কি করে চাচা?

তা জাইন্না তুই-আমি কি করবো?আমাদের টাকা নিয়া কাম,টাকা পাইলেই হয়লো।মুখ বন্ধ কইরা শরীরে জোর দিয়া প্যাডেল মার।

আর কোনো কথা না বলে সোজা রাস্তার বুক চিরে ভ্যান নিয়ে ছুটতে লাগলাম।দীর্ঘ লম্বা রাতটা তখন প্রায় শেষের দিকে।ফাঁকা প্রান্তর থেকে দমকা বাতাস এসে গায়ে লাগছে।একটু পরেই হয়তো ফযরের আযান দিবে।

রমিজ চাচা বললো,"তোগো বাসায় তো তুই একাই থাকোস তাই না?

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,"হুম,কেন?

লাশটা তোগো রুমে নিয়া রাইখা দে,আমি সংকর দার লগে কথা বইলা তারপর নিয়া যামু,কোনো রিস্ক টিস্ক নাইতো?

নাহ্,তবে আমার কেন যানি ভয় লাগছে চাচা!

আগেই কইছিলাম,তোগো মত পুলাপান গো দিয়া এইসব কাম হইবো না।

রমিজ চাচার এই কথাটা শুনে জেদ চেপে গেলো,বললাম,"আচ্ছা ঠিক আছে,আমি নিয়ে যাচ্ছি।

তারপর লাশটাকে আমার রুমে এনে ফ্রিজাপ করে পাটি চাপা দিয়ে ঠিকঠাক করার পর রমিজ চাচা তার ভ্যান গাড়ি নিয়ে আবার রওনা দিলো।আর যাবার সময় বলে গেলো,"ভালো কইরা একটু তদারকি করিস,লাশে থেইক্কা যেন কোনমতে গন্ধ্য না ছুটে।

আমি, "আইচ্ছা" বলে রুমের দরজা টেনে দিলাম।সারারাত জাগার কারণে চোখ দুটি কেমন যানি ঘুমে ঢলঢল করছে।

চোখে পানি দেওয়াটা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে চোখে ঠান্ডা পানির ছাঁটা দিতেই শরীরটা কেঁপে উঠলো। গামছা দিয়ে মুখ মুছে বার হতে যাবো,ঠিক তখনি বাথরুমের দরজার সামনে একটা কম বয়সি লাস্যময়ী নারীকে দেখে চোখ আটকে গেলো আমার।

ঘুমের ঘোরে কি আমি স্বপ্ন দেখছি,ভালোমত চোখ ডলে আবার তাকালাম,নাহ্ কোনো স্বপ্ন নয়।বাস্তবে আমার চোখে সামনে সুন্দরী এক ললনা দাঁড়িয়ে আছে।আমি তো রমিজ চাচাকে বিদায় দিয়ে দরজা লাগিয়ে তারপর বাথরুমে ঢুকেছিলাম,তাহলে এই মেয়ে ঢুকলো কি করে?নাহ্ বার হওয়ার তড়িঘড়ি করে দরজা দিতেই ভুলে গিয়েছিলাম?

সব প্রশ্ন পিছনে ফেলে জানতে চেয়ে বললাম,"কে আপনি?আমার রুমে এতো রাতে কি করছেন?

মেয়েটা হা হা করে হেসে বললো, আমি আপনার সহযাত্রী,নিজের কাঁধে করে বয়ে এনে এখন আবার জানতে চায়ছেন আমি কে,এখানে কি করছি?

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েটির সেই অট্টহাসিটাকে দেখছি।সেই হাসির শব্দ যেন মেঘের গর্জন তোলার মত বুকের ভিতরে গেঁথে গিয়ে আমার প্রাণনাশ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।




চলবে....





লেখা: আশিকুর রহমান

 

Delivered by FeedBurner

a