|১|
শুভ্র মেঘে লালাভ রং ধরেছে। গোধূলি আলোয় রাজ্যসম বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশালাকার পর্বত। ফিনফিনে বাতাসে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির আভাস। বিশাল বুকটাতে এক ঝাঁক দুষ্টু মেঘ নিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে আকাশ। ওয়াই জংশন পাশে রেখে সাইরু হিল রিসোর্ট’র সামনে গাড়ি থামতেই জানালা দিয়ে মাথা বের করল লাবণ্য। প্রায় সাথে সাথেই এক দল চঞ্চল মেঘ আদুরে স্পর্শে ভিজিয়ে দিল তার তুলতুলে গাল, পাতলা ঠোঁট, ছোট্ট নাক আর মাথাভর্তি চুল। লাবণ্য সেকেন্ডের জন্য চোখ বন্ধ করল। তারপর ধীরে ধীরে চোখ মেলে চাইল মিতালি ওই আকাশের দিকে। আকাশের গায়ে আজ বন্ধুত্বের আহ্বান।
' লাবণ্য? জলদি নেমে এসো। আমরা চললাম।'
লাবণ্য ঝটপট নেমে দাঁড়াল। সাইরু রিসোর্টের দিকে চেয়ে আলতো উত্তেজনা বোধ করল বুকে। কাল থেকে টানা সপ্তাহখানেক চলবে স্বপ্নময় দিবারাত্র। দেখা হবে দেশী-বিদেশী কতো গুণীদের চিত্রকর্ম। লাবণ্য ছোট্ট শ্বাস ফেলে লাগেজটা শক্ত হাতে ধরল। 'কালচ্যারাল ট্যালেন্ট' নামে আন্তর্জাতিক এক এক্সিবিশনে অংশগ্রহণ করতে এসেছে লাবণ্য। বিভিন্ন দেশের মানুষ ছুটে আসছে নিজস্ব সংস্কৃতিকে চিত্রকর্ম, সংগীত, থিয়েটারের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে তুলে ধরবে বলে। ছড়িয়ে দিবে তাদের নিজস্ব ভাবনা, জ্ঞান। লাবণ্য দ্রুত পা চালিয়ে দলের সাথে মিশে গেল। মুগ্ধ চোখে প্রকৃতি দেখতে দেখতে বলল,
' কী ব্যাপার বলুন তো নাজমুল ভাই? এতো বিশাল ফিল্ডের কম্পিটিশনের জন্য বাংলাদেশের বান্দরবানের মতো একটি জায়গা সিলেক্ট করা হলো কেন?'
নাজমুল ছোট-খাটো মানুষ। বয়স পেরিয়ে এখন চৌত্রিশের কোঠায়। চোখে-মুখে অদ্ভুত ধূর্ত ভাব। নাজমুল চোখ ছোট ছোট করে লাবণ্যর দিকে তাকাল। নাজমুলের অতিরিক্ত ছোট চোখদুটি হঠাৎই বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে মনে হলো,
' বান্দরবানের মতো জায়গা বলতে কী বুঝাতে চাইছ? তুমি কী বান্দরবানকে আন্ডারেস্টিমেট করছ?'
লাবণ্য ব্যস্ত হয়ে বলল,
' এমা! না, না তা কেন? কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল একটা প্ল্যাটফর্মের জন্য আমেরিকা, সুইডেনের মতো উন্নত দেশগুলোই বেশি প্রাধান্য পাওয়ার কথা। সে হিসেবে বাংলাদেশকে প্রাধান্য দেওয়া হলো, ব্যাপারটা অবাক হওয়ার মতো নয়?'
নাজমুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
' এখানেও নিশ্চয় পলিটিক্স খাটাচ্ছে শালারা। আবার এমনও হতে পারে তারা ন্যাচারাল কিছু চাচ্ছিল। বান্দরবানের ন্যাচারাল ভিউ কিন্তু মুগ্ধ হওয়ার মতো।'
লাবণ্য মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। রিসোর্টের ভেতর ঢুকে নিজেদের নাম বলতেই তাদেরকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিজ নিজ ঘরের চাবি এবং রুম নাম্বার বলে দেওয়া হলো। রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের আপ্যায়নে মুগ্ধ হলো লাবণ্য,
' চমৎকার! বাংলাদেশের রিসোর্টগুলোও যে এমন ওয়েল বিহেভড হয় জানতামই না।'
নাজমুল তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
' ওয়েল বিহেভড কী-না জানি না। তবে সাত দিনের জন্য পুরো রিসোর্টই বুক করে নিয়েছে অনুষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। রিসোর্ট চলছে এখন তাদের নিয়মে। অর্ভ্যথনা থেকে শুরু করে এভ্রিথিং। শালাদের শাসন চালানোর স্বভাব কোনোদিন যাবে না।'
লাবণ্য হাসল। দু'তলার শেষ মাথায় পাশাপাশি তাদের রুম। প্রতি রুমে দু'জন করে থাকার ব্যবস্থা। লাবণ্য দরজায় চাবি দিয়ে নব গোড়াতেই চাপা হৈ-হুল্লোড় কানে এলো। লাবণ্য অবাক হয়ে বলল,
' কীসের আওয়াজ?'
নাজমুল পাত্তা না দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
' আমাদের দেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে একটা থিয়েটার দলও পার্টিসিপেট করছে এবার। ওরা কোনো রুম নেয়নি। রিসোর্টের সামনে তাবু খাটিয়েছে। ওখানেই যত হৈ-হুল্লোড়।'
'থিয়েটার' শব্দটা বিড়বিড় করতে করতে ভেতরে ঢুকল লাবণ্য। ঘরে ঢুকে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি দিল। অদূরে একদল ছেলেমেয়ে নিজ নিজ কাজ করতে করতেই গলা ছেড়ে গান গাইছে। কেউ তাবু খাটাচ্ছে। কেউ-বা মাদুর বিছাচ্ছে। কেউ-বা জড়ো করছে শুকনো কাঠ। কাজের তালে কারো সুর কাটছে না। কথা হারাচ্ছে না। লাবণ্য অবাক চোখে চেয়ে রইল। থিয়েটার ব্যাপারটা ভীষণ প্রাচীন লাগে তার। আধুনিক যুবক-যুবতীরাও যে থিয়েটার নিয়ে মাতামাতি করতে পারে ধারণায় ছিল না তার। কী আশ্চর্য উচ্ছ্বসিত তাদের প্রাণ! গোধূলি সন্ধ্যায় সব ভুলে বারান্দায় ঠেস দিয়ে ওদেরকেই চোখ ভরে দেখতে লাগল লাবণ্য। হঠাৎ খেয়াল করল, তাদের মধ্যকার একটা ছেলেকে অযথায় ভীষণ ভালো লাগছে তার। দলের সবথেকে প্রাণবন্ত সেই মানুষটির গায়ের রং কালো। অথচ কী লাবণ্য তার চোখে-মুখে। প্রতিটি নজরে, কথায়, ভঙ্গিতে যেন ঠিকরে পড়ছে প্রাণ, আনন্দ, বেঁচে থাকার তৃষ্ণা! চোখদুটো ঘুরেফিরে অবচেতনেই লক্ষ্য করছে স্বাস্থ্যবান সেই কৃষ্ণ পুরুষটির ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিমা। সন্ধ্যা গড়িয়ে যখন রাত নামল। আকাশের বুকে উঁকি দিল বিশাল চাঁদ। তাবুর সামনে শুকনো কাঠে আগুন জ্বাললো ছেলেরা। মুক্ত আকাশের নিচে গোল হয়ে বসে শুরু হলো নাটকের রিহার্সেল। স্ক্রিপ্ট হাতে নির্দেশকের আসনে বসে থাকা কৃষ্ণমানবের মুখ লাবণ্য যেন আরও একবার উদ্ভাসিত হলো আগুনের শিখায়। লাবণ্য অনুভব করল তার জ্বর হচ্ছে। ভীষণ জ্বর। শরীর কাঁপিয়ে, মন ছাপিয়ে এ কেমন বিভীষিকাময় জ্বর তার? রাতে খাবার ডাক এলো। দলের অন্যরা জড়ো হলো তার দরজায়। লাবণ্য দরজা খুললো না। ব্যাগ ভর্তি রং-তুলি ছড়িয়ে দিল বারান্দায়। বারান্দার এক কোণে ক্যানভাস ঠিক করে একের পর এক আঁচড় টানতে লাগল কাগজে। নিশুতি রাতে, বিশাল অগ্নিকুণ্ডের পাশে থিয়েটার দলের উচ্ছল রিহার্সালের ছবি আঁকতে গিয়ে রক্তিম আগুনের ওপাশে বসে থাকা মূর্তির মতো সুন্দর সেই যুবা পুরুষটিই উঠে এলো বেশি। সবকিছু ছাপিয়ে কাগজে ফুটে উঠল কামলা রঙের আগুন। আর সেই আগুনের আভায় আলোকিত অদ্ভুত সুন্দর কৃষ্ণ পুরুষ!
সেই বিভীষিকাময় জ্বর নিয়েই রাত কাটল লাবণ্যর। লাজুক চাঁদ ঘুমোতে গিয়ে আকাশ দখল করল তেজস্বী সূর্য। সূর্যের আলো ঠিকরে পড়তেই চঞ্চল হয়ে উঠল পাহাড়ী গাছ, পাখি আর মানুষগুলো। রিসোর্টে তখন সাজ সাজ রব। এক তলার এক পাশটাই হচ্ছে আর্ট এক্সিবিশন। অন্য পাশটায় ফোক সং প্রতিযোগীতা। লাবণ্য আর্ট এক্সিবিশনে নিজের বাছাই করা কিছু ছবি সাজিয়ে নিতেই পাশে এসে দাঁড়াল নাজমুল। বিরক্ত হয়ে বলল,
' কাহিনী কী বলো তো? তুমি তো ভাই অমাবস্যা হয়ে গেছো। দেখা সাক্ষাৎ নেই।'
লাবণ্য ফ্যাকাশে হেসে বলল,
' খুব সিক ফিল করছিলাম নাজমুল ভাই।'
' বলো কী! আর যায় হোক, এই পাহাড়ে ফিট টিট হয়ে যেও না। হাসপাতালে টানাটানি মানেই বিশদ যন্ত্রণা। যদিও মেডিক্যাল টিম আছে এখানে। তবুও সিক ফিক মানেই ঝামেলা। তার থেকে ঝটপট দুটো নাপা গিলে ফেলো। কাহিনি খতম!'
লাবণ্য হেসে ফেলল,
' নাপা কী সব অসুখের ঔষধ নাকি নাজমুল ভাই?'
নাজমুল প্রত্যুত্তরে বিশদ যুক্তি দিল কিন্তু কোনো কথায় লাবণ্যের শ্রবণেন্দ্রিয় পর্যন্ত পৌঁছাল না। ভিড়ের মাঝে একটা মুখ দেখেই কেমন অস্থির হয়ে উঠল সে। কোমল গালদুটো আচমকা লালাভ আভা ছড়াল। কান হয়ে উঠল গরম। লাবণ্য অপরাধীর মতো সংকুচিত হয়ে গেল। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে চোখ সরিয়ে নিল দ্রুত। আবার যখন সেদিকটাই তাকাল তখন সেই মুখটি দেখতে না পেয়ে অস্থিরতা বেড়ে গেল দ্বিগুণ। কোথায় গেল সেই কৃষ্ণ মানব? বাকি সময়টা নিজের অজান্তেই উৎসুক চোখে এদিক-ওদিক দেখতে লাগল লাবণ্য। বুকের ভেতর চাপা এক অভিমান ফুঁসে উঠল বারবার। কিন্তু চোখদুটো শান্ত হলো না। সকাল গড়িয়ে, দুপুর গড়াল। লাবণ্য দলের অন্যান্যদের সাথে খেতে যেতেই আবারও দেখা দিল সেই মানব। ঠিক লাবণ্যদের সামনের টেবিলটিতে বসে আছে সে। তাকে ঘিরে আছে তার দলবল। সামনের টেবিলটিতে উপচে পড়ছে খাবার। সাদা ভাত, আলু ভর্তা, টমেটো ভর্তা, বেগুন ভর্তা, শাকভাজি, পাহাড়ি সবজি, শুটকি, ব্যম্বু চিকেন, ছোট মাছ ফ্রাই, বড় মাছ ফ্রাই, ডাল গুগরি, সঞ্জি, পানি সরবর, সালাদ, ম্যেনুর কোনো খাবারই যেন বাদ দেয়নি তারা। লাবণ্য হেসে ফেলল। বাঁশের কান্ডে সাজিয়ে পাহাড়ি রীতিতে পরিবেশন হচ্ছে খাবার। লাবণ্য বেম্বু ফ্রাইয়ের এক টুকরো মুখে পুড়ে আড়চোখে ছেলেটির দিকে তাকাল। ঠিক তখনই সে বুঝতে পারল, যাকে দেখে মন কাঁপে তার সামনে খাবার খেতে বসা মানেই ভয়াবহ বিপদ। কৃষ্ণমানব তখন গল্পে সাজাতে ব্যস্ত। হাত নেড়ে নেড়ে শুনিয়ে চলেছে কত অজানা, অতৃপ্ত কথা। সবই যেন অমৃত। কোনো এক রূপকথার গল্প! বন্ধুমহলে বরাবরই সুন্দরী বলেই পরিচিত ছিল লাবণ্য। সব থেকে সুন্দর নাকি তার চোখ! এই ছাব্বিশ বছরের জীবনে এই সুন্দর চোখদুটো দিয়ে অনেক রূপবান ছেলেদের দেখেছে সে। বলতে দোষ নেই, মুগ্ধও হয়েছে। কেউ কেউ-বা অহেতুক চিন্তাতেও এসেছে। কেউ কেউ অবসরের কল্পনায় এসেছে। কিন্তু কোনো রূপবানকে দেখেই এমন কাঁপন ধরেনি বুকে। বুক ভারী হয়ে যায়নি দীর্ঘশ্বাসে। লাবণ্য খাওয়া ছেড়ে উঠে গেল। এই লোকের মুখোমুখি বসে থাকা মানেই দমবন্ধ মৃত্যু। আবার কিছুক্ষণ না দেখলেও যে দমবন্ধ অস্থিরতা!
তখন বিকেল। প্রথম দিনের এক্সিবিশনের সমাপ্তি ঘটার আধ ঘন্টা আগে হঠাৎ , একদম আচমকা এক্সিবিশন হলে কৃষ্ণমানবের সামনে পড়ে গেল লাবণ্য। লাবণ্যের দৃষ্টি অস্থির হয়ে গেল। বুক কাঁপতে লাগল। ঘাম ছাড়তে লাগল শরীর। স্মার্ট লাবণ্য এই প্রথমবার কোনো ছেলের চোখে চোখ রাখতে পারল না। স্পষ্ট কথা বলায় অভ্যস্ত কন্ঠটা ভীষণ নিমকহারামের মতো জমাট বেঁধে গেল। কৃষ্ণমানবের পাশ থেকে একজন বলল,
' বাহ! পেইন্টিংটা চমৎকার হয়েছে। বাঙালি মেয়েরা এতো ভালো পেইন্টিং করে ভাবতেই পারিনি।'
লাবণ্য কিছু বলতে গিয়েও কৃষ্ণমানবের দিকে চেয়ে থমকে গেল। বহু প্রচেষ্টাতেও একটা শব্দ বেরুলো না গলা থেকে। কৃষ্ণমানব সূক্ষ্ম চোখে পেইন্টিংটা দেখে বলল,
' উহু। পেইন্টিংটাতে একটা মিসটেক আছে। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে গাঢ় রঙ পড়ে যাওয়ায় ছবির ফোকাস নষ্ট হয়েছে। ব্যাকগ্রাউন্ড কালারটা হালকা হলে অসাধারণ কিছু হতো।'
মন্তব্যটা ছুঁড়ে দিয়ে একদম সাবলীল ভঙ্গিতে অন্য পেইন্টারদের ছবির দিকে চলে গেল কৃষ্ণমানব। তার সেই কন্ঠ! তার সেই স্বপ্নমাখা কন্ঠে শ্রবণেন্দ্রিয় থেকে শুরু করে পুরো দেহ ঝনঝন করে উঠল লাবণ্যর। নিঁখুত, স্পষ্ট উচ্চারণে বলা এই অল্প কিছু কথাতেই লাবণ্যর পৃথিবীটা ঘুরে গেল হঠাৎ। কান, মুখ গরম হয়ে গেল। নিজের এই উদ্দাম, অস্থির, অচেনা অনুভূতিতে নিজেই বিরক্ত হলো লাবণ্য। কিন্তু, এই অনুভূতিকে সামলানোর ক্ষমতা তার রইল না। তার ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখটি খেয়াল করে কৃষ্ণমানবের সেই সঙ্গীটি বলল,
' আপনি ঠিক আছেন? অসুস্থ দেখাচ্ছে। আমি কী কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?'
লাবণ্য তাকাল। চারপাশটা কেমন ঝাপসা লাগছে তার। গা গুলাচ্ছে। হঠাৎ এমন অসুস্থতার কারণ কী? লাবণ্য চারপাশে তাকিয়ে নিজের পরিচিত কাউকে খুঁজলো। কিন্তু, একি! সব এমন ঝাপসা লাগছে কেন? লাবণ্য মৃদু কন্ঠে বলল,
' হঠাৎ শরীর খারাপ লাগছে। আমায় একটু পানি দিতে পারবেন?'
ছেলেটি বলল,
' আপনি বাইরে খোলা হাওয়ায় চলুন। এখানে মেডিক্যাল ক্যাম্প আছে। আপনার উচিত একবার চেক আপ করিয়ে নেওয়া। চলুন, আমি সাহায্য করছি।'
লাবণ্য কথা বাড়াল না। ছেলেটি খুব নম্রতার সাথে একটি হাত ধরে তাকে হাঁটতে সাহায্য করল। পেছন ফিরে সেই কৃষ্ণমানবটিকে ডেকে বলল,
' এই সুব্রত? তুই এখানে থাক। আমি আসছি।'
কৃষ্ণমানব চোখ ফিরিয়ে চেয়ে স্পষ্ট বিস্ময় প্রকাশ করল। তারপর ঠোঁট উল্টে বলল,
' আচ্ছা।'
লাবণ্যের মাথায় চট করে ঢুকে গেল সেই শব্দ, 'সুব্রত'। মাথার ভেতর টেপরেকর্ডারের মতো বাজতে লাগল 'সুব্রত, সুব্রত'। খোলা হাওয়ায় এসে, পানি খেয়ে কিছুটা সুস্থ হলো লাবণ্য। কৃতজ্ঞ কন্ঠে বলল,
' আপনাকে ধন্যবাদ। আসলে কাল রাতে ঘুম হয়নি তো। তারওপর আজ এক্সিবিশন নিয়ে এতো এক্সাইটেড ছিলাম যে সকাল আর দুপুরে ঠিকঠাক খেতেও পারিনি। সব মিলিয়ে প্রেশার ফল করেছে। আপনি না থাকলে ভীষণ বিপদে পড়ে যেতাম।'
ছেলেটি হেসে বলল,
' দূর! এভাবে ধন্যবাদ দেওয়ার মতো কিছু করিনি। যায় হোক, আমি কৌশিক আহমেদ।'
লাবণ্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
' আমি লাবণ্য।'
' লাবণ্য? রবিবাবুর লাবণ্য নাকি? অমিত রায়ও আছে নিশ্চয়?'
লাবণ্য হেসে ফেলল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
' আপনারা বোধহয় থিয়েটার করবেন, তাই না?'
কৌশিক অবাক হয়ে বলল,
' হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কী করে জানলেন?'
' কাল রিহার্সাল করছিলেন দেখলাম। সুব্রতবাবু বুঝি পরিচালক?'
কৌশিক হেসে বলল,
' সুব্রতবাবু? বেশ লাগছে তো শুনতে। একদম মধ্যযুগীয় উপন্যাসের মতো।'
' সুব্রত নামটাই তো প্রাচীন। তাছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সাথে সাহেবের থেকে বাবু-ই বোধহয় বেশি মানায়। আপনাদের পরিচালক সাহেব বুঝি সনাতন ধর্মাবলম্বী?'
প্রশ্নটা করেই হৃদয় চেপে বসে রইল লাবণ্য। বুক কাঁপছে থরথর। কৌশিক যদি উত্তরে 'হ্যাঁ' বলে তখন কী হবে? এতো এতো অনুভূতির কর্ণধার যদি বিধর্মী হয় তবে কী করে এই অনুভূতি সামলাবে লাবণ্য? লাবণ্য মনে মনে কাতর প্রার্থনা করল, 'কৌশিক আপনি উত্তরটা দিবেন না। দয়া করে দিবেন না। উত্তরটা আমি শুনতে চাই না।
চলবে...
Writer:- নৌশিন আহমেদ রোদেলা