Leave a message
> স্যান্যাল বাড়ির ট্রাডিশন | নতুন বাংলা গল্প | Bangla new latest story | Bangla new story
-->

স্যান্যাল বাড়ির ট্রাডিশন | নতুন বাংলা গল্প | Bangla new latest story | Bangla new story

শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসব অষ্টমঙ্গলায়।আমার হাতে একটি প্যাকেট দিয়ে আমার শাশুড়িমা বললেন,

-বৌমা এটা নিয়ে যাও।তোমার মাকে দিও।

জিজ্ঞেস করলাম,

-কি আছে এতে?

-শাড়ি।তোমার মাকে বলো আমি এটা পাঠিয়েছি।

মনে মনে ভাবলাম নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে।তা না'হলে আমার মায়ের জন্য শাড়ি দিতে যাবেনই বা কেন?অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ নয় তো?শাশুড়ি  মা সম্পর্কে এমন খারাপ ভাবনা আমার হত না যদি ওই কথাটা না শুনতাম।ঘটনাটা ঘটল বিয়ের পাঁচ দিনের মাথায়।আত্মীয় স্বজনরা যে যার বাড়ি চলে গেছেন।আমার একমাত্র ননদ সেও সেদিন চলে যাবে।আমি বলেছিলাম,'দিদিভাই আরো দুটো দিন থেকে যাও।' ননদ বলল,'থাকলে হবে না।ছেলের পরীক্ষা সামনে।বিয়ে বাড়িতে অনেক হৈ হুল্লোড় হয়েছে।এর পর থাকা মানে সময় নষ্ট।' বাড়ি যাওয়ার সময় আমার ননদ শাশুড়ি মায়ের ঘরে ঢুকে বলে গেল,

-মা তোমার মনের ইচ্ছেটা এবার পূরণ হবে।নতুন বৌ তো এসেই গেছে।শুরু করে দাও।

আমি শাশুড়ি মায়ের ঘরে ঠিক তখনই ঢুকতে যাচ্ছিলাম,ননদের এমন কথাটা কানে আসতেই ঘরে ঢুকতে গিয়েও আমি আর ঢুকলাম না।তারপর আমার শাশুড়িমা বলে উঠলেন,

-সে কথা বলতে।শুরু তো করবই।এই তো সবে পাঁচ দিন হয়েছে।দাঁড়া,আস্তে আস্তে সব হবে।মনের সমস্ত রাগ এবার উশুল করে নেব।

রাগ উশুল করে নেব এমন কথা শুনে আমি তো হয়ে গেছি।মনে মনে ভাবলাম আমি এই পাঁচদিনে কি এমন করলাম যে রাগ উশুল করবেন?আমি তখন দৌড়ে এসে একেবারে আমার ঘরে।আমার বর তখন জামা প্যান্ট আয়রন করছিল।আমাকে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে বর জিজ্ঞেস করেছিল,

-কি হল,এভাবে দৌড়ে এলে? 

আমি কি উত্তর দেব তখন বুঝতে পারছিলাম না।কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে বললাম,

-কই কিছু না তো।

-যেভাবে তুমি দৌড়ে এলে আমি ভাবলাম ভয় পেয়ে ছুটে এসেছো।

এদিকে  ননদ তখন শাশুড়ি মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে।আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসি,সঙ্গে আমার বরও।আমি কাছে যেতেই ননদ বলল,

-ভালো থেকো।সুখে সংসার করো।সব সময় হাসি খুশি থাকবে।

আমার বরের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,

-ভাই,আরশীকে ভালো রাখিস।ও এ বাড়িতে ও নতুন।ভুল ত্রুটি হলে মানিয়ে নিস।

এমন কথা শুনে আমি হতবাক।কিছুক্ষণ আগেই শাশুড়িমাকে যে ওই রকম একটা কথা বলে এল,আবার আমার সামনে এসে অন্য সুরে কথা?ভাবতেই পারছিলাম না।একটা খটমট ব্যাপার তৈরি করে দিয়ে ননদ বাড়ি চলে গেল।

এদিকে মনের মধ্যে ওই কথাটাই তোলপাড় করছে।ভাবলাম এ কোন বাড়িতে এসে পড়লাম রে বাবা।শাশুড়ি মায়ের মনে অসৎ উদ্দেশ্য আছে জেনেই ভয় করতে লাগল।ভাবছি বাড়িতে ফোন করে কি মাকে জানাব?তারপর ভাবলাম না থাক।মা এমনিতেই টেনশন করে।এসব শুনলে মায়ের প্রেসার বেড়ে যাবে।এমনিতেই দিদিকে নিয়ে চিন্তা করে।নিজের মধ্যেই রেখে দিলাম ব্যাপারটা।ননদ চলে যেতেই বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল।শাশুড়িমাকে তারপর থেকে সন্দেহর চোখেই দেখতে লাগলাম। কিন্তু উনি আমার সাথে এত ভালো ব্যবহার করতে লাগলেন আমি কিছুতেই ওনার ভালো ব্যবহার করাটা মেনে পারছিলাম না।সেদিন দুপুরেই লাঞ্চ করতে বসে দেখলাম শাশুড়িমা অনেক কিছু রান্না করেছেন।খেতে বসে আমার বর বলে উঠল,

-আজ মুড়ি ঘণ্ট রান্না করেছো দেখছি,কি ব্যাপার!

শাশুড়ি বললেন,

-বৌমাকে খাওয়াব বলে।

তারপর কাতলা মাছের বড়ো পিসটা আমার পাতে দিয়ে আমার বরের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-এবার থেকে মাছের সব থেকে বড় পিসটা বৌমার জন্য থাকবে।

মনে মনে তখন ভাবছি মানুষ এত সুন্দর অভিনয় করে কি করে?যার মনে খারাপ চিন্তা থাকে সে মানুষটা আমার জন্য এত ভালো কিছু করছে? এতেই আমার সন্দেহটা বাড়ল।শাশুড়ি মায়ের এই খাতির যত্ন করাটা  আমার চোখে ভালো ঠেকল না তখন।কারণ মনের মধ্যে পুষে রেখেছি ওই কথাটা।তার ওপর অষ্টমঙ্গলায় যাওয়ার সময় মায়ের জন্য শাড়ি পাঠানোটা আমার সন্দেহটাকে আরো বাড়িয়ে তুলল যেন।

আমি অষ্টমঙ্গলায় বাপের গেলাম।শাশুড়িমায়ের পাঠানো শাড়িটা আমার মা হাতে পেয়েই আমার শাশুড়ির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল।আমি কিন্তু খুশি হতে পারলাম না।ভাবলাম চাকরি করা বৌমা পেয়েছে তো।তাই এই সব ন্যাকামি।কারণ আমি জানি এসব করার পিছনে একটা উদ্দেশ্য আছেই।স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছুই করে না।তখন মনে পড়ছিল আমার দিদির কথা।আমার দিদিকেও নাকি দিদির শাশুড়ি বিয়ের পর ঠিক এমন যত্নটাই করেছিলেন।বুঝলাম নতুন বৌ হলে প্রথম  কয়েকদিন এই রকম একটু আধটু সবাই দেখায়।আমার দিদিও প্রথম প্রথম শাশুড়ির ভীষণ প্রশংসা করত।পরে দিদি বুঝেছিল এসব লোক দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়।ভণ্ড কিছু মানুষ থাকে যারা প্রথমে ভালো দেখালেও পরে তাদের আসল রূপটাই চোখে পড়ে।আসলে দিদির স্যালারির টাকা শাশুড়ির হাতে তুলে দেয়নি বলেই অশান্তি।তারপর থেকে আর আদর যত্ন দিদির কপালে আর জোটেনি।

দিদির কথা ভাবলেই যেন আমার চোখে জল আসে।দিদির মত শান্ত স্বভাবের মেয়ের কপালে ওরকম একটা শাশুড়ি জুটবে ভাবতেই পারি না।দিদির বিয়েটা প্রেম করেই।শ্বশুরবাড়িতে দিদির কোনো স্বাধীনতা নেই।অথচ দিদি চাকরি করে।চাকরি করলেও দিদি যেন নিজে থেকে কিছুই করতে পারে  না।বাবা মাকে যদি কিছু দেয় তাও আবার লুকিয়ে।যদি জানতে পারে তাহলেই অশান্তি।অশান্তি শুধু দিদির শাশুড়িই করে না,অনির্বাণদাও দিদির সাথে ঝামেলা করে।অনির্বাণ দা বলে,'মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও তোমার বাবা তোমার থেকে হাত পেতে টাকা নেয় কি করে?' অথচ বিয়ের  আগে এই অনির্বাণদা কত ভালো মানুষ ছিল।বিয়ের পর সব পাল্টে গেল।বাবা মাকে একটু আধটু যা দেয় তাও লুকিয়ে।একটা কথা তাই ভাবি, বিয়ের পর মেয়েরা কেন পর হয়ে যায়?কেন তাদের বাবা মায়ের জন্য কিছুই করতে পারবে না?চাকরি করা মেয়েরা বিয়ের পর বাবা মায়ের জন্য কিছু করলে কেন এত অশান্তি করে?আমি ঠিক করেই রেখেছিলাম আমাকে যেন দিদির মত না হতে হয়।তাই যা করব লুকিয়ে নয়,করব প্রকাশ্যেই।বাবা মায়ের জন্য কিছু করতে গেলে লুকিয়ে করতে হয় নাকি?কারণ আমিও তো চাকরি করি।

অষ্টমঙ্গলা কাটিয়ে শ্বশুর বাড়িতে ফিরি।ছুটির মেয়াদও শেষ হয়।আমি চাকরিতে জয়েন করি।বাড়িতে সদস্য আমরা চারজন।আমি,আমার বর,শ্বশুর আর শাশুড়ি।অষ্টমঙ্গলার পর যখন ফিরলাম,শাশুড়ি বললেন,"ঘরের কাজটা যেমন কাজ,বাইরের কাজটাও তেমনি কাজ।তুমি যেহেতু চাকরি করো তোমাকে সে দিকটা আগে সামলাতে হবে।বাড়ির রান্না বান্না আমি সামলে নেব।ছুটির দিনে তুমি চাইলে রান্না করতে পারো।"

এমন কথা শুনে ভাবলাম এত ভালো মানুষ উনি?কি জানি এর পিছনে কি উদ্দেশ্য?যত দিন যায় ততই আশ্চর্য লাগে মানুষটাকে।সকালে বের হবার আগে টিফিন গুছিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে জলের বোতলে জল ভরে দেওয়া পর্যন্ত এভ্রিথিং।যেমনটি নিজের ছেলেকে করেন তেমনি আমার জন্যও।দু মাস,পাঁচ মাস,সাত মাস,এক বছর কেটে গেল মানুষটার কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ছিল না।যত দিন  যায় তত আরো ভালোটাই চোখে পড়তে থাকল।বৌমার যত্নের কোনো ত্রুটি করেন না।অবাক করার বিষয় আমার স্যালারি নিয়েও কাউকেই মাথা ঘামাতেও দেখেনি।না আমার বর,না আমার শ্বশুড়,না শাশুড়ি।আমার ইচ্ছে মত টাকা আমার বাবাকে দিই।আর সেটা আমার বর, শাশুড়ি সবাই জানে।আমার সময় মত বাপের বাড়ি যাই।আমার স্বাধীনতায় কারো হস্তক্ষেপ নেই।যখন ইচ্ছে হয় আমার মা বাবা আমার শ্বশুরবাড়িতেও আসে।মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে আমার বাবা মা যেভাবে সম্মান পায় সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়।আসলে আমি আমার বাবা মায়ের জন্য  লুকিয়ে  কোনো কিছু করি না।তবে এটা নিয়ে কোনো অভিযোগ করতে দেখিনি কাউকেই।শাশুড়িকে যেহেতু সন্দেহের চোখে দেখতাম সব ভালো কাজের পরেও ওনার গতিবিধি নজরে রাখতাম‌।একদিন আমি আড়াল থেকে শুনতে পাচ্ছি আমার শাশুড়ি আমার বরকে বলছেন,

-ওই বাড়িতেও বৌমার বাবা মা আছেন।তুই আমার জন্য এত সুন্দর একটা শাল কিনেছিস,বৌমার মায়ের জন্য?

-তুমি আমাকে কি ভাবো বল তো?আমি কিনব না সেটা হয়?

-ছেলে মেয়েকে মানুষ করা তো এই জন্যই।আমি জানি সে কর্তব্য তোর আছে।এই যে বৌমা আমাদের জন্য এই যে এত কিছু কিনে কেটে নিয়ে আসে আমাদের সেটা পরম সৌভাগ্য।মেয়েটা বড়ো ভালো।নিজের বাবা মায়ের জন্যও যে করতে পারছে সেটা দেখে ভালো লাগছে।ছেলেই হোক আর মেয়ে বাবা মা কিন্তু কষ্ট করেই মানুষ করে তাদের।উচিত তো বাবা মাকে দেখা শোনা করা।মেয়েটার কর্তব্য কর্ম দেখে ভালো লাগে বেশ।তোর বাবাও তাই বলে,নিজের  বাবা মায়ের জন্য কিছু করতে পারার মত সুখ আর কিছু নেই।যেটা আমি পারিনি সেটা বৌমা করতে পারছে।নিজের অপূর্ণ ইচ্ছে গুলো যদি সন্তানদের মধ্যে দিয়ে পূরণ হতে দেখি তার মত আনন্দের কিছু নেই।আমিও এক সময় চেয়েছিলাম করতে।বাবার একমাত্র মেয়ে ছিলাম আমি।চাকরিও পেলাম।ভেবেছিলাম  বিয়ের পরেও বাবা মায়ের জন্য অনেক কিছু করব।তোর বাবা সায় দিলেও তোর দাদু ঠাকুমা মেনে নিল না।বিয়ের পর আমাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করল।তোর ঠাকুমা বলল,"স্যান্যাল বাড়িতে বৌ রা চাকরি করে না।তাদের একটা ইজ্জত আছে।এমন অভাব নেই যে চাকরি করতে হবে।এই ট্রাডিশন ধরে রাখতে না পারলে এ বাড়িতে তোমার জায়গা হবে না।" মনের কষ্ট নিয়ে চাকরি ছেড়ে দিলাম।তোর বাবাও তখন বাবা মায়ের মুখের ওপর সেভাবে জোর দিয়ে বলতে পারেনি।বললেই অশান্তি হত।আমি অশান্তির ভয়ে সব কিছু মেনে নিয়ে চুপ করে গিয়ে ছিলাম।বাবা মায়ের জন্য নিজে কিছু করতে পারিনি।বড় আক্ষেপ।তবে তোর বাবা লুকিয়ে হেল্প করে গেছে অনেক।একটা রাগ আমার ছিলই।বাড়ির বৌকে তার বাবা মায়ের জন্য কিছু করতে না দেওয়াটা বড় অপরাধ।প্রতিজ্ঞা করেছিলাম স্যান্যাল বাড়ির এই ট্রাডিশন আমি একদিন ভেঙে দেব।স্যানাল বাড়ির বৌ হয়ে এর পর যে আসবে সে যেন চাকরি করে।সে যেন নিজের রোজগারের টাকায় বাবা মাকে ভালো রাখতে পারে।বাড়ির বৌকে অবহেলা নয়,কষ্ট দেওয়া নয়,তাকে যত্ন করাই হবে স্যান্যাল বাড়ির ট্রাডিশন।যা আমি পাইনি,তা আমার বৌমা পাক।যা আমি পারিনি তা আমার বৌমা করুক।তাতেই আমার সুখ।

কথা গুলো শুনে আমি দৌড়ে চলে আসি আমার ঘরে।নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি আর।মুহূর্তের জন্য চোখটা ঝাপসা হয়ে যায়।আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াই।নিজেকে দেখে নিজেই যেন লজ্জিত।একটা সহজ সরল মানসিকতাকে কত খারাপ দৃষ্টিতে দেখেছিলাম আমি।মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নেই সেই আদর্শিনীর কাছে,যিনি নিজেই একটা ট্রাডিশন হয়ে গেছেন ততক্ষণে।অতীতে ঘটে যাওয়া একটা রাগের প্রতিশোধ কেউ এভাবে ভালোবেসে উশুল করতে পারে বলে আমার ধারণা ছিল না।যে ট্রাডিশন মানুষকে আঘাত করে,কষ্ট দেয় সেই ট্রাডিশনকে বদলে নেওয়াটাই হল ভালো মনের পরিচয়।আজ আমার বাবা মায়ের জন্য এত কিছু করতে পারছি,নিজেকে ভালো রাখতে পেরেছি এই মানুষগুলো আমাকে সহযোগিতা করছে বলেই।একটা ভালো পরিবেশ পেয়েছি বলেই নিজের মত চলতে পারি।যা আমার দিদি পায়নি।ভুলটা ভেঙে যায়।তারপর থেকেই সব কিছু ঠিকঠাক চলছে।স্যানাল বাড়ির ট্রাডিশনই আমাকে বদলে দিয়েছিল,বদলে দিয়েছিল আমার নিচু মানসিকতাকে।






সমাপ্ত...






Writer:- সরজিৎ ঘোষ

 

Delivered by FeedBurner

a