৮৩০ খ্রিস্টাব্দ,
মেক্সিকো, গুয়েতেমালাসহ মেসোআমেরিকান রিজিওনে গড়ে ওঠা মায়ান সভ্যতা তার স্বর্ণযুগ পার করছে বলা চলে! প্যালাংকে, কোপান, নারানহো, টিকাল সহ আরো ছোটবড় অনেকগুলো স্থানে গড়ে উঠেছিল মায়াদের সেক্রেড টেম্পলগুলো। যেগুলোকে আমরা "মায়ান পিরামিডস" নামে চিনি। এই টেম্পলগুলো মায়ারা ব্যবহার করত মূলত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, স্যাক্রিফাইস সহ অনেক অনেক কাজে। তো, মায়ারা তাদের দশম "বাকতুন" উদযাপনের প্রিপারেশন নিচ্ছিল, যেটা কিনা পালন করা হয় প্রতি ৪০০ বছর পর-পর।
কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে এই বছরই প্যালাংকো, কোপান এভাবে একে একে মায়াদের সবচেয়ে বৃহৎ টেম্পল টিকালও পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে! প্রায় ৯৫% মায়া এক নিমিষেই উধাও হয়ে যায়, leaving no trace of them!
কি হয়েছিল আসলে মায়াদের সাথে?
কেনই বা তারা তাদের সেক্রেড প্লেসগুলো ছেড়ে চলে গেছিলো? যারা কিনা নিজেদের ধর্মের প্রতি অনেক বেশি ডেডিকেটেড ছিল!
.
মায়াদের এভাবে উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে অনেকেরই মাথায় আসতে পারে যে যুদ্ধের কারণেই হয়ত বা বেশিরভাগ মায়ান জনগোষ্ঠী নিহত হয়েছিল; যেহেতু তখন গোত্রে গোত্রে অনেক বেশি যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকত। কিন্তু, হিস্টোরিয়ানদের মতে, মায়াদের এই সাইটগুলো পর্যবেক্ষণ করে যুদ্ধের কোনো চিহ্নই পাওয়া যায় নি! এই ব্যাপারটা নিয়ে বর্তমান মায়াদের যে সামান্য অংশ টিকে আছে তাদের ভাষ্যটা পিলে চমকে দেওয়ার মত!
তাদের মতে, "They went back home"
.
কি মিন করে আসলে এই কথাটা?
হিস্টোরিয়ানদের মতে, মায়ারা তাদের ঈশ্বর হিসেবে যাদের পূজা করত সেগুলো আসলে কোনো ফ্যান্টাসি ক্যারেক্টর না বরং ভিনগ্রহের প্রাণী, আই মিন এলিয়েন!
তাহলে, কেন এমনটা মনে হল হিস্টোরিয়ানদের?
.
এ ব্যাপারে বলতে গেলে অবশ্য মায়ান ক্যালেন্ডারের ব্যাপারস্যাপার স্বভাবতই উঠে আসে। তো, আর্কিওলজিস্টরা এই পর্যন্ত প্রায় ২০টা(!) মায়ান ক্যালেন্ডার উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। এটা দেখেই বোঝা যায় যে, মায়ারা সময়ের প্রতি কতটা জ্ঞান রাখতো...
.
তাদের একটা সৌরক্যালেন্ডার, একটা চন্দ্র ক্যালেন্ডার, একটা শুক্র ক্যালেন্ডার.... এভাবে মোট বিশটা ক্যালেন্ডার ছিল। এরমধ্যে সবচেয়ে মিস্টেরিয়াস ক্যালেন্ডারটা ছিল "নাইন-ডে ক্যালেন্ডার", এই ক্যালেন্ডারটা আসলে এতটাই মিস্টেরিয়াস যে, হিস্টোরিয়ানরা এখনো এর মর্মোদ্ধার করতে পারেননি।
.
তবে, মায়াদের যে তিনটা প্রাইমারি ক্যালেন্ডার ছিল সেগুলো ছিল মূলত
1. Long Count Calendar
2. Tzolk'in বা Spiritual Calendar
3. Haab' calendar
.
স্পিরিচুয়াল ক্যালেন্ডারটা মায়ারা মূলত ব্যবহার করত তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং গডদের সম্মান প্রদর্শনের দিন গণনার জন্য। যেটাতে, ২৬০ দিনের উল্লেখ পাওয়া যায়। আর, তিন নাম্বার ক্যালেন্ডারটা আইমিন হ্যাব ক্যালেন্ডারটা তাদের বলে দিত, কবে তারা চারা রোপন করবে আর কবে ফসল ঘরে তুলবে।
.
কিন্তু, লং-কাউন্ট ক্যালেন্ডারটা ছিল সবচাইতে ভিন্ন ধরনের। এই ক্যালেন্ডার নিয়ে হিস্টোরিয়ানদের এখনো গবেষণার যেন শেষই নেই। এই লং-কাউন্ট ক্যালেন্ডারটাতে মোট ৫,১২৫ বছর ছিল। প্রসঙ্গতই বলে রাখি যে, মায়াদের প্রতিটা ক্যালেন্ডারই ছিল গোলাকার। তাহলে, পুরো ক্যালেন্ডারটা একবার ঘুরে আসতে সময় লাগবে ৫,১২৫ বছর যেটাকে বলা হয় "One Great Cycle"...
পুরো ক্যালেন্ডারটা আবার ১৩টা ভাগে ভাগ করা। এর প্রত্যেকটা ভাগকে বলা হয় "বাকতুন"। তাহলে প্রতিটা বাকতুনে প্রায় ৪০০ বছর করে থাকে, যেটা আমি উপরেই উল্লেখ করেছি। প্রতিটা বাকতুন শেষ হওয়ার মুহূর্তটাকে মায়ারা স্মরণীয় করে রাখার জন্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করত।
.
কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এই লং-কাউন্ট ক্যালেন্ডারে ৩৬০ দিনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। দ্যাট মিনস, এটা কোনো সৌর ক্যালেন্ডার না। না কোনো চন্দ্র ক্যালেন্ডার! ইভেন আমাদের সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহও ৩৬০ দিনে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে না।
তাহলে, প্রশ্ন থেকেই যায়, কেন মায়ারা এই ক্যালেন্ডারটা বানিয়েছিল?
.
আরো ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, গুয়েতেমালার গ্র্যান্ড প্লাজায় অবস্থিত মায়াদের সাতটা পিরামিড হুবহু প্লাইডিস নক্ষত্রমন্ডলের (Pleaides Constellation) সাতটা নক্ষত্রের জ্যামিতিক প্যাটার্নের সাথে মিলে যায়!
এই ব্যাপারটা যে শুধুমাত্র মায়াদের ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা গেছে তাই না, অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতাগুলোতেও সেইম জিওম্যাট্রিক প্যাটার্ন ব্যবহার করে পিরামিড বা টেম্পল বানাতে দেখা গেছে।
আর্কিওএস্ট্রোনোমারদের মতে, এই প্লাইডিস নক্ষত্রমন্ডলের প্যাটার্নটা যে শুধুমাত্র গ্র্যান্ড প্লাজার ওই সাতটা পিরামিডেই লক্ষ্য করা গেছে তা না, মায়াদের আরো অনেক অনেক মনুমেন্টেও একট প্যাটার্ন লক্ষ্য করা গেছে।
.
তাই, অনেক এলিয়েন থিওরিস্টই মনে করেন, মায়ারা এই পৃথিবীর লোকই না, বরং তারা এসেছে ওই প্লাইডিস নক্ষত্রমন্ডলে অবস্থিত কোনো এক গ্রহ থেকে। বলা বাহুল্য যে, এই প্লাইডিস নক্ষত্রমন্ডল আমাদের পৃথিবী থেকে প্রায় ৪৪৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত!
.
তাহলে মায়ারা কি ওই দূরের নক্ষত্রমন্ডলের কোনো গ্রহ থেকে পৃথিবীতে এসেছে যে কারণে তাদের মনুমেন্টগুলো ওই জ্যামিতিক প্যাটার্ন অনুসারে বানানো হয়েছিল যেন আমরা বুঝতে পারি তাদের অরিজিন সম্পর্কে?
একারণেই কি তাহলে তাদের বর্তমান বংশধরেরা বলেন, "They went back home"?
.
ব্রিটিশ ইউএফও থিওরিস্ট ও " ফাইনাল ইভেন্টস" বইয়ের লেখক নিক রেডফার্ণের মতে, যাদের মায়ারা গড হিসেবে স্মরণ করত তারা হয়তোবা ওই গ্রহের রুলার ছিল যারা তাদের ফোর্সেবলি এখানে পাঠিয়েছে এবং সময় শেষে আবার তাদের তুলে নিয়ে গেছে।
.
বর্তমান মায়ারা বলে, তারা বর্তমানে যে "ক্যালেন্ডার এইজ (Calendar Age)" পার করছে, এটা তাদের ফিফথ এইজ যেটা শুরু হয়েছে ৩১১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগস্ট মাসে! ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, মায়ান সভ্যতার অস্তিত্ব কিন্তু সেইসময় ছিলই না!
.
তাহলে কিভাবে তারা বলল যে তাদের ফিফথ এইজ ওইসময় থেকে শুরু হয়েছে?
যদি এটা মেনেও নেয়, তাহলে তাদের ফার্স্ট এইজ নিশ্চয়ই আরো অনেক অনেক হাজার বছর আগে শুরু হয়েছে?
যেহেতু ওইসময়ে এই পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণাই পাওয়া যায় না, তাহলে তারা সেসময়টায় আসলে কোথায় ছিল? নিশ্চয়ই অন্য কোনো গ্রহে(!) অন্তত এলিয়েন থিওরিস্টরা এমনটাই মনে করেন।
.
এই ব্যাপারটা আরো বেশি রহস্যময় হয় তখন যখন ক্রিপ্টোলজিস্টরা (Cryptologists) মায়াদের স্পিরিচুয়াল বুক "Chilam Balam" নিয়ে ঘাটাঘাটি করে।
এই বই অনুসারে, "নক্ষত্রের সুসজ্জিত পথগুলো যখন আকাশ থেকে নেমে আসে, তখন স্বর্গ থেকে নেমে আসে ২২ জন ঈশ্বর(!) যারা কিনা আমাদের শিক্ষা দেয় ধর্মীয় রীতি-নীতিগুলো, গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কে আর কৃষিকাজ সম্পর্কেও"
.
যেহেতু গণিতের কথা এলো তাহলে এখানে ছোট্ট করে একটা লেখা আপনার ব্রেইনের খাতায় টুকে রাখুন, "শূন্য(০) কিন্তু মায়াদেরই আবিষ্কৃত সংখ্যা"
.
থিওরিস্টদের মতে, চিলাম বালাম বইয়ের এই নক্ষত্র বলতে মায়ারা প্লাইডিস নক্ষত্রমন্ডলকে বুঝিয়েছে আর, ৯ এবং ১৩জন গড বলতে তারা ওই গ্রহের রুলারদের বুঝিয়েছে যারা হয়তবা মায়াদের কোনো শাস্তিস্বরূপ এখানে পাঠিয়েছে, এবং শাস্তির দিনক্ষণ শেষ হওয়ার পর আবার তুলে নিয়ে গেছে।
.
তবে, এখানে প্রশ্ন থেকেই যায়, তাহলে বাকি ৫% এর কি হলো যারা এখনো বেঁচে আছে? যদি দুইয়ে দুইয়ে চার মিলেই যেত তাহলে আমরা বলেই দিতে পারতাম যে, মায়ারা এগ্রহের কোনো মানুষই না, তারা ভিনগ্রহের প্রাণী। ঠিক একইভাবে আমরা উল্টোটাও বলতে পারি না, যতক্ষণ না আমরা মায়ান মিস্ট্রিগুলো সোলভ করতে পারছি....
তথ্যসূত্র:-
উইকিপিডিয়া, লাইভ সায়েন্স, ব্রিটানিকা, হিস্টোরি টিভি
ছবিসূত্র:-
উইকিমিডিয়া, হিস্টোরি টিভি