Leave a message
> ভূপেন হাজারি
-->

ভূপেন হাজারি


কতো হাজারো গান লিখা হয় প্রতিদিন। কিছুদিন মনে রাখে মানুষ, তারপর ভুলে যায়। এর মাঝেও কিছু গান আছে যা শত বছর পরেও মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। লিখতে বসেছি ভূপেন হাজারিকাকে নিয়ে। তিনি কিংবদন্তীতুল্য এক গায়ক। একই সাথে তিনি গান লিখেছেন, গানের সুরও করেছেন। কোটি মানুষের দুঃখ-দূর্দশা, কষ্ট-হতাশা তাকে গভীরভাবে হতাশ করে তোলে। হতাশা থেকে তার ক্ষোভ জন্ম নেয়। সবটুকু ক্ষোভ নদীর উপর চাপিয়ে তিনি লিখে যান তার অনবদ্য গান ‘বিস্তীর্ণ দু’পারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও নিঃশব্দে নীরবে- ও গঙ্গা তুমি-গঙ্গা বইছো কেন’? কি অদ্ভুত প্রতিবাদ সমাজের অসঙ্গতি নিয়ে, মানুষের যন্ত্রণা নিয়ে! কথিত আছে, ৯০ এর দশকের শেষ ভাগে অটল বিহারী বাজপেয়ি যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন এক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অতিথির কাতারে ছিলেন ভূপেন হাজারিকা। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে যখন সবাই চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন অটল বিহারী বাজপেয়ি একটা চিরকুট লিখে হাজারিকার কাছে পাঠান ‘যাযাবর’ গানটি গেয়ে শোনাবার জন্য। বাজপেয়ির অনুরোধে ভূপেন হাজারিকা দর্শকদের গেয়ে শোনান ‘আমি এক যাযাবর। পৃথিবী আমারে আপন করেছে, ভুলেছি নিজেরই ঘর’। এমন এক গান যা শুনলে ভীষণ সংসারী মানুষেরও ক্ষণকালের জন্য যাযাবর হতে ইচ্ছে করে। বাজপেয়ি পরে বলেছিলেন ‘ভূপেনদা’র কন্ঠে এই গান শোনার জন্য আমি যেনো ছটফট করছিলাম তখন’।
এমন কত শত গান তাকে অমর করে রেখেছে। এক জরিপে দেখা গেছে বাংলা ভাষায় সবচয়ে জনপ্রিয় গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। আর দ্বিতীয় কোনটা? ভূপেন হাজারিকার দরাজ কন্ঠে গাওয়া ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না? ও বন্ধু...’। তার গানগুলো শুধুই গান নয়, প্রতিটা লাইন যেনো আমাদের মনের গহীনে লুকানো কোনো কাহিনী। মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি সিনেমার জন্য গান গাওয়া শুরু করেন। প্রথমবার তিনি আসামের এক সিনেমায় গান গেয়েছিলেন। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গানই ছিলো তার ধ্যান, গানই জীবন। এই গানের মাধ্যমেই তিনি শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, অসহায়ের জন্য সমবেদনা জানিয়েছেন আর গানের মাঝে দিয়েই মানুষে মানুষে ধর্ম-বর্ণ এবং জাত নিয়ে বিভেদের প্রতিবাদ করেছেন।
তিনি অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। ছেলেবেলায় পড়ালেখা করেছেন গৌহাটিতে। গ্র্যাজুয়েশন করেছেন বানারসি হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পাড়ি জমান। সেখানে বিখ্যাত কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ‘মাস কম্যিউনিকেশন’ নিয়ে করেছেন পিএইচডি। দেশে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন কিছুদিন। কিন্তু সংগীতের সাধনা তার থেমে থাকেনি। অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে একসময় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন গানের ভুবনে। হয়ে উঠেন বিখ্যাত সুরকার ও গীতিকার। তার লিখা অনেক গানই মূলত আসামী ভাষায় লিখা। তবে অনুবাদ হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়- বিশেষত বাংলা ও হিন্দিতে। জীবিতকালেই তিনি পেয়েছেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, রাষ্ট্রীয় সম্মান। ভারতীয় সিনেমার মর্যাদাপূর্ণ ‘দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার’ পেয়েছেন তিনি ১৯৯২ সালে। পর্যায়ক্রমে তিনি পেয়েছেন পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ। তার মৃত্যুর ৮ বছর বছর ২০১৯ সালের জানুয়ারীতে ভারত সরকার তাকে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারে ভূষিত করে ‘ভারতরত্ন’ (মরণোত্তর)।
আজ ৫ নভেম্বর এই মহান শিল্পীর মৃত্যুদিবস। ২০১১ সালের এই দিনে ৮৫ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন তিনি। তারই লিখা গান ‘চোখ ছলছল করে’- দিয়েই লিখাটা শেষ করবো, আপনার গান আজও আমাদের অনেকের চোখেই জল নিয়ে আসে, আমাদেরও চোখ ছলছল করে। মৃত্যুদিনে এই মানবতাবাদী ও দরদী শিল্পীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা...

Writer:- Rumel M S Pir
 

Delivered by FeedBurner

a