বইঃ নির্বাসন
লেখকঃ সাদাত হোসাইন
কণা- মনসুরের জীবনে নেমে আসে অপ্রত্যাশিত ঝড় যার রেশ উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত রয়ে যায়৷ একদিকে কণার সাথে তার বাবা দেলোয়ার হোসেনের বিভিন্ন বিষয়ে মনোমালিন্য, মা শাহিনা বেগমের প্রতি বিরক্তি, কণাকে হারানোর চিন্তায় দিশেহারা শ্বশুর আজাহার খন্দকার। অপরদিকে ডাকাত দলের একের পর এক অভিযান৷ প্রায় সমান্তরালে চলমান ঘটনাপ্রবাহের আকস্মিকতায় যেনো চরিত্রগুলোর সাথে সাথে পাঠকও দিশেহারা হয়ে যাবে। এসব ঘটনা গল্পকে কোন দিকে নিয়ে যাবে তা পাঠক শুরুতে আন্দাজ ও করতে পারবেনা। আন্দাজ করতে হলে পড়তে হবে "নির্বাসন" উপন্যাস।
১। "অজস্রবার ভালোবাসি বলার পরও ভালোবাসা হয় না। আবার একবার না বলেও পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম অনুভূতি নিয়ে ভালোবেসে ফেলা যায়"।
২। 'জীবন কি আশ্চর্যরকম অনিশ্চিত, অনির্দেশ্য। আর মানুষ সেখানে কী ভীষণ অসহায়! এখানে নাটকের লিখে রাখা পান্ডুলিপিও মঞ্চস্থ হওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে হুট করে বদলে যায়। হয়ে যায় অচেনা অন্য কোনো গল্প। সেই গল্পে মানিয়ে নিতে হয় কুশীলবদের। কিন্তু সেই মানিয়ে নেয়া বড় কষ্টের'।
৩। 'জগতে নিঃসঙ্গ মানুষের কান্নার মতো এমন গভীর আর কিছু নেই'!
৪। ‘মায়া এমন এক জিনিস যা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। হিতাহিত জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পাইয়ে দেয়৷ মায়ার প্রভাব ভালোবাসার চেয়েও বেশি।’
৫। ‘সংসার আসলে সঙসার। সঙ মানেতো পাগল! যেখানে পাগলের বসবাস, সেটাই সঙসার।’
৬। ‘মায়া বড় ভয়ানক এক জাল। এই জালে একবার কেউ আটকে গেলে তার পুরোটা জীবন কেটে যায় সেই জাল ছিন্ন করতে করতে। কিন্তু দিন শেষে দেখা যায়, সেই জালে মানুষ আবার জড়িয়েই পড়েছে। আর কখনোই বের হতে পারে না সে। কিংবা বের হতে চাওয়ার ভান করলেও ভেতরে ভেতরে সে হয়তো আর বের হতে চায়ও না।
লেখকঃ সাদাত হোসাইন
প্রকাশনঃ অন্যধারা
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৩৭৬
মূল্যঃ ৫৯০ টাকা
"লুইস ম্যাকেন" এর একটি কথা আছে-" ভালোবাসা হচ্ছে এক ধরণের মায়া যেখানে পুরুষ এক নারীকে অন্য নারী থেকে আর, নারী এক পুরুষকে অন্য পুরুষ থেকে আলাদা করে দেখে"। সত্যি তাই - ভালবাসা আর মায়া এক হয়ে নারী পুরুষের মধ্যে যে শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরী করে তা ছিন্ন করতে তারা পারে না। এ মায়ার জালে আবদ্ধ হয়ে সব তারা নির্বাসনে যেতেও দ্বিধা করে না। লেখক সাদাত হোসাইন এর নির্বাসন এ রকমই একটা উপন্যাস যেখানে ভালবাসার মায়ায় আবদ্ধ হয়ে উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো একে একে নির্বাসনে যায়। সংসারের মায়া, জীবনের প্রতি মায়া, সম্মানের মায়া, ভালোবাসার মানুষগুলোর জন্য মায়া।
নির্বাসন বৃহৎ উপন্যাস। বড় উপন্যাস পড়তে গেলে অনেকের বিরক্ত লাগে কিন্তু নির্বাসন পড়তে গেলে আপনি হুট করে এর প্রেমে পড়ে যাবেন। মানুষের জীবন যেমন বহতা নদীর মত, তাতে হাসি, কান্না, দুঃখ সব ভাসে, আবার মাঝে মাঝে টর্নেডোর মত সব সমীকরন বদলে দেওয়া ঘটনাও থাকে তেমনি এই উপন্যাস।
এত বড় উপন্যাস পড়তে ধৈর্য দরকার হয়। যদি তাতে মাল মশলা না থাকে তবে আপনি একটুতেই হাল ছেড়ে দেবেন। কাহিনী যদি একটু পরপর আপনাকে চমকে না দিতে পারে, যদি পাঠক মনে প্রশ্ন না জাগে এর পরের পাতায় কি চমক আছে, তবে সেই উপন্যাস বানিজ্যিক ভাবে ফ্লপ। এখন আসি উপন্যাসের মূল কাহিনীতে-
সুবর্নপুর বিলের নাম, সেই বিল ছাড়িয়ে জলের বুকে জঙ্গল। লস্করদের চর জঙ্গলের ওপারে। তোরাব আলী লস্কর হলো লস্করদলের সর্দার। সোনাপুর বাজারে ডাকাতি করতে গিয়ে গ্রামবাসীদের হাতে ধরা পড়ে আর ফেরত আসেনি তেরাব আলী লস্করের মেজো ছেলে ফয়জুল। দীর্ঘ সাত বছর তিনি তার মেজো ছেলের জন্য অপেক্ষা করে আছেন। তোরাব আলী লস্কর তার মেজো ছেলের মেয়ে জোহরাকে নিয়ে খুব ভাল সময় কাটান এবং জোহরাকে নিয়ে অন্য জীবনের স্বপ্ন দেখতে থাকে। তোরাব আলী লস্কর চান না জোহরা লস্কর চরে থেকে জীবন অতিবাহিত করুক।
নাতনিকে তিনি বিল ছাড়িয়ে, চর ছাড়িয়ে বিয়ে দিতে চান অন্য কোনো সুন্দর জাযগায় সুন্দর কোনো ছেলের সাথে।
নাতনিকে তিনি বিল ছাড়িয়ে, চর ছাড়িয়ে বিয়ে দিতে চান অন্য কোনো সুন্দর জাযগায় সুন্দর কোনো ছেলের সাথে।
গল্পের অন্য অংশে তখন ঢাকায় মেডিকেল কলেজে পড়ুয়া মনসুর নবীগঞ্জের আজহার খোন্দকারের বড়ছেলে। মনসুর গোবিন্দপুরের স্কুল মাস্টারের মেয়ে কণার সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তারই ধারাবাহিকতায় দুই পরিবারের মধ্যে ঝগড়া এবং পরিশেষে মনসুর ও কনার প্রনয় সম্পন্ন হয়। আপনারা উপন্যাসটি পড়লেই জানতে পারবেন মনসুর আর কণার প্রেম অনেক ভালবাসাময় ছিল পুরো উপন্যাস জুড়ে। কনা ছাড়া মনসুরের পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কি ভীষন জঘন্য হবে এই কথা দিয়েই লেখক বুঝিয়ে দিয়েছেন তাদের ভালবাসার চমৎকারিত্ব। একটা মানুষের তার নিজের মানুষটিকে শুধুমাত্র পাশে পাবার অপেক্ষায় তার বুকে যে কি ভীষণ তৃষ্ণার উৎপত্তি ঘটে তা কণা-মনসুরের মধ্যে দেখা যায়।- ‘যে হয়েছিল ভোর, অথৈ আদর, নামহীন নদী, একা লাগে যদি, মনে রেখো তাকে।’
ঘটনার এগিয়ে যাওয়ার সূত্র ধরে পরবর্তীতে জোহরার লস্কর দলের সাথে সরাসরি কাজ করবার মধ্য দিয়ে খুন, জখমে লিপ্ত হওয়া, শেষ জীবনের পরিনতি কি হবে। এই লাইন কয়েকটির মতো তা শুধু জোহরাই জানে!-- ‘ও বন্ধু তোমার লগে আমি আমার মন বাইন্ধাছি শুধু আমি জাইনাছি, ‘তোমার ল্যাইগা আমি আমার মন বাইন্ধাছি।’
তার চাচাতো ভাই হানিফের সাথে জোহরার বিয়ে পাকাপাকি হওয়ার পরও ঠিক কেনো জোহরা গড়িমসি করছিল? পাঠক হতচকিত হবেন হঠাৎ হঠাৎ বিভিন্ন জায়গায় উপন্যাসটির মোড় এতো দ্রুত ঘুরে যাওয়া দেখে।
অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা ঘটে যায় আজহার খন্দকারের সর্তকতা বা ভুলের কারনে, জীবনে নেমে আসে দূর্বিষহ বিপত্তি। জোহরার প্রাধান্যে লস্কর চরের সর্দার তোরাব আলীর অস্তিত্ব কোনঠাসা হয়ে যেতে থাকে দিন দিন। লস্কর চরে নিজেদের মধ্যেও ঝামেলা শুরু হয়।
কণা- মনসুরের জীবনে নেমে আসে অপ্রত্যাশিত ঝড় যার রেশ উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত রয়ে যায়৷ একদিকে কণার সাথে তার বাবা দেলোয়ার হোসেনের বিভিন্ন বিষয়ে মনোমালিন্য, মা শাহিনা বেগমের প্রতি বিরক্তি, কণাকে হারানোর চিন্তায় দিশেহারা শ্বশুর আজাহার খন্দকার। অপরদিকে ডাকাত দলের একের পর এক অভিযান৷ প্রায় সমান্তরালে চলমান ঘটনাপ্রবাহের আকস্মিকতায় যেনো চরিত্রগুলোর সাথে সাথে পাঠকও দিশেহারা হয়ে যাবে। এসব ঘটনা গল্পকে কোন দিকে নিয়ে যাবে তা পাঠক শুরুতে আন্দাজ ও করতে পারবেনা। আন্দাজ করতে হলে পড়তে হবে "নির্বাসন" উপন্যাস।
পাঠ পর্যালোচনাঃ লেখক হিসেবে সাদাত হোসাইনের যেমন অনেক সুনাম আছে তেমনি তাকে নিয়ে সমালোচনাও কম নেই। সাধারন পাঠক হিসেবে নির্বাসন হলো আমার পড়া লেখকের প্রথম বই। প্রথম বই পড়ে লেখক হিসেবে সাদাত হোসাইন কেমন তা বিচার করার ক্ষমতা আমার নেই। তবে তার বই পড়ে কিছু লিখতে পারছি এটাই অনেক।
উপন্যাসের পটভূমি যুদ্ধ পরবর্তী ১৯৮৮ সালের। এ উপন্যাস দুটি অংশ নিয়ে লিখিত। লেখক অত্যান্ত সুন্দরভাবে দুটি অংশের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করেছেন বুদ্ধিমানের সাথে এবং সুন্দরভাবে। নির্বাসন উপন্যাস আসলে একটুকরো জীবনের গল্প। এর শুরুটাও নেই শেষটাও নেই। মাঝখানের ঘটনাবলির একটা অংশ আমাদের সামনে দৃশ্যমান শুধু।
কোনো পাঠক যখন গল্পের ভিতর নিজেকে আবিষ্কার করেন, নিজেকে কল্পনা করেন কোনো একটি চরিত্রে তখনই পাঠক মজা পায়, আর এটা হলো যে কোনো ভাল গল্পের মূল চালিকা শক্তি। আমি সত্যি কথা বলতে এ উপন্যাস পড়ে নিজেকে কোনো চরিত্রের সাথে মেলাতে পারিনি তারপরও বিশাল উপন্যাস পড়তে আমার কস্ট হয় নি। কারন- প্রাঞ্জল ভাষায় এক টুকরো জীবনের গল্প অনেক দিন পরে হাতের মুঠোয় ছিল।
উপন্যাসের চরিত্র নিয়ে যদি কিছু বলতে হয় তাহলে আমি জোহরা চরিত্রকে প্রধান চরিত্র হিসেবে বাছাই করবো। আমার মতে এটা একটা নায়িকা নির্ভর উপন্যাস। যে উপন্যাসে জোহরা চরিত্রের আর্বিভাব আগে ঘটে এবং পুরো উপন্যাস জুড়ে তার বিস্তার ছিল চোখে পড়ার মত। অনেকে হয়তো কনা আর মনসুরকে উপন্যাসের নায়ক নায়িকা মনে করে থাকবে।
জোহরা এমন এক চরিত্র যে একই সাথে দুটি রহস্যময় রূপ ধারণ করে থাকে। শান্ত স্নিগ্ধ নদীর মতো সে হঠাৎ কখন যে উত্তাল সমুদ্রে পরিণত হয়ে যায় তা কেউ বুঝে উঠতে পারে না। ডাকাত দলের এক একটি অভিযানে পাঠক দেখবেন জোহরার প্রলয়ঙ্করী রূপ আর সেই সাথে মুখোমুখি হবেন অসংখ্য রোমাঞ্চকর অনুভূতির। সব থেকে বেশি সাহস দেখায় সে মনসুরের প্রেমে পড়ে এবং পরে তাকে মুক্ত করে দিয়ে। নিজ সীদ্ধান্তে অটল থাকার যে কঠিন চরিত্র সাদাত হোসাইন এঁকেছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
কনা এবং মনসুরের প্রেমের যে কথপোকথন তা অনেকটাই নাটুকে মনে হয়েছে আমার কাছে। ভালোবাসার মানুষের সাথে ঠিক এভাবে কথা বলে কিনা মানুষ তা নিয়ে আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে। উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি চরিত্র এস আই মইনুল হোসেন, যিনি প্রায় প্রতিটি ঘটনায় কম বেশি জড়িত ছিলেন।
নির্বাসন’ পাঠক হৃদয়ে সৃষ্টি করবে এক অব্যক্ত বিষণ্ণতা। আমাদের জীবন যে সত্যিই কতটা অনিশ্চিত তা এই উপন্যাস পড়ে বারবার উপলব্ধি হতে থাকে। তবে উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠা পড়ে আমার মনে চরম অতৃপ্তির উৎপত্তি হয়েছে। সাদাত হোসাইন এমনভাবে উপন্যাসটি শেষ করেছেন যাতে অসমাপ্ত শেষ পাতায় পাঠকের কল্পনায় অনেক রকমের দ্বিধাদ্বন্দ্ব মিশ্রিত সমাপ্তি ঘটতে পারে। আপনারা তাহলে উপন্যাসটি শেষ করে সেই নানা রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব সমাপ্তি কি হতে পারে তা কল্পনা করেন?
বই থেকে তুলে আনা কিছু কথা:-
১। "অজস্রবার ভালোবাসি বলার পরও ভালোবাসা হয় না। আবার একবার না বলেও পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম অনুভূতি নিয়ে ভালোবেসে ফেলা যায়"।
২। 'জীবন কি আশ্চর্যরকম অনিশ্চিত, অনির্দেশ্য। আর মানুষ সেখানে কী ভীষণ অসহায়! এখানে নাটকের লিখে রাখা পান্ডুলিপিও মঞ্চস্থ হওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে হুট করে বদলে যায়। হয়ে যায় অচেনা অন্য কোনো গল্প। সেই গল্পে মানিয়ে নিতে হয় কুশীলবদের। কিন্তু সেই মানিয়ে নেয়া বড় কষ্টের'।
৩। 'জগতে নিঃসঙ্গ মানুষের কান্নার মতো এমন গভীর আর কিছু নেই'!
৪। ‘মায়া এমন এক জিনিস যা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। হিতাহিত জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পাইয়ে দেয়৷ মায়ার প্রভাব ভালোবাসার চেয়েও বেশি।’
৫। ‘সংসার আসলে সঙসার। সঙ মানেতো পাগল! যেখানে পাগলের বসবাস, সেটাই সঙসার।’
৬। ‘মায়া বড় ভয়ানক এক জাল। এই জালে একবার কেউ আটকে গেলে তার পুরোটা জীবন কেটে যায় সেই জাল ছিন্ন করতে করতে। কিন্তু দিন শেষে দেখা যায়, সেই জালে মানুষ আবার জড়িয়েই পড়েছে। আর কখনোই বের হতে পারে না সে। কিংবা বের হতে চাওয়ার ভান করলেও ভেতরে ভেতরে সে হয়তো আর বের হতে চায়ও না।