Leave a message
> কনে দেখা আলোয় পর্ব ৯
-->

কনে দেখা আলোয় পর্ব ৯


সাক্ষরের বাম হাতটা কিনঞ্জলের বাম বাহুতে আর ডান হাতে কিনঞ্জলের ডান হাতটা শক্ত করে ধরে ধীরে ধীরে কিনঞ্জলকে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠাচ্ছিলো সাক্ষর।গত দুইদিন ধরে কিনঞ্জল নিজেই হাটতে পারছে তবে পায়ে একটু প্রেশার পড়লেই রাতে পা ফুলে,জ্বর এসে একাকার অবস্থা হয়ে যায়।তাই সাক্ষর আর কিনঞ্জলকে একা ছাড়ে না।বাসায় যতক্ষন থাকে নিজে পাশে থেকেই কিনঞ্জলকে ধরে হাঁটায়।পায়ে একটু প্রেশার পরলে কিনঞ্জল সাক্ষরকে বলতেই সাক্ষর কিনঞ্জলকে পাঁজকোলা করে রুমে নিয়ে বসিয়ে দেয়।আজকেও হাটার সময় হঠাৎ করে পায়ে একটু চিনচিন করতেই কিনঞ্জল বলল,
"সাক্ষর ভাই,পায়ে চিনচিন করছে।এখন আর হাঁটবো না।রুমে চলো।"
কিনঞ্জল কথাটা বলতেই সাক্ষর খানিকটা ঝুকে নির্দ্বিধায় কিনঞ্জলকে পাঁজকোলা করে তুলে রুমের দিকে যেতে লাগলো।আর কিনঞ্জলও সাক্ষরের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
"গতকাল নূর কল করেছিলো।আজকে নাকি আইসিটি প্রাকটিকাল খাতা জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট।আপনি কি আমাকে একটু কলেজে নিয়ে যেতে পারবেন?পা ঠিক থাকলে আমি একাই যেতে পারতাম কিন্তু এখন একা যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না।"
সাক্ষর সামনের দিকে তাকিয়েই বলল,
"এখনতো প্রায় ৮.৩০টা বাজে।ক্লাস তো শুরু হয়ে গেছে।?"
"ব্রেকফাস্ট তো করেই আসলাম।একটু পর বের হবো।আর আমিতো ক্লাস করব না।অফিস-রুমে গিয়ে স্যারকে দিয়ে সাইন করিয়ে আবার চলে আসবো।"
সাক্ষর সব শুনে কেবল বলল,
"হুম"
বেলা ৯টার দিকেই সাক্ষর আর কিনঞ্জল রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়েছিলো।আধা ঘন্টার মধ্যেই কলেজের সব কাজ শেষ করেই কলেজ থেকে বেরিয়ে গেছে।তবে আজকে আর সাক্ষর বাইক নিয়ে বের হওয়ার রিস্কটা নেয়নি গাড়িতেই ফিরছে ওরা দুজন।কিন্তু অদ্ভুদ ব্যাপার হলো কিনঞ্জল থেকে থেকে বারবার আড়চোখে সাক্ষরের দিকে তাকাচ্ছে।সাক্ষর প্রথম থেকেই ব্যাপারটা নোটিশ করলেও চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছিলো।কিন্তু এবার সাক্ষর সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতেই বলল,
"আড়চোখে না তাকিয়ে দেখতে হলে সরাসরি দেখ।আর সামান্য একটা খাতা সাইন করাতে আধঘন্টা লেগে গেলো তোর?কি করছিলি এতক্ষন?স্যারের সাথে আবার লাইন মারার ধান্দা করছিলি না তো?তোর তো আবার স্যারদের সাথে লাইন মারার রেকর্ড আছে!"
সাক্ষরের মুখে কথাটা শুনেই মূহুর্তের মধ্যে কিনঞ্জলের মুখটা তেতো হয়ে গেলো।বিশ্রী রকমের একটা গালি দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে মুখটা ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল,
"স্যারের বয়স অলমোস্ট ফিফটি সেভেন সাক্ষর ভাই।আর ফ্রেন্ডসরা ছাড়ছিলো না।অনেকদিন পর কলেজে এলামতো তাই একটু গল্প করছিলাম।"
"তা কি এমন গল্প করলি যে এত সময় লেগে গেলো?আমি যে বাইরে তোর জন্য ওয়েট করছিলাম ভুলে গেছিলি?"
"ভুলব কেনো?আমরা তো দু'তলার ওই পাশের বিল্ডিংটাতে ছিলাম।ওখান থেকে আপনাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো।আর দেরি তো আপনার জন্যই হলো।"
কিনঞ্জলের কথায় সাক্ষর ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই কিনঞ্জল ঠোঁট বাকিয়ে বলল,
"আমার ফ্রেন্ডসগুলো আপনাকে দেখেই নাকি ক্রাশ খেয়ে গেছে।আপনি দেখতে এমন,আপনার সাইড প্রোফাইল অমন,আপনি হাটলে এর মতন লাগে,চুলে আঙুল দিয়ে ব্যাকব্রাশ করাটা তার মতোন লাগে আরো কত হাবিজাবি বকছিলো।"
মূলত কিনঞ্জল কথাটা ব্যাঙ্গ করে বললেও পাশাপাশি একবার সাক্ষরের চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।সত্যি পাঁচ ফুট সাড়ে এগারো ইঞ্চি লম্বা এই মানুষটা প্রথম দেখাতেই যে কারো নজরে পড়তে বাধ্য।সাক্ষর পড়াশোনার দরুন দীর্ঘ চার বছর লন্ডনে ছিলো সেজন্যই হয়তোবা বাঙালি হলেও সাক্ষরের চেহারায় খানিকটা পাশ্চত্যের ছাপ রয়ে গেছে।উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের সাক্ষরের ভ্রুজোড়ার আকৃতিটা সফট আর্চ আর তার নিচের চোখজোড়া দুটো ভীষণ শান্ত, কালো দেখতে চোখের মণিদুটো যেনো কৃষ্ণগহ্বর।ছোটখাটো হালকা বোচা টাইপ নাকটাও চেহারার সাথে বেশ মানানসই।সেই সাথে গালভর্তি ট্রিম করা দাড়ি,কালচে গোলাপি ঠোঁট আর মাথাভর্তি ঘনকালো চুল।শার্টের হাতাটা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করে রাখার দরুন সাক্ষরের হাতের বড়বড় লোমগুলোও নজর কাড়লো কিনঞ্জলের।মানুষটার সব কিছুতেই যেনো নিঁখুত শৈল্পিক ছোঁয়া রয়েছে।
কিনঞ্জলের এমন বডি স্ক্যান করার মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখেই সাক্ষর ধমকে বলে উঠল,
"তুই আর তোর ফ্রেন্ড সার্কেল সবগুলোই এক ঘাটের গরু।ওগুলোর সাথে থেকে থেকেই কি এমন হয়েছিস?অমন শকুনের মতো করে কি দেখছিস?বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখেই একদম কাত হয়ে যাস।যত্তসব টিন এইজের ফালতু আবেগ!"
এবার কিনঞ্জলও খানিকটা তীক্ষ্ণ মেজাজ নিয়েই বলল,
"আমার সবকিছুই আপনাদের কেনো টিনএইজের ফালতু আবেগ মনে হয় বলুন তো?আমি কাউকে ভালোবাসলে সেটা টিনএইজের আবেগ,কাউকে সুন্দর মনে হলে সেটা আবেগ!অথচ টিনএইজের একটা মেয়েকে পরিবার থেকে ধরেবেধে ঠিকই বিয়ে দিয়ে দিলো।তখন তাদের ম্যাচুরিটি কোথায় ছিলো?"
কিনঞ্জলের প্রশ্নের তোপে পড়ে সাক্ষর গাড়িটা একপাশে পার্ক করল।যদিও প্লেসটা নো পার্কিং এরিয়া ছিলো।সাক্ষর স্টিয়ারিং এর উপর হাত রেখেই খানিকটা কিঞ্জলের দিকে ঘুরে বসে বলল,
"লিসেন কিনঞ্জল,তোর যে বয়সটা এই বয়সে তোর ভালো যে করতে চাইবে তোর তাকেই চিরশত্রু মনে হবে।আর যে আসলেই তোর ক্ষতি
করতে চায় তাকেই তোর পরমাত্মীয় মনে হবে।এজন্যই তুই তোর ফ্যামিলির ডিসিশনটা মানতে পারছিস না।তোর কাছে সৌন্দর্যের মানে হচ্ছে লম্বা করে,ফর্সা,হিরোদের মতো দেখতে সুন্দর মতন একটা ছেলে।কিন্তু বাহ্যিক সৌন্দর্য হলো অনেকটা গাছের ফুলের সুবাসের মতন।একপর্যায়ে তা ক্রমশ ফুরিয়েই যায়।সৌন্দর্য কখনো কাউকে ধরা দেয় না কিনঞ্জল।সৌন্দর্য অনুভব করতে হয়।ভালোবাসার মানুষটা যখন জীবনের শেষ সময়ে বিছানায় নির্জীব হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকবে তখনও তার কুচকে যাওয়া গালদুটো,চোখের নিচের জমা কালি,মুখের বলি রেখা সবকিছুতেই অপার শৈল্পিকতার ছোঁয়া পাবি তুই,যদি তাকে মন থেকে ভালোবেসে থাকিস।আর ভালোবাসার কথা বলছিস তো।তুই তো বলিস তুই নুহাশকে ভালোবাসিস।তা তোর সঙ্গে আমার বিয়ের বয়স তো প্রায় ১৫দিন।এই পনেরো দিনে তুই নুহাশকে ঠিক কতবার মনে করেছিস বলতো?"
কিনঞ্জল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলো,
"ঠিক যতবার আপনি আমাকে হার্ট করেছেন।আমি নুহাশের পৃথিবী ছিলাম।ও কখনো আমাকে কষ্ট দিতাও না।আমার ভালোর কথা ভেবেই ও আমার লাইফ থেকে সরে গিয়েছে।নিজেও কষ্ট পাচ্ছে আর আমাকেও কষ্ট দিচ্ছে।"
এই বলেই কিনঞ্জল ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।সাক্ষর প্রায় সাথে সাথেই ধমকে বলে উঠল,
"কান্না থামা ভ্যাবলি!কতবার বলেছি আমার সামনে কান্না করবি না।"
সাক্ষরের ধমক শুনে কিনঞ্জল এবার একদম হু হু করেই কেঁদে উঠল।এই দেখে সাক্ষর সিট বেল্টটা খুলে খানিকটা ঝুঁকে কিনঞ্জলের ডান হাতটা নিজের হাতে নিয়ে চোখের পানিটুকু মুছিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
"ধূর পাগলি!কাঁদছিস কেনো?আমি কি তোকে বকেছি নাকি?তোকে আমি কতবার বলেছি তোর কান্না আমার ভালো লাগে না।তুই নিজেই বল এই এতগুলো দিনে আমি যে কয়দিন তোর সাথে একটু রুড বিহেব করেছি ঠিক সে কয়দিন তোর নুহাশের কথা মনে পরেছে।কারন তুই আমার আর নুহাশের মধ্যে কম্পেয়ার করতে চাইতি।কিন্তু ভালোবাসায় কি কখনো তুলনা দিয়ে হয়।নুহাশের প্রতি তোর অনূভুতিটুকু যদি সত্যিই ভালোবাসা হতো তবে তুই এক সেকেন্ডের জন্যও নুহাশকে ভুলতে পারতি না,আর না আমার সাথে ওর কম্পেয়ার করতে চাইতি।তবে নুহাশের তোর প্রতি ভালোবাসা নিয়ে আমার নিজেরও কোন সন্দেহ নেই।ছেলেটা সত্যিই তোকে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতো।কিন্তু তাই বলে তুই তার পৃথিবী ছিলি আমি এই কথাটা মানতে পারলাম না।তুই যদি তার পৃথিবীই হবি তাহলে সে এখনো বেঁচে আছে কি করে?ওর দুনিয়াটা তো থমকে যাওয়ার কথা।কিন্তু কষ্ট হলেও কিন্তু নুহাশ বেঁচে আছে।এই পৃথিবীতে সবাই নিজের জন্য বাঁচে।হ্যাঁ আবেগের বশে হয়ত প্রিয়জন হারানোর জন্য জীবন দিয়ে দেয়।তবে আমার চোখে তা নিছক বোকামি।আর নুহাশ মোটেও বোকাদের পর্যায়ভুক্ত নয়।কি করবি বল?আল্লাহ তোকে নুহাশের পাজরের হাড় দিয়ে তৈরি করেনি করেছে আমার পাজর দিয়ে।তুই মানিস কিংবা না মানিস এটাই কিন্তু সত্যি।তাই নিজেকে সকল পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে আর বাস্তবতাকে গ্রহণ করতে শিখ।"
এই বলেই সাক্ষর কিনঞ্জলের ডান হাতটাতে আলতো করে চাপ দিলো।কিনঞ্জল শূন্য দৃষ্টিতে সাক্ষরের দিকে তাকাতেই সাক্ষর আবার বলল,
"আজকে হয়ত তুই আমার কথাগুলোর মানে বুঝতে পারছিস না কিন্তু একদিন আমার বলা এই কথাগুলো মনের ভেতর ঠিকই আওড়াবি।আর বিয়ের কথা বললি তো!তোর বাবা-মা ইমম্যাচুউর নয় বলেই তোকে আমার হাতে তুলে দিয়েছে।বিয়ে হয়েছে বলেতো খুব আক্ষেপ করছিস।কিন্তু এইটা একবার ভাবতো,তোর আগের লাইফ আর ম্যারিড লাইফে কি নূন্যতম পরিবর্তন এসেছে।আমি কি কখনো স্বামীর অধিকার নিয়ে তোর সামনে দাঁড়িয়েছি নাকি আমার পরিবার তোর হাতে সংসারের দ্বায়িত্ব সপে দিয়েছে।বিয়ের আগেও তোর লাইফ যেমন ছিলো এখনো ঠিক তেমনই আছে।তফাৎ শুধু পরিবার আর চোখের সামনের মুখগুলো পাল্টেছে।আমি আর আমার পরিবার তোকে ঠিক ততটুকু সময় দিতে প্রস্তুত যতটুকু তোর নিজেকে ধাতস্ত করতে প্রয়োজন।যা তুই নুহাশের ফ্যামিলি কিংবা অন্য কোন ফ্যামিলি বা লাইফ পার্টনারের থেকে পাবি না। আর নিজের বাবা-মায়ের ডিসিশনের উপর নূন্যতম ভরসাটুকু রাখিস কিনঞ্জল।ইনশাআল্লাহ তুই নিরাশ হবি না।বাবা-মা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না।তাদের কঠিন থেকে কঠিনতম সিন্ধান্তের পেছনেও সন্তানের কল্যান আর সুন্দর জীবন লুকিয়ে থাকে।"
এইটুকু বলেই সাক্ষর কিনঞ্জলের চোখে চোখ রাখল।অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যাকে বলে।সাক্ষর যেনো কিনঞ্জলের চোখের ভেতর দিয়েই ওর সবটা পড়ে ফেলবে।কিনঞ্জল সাক্ষরের চোখে চোখ রেখেই বলল,
"আপনি মানুষটাকে আমি এক বিন্দুও বুঝতে পারি না সাক্ষর ভাই।মাঝে মাঝে মনে হয় আপনি একজন খুব ভালো মনের মানুষ।কি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলেন। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় আপনি একটা ডাকু দলের সর্দার।জল্লাদ আর পিশাচের মতই বজ্জাত,বদমেজাজি একজন প্রানী।"
কিনঞ্জলের কথায় সাক্ষর এবার আর রাগ না করে মুচকি হেসে কিনঞ্জলের গালে হালকা চাপড় মেরে বলল,
"তুই তো ভ্যাবলি,আর সারাজীবন ভ্যাবলিই থাকবি।তাই এতোকিছু বুঝিস না।উমম..আমার বেশ গলা শুকিয়ে আসছে।কাছেই একটা আইসক্রিম পার্লার আছে চল একটু গলা ভিজিয়ে আসি।"
এই বলেই সাক্ষর কিনঞ্জলের উত্তরের অপেক্ষা না করেই সামনে ঘুরে সিট বেল্ট বেধে গাড়ি স্টার্ট করলো।আর কিনঞ্জলও বিড়বিড়িয়ে বলল,
"আপনিও একটা পিশাচ সাক্ষর ভাই।আর সারাজীবন পিশাচই থাকবেন।"
(চলবে)...

Writer:- নাজমুন নাহার তৃপ্তি

 

Delivered by FeedBurner

a