Leave a message
> কনে দেখা আলোয় পর্ব ২৪
-->

কনে দেখা আলোয় পর্ব ২৪


বাড়িসুদ্ধ সবাই হইহই করতে করতে নিজ নিজ লাগেজ,ব্যাগ প্যাকিং করতে শুরু করে দিয়েছে।কালকেই চৌধুরী বাড়ির সবাই নিজেদের গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাবে।সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সপ্তাহ খানেক গ্রামেই থাকবে সবাই।তাহা-তাহি তো প্রচন্ড এক্সাইটেড কেননা তারা এই প্রথমবারের মতো গ্রামে যাবে।ওদের সঙ্গে তাল মিলিয়েছে কিনঞ্জলও।নাচতে নাচতেই নিজেদের জিনিসপত্র গোছাচ্ছে তিনজন মিলে।তবে কিনঞ্জলের আনন্দটা-উল্লাসটা আজকে কেনো জানি সাক্ষরের চোখে বড্ড বেশিই বিঁধছে।এতকিছুর পরেও মেয়েটা এতটা স্বাভাবিক আচরণ করছে কিভাবে এটাই সাক্ষরের মাথায় ঢুকছে না।তবে সাক্ষরকে বেশ এড়িয়ে চলছে।মেয়েটা মনে হয় আসলেই বড় হয়ে গেলো??সব পরিস্থিতিতেই বোধহয় নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে শিখে গেছে।তবে সাক্ষর কেনো পারছে না স্বাভাবিক হতে??এই এত আনন্দ-উল্লাসের মাঝে থেকেও কেবল আনন্দ করতে পারছে না সাক্ষর।একটা অপরাধবোধ গতকাল থেকে ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।এত হৈ-হুল্লোড় কিছুই ওর মনটাকে এক সেকেন্ডের জন্যও শান্ত করতে পারছে না।তাই একটু একা সময় কাটানোর জন্য সাক্ষর সোফা ছেড়ে উঠে ছাদের দিকে পা বাড়ালো।ব্যাপারটা সবার চোখ এড়ালেও সাফিন ব্যাপারটা প্রথম দিক থেকেই খেয়াল করছিলো।তাই সাফিনও সাক্ষরের পেছন পেছন ছাদের দিকে যাচ্ছিলো তবে হুট করেই সাফিন মাঝ সিড়িতে এসে থেমে গেলো।ভাবলো সাক্ষরকে অন্তত কিছুটা সময় একা কাটাতে দেওয়া উচিত।মনটা একটু হালকা হোক তখন না হয় একটু কথা বলে নেওয়া যাবে।এই ভেবেই সাফিন আবার নিচে চলে গেলো।
.
প্রায় ৯-১০ বছর পর স্বামীর ভিটেতে পা রাখতে যাচ্ছেন পরিমন বিবি(সাক্ষরের দাদি)।কথাটা ভাবতেই যেনো পুরোনো স্মৃতিগুলো আরও বেশি করে মনে পরে যাচ্ছে তার।সেই পনেরো বছর বয়সে নিজের ছোট্ট শরীরটাতে বারো হাত লালটুকে শাড়ি জড়িয়ে,কপালে চন্দন লেপ্টে,ঠোঁটে লাল রঙ মেখে ওই বাড়িতেই তো তিনি প্রথম উঠেছিলেন।সাহাবুদ্দিন,সাফিন ওরা দু'ভাইও তো ওই বাড়িতেই জন্মেছে।সাফিন শাহাবুদ্দিনের প্রায় বারো বছরের ছোট।ওদের প্রথম হামাগুড়ি,দু'এক পা হাঁটতেও শিখেছে ওই পুরোনো বাড়ির আঙিনায়।কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চোখগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে পরিমন বিবির।তার মরহুম স্বামী ব্যাবসার কাজে প্রায় সারাবছর ঢাকাতেই থাকতেন।মাসে দু-তিন দিনের জন্য গ্রামে যেতেন স্ত্রী-সন্তানদের দেখতে।এরপর যখন সুফিয়া(সাক্ষরের ফুপি) জন্মালো তখনই তো প্রথম ওই বাড়ি ছেড়ে ঢাকার পথে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে পা বাড়িয়েছিলো পরিমন বিবি।স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে প্রায় প্রতিবছর তার মৃত্যুবার্ষিকীতে গ্রামে পুরো পরিবার নিয়ে এলাকার অসহায় মানুষদের এক বেলা পেটপুরে খাওয়ানোর জন্য যেতেন পরিমন।কিন্তু গত দশবছর যাবত ঢাকাতেই বিভিন্ন মাদ্রাসা,এতিমখানাতেই মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মিলাদ-মাহফিল করেন।এই দীর্ঘসময়টাতে আর গ্রামে যাওয়া হয়নি।তবে ওই বাসার কেয়ারটেকার মাঝেমধ্যেই এসে নিজের পাওনাগণ্ডা বুঝে নিয়ে যান।এ মাসে যখন টাকা নিতে এসেছিলো তখনই তাকে বলে দেওয়া হয়েছে বাড়িঘর যাতে পরিষ্কার করে রাখা হয়।মাস শেষে পুরো পরিবার নিয়ে গ্রামে একবার যাবেন পরিমন।
.
সন্ধ্যা প্রায় লাগলো বলে!এদিকে সাক্ষর দোলনায় বসে হাটুতে ভর দিয়ে হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে তাতে মাথাটা ঠেকিয়ে গতকাল রাতের কথাগুলো একে একে ভাবছিলো।হুট করে কাধে কারো স্পর্শ টের পেয়ে পেছনে তাকাতেই দেখে সাফিন ছোট্ট একটা ট্রেতে করে দু'মগ কফি নিয়ে এসে ওর পাশেই বসল।সাফিন এক মগ কফি সাক্ষরের হাতে দিয়ে নিজেই যেচে বলতে লাগল,
"কি হয়েছে সাক্ষর?সিরিয়াস কিছু যে ঘটেছে তা তো তোর চোখমুখ দেখেই বুঝতে পারছি।আমাকেও কি ব্যাপারটা বলা যাবে না?"
সাক্ষর মগটা একপাশে সরিয়ে রেখে মন খারাপ করেই বলল,
"তোমাকে বলা যাবে না এমন কোন ঘটনা আমার জীবনে ঘটবেই না চাচ্চু।তুমি তো একমাত্র মানুষ যার কাছে আমি লাজলজ্জা বিসর্জন নিয়ে নির্ভয়ে নিজের কথাগুলো বলতে পারি।"
"তাহলে তোর এতটা হীনমন্যতায় ভোগার কারণটা কি?আমিতো আর মরে যাইনি।একটা বার আমাকে ডেকে সবটা বললেই পারিস।হয়ত তোর প্রবলেমের কোন স্যলুউশন দুজন মিলে বের করে ফেলতেও পারি।"
সাক্ষর কিছুটা সময় ঝিম মেরে বসে থেকে এক নিশ্বাসে বলল,
"গতকাল রাতে আমি কিনঞ্জলের প্রতি একদম উইক হয়ে পরেছিলাম চাচ্চু।আর একটা ঘোরের মধ্যে থেকেই কিনঞ্জল ঘুমে থাকাকালীন ওর কাছে চলে গিয়েছিলাম।আর ওর ঘুমটাও তখনই ভেঙে গিয়েছিলো।"
সাফিন চিন্তিত গলায় বলল,
"কিনঞ্জল কি তোর সঙ্গে এই নিয়ে মিসবিহেব করেছে?"
সাক্ষর দোলনায় হেলান দিয়ে মাথা নাড়িয়ে না জানালো।এবার সাফিন কিছুটা সময় ভেবে নিয়ে বলল,
"কিনঞ্জল হয়ত ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে তাই কোন বাজে রিয়্যাক্ট করেনি।তোরা দু'জন তো স্বামী-স্ত্রী কাজেই তোর ওর কাছে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক।কিনঞ্জলও হয়ত তোকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে।"
সাক্ষর এবার লাজলজ্জা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে হতাশ সুরে বলতে লাগলো,
" ব্যাপারটা তুমি যতটা স্বাভাবিক ভাবে ভাবছো ব্যাপারটা কিন্তু আসলেও অতোটা সহজ না চাচ্চু।তুমি তো জানোই কিনঞ্জল কি বাজে ভাবে ঘুমায়।ছোটবেলায় ও তো তোমার সাথে দু-একবার ঘুমিয়েছিলো। মনে নেই ও তোমার গলার উপর পা দিয়ে কিভাবে পা উঠিয়ে দিয়েলেছিলো।গতকাল রাতেও ধরে নাও ওরকম বাজে ভাবেই ঘুমিয়েছিলো আর আমিও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।এতদিন না হয় আমি নিজেই নিজেকে সময় দিচ্ছিলাম।আর যাকে এতটা বছর ছোটবোনের নজরে দেখে এসেছি তার প্রতি দুর্বল হওয়ার প্রশ্নই আসে না।কিন্তু এখনতো ওকে আমি নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছি।ওকে ওর প্রাপ্য ভালোবাসাটাও উজাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করছি। কাজেই ওর প্রতি আমার দুর্বল হওয়াটা খুব স্বাভাবিক।আমিতো একজন মানুষ,রোবট তো আর না!আমারও কিছু চাহিদা আছে।কিন্তু আমার এই মেনে নেওয়াটা কেবলই একপাক্ষিক চাচ্চু।আমার মনে হয়না কিনঞ্জল কখনো আমাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবে।গতকাল রাতে যখন আমি ওর কাছে গিয়েছিলাম আর ওর ঘুমটাও ভেঙে গিয়েছিলো।কিনঞ্জল তখন চোখে ছলছল পানি নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় কেবল বলেছিলো 'প্লিজ সাক্ষর ভাই!' এখন তুমিই বলো ওর চোখে পানি কেনো ছিলো?ও নিশ্চয়ই আমাকে খুব খারাপ একটা ছেলে ভেবেছে।ওর বাধা দেওয়া নিয়ে আমি কিছু ভাবছি না।আমার নিজেরই ওকে আরও সময় দেওয়া প্রয়োজন ছিলো।কিন্তু ভুলটা আবার আমিই করেছি।তুমিই দেখো,আজকে সবার সাথেই হাসি-ঠাট্টা করছে।কেবল আমার সামনেই আসছে না।এবার তুমিই বলো আমি কি করবো?আমার তো সব কিছুই কেমন ঝাপসা মনে হচ্ছে?ও আবার না আমাকে ভুল বুঝে বসে থাকে!"
সব শুনে সাফিন হালকা হেসে সাক্ষরের ঘাড়ে হাত রেখে বলল,
"ধুরর বোকা!এই সামান্য বিষয়টা নিয়ে আমার ভাইপোটা এত আপসেট হয়ে আছে?আমি তো তোকে খুব বুদ্ধিমান ভাবতাম রে সাক্ষর!কিনঞ্জলের ওরকম রিয়্যাক্ট করাটাই তো স্বাভাবিক।বরং ওর ওরকম রিয়্যাক্ট করাটাকেই তো আমি পজিটিভ সাইন হিসেবে দেখছি।ও যদি তোকে নাই মেনে নিতো তাহলে কি আজকে এতটা স্বাভাবিক থাকতো?আর তোর সাথেও তো মিসবিহেব করার কথা।দেখলি না আমিই তখন তোকে জিজ্ঞেস করলাম তোর সাথে মিসবিহেব করেছে কিনা?আর চোখে পানি ছিলো কারণ ও হয়ত ভয় পেয়েছে বা তোকে এতটা কাছে আশা করেনি তাই।একটু সময় দে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।আর তোর সামনেও হয়ত লজ্জায় আসছে না।তোর মধ্যে যেহেতু অপরাধবোধ কাজ করছে।তুই নিজেই ওর কাছে যা।নিজের দিকটা ওর কাছে ক্লিয়ার করে তুলে ধর।আশা করি সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে।আর যদি এরপরও তোর মনে হয় কিনঞ্জল তোকে কখনই মেনে নিতে পারবে না তখন না হয় অন্য পথ বেছে নেওয়া যাবে।"
সবটা শুনে সাক্ষরের মনটা কিছুটা শান্ত হলেও সাফিনের শেষের কথাটা শুনে চমকে উঠে বলল,
"অন্য পথ মানে??"
"ডিভোর্স এর কথা বুঝিয়েছি।দু'জন মানুষের লাইফ তো এমন ছন্নছাড়া হয়ে চলতে পারে না সাক্ষর।কিনঞ্জল যদি তোকে মেনে নেয় তবে তো সব ঠিকঠাক হয়েই গেলো।আর যদি নাই মেনে নিতে পারে তখন না হয় দু'পরিবার মিলে এমন একটা সিদ্ধান্তই নিবো।এখন যা কিনঞ্জলের কাছে গিয়ে একটু কথা বল।ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।আর আমিও নিচে যাই অন্ধকার হয়ে এসেছে প্রায়।কুয়াশাও পড়ছে এখন আর ছাদে বসে থাকিস না ঠান্ডা লেগে যাবে।"
এই বলেই চাচা-ভাতিজা দুজনই নিচে নেমে গেলো।আর সাক্ষর নিজের ঘরের দিকে রওনা দিলো।

(চলবে)


লেখা~ নাজমুন নাহার তৃপ্তি

 

Delivered by FeedBurner

a