Leave a message
> কনে দেখা আলোয় পর্ব ২২
-->

কনে দেখা আলোয় পর্ব ২২


শপিংমলে ঢুকেই সাক্ষর কিনঞ্জলের হাতটা শক্ত করে নিজের হাতে নিয়ে নিলো।এমনিতেই বিয়ের সিজন চলছে এই কারনে এই কয়েকমাস শপিংমল থেকে শুরু করে স্যাকরার ঘর পর্যন্ত মানুষজন হুমড়ি খেয়ে পরে থাকে।এই ভিড়ের মাঝে দুজন আলাদা হয়ে গেলে তখন আরেক বিপদ হবে এই ভেবেই সাক্ষর কিনঞ্জলের হাতটা শক্ত করে ধরেই হাঁটছিলো আর টুকটাক কথা বলছিলো। দুজন কথা বলতে বলতেই সাক্ষর কিনঞ্জলের পছন্দ মাথায় রেখে কিনঞ্জলকে জিজ্ঞেস করে করে নিজেদের রুমের জন্য দরজা-জানালার পর্দা,পাপোশ,বিছানার চাদর,কুশনসহ ঘর সাজানোর কিছু জিনিসপত্র কিনে নিলো।আর তারপরই কিনঞ্জলের বাধা দেওয়া স্বত্ত্বেও নিজে পছন্দ করে কিনঞ্জলকে একটা সাদার মধ্যে সোনালি জড়ির কাজ করা জামদানি শাড়ি,একটা সুতির থ্রি-পিস,একটা টপস,একটা কাশ্মেরি শাল আর তিনটা হিজাব কিনে দিলো।যদিও কিনঞ্জল হিজাব বাধতে পারে না আর কখনো পরেও না।এ কথা সাক্ষরকে বলতেই সাক্ষর বিরস মুখে জবাব দিয়েছে,
"পরতে না পারলে ইউটিউবে টিউটোরিয়াল আছে শিখে নিবি আর তাও না পারলে টপসের সাথে ম্যাচিং করে গলায় পেঁচিয়ে রাখবি।"
তারপর আর কিনঞ্জল কিছুই না বলে ঘুরে ঘুরে সাক্ষরের জন্য একটা ফর্মাল শার্ট,তাহা-তাহির জন্য একই রকম প্রিন্সেস ড্রেস,ফুপির জন্য একটা শাড়ি,দাদির জন্য একটা শাল,বাবার জন্য একটা হাত ঘড়ি আর মায়ের জন্য নিয়েছে।সাফিন চাচ্চুর ক্যামেরাটা গত ট্রীপে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছে বলে তার জন্য একটা ক্যামেরা কিনতে গিয়েও টাকায় হয় নি বলে পরে একটা লেদারের জ্যাকেট নিয়ে নেয় সাক্ষর।আর পরে একসময় চাচ্চুকে ক্যামেরাটা গিফট করবে এই কথা বলতেই কিনঞ্জল নিজের ব্যাগ থেকে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের স্টুডেন্ট একাউন্টের এটিএম কার্ডটা বের করে সাক্ষরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
"এখানে তেরো হাজার দুই-তিনশর মতন টাকা।আর বাকি টাকাটা আপনি মিলিয়ে এখনি ক্যামেরাটা নিয়ে নিন।চাচ্চু খুব খুশি হবে।"
প্রতিত্তোরে সাক্ষর কিনঞ্জলের গালে হালকা চাপড় মেরে বলল,
"নেক্সট মান্থের স্যালারি পেলে আমি নিজেই কিনে দিবো চাচ্চুকে।এই মাসে আজকে অনেক খরচ হয়ে গেছে আর খুব বেশি টাকাও নেই আমার কাছে।বাকি মাসটাও তো চলতে হবে,বিয়ে করেছি বউয়ের প্রয়োজনগুলোও তো আমাকেই দেখতে হবে তাই এখন নিলাম না।তবে নেক্সট মান্থে স্যালারি পেলেই চাচ্চুকে ক্যামেরাটা গিফট করব।আর তুই বাচ্চা মানুষ এত টাকা জমালি কিভাবে?
"টিফিনের টাকা,ঈদের সালামি এগুলোই।আবার বাবাও মাঝেমধ্যে টাকা দিতো ওগুলোই কলেজে যাওয়ার পথে একাউন্টে জমা রাখলাম।একটু একটু করে জমাতে জমাতে এতগুলো টাকা হয়ে গেছে।"
এই শুনে সাক্ষর হেসে বলল,
"বাবাহ!আমার বউটা দেখি বেশ লক্ষী।মাসের শুরুতে আমার স্যালারিটাও তোর হাতে তুলে দিতে হবে দেখছি।তুই নিজের কাছে সব টাকা রাখবি আমার প্রয়োজনে আমি তোর থেকে চেয়ে নিবো।আর যদি দেখিস আলতু ফালতু খরচের জন্য টাকা চাইছি তাহলে একদম দিবি না।বেশি বাড়াবাড়ি করলে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা বানিয়ে দিবি আমাকে।আমার যা খরুচে স্বভাব!"
কিনঞ্জল মুখে কিছু না বললেও সাক্ষরের কথায় নিজের হাসিটা অনেক কষ্টে চেপে রাখল আর খানিকটা লজ্জাও পেলো ওকে লক্ষীবউ বলায়।হুট করেই কিনঞ্জল কি যেনো ভেবে সাক্ষরকে বলল,
"সাক্ষর ভাই,আমি একটু ওয়াশরুমে গেলাম।আপনি এখানেই একটু দাঁড়িয়ে থাকুন আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে আসবো।"
এই বলেই কিনঞ্জল চলে গেলো।সাক্ষর মিনিট দেড়েক দাড়িয়ে থেকেই একটু হাঁটাহাঁটি করতে লাগল।সুযোগ বুঝে পাশেই একটা শপে ঢুকে লেডিস শপকিপারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
"এক্সকিউজ মি আপু,আমাকে একটু হেল্প করতে পারবেন?"
ফর্সামতন এক গোলগাল চেহারার অধিকারী মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল,
"Hello sir.How can i help you?
সাক্ষর একটু ভেবে বলল,
"আপু,এই যে আপনি এখন যেভাবে সেজে আছে তার জন্য কি কি প্রডাক্ট কিনতে হবে??
শপকিপার মেয়েটি প্রথম দিকে একটু ভড়কে গেলেও পরে হালকা হেসে বলল,
"স্যার,আমিতো প্রাইমার,ফাইন্ডেশন,কনসিলার, হাইলাইটার,ব্লাশ,বেকিং পাউডার,আইলাইনার, আইল্যাশ, কাজল,শ্যাডো,লিপস্টিক,সেটিং স্প্রেসহ আরও কিছু প্রডাক্ট ইউজ করেছি।কিন্তু এই সব প্রডাক্ট আবার স্কিনটোন,ড্রাই স্কিন,অয়েলি স্কিনের উপর ডিপেন্ড করে নিতে হয়।এখন আপনার প্রিয়জন মানে যার জন্য এসব নিতে চাইছেন তার স্কিনটোন,কি ধরনের স্কিন এইসব না জেনে তো আমি কোন প্রডাক্ট সাজেস্ট করতে পারব না।"
সাক্ষর চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
"আমার স্ত্রীর গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা।তাহলে কি কি নিতে হবে?আর হ্যাঁ প্রচুর অয়েলি স্কিন ওর।মুখে কিছুই ইউজ করতে পারে না।শপিংব্যাগ থেকে সাদা জামদানিটা বের করে শপকিপার মেয়েটাকে দেখিয়ে বলল এই শাড়িটা পরার পর সাজার জন্য যা যা লাগবে সব দিয়ে দিন।"
মেয়েটা সাক্ষরের কথায় হাসি চেপে একে একে কাজল,একপাতা টিপ,লিপস্টিক আর আলতা একটা প্যাকেটে ভরে পাশেই এই শপের জুয়েলারি সেকশনে গিয়ে এক জোড়া গোন্ডেন কালারের স্টোনের ভারী ঝুমকো,এক জোড়া সেইম কালারের স্টোন বসানো নুপুর আর এক সারিতে সাদা স্টোন বসানে একটা বিছা এনে দিলো সাক্ষরকে।প্যাক করতে করতে বলল,
"ম্যামের হাতের মাপ না জানায় চুড়িটা দেওয়া হয়নি স্যার।আপনি ম্যামকে নিয়ে আরেকদিন এসে চুড়িটা কিনে নিয়েন।আর আর্টিফিশিয়াল ফুলের মালা ছিলো আমাদের কাছে তবে ম্যাম যেদিন এই শাড়িটা পরবে খোপায় দেওয়ার জন্য আপুকে বেলি ফুলের গাজরা এনে দিয়েন।আশা করি আপনি আপনার স্ত্রীকে যে সাজে দেখতে চাইছে এই কয়টা জিনিসেই হয়ে যাবে।তারজন্য আমার এই ডেস্কে রাখা এত্তগুলা প্রডাক্টের প্রয়োজন পরবে না।"
এইকথা বলেই মেয়েটা এবার একটু জোড়ে হেসেই বলল,
"আপনার জায়গায় আজকে অন্য কেউ থাকলে কম করে হলেও পনেরো-বিশ হাজার টাকার প্রডাক্ট হাতে ধরিয়ে দিতাম।"
সাক্ষরও মেয়েটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হেসে দিয়ে বলল,
" থ্যাংক ইউ বোন।আমাকে সাহায্য করার জন্য।আসলে মেয়েদের সাজগোজ করতে কি কি প্রয়োজন এইসব সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই।"
মেয়েটা মিষ্টি হেসে বলল,
"আপনার আমার মুখের দিকে আঙ্গুল তাক করে আমি সাজতে কি কি ইউজ করেছি এই কথা শুনেই আমি বুঝতে পেরেছি যে আপনার মেয়েদের সাজগোজ সম্পর্কে কোন ধারণা নেই।যাই হোক,আবার আসবেন স্যার।"
সাক্ষর হেসে বলল,
"অবশ্যই।"
এই বলে সাক্ষর কাউন্টারে টাকা পে করতে গিয়েই দেখল কিনঞ্জল পাশের একটা দোকানে দাড়িয়ে লেডিস শপকিপারের সঙ্গে কথা বলছে।সাক্ষর টাকাটা পে করেই ওই শপে ঢুকতেই দেখল কিনঞ্জল একটা কাগজে মোড়ানো প্যাকেট নিজের ব্যাগপ্যাকে ঢোকালো।আর একটা একশো টাকার নোট আরেকটা দশ টাকার নোট দিয়ে বের হতে গিয়েই সাক্ষরকে দেখতেই একটু বিব্রত হলো।কিন্তু মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
"আপনাকে বললাম না আমার প্রয়োজনীয় কিছু কেনার আছে।এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম ভাবলাম এখানে যেহেতু আছে নিয়েই যাই।"
সাক্ষর আর তেমন কিছুই না বলে আবার আগের দোকানটায় গিয়ে সেই শপকিপার মেয়েটিকে বলল,
"আপু যে চুড়ি জোড়া দিতে চেয়েছিলেন ওর হাতের মাপে দিন।আর কিনঞ্জল তুই এই দোকান'টায় একটু থাক আমি আসছি।"
"ঠিকাছে সাক্ষর ভাই!"
এই বলেই সাক্ষর চলে গেলে শপকিপার মেয়েটি কিনঞ্জকে উদ্দেশ্য করে বলল,
"আপনার ভাবী কিন্তু বেশ ভাগ্যবতী আপু।এমন একটা মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে।আপনার ভাবিও মনে হয় আপনার মতই শুকনা।তাই আপনার হাতের সাইজের চুড়ি নিচ্ছে।"
কিনঞ্জল মেয়েটার কথায় ভ্রু কুঁচকালো।মনে কৌতূহল জাগলেও মেয়েটার এমন উদ্ভট কথার কারনটা কেনো জানি জিজ্ঞেস করল না।বরং সাক্ষর যেহেতু নেই এই সুযোগে বাকি দরকারি জিনিসটাও কিনে নিয়ে ব্যাগে ভরে ফেলল।"
সাক্ষর একে একে ডার্ক চকলেট,হট ব্যাগ,কিছু কাঠবাদাম,পেস্তা বাদাম কিনল।এর পরই একটা পেস্ট্রি শপে ঢুকে চকলেট ব্রাউনি,সুইজ রোল,কাপ কেক নিয়ে নিলো।বিশেষ করে কিনঞ্জলের প্রিয় ভেলবেট কেকটা নিতে একদম ভুলল না।সবকিছুই কিনঞ্জলের সাথে সাথে তাহা-তাহির জন্যও নিয়ে নিলো।এরপরই কিনঞ্জলকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।আর রাস্তার ধারের ছোট্ট একটা ডিস্পেন্সারিতে গিয়ে এক পাতা ওষুধ আর দুই-চারটে জিনিস নিয়ে নিলো।
ড্রাইভ করতে করতেই সাক্ষর কিনঞ্জলের দিকে একবার তাকিয়ে দেখল মুখটা একদম ফ্যাকাসে হয়ে আছে।কারণটা অবশ্য সাক্ষর আগেই বুঝে গেছে।তবুও ধীর গলায় সামনের দিকে তাকিয়েই বলল,
"পিরিয়ড লজ্জার কিছু না কিনঞ্জল বরং একটা মেয়ের নারীত্বকে পরিপূর্ণ করে।পিরিয়ড নিয়ে হাসি-তামাশা বা ঘৃণা করার মত অমানুষ বা মূর্খ কোনটাই আমি নই।তাই এরপর থেকে আমার কাছে কিছু না লুকিয়ে যখন যা প্রয়োজন নিজ থেকেই বলবি।আর ওই সাদা ব্যাগটাতে কিছু ডার্ক চকলেট,হট ব্যাগ,বাদাম,কেক-টেক আছে।বাসার খাবার খেতে ইচ্ছে না করলে ওগুলো খাবি।আর বাদাম প্রতিদিন খাবি।আর হট ব্যাগ এনেছি পেটে-কোমড়ে ব্যাথা করলে তার জন্য।আর পেট ব্যাথার কিছু ওষুধও আছে।প্যাড কোনটা ইউজ করিস তা তো জানি না তাই দোকানদার যেটা ভালো বলেছে সেটাই নিয়ে এসেছি।"
কিনঞ্জল লজ্জায় সাক্ষরের দিকে তাকাতেই পারছে না।মাথা নিচু করেই বসে আছে।মাথাতেই ঢুকছে না সাক্ষর ব্যাপারটা বুঝলো কিভাবে?সাক্ষরভাই খুব বড়জোর প্যাডের প্যাকটা ব্যাগে ঢুকাতে দেখেছে।তবে তাও তো পেপারে মোড়ানো ছিলো।হয়ত প্যাকেটের সাইজ আর কিনঞ্জলের বিব্রত হওয়া দেখেই দুইয়ে-দুইয়ে চার মিলিয়ে নিয়েছে।
সাক্ষর আবারও বলল,
"চোখ-মুখ এমন ফ্যাকাসে লাগছে কেনো?তোর কি খুব পেট ব্যাথা করছে?"
কিনঞ্জল লজ্জায় চোখমুখ বুজে বলল,
"সাক্ষর ভাই,আমার পিরিয়ড হয়নি।সামনেই ডেট আর বাসায় কিছু ছিলো না বলে আগেই প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনতে এসেছিলাম।আপনি একটু বেশিই ভাবছেন।"
সাক্ষর ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বলল,
"ওহ্!সে যাই হোক।আর এত লজ্জা পাচ্ছিস কেনো?তোর তো অহংকার হওয়ার কথা।বরং তোর পিরিয়ড না হলে আমাকেই ছুটোছুটি করতে হতো।এই জীবনে আমার বাপ হওয়ার সাধ ঘুচে যেতো।যাই হোক ডেট কবে?আমাকেও তো তোর ওইদিন গুলোতে যত্ন-আত্তি করতে হবে।"
কিনঞ্জল আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,
"এক সপ্তাহ পর!"

(চলবে)...

লিখা:~ নাজমুন নাহার তৃপ্তি

 

Delivered by FeedBurner

a