> আশ্রয় | Bangla Short Story | Boipoka365
-->

আশ্রয় | Bangla Short Story | Boipoka365


রুমে বসেই পাশের রুম থেকে আমার বন্ধু রিফাত আর ওর স্ত্রীর ঝগড়া শুনতে পাচ্ছি। এমনকি ঝগড়ার মূল বিষয়বস্তু আমাকে নিয়েই। রিফাত বারবার তিথিকে বলছে,

"তুমি একটু চুপ করো! পাশের রুমে কিন্তু মারুফ আমাদের সব কথা শুনতে পাচ্ছে। আর ওতো এখানে বেশিদিন থাকবে না, মাত্র তিনদিন। অফিসের কাজ সেরেই চলে যাবে বলছে। আর ঢাকাতে কেউ নেই দেখেইতো আমাদের এখানে এসেছে।"

রিফাতের কথা শেষ না হতেই তিথি উত্তেজিত কণ্ঠে বলে,

"আমি আর একটা কথাও শুনতে চাই না। কেনো আমাদের এখানেই আসা লাগবে কেনো? মেসে থাকতে পারলো না? আমার কি ঠ্যাকা পরছে যে এসব আলতু ফালতু মানুষকে রান্না করে খাওয়াবো? তুমি যদি একে বিতাড়িত না করো তাহলে আমি সাফ সাফ বলে দিচ্ছি আমি কোনো রান্নাবান্না করতে পারবো না।"

পরক্ষণেই আমি ঠাস করে একটি চড়ের শব্দ বেশ স্পষ্টভাবে শুনতে পেলাম। মুহূর্তেই আমার শরীরটা কেমন যেন করে উঠলো।

রাত এখন দশটা, তাই চাইলেও এই মুহূর্তে কোথাও যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। স্টুডেন্ট লাইফে ঢাকা শহরকে ভেজে খেয়েছি বলা যায়। কতশত মানুষকে নিজের মেসে জায়গা দিয়েছি তার হিসেব নেই কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের দিক ভাবলে চলবে না সেটাও ঠিক। কারণ একটি ফ্যামিলি বাসাতে অবশ্যই আমার মতো এমন অচেনা এক ছেলেকে জায়গা দিতে যেকোনো নারীরই মন চাইবে না, এটাই হয়তো স্বাভাবিক। 

কোনোরকম ইতঃস্তত ভঙ্গিতে খাঁটের উপর বসে আছি এমন সময় রিফাত হাতে একটি বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। আমি নিশ্চিত হলাম এটা ও কিছুক্ষণ আগেই হয়তো দোকান থেকে কিনে নিয়ে এসেছে। টেবিলের উপর প্যাকেটটি রেখে যখনি ও প্লেট নিয়ে আসতে আবার রুম থেকে চলে যেতে ধরবে তখনি আমি ওকে ডাক দিয়ে বলি,

"রিফাত! আমার অফিসের কাজ কালকেই শেষ হবে আর কালকে সকাল সকালই এখান থেকে সরাসরি বের হয়ে যাবো, এরপর ট্রেনিং শেষে সেখান থেকেই বাড়িতে রওনা দিবো। বুঝছিস?"

রিফাত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

"কেনো? তুই না বললি যে তোর তিনদিনের ট্রেনিং?"

আমি ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বলি,

"না মানে আমিও তিনদিনের টার্গেট নিয়েই এসেছিলাম কিন্তু কিছুক্ষণ আগে অফিস থেকে কল দিয়ে বললো যে একদিনেরই নাকি ট্রেনিং হবে। তাই আর কি!"

রিফাত হয়তো বুঝতে পেরেছে কিছুটা হলেও যে আমি কোনো এক অজুহাতে ওর বাসা থেকে চলে যেতে চাচ্ছি। তবুও একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

"ঠিক আছে। সমস্যা নেই। কিন্তু এমনিতে থেকে যা কয়েকটা দিন।"

শেষ কথাটা বলার সময় আমার মনে হলো ওর গলাটা কেমন যেন আটকে এসেছে। আমিও আর ওকে বিপদে না ফেলে হাসিমুখে বলি,

"আরে না না! অফিসের কাজ ছেড়ে কি থাকা যায়? আবার যদি ঢাকাতে আসি তখন নাহয় দেখা যাবে।"

রিফাত এক চিলতে হাসি দিয়ে বলে,

"ঠিক আছে তাহলে তুই একটু বস আমি প্লেট নিয়ে আসি।"

এই বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেলো আমার বন্ধু। ওর কথা শুনে আমার মুখে হাসি ফুটানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই এইমুহূর্তে।

একটি আবাসিক হোটেলে উঠেছি দুইদিনের জন্য। ঢাকার শহরের হোটেল গুলো যে বেশ ব্যায়বহুল তা আগেই জানতাম, দুই রাত থাকার জন্যই আমাকে ব্যয় করতে হবে তিন হাজার টাকা আর খাওয়ার কথাতো বাদই দিলাম। হোটেল রুমের মধ্যে বসে আছি এমন সময় আমার স্ত্রী মিহি আমাকে কল দিলো। কলটি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে ওঠে,

"কেমন আছো? আর রিফাত ভাই ওনারা কেমন আছে? ভাবী ভালো আছেতো?"

মেয়েটির এতোগুলো প্রশ্ন শুনে আমি স্বাভাবিক কণ্ঠে বলি,

"হ্যাঁ সবাই ভালো আছে। আর ভাবীতো আজকে আমার জন্য অনেক কিছু রান্না করেছে। তার মতো অমায়িক মানুষ হয়ই না, বুঝছো?"

মিহি উৎফুল্ল স্বরে ওপাশ থেকে বলে,

"বলো কি! আমিও জানতাম রিফাত ভাইয়ের বউ ভালোই হবে। তুমি একটু ভাবীর কাছে ফোনটা দাও আমি একটু কথা বলি।"

আমার স্ত্রীর কথা শুনে মুহূর্তেই আমার হৃদপিন্ডটি ছ্যাঁত করে উঠলো। কোনোরকম নিজেকে আয়ত্তে এনে বলি,

"আরে এখন আমি একটু বাহিরে আছি। পরে নাহয় তোমার সাথে কথা বলিয়ে দিবো।"

মিহি আমার কথা শুনে আর এব্যাপারে কিছু বলেনি, টুকটাক ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে শেষমেশ ফোনটি রেখে দেয়।

আমি যদি এখন মিহিকে গতকাল রাতের কথাগুলো বলতাম তাহলে হয়তো ওর কষ্টের সীমা থাকতো না পাশাপাশি দুই একটা কথাও হয়তো আমাকে শুনিয়ে দিতো। কারণ একটা সময় যখন রিফাত ছাত্রাবস্থায় নিজের শূন্য পকেটে আমার মেসে মাসের পর মাস ফ্রি-তে থেকেছিল এবং খেয়েছিল সেটা মিহির অজানা নয়।

এরপর পার হয়েছে তিনবছর...

অফিস থেকে আমাকে শেষমেশ অনেক পত্র দরখাস্ত দেওয়ার পর ঢাকা শহরে ট্রান্সফার করলো। কারণ রিফাতের বাড়িতে সেই ঘটনার পর থেকে নিজের মধ্যে এক অজানা জেদ চলে এসেছিল যে যেভাবেই হোক ঢাকাতে ট্রান্সফার হবো। আমার স্ত্রী এখনো জানে না এই তোড়জোড়ের আসল কারণটা কি? 

সেদিন হঠাৎই রিফাত আমাকে ফোন দেয়। বহুদিন পর ওর ফোন পেয়ে বেশ খুশিই হয়েছিলাম কারণ যত যাই হোক বন্ধুত্বের বন্ধন কি আর ভোলা যায়? টুকটাক খোঁজখবর নিয়ে হঠাৎই রিফাত বলে,

"বন্ধু তোর সাথে একটা কথা ছিল! আসলে আমার চাকরিটা চলে যাওয়ার পর গ্রামে এসে ব্যবসা করছি সেটাতো জানিসই। মূলত আমার শাশুড়ির অবস্থা খুবই খারাপ! ক্যান্সার ধরা পরেছে। ডাক্তার বলছে ঢাকা নিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাতে, তাই আর কি...।"

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলি,

"সমস্যা কি? আমার বাসায় চলে আয়। আমার বাসার একরুম সবসময় খালি থাকে। মূলত মেহমান দের জন্যই একরুম এক্সট্রা দেখে ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম।"

রিফাত ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বলে,

"সেটা নাহয় বুঝলাম কিন্তু ভাবীর আবার কোনো সমস্যা হবে নাতো? উনি যদি রাগ করে!"

আমি সামান্য হেসে বলি,

"আরে ব্যাটা কি বলিস! সেই তো মেহমানের কথা চিন্তা করে একরুম আমাকে বেশি দেখে বাসা ভাড়া নিতে বলছে। ওসব নিয়ে চিন্তা নেই চলে আয়। তোরা আসলে মিহি ঠিকই খুশি হবে। আর ঢাকাতে কেউ বেড়াতে আসে নাকি? প্রয়োজনের জন্যইতো আসে।"

রিফাত আমার কথা শুনে সাথে সাথে উৎফুল্ল স্বরে বলে,

"অনেক ধন্যবাদ বন্ধু। তুই না থাকলে আমার কোথাও বাসা ভাড়া নেওয়ারও উপায় ছিল না। এখন খুবই সংকটে আছিরে বন্ধু।"

রিফাতের স্ত্রী তিথির প্লেটে যখন আমার স্ত্রী বড় একটি রুই মাছের পিস দিতে যাবে তখনি তিথি লজ্জা পেয়ে বলে,

"আরে ভাবী কি করছেন? আপনাদের এখানে আশ্রয় পেয়েছি এটাই অনেক কিছু। এতো আয়োজনের কি দরকার ছিল? বলুনতো!"

মিহি মুচকি হেসে বলে,

"কি যে বলেন ভাবী! আপনার প্রশংসা আপনার মারুফ ভাই যে আমার কাছে কত করেছে তা কি আমি ভুলে গেছি নাকি? প্রতিবার ঢাকায় আসলে তো আপনাদের বাড়িতেই আসতো আগে। আর আপনি তার জন্য কত আপ্যায়ন করেছেন তা কিন্তু ভুলিনি। সেই হিসেবে এগুলোতো কিছুইনা।"

মিহির কথা শুনে তিথি আর রিফাত অবাক নয়নে মিহির দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ বাদেই দুজন আমার দিকে তাকালো। আমি হালকা রহস্যময় হাসি দিয়ে খাওয়ায় মনোযোগী হলাম। হয়তো ওরা ভাবছে জীবনে একবারই তো ওদের বাসায় গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরেছিলাম সেখানে কিনা মিহি বলছে উল্টো কথা? তাহলে কি আমি আসলেই মিহিকে ওদের ব্যপারে মিথ্যা বলেছি?

দুজনই খাবার অল্প অল্প খাচ্ছে আর লজ্জায় কিছুক্ষণ বাদে বাদেই আমার দিকে তাকাচ্ছে। সেটা আমি সরাসরি না দেখলেও ওদের তাকানোটা অনুভব করছি বেশ। কিছু বিষয়ের প্রতিশোধ হয়তো পরোক্ষভাবে দিলেও তার তীক্ষ্ণতা হয় অতুলনীয় যার দৃষ্টান্ত আমার সামনেই। ভালো স্ত্রী পেতেও হয়তো ভাগ্য লাগে যেরকম আমি এক সৌভাগ্যবান।


( সমাপ্ত )




লেখা: মিসক আল মারুফ

NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner